#এল_এ_ডেইস
পর্ব-৪
লেখনী – মাহীরা ফারহীন
তীক্ষ্ণ শব্দে শীশ বেজে উঠল। কোনো এক ছাত্রের এই শীশের শব্দ কক্ষ অতিক্রম করে বাইরে করিডোরেও শোনা গিয়েছে। শিক্ষার্থীদের নিকট সবচেয়ে বিরক্তকর ক্লাসগুলোর মধ্যে একটি হলো ফিজিক্স ক্লাস। এ ক্লাসের সমাপ্তি ঘটলে প্রত্যেকে হরেক রকম ভাবে আনন্দ এবং স্বস্তি প্রকাশ করে। প্রতিটা ক্লাস শেষে অন্তত দশ মিনিট বিরতির পর অপর ক্লাস শুরু হয়। এর মাঝে শিক্ষার্থীরা লকারের সামনে থেকে এক পাক ঘুরে আসে এবং নির্দিষ্ট ক্লাসেও পৌঁছে যায়। তবে মাহীন ক্লাস থেকে বের হওয়ার পূর্বেই সেই কাউন্টারের লাল চুলো গোমড়ামুখো মহিলা ক্লাসে এসে উপস্থিত হলেন।
শীশবাদক ছেলেটা ভাবল এই বুঝি কান মলা দিয়ে ধরে নিয়ে যাবে। ছেলে-মেয়েদের হইচইয়ের মাঝে মাহীন প্রথমে তাকে লক্ষ্য করেনি যতক্ষণ না পর্যন্ত তিনি চিৎকার করে বললেন,
“মিস ফারুকী!” মাহীন রীতিমতো হকচকিয়ে গেল। ক্লাসে উপস্থিত সকল ছাত্র ছাত্রীই চমকে উঠেছে। সকলেরই চোখে মুখে থমথমে একটা ভাব ছেয়ে গেল। মাহীন নিজেকে সামলে নিয়ে শুকনো ঢোঁক গিলে আমতা আমতা করে বলল,
“আমি, আমি এখানে।” মহিলা এগিয়ে এসে একদম মাহীনের সামনে দাঁড়ালেন। তারপর একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে কঠোর গলায় বললেন,
“এই যে তোমার পার্টনার দের নাম। তাদের সাথে কথা বলে তোমাদের আর্টিকেলের বিষয়বস্তু আমাকে আগামী বিশ মিনিটের মধ্যে লিখিত ভাবে জমা দেবে।” মাহীন চিন্তিত গলায় সঙ্গে সঙ্গে বলল,
“মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যে?”
লাল চুলো মহিলা গম্ভীর মুখে বললেন,
“আগামী বিশ মিনিট কোনো ক্লাস হবে না। এবং এর মধ্যেই এইসব কাগজপত্র আমার কাছে জমা দিতে হবে।” বলেই উনি গটগট করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। তার রাগের তোরে অনেকেরই মনে হয় তিনি হাঁটলে বুঝি অগ্নিমূর্তির মতো তার শরীর থেকে লালচে অগ্নিশিখা ঝাঁপটা দেয়। ছাত্র ছাত্রীরা সকলে হা করে মাহীনের দিকে তাকিয়ে ছিলো। একটা মেয়ে পেছন থেকে ভারি কন্ঠে বলল,
“সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি তোমার সঙ্গীদের খুঁজে বের করো।”
মাহীন অবশেষে হাঁপ ছেড়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর সোজা নিচ তলায় লকারের কাছে চলে গেল। ব্যাগটা লকারে রেখে দিল। এবার লাল চুলো মহিলার দিয়ে যাওয়া কাগজটির দিকে চোখ রাখল। দুইজন সঙ্গী। একজন সফোমোর লিম জু ফেন। আরেকজন ইলেভেন্থ গ্রেডের রায়েদ মাদিহ। মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তালিকাটির দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো। তারপর পুনরায় দ্বিতীয় তলায় চলে গেল। প্রথমে মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে চায় ও। মনে মনে ভাবছে,
‘এখানে কারোও কোনো নির্দিষ্ট শাখা নেই দেখে কাউকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন। এবং মেয়েটার নাম দেখে মনে হচ্ছে চাইনিজ।’ ভাবতে ভাবতেই দ্বিতীয় তলায় এসে প্রতিটা কক্ষে ঢু মেরে কাউকে না কাউকে জিজ্ঞেস করল মেয়েটার কথা। তবে কেউই তার হদিস দিতে পারল না। শেষে একজন বলল যে আজ মেয়েটা স্কুলেই আসেনি। মাহীন মাঝ করিডরে দাঁড়িয়ে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে হাত ঘড়ির দিকে চাইল। ইতোমধ্যেই দশ মিনিট হয়ে গিয়েছে। আর দশ মিনিট বিরতি থাকবে এরপর আবার ক্লাস শুরু হবে। এরই মধ্যে এখন ওর রায়েদ মাদিহকে খুঁজে বের করতে হবে। যেহেতু সে ইলেভেন্থ গ্রেডের ছাত্র সুতরাং মাহীন সোজা চারতলায় চলে গেল। চারতলায় জুনিয়রদের ক্লাস হয় এটা জানা আছে ওর। মাহীন করিডোরের একপাশে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বুক ভরে শ্বাস নিল। এত ছুটাছুটি করে বেজায় ক্লান্ত হয়ে পরেছে। বুক ধড়ফড় ধড়ফড় করছে। বুক ভরে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিল। একটা মেয়েকে সামনের কক্ষ থেকেই বের হতে দেখে বলল,
“আচ্ছা তুমি বলতে পার রায়েদ মাদিহকে কোথায় পাব?” মেয়েটা থমকে দাঁড়ালো। অবাক দৃষ্টিতে চাইল মাহীনের দিকে। যেন এখনই মাহীন কোনো অর্থহীন কথা বললো। সে ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,
‘তুমি নিশ্চিত তুমি রায়েদ মাদিহকেই খুঁজছ?
মাহীন বিভ্রান্ত হলো এহেন কথায়। তবে গাঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি নিশ্চিত না হলে পরিষ্কার ভাবে তার নামটা বলতে পারতাম না।”
“আমি জানি না ও কোথায়।’ খাপছাড়া ভাবে কথাটা বলেই মেয়েটা মাহীনকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। মাহীন ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে হাঁটতে দেখল একটা ছেলে রেলিঙের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মোবাইলের দিকে চেয়ে রয়েছে। সেদিকেই এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” বলতে পারো রায়েদ মাদিহ কোথায়?”
ছেলেটা মুখ তুলে চেয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করল এবং বলল,
“ওকে কেন খুঁজছ?”
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমার দরকার তাই।”
ছেলেটা শ্রাগ করে বলল,
“কি জানি কোথায় আছে।
অবশেষে মাহীন জিজ্ঞেস করল,
“ও কি আদৌও স্কুলে এসেছে?”
ছেলেটা বিদ্রুপ হাসল। বলল,
“স্কুলে এসেছে মানে? স্কুল থেকে ও বের হয় কখন আমি তো এটাই বুঝি না।” ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গিমায় বেজায় বিরক্ত হলো মাহীন। আর একটাও প্রশ্ন না করেই এগিয়ে গেল। এবার আর কাউকে জিজ্ঞেস করা লাগল না কিছু। একটা লম্বা চওড়া লাল চুলো ছেলে দয়া করে এসে দাঁড়াল ওর সামনে। তারপর বলল,
“তুমি কি রায়েদ মাদিহকে খুঁজছ?”
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ে।”
ছেলেটা বলল,
“তাহলে মনিটরকে জিজ্ঞেস করলেই তো পার। এমন কেউ নেই যার খবর মনিটর রাখে না।”
মাহীন হতাশ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
‘এবং এই মনিটর কে কোথায় পাব?’
ছেলেটা হাতের বাম দিকের প্রথম কক্ষটা দেখিয়ে বলল,
“এই রুমে জানালার পাশের একদম প্রথম টেবিলে যে বসে আছে সেই মনিটর। মাহীন ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
“ধন্যবাদ।” বলেই এগিয়ে গেল দ্রুত গতিতে। সেই কক্ষে প্রবেশ করেই প্রথমে দৃষ্টি খুঁজে বেরাল জানালার পাশের প্রথম টেবিলটা। সেখানে যেই ছেলেটা বসে আছে সে যথেষ্ট ফ্যাকাসে দেখতে। এবং তার চুলগুলো বাদামি এবং চোখের মণি নীল। মাহীন সামনে এগিয়ে যেতেই পরিষ্কার ভাবে তাকে দেখতে পেল। এবং বড়ই চেনা চেনা লাগল। মনে করার চেষ্টা করতে লাগল কোথায় দেখেছে তাকে। হঠাৎ মনে পরতেই মনে মনে ভাবলো, আরেহ এটাই তো সেই ধরিবাজ ছেলে। সে আবার মনিটর।’ ভাবতে ভাবতেই ভিনজেল সামনে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। ছেলেটা মুখ তুলে চাইল। মাহীন বলল,
“আমাকে একটা সাহায্য করতে হবে।”
ছেলেটা বাঁকা হাসলো এবং বলল,
“তুমি মনে হয় এখানে নতুন। আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছ জানো আমি কে?”
মাহীন ড্যাম কেয়ার ভাবে বলল,
“এসব জেনে আমার কোনো কাজ নেই। তুমি মনিটর সুতরাং নিজের দায়িত্ব পালন কর।”
“আসলে তুমি নতুন তো তাই এই স্কুল সম্বন্ধে কোনো কিছুই জানো না। এবং আমার এখন তোমার সাথে কোনো ঝামেলা করার মত ইচ্ছে নেই। আমার অনেক কাজ আছে।” মাহীন এবার নিজের সেলফোনটা হাতে নিল। মিনিটও পার না হতেই সেটা ও ছেলেটার দিকে ঘুরিয়ে ধরল। স্ক্রিনে সেই দিনের ভিডিওটা চলছে। ছেলেটার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল এবং চোয়াল ঝুলে পরল। ওর সেই ক্যাবলাকান্ত চেহারা দেখে মাহীনের হাসি পেল। তবুও হাসি চেপে গিয়ে গম্ভীর মুখভঙ্গি করে রাখল। ছেলেটা বিস্ময় মাখা কন্ঠে বলল,
“তু..তুমি এই ভিডিও কোথায় পেলে?”
মাহীন কঠোরভাবে বলল,
“সেটা বড় কথা নয়। কথা হল, এখনই আমাকে বল রায়েদ মাদিহ কোথায় নাহলে…ছেলেটা কথার মাঝেই তরিৎ গতিতে বলল,
“রায়েদ মাদিহকে কেন খুঁজছ? ”
মাহীন ভারি কন্ঠে বলল,
“আমার কাজ আছে তাই। যাকেই বলি না কেন কেউই বলতে পারে না সে কোথায়।”
ছেলেটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বলল,
‘এই স্কুলে যদি কেউ অন্তত পক্ষে এক সপ্তাহও পড়ে থাকে তাহলে সেও জানবে ক্লাসের সময় ছাড়া রায়েদ মাদিহ একমাত্র লাইব্রেরিতেই থাকে।
মাহীন তীক্ষ্ণ ভাবে বলল,
‘এতই যখন জানে তাহলে এরা আমাকে বলল না কেন শুনি?’
“খুব বেশিই দয়া দেখাতে গিয়ে।”
মাহীন ঘুরে দাঁড়াল। তবে এক কদম অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই পুনরায় পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়। এবং বলে,
“এক মিনিট লাইব্রেরি আবার কোথায়?”
ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়।বলল,
“তোমাকে এখন লাইব্রেরি কোথায় বোঝাতে গেলে আমার ম্যাপ খুলে বসা লাগবে। তার চাইতে আমার সাথে চল। তারপর একটু থেমে আবার বলল,
“আর হ্যা তুমি সেই ভিডিও টা আমার মাকে দয়া করে দেখিও না।
মাহীন গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ তুমি তোমার মনিটরের দায়িত্ব সৎ ভাবে পালন করছ।” ছেলেটা আর কিছু বলল না। সোজা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মাহীনও পিছু ধরল। ছেলেটা হাঁটছে না যেন দৌড়চ্ছে। মাহীন জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তোমার নামটা কী?”
ছেলেটা বলল, “ডেক্সটার হকিংস।”
মাহীন খেয়াল করে দেখল, করিডোরে অবস্থানরত শিক্ষার্থীরা সকলে ছানাবড়া চোখে ওদের দিকে চেয়ে আছে। ওদের মুখভঙ্গি দেখে মাহীন চাপা হাসল। মনে মনে ভাবলো,
যেই ছেলেটা আমাকে এই ধরিবাজের কাছে পাঠিয়েছে সে আমাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে এটা করেনি। সে আমাকে ঝামেলায় ফেলতে চেয়েছিল। কারণ এই ধড়িবাজের ব্যবহার দেখেই বোঝা যায়, ওর কোনো না কোনো ক্ষমতা রয়েছে যার কারণে ফাঁকিবাজি করার পরও এখনো মনিটর হিসেবে টিকে আছে। এবং যেকোনো কাউকে ঝামেলায় ফাঁসাতে পারে। হয়তোবা তাই সকলে একে এড়িয়ে চলে। কিন্তু আমার ভাবনাই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। ঠিকই সেই ভিডিওটা কাজে লাগল। এবং সামনেও লাগবে। আজকেই বাড়ি গিয়ে এটা লেপটপে তুলতে হবে।” ওরা হাঁটতে হাঁটতে চত্ত্বর পেরিয়ে লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের কাছে আসতে পাক্কা ছয়-সাত মিনিট লাগল। লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের সামনে একটা বিশালাকৃতির ওক গাছ। লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের তিনতলায় খোলা করিডোরে কিছুদূর পর পর একটা করে কাঠের দরজা। হাঁটতে হাঁটতে ঠিক করিডোরের শেষ প্রান্তে এসে নয় নম্বর দরজার সামনে থেমে গেল ডেক্সটার। তারপর পেছনে ঘুরে দাঁড়াল। মাহীন এদিকে প্রচন্ড হাঁপিয়ে উঠেছে। ঠিকমত শ্বাসও নিতে পারছে না। এবং বাইরের রোদের মধ্যে দিয়ে হেঁটে আসার কারণে ঘেমেও গিয়েছে। ডেক্সটার বলল,
“এদিক থেকে ভেতরে গিয়ে সেলফের মাঝের গলি দিয়ে সোজা যাবা। তারপর একদম কোণায় বড় জানালার পাশে একটা বড় টেবিল আছে। দেখবা চশমা পরা একটা ছেলে সেখানে পুরো টেবিলে বইখাতা ছড়িয়ে বসে আছে। সেই রায়েদ মাদিহ।” মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়লো। এবং মনিটরকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করার সময় থেমে গিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।” মনিটর কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে চাইল ওর দিকে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। মাহীন বুক ভরে একবার লম্বা শ্বাস নিল। তারপর ভেতরে ঢুকে ধীরে ধীরে হেঁটে যেতে লাগল। সারি সারি সেলফ পার হয়ে কামরার কোণায় এসে থামল। মস্ত বড় দুটো জানালার সামনে বড় একটা টেবিল রাখা। সেখানে একটা ছেলে বসে আছে মাথা নিচু করে। অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পড়ায় ব্যস্ত। ছেলেটা দেখতে ফর্সা, কালো চুল, চোখে চিকন কালো ফ্রেমের চশমা। শক্ত চোয়াল। এবং ডেক্সটারের কথা মতোই সারা টেবিল জুড়ে বইখাতা বিছিয়ে রাখা। কেমন জানি রাশ ভারি এক ভাব তার মধ্যে। মাহীন এগিয়ে গিয়ে টেবিলের সামনে দাঁড়াল। তারপর বলল,
“এক্সকিউজ মি?” ছেলেটা ভ্রূক্ষেপহীন। তাকে দেখে মনে হলো সে যেন কিছুই শোনেনি।
মাহীন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার বলল,
“তোমার সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে”।
ছেলেটা এবার কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর গম্ভীর কন্ঠে বলল,
” আমার সাথে কারোর কোনো জরুরী কথা থাকতে পারে না।”
মাহীন কিছুটা চমকায়িত হল ওর উত্তর শুনে। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“কিন্তু আমার আছে।”
রায়েদ কিছুটা ঝাঁঝের সঙ্গে বললো, “এবং আমি সেটাকে জরুরি কথা বলে মনে করিনা। তারপর একটু থেমে আবার কঠোর গলায় বলল,
” আর দেখতে পাচ্ছ না আমি ব্যস্ত আছি “।
এখন পর্যন্ত রায়েদ একবারও মুখ তুলে চায়নি।ছেলেটার কোনো কারণ ছাড়াই এমন দাম্ভিক ভাবসাব মাহীনের গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল। ক্রোধ চেয়াল শক্ত হলো। মনে মনে ভাবল, কি আশ্চর্য আর অভদ্র একটা ছেলে। এটা কোন ধরনের পদ্ধতি একটা অচেনা মানুষের সাথে কথা বলার! এত অহংকার কিসের? দাম্ভিক একটা। তোমার ব্যবহারের জন্য যদি তোমাকে মজা না দেখিয়েছি আমিও এখান থেকে নড়ব না। এবং বিশ মিনিটের মধ্যে বিষয়বস্তু লিখিত ভাবে জমা না দেওয়ার কারণ হিসেবে তো তোমার কথাই বলব। আরেকজন তো আসেইনি। শাস্তি পেলে আমি একা কেন পাবো? তোমাকে সাথে নিয়ে শাস্তি পাবো। তাছাড়া এ বিষয় আমার সাথে কথা না বললে, আমি আমার ইচ্ছে মতো টপিক দিয়ে দেব, পরে সে তোমার পছন্দ হোক আর নাই হোক।” তবে মুখে তিক্ত কন্ঠে বলল,
“খুব দেখতে পাচ্ছি। তবে তোমার সাথে কথা না বলে আমিও এখান থেকে নড়ব না।” বলেই পাশের টেবিলের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পরল। রায়েদ কিছুই বলল না। তারপর সেলফোনটা হাতে নিল। মোবাইল দেখার ভান করে আঁড়চোখে রায়েদের টেবিলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখল। দেখল একটা খাতায় ও কোনো কিছুর গ্রাফ অংকন করতে ব্যস্ত। বইয়ের পাশেই একটা আধা কফি ভরা কালো কাঁচের কাপ রাখা। কাপের গায়ে একটা কোট লিখা রয়েছে, “After All this time? – Always”। মাহীনের এক মুহূর্ত লাগলো না এটা বুঝতে যে রায়েদ নিশ্চিত ভাবে পটারহেড। কারণ এটা হ্যারি পটারের একটা চরিত্রের কোট। মনে মনে ভাবতে লাগল, কাপের গায়ে কি লেখা সেটা ভাবার বিষয় নয়। ভাবার বিষয় হচ্ছে ক্যাফেটেরিয়া থেকে কফি নেওয়াই যায় কিন্তু ওয়ান টাইম কাপে। তাহলে এই স্কুলে বসে ও হ্যারি পটার কাপ কোথায় পেল? নাকি সেটাও সাথে করে নিয়ে ঘোরে? তবে এটা নিশ্চিত যে এটা ওর নিজের কাপ। এতই ভাব এর যে নিজের রত্নাখচিত কাপ ব্যবহার করবে। বাহ!’
রায়েদ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই মাহীনের ভাবনায় বিঘ্ন ঘটল। রায়েদ সোজা সেলফের কাছে হেঁটে গিয়ে ঝুঁকে নিচের দিকের তাকগুলো থেকে কোনো একটা বই খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পরল। মাহীন একবার ওর দিকে চাইল আরেকবার কফির কাপটির দিকে চাইল। তারপর ভাবল, এই সুযোগ। তোমার এটেনশন কিভাবে আমার দিকে আনতে হয় আমি জানি।” ভাবতে ভাবতেই পকেট থেকে তিন ইঞ্চি লম্বা একটা কৌটা বের করল। তারপর সেটা খুলে সেখান থেকে বেশখানিকটা লবণ হাতে নিয়ে কফির মধ্যে ঢেলে দিল। তারপর কাপটা সাবধানে তুলে হালকাভাবে দুলিয়ে নিয়ে আবার নিঃশব্দে নামিয়ে রাখল। রায়েদ তখনই একটা বই হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মাহীন চমকে উঠে তাড়াতাড়ি আবার নিজের মোবাইলের দিকে চোখ ফেরাল। রায়েদ এসে আবার বসতে যাবে তখনই লাল চুলো মহিলাকে সারি সারি সেলফগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে আসতে দেখা গেল। মাহীন সরাসরি তাকাল না সেদিকে। তবে আড় চোখে দেখে মনে মনে ভাবলো, এই মরেছি। এই মহিলা এখন আমাকে ছাড়বে না। বিশ মিনিট সেই কখন শেষ হয়ে গিয়েছে। আর এতক্ষণে নিশ্চয়ই ক্লাসও শুরু হয়ে গিয়েছে। অবশ্য সমাজ ক্লাস, খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ তবে মহিলা রায়েদের টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবং একটা কাগজ টেবিলের ওপর রাখলেন। তারপর কিছুটা স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“রায়েদ তোমার সঙ্গীদের সঙ্গে কথা বলে তোমার আর্টিকেলের বিষয়বস্তু লিখিত ভাবে আমাকে জমা দিবে।”
রায়েদ নির্বিকার চিত্তে বলল, “কিন্তু এসব করে কোনো লাভ নেই।”
মহিলা দৃঢ়ভাবে বললেন, “লাভ-ক্ষতির হিসাব আমি করব, তুমি নয়।”
“মিসেস রে, আপনি খুব ভালো করেই জানেন, আমি পার্টনার এটা শোনা মাত্র যে কেউ পারলে ইভেন্ট থেকে নিজের নাম কাটিয়ে নেবে। তাহলে আলোচনা কিসের?”
“দেখ আমি জানি এটা। তবে তাঁরা কি করবে না করবে সেটা পরের কথা। আগে তোমাকে একবার নিয়মটা পালন তো করতে হবে।”
“বলতে পারেন শেষ কবে কে আমার পার্টনার হিসেবে আমার সাথে কাজ করেছিল?”
মিসেস রে একটু ভেবে বললেন, “তুমি যখন সেভেন্থ গ্রেডে ছিলে তখন।”
রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্লান কন্ঠে বলল, “ঠিক আছে।”
মিসেস রে ঘুরে দাঁড়ানোর পূর্ব বললেন, “আরেকটা কথা চায়নিজ যেই মেয়েটা সে আজ স্কুলে আসেনি। সুতরাং আরেকজন যে আছে তার সাথে আলোচনা করে নিও।”
রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়লো। লাল চুলো মহিলা পেছন ঘুরে দ্রুত গতিতে হেঁটে চলে গেলেন। মাহীন এতক্ষণ নিশ্চুপ বসে সব শোনার পর মনে মনে ভাবলো,
‘ঘটনা কি? গোমড়া মুখো মহিলা দেখি রায়েদের সঙ্গে খুব একটা কঠোর ভাবে কথা বললেন না। নাকি নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই কড়া আচরণ করেন?’
রায়েদ বইখাতা গুলো গুছিয়ে রাখতে শুরু করল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এগুলো গুছিয়ে ও এখান থেকে বেরিয়ে যাবে। মাহীন বলল,
“এখন চলে যাবে বুঝি?”
“শোনোনি মিসেস রে কি বললো। আমার হাতে বেশি সময় নেই মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে হবে।” ঝাঁঝ ভরা কন্ঠে বলল রায়েদ।
মাহীন বলল, ‘ওহ আচ্ছা।” এতটুকু বলে থেমে গেল। এবার আমোদ ভরা কন্ঠে বলল, “আচ্ছা মেয়েটার নাম কি?”
রায়েদ ফট করে টেবিলে রাখা কাগজটার দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলল, “মিস ফারুকী।”
মাহীন সুর করে বলল, “ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, আই এম মাহীন ফারুকী।”
রায়েদ এবার বিস্মিত হয়ে ওর দিকে মুখ তুলে চাইল। এতক্ষণে প্রথমবার সরাসরি মাহীনের দিকে চাইল ও। ডায়মন্ড আকৃতির উজ্জ্বল বর্ণের মুখের গঠন।
ঘন নেত্রপল্লবের পেছনে গাঢ় বাদামি চোখের মণি। ছেলেটা যে আসলেই এক সুন্দর চেহারার অধিকারী তা অন্তত মনে মনে স্বীকার করতেই হলো মাহীনকে।
তারপরও রায়েদ একবার নিশ্চিত হওয়ার জন্যেই বোধহয় টেবিলে রাখা কাগজটির দিকে চাইল। বলল,
“এবং বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করতেই এখানে এসেছ তুমি?”
মাহীন উঠে দাঁড়িয়েছে। বলল, “অবশ্যই।”
রায়েদের ভ্রু সুচালো হলো। বললো, “তুমি কি নিশ্চিত ভাবেই আমার সাথে কাজ করতে রাজি?”
বারবার একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলায় মাহীন মহা বিরক্ত। মনে মনে ভাবল, কী সমস্যা এদের? এখন পর্যন্ত এই রায়েদ তৃতীয় ব্যক্তি যে একই কথা বারবার বলছে।’ মুখে গাঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি তোমার সাথে কাজ করব বলে ইভেন্ট জয়েন করিনি। ইভেন্টে কাজ করার জন্যে ইভেন্ট জয়েন করেছি সে যার সাথেই হোক আমার কোনো সমস্যা নেই।”
তারপর এসে রায়েদের টেবিলের অপর পাশের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। রায়েদও নিজের চেয়ারে বসে গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি এই স্কুলে নতুন?”
মাহীন বলল, “এখন কাজের কথায় আসা যাক।”
এই স্কুলে ও নতুন, এই বিষয়টা আর কাউকে জানাতে রাজি নয় মাহীন। তাই তাড়াতাড়ি প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল। রায়েদ ড্যাম কেয়ার ভাবে বলল, “ঠিক আছে। আমরা বিগ ব্যাং থিওরি নিয়ে লিখব।
মাহীন বিস্মিত হয়ে বলল,
“কি! বিগ ব্যাং থিওরি! এটা একটা বিষয় হল?”
রায়েদ তিক্ত কন্ঠে বলল, “এমন ভাবে বলছো যেন আমি পারমাণবিক বোমা তৈরির কথা বলেছি। বিগ ব্যাং থিওরি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।”
“মোটেও না। এমন একটা জটিল বিষয় নিয়ে ইভেন্টে আর্টিকেল লেখার কোনো মানে হয় না। পৃথিবীতে কি জিনিস এবং জায়গার অভাব পরেছে আর্টিকেল লেখার জন্য?”
রায়েদ তিক্ত কন্ঠে বলল, “সাইন্সের মাঝেও বা সমস্যা কি?”
“এটা একটা ক্রিয়েটিভ ইভেন্ট। সুতরাং কাজের মাঝে নিজের ক্রিয়েটিভি আনতে হবে। সাইন্সের তথ্যতত্র তো যে কেউ লিখে দিতে পারে।”
রায়েদ কঠোর গলায় বলল,
“তোমার সাইন্সের সঙ্গে সমস্যাটা কি বলো তো?”
মাহীন জিজ্ঞেস করল, “তুমি সাইন্সের ছাত্র তাই না?”
রায়েদ স্বগোতক্তি করল, “হ্যা, এবং তুমি নিশ্চয়ই আর্টসের ছাত্রী?”
মাহীন কাটাকাটা ভাবে বলল, “না,আমিও সাইন্সেরই ছাত্রী।”
রায়েদ কিছুটা অবাক হলো। তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল,
“তাই? শুনে দুঃখীত হলাম।”
মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইল। বলল,
“কি বলতে চাচ্ছ তুমি?”
রায়েদ মুখে কৃত্রিম করুণা ফুটিয়ে তুলে বলল,
“সাইন্স বিষয়টাও হয়তো আফসোস এবং লজ্জিত বোধ করছে তোমার মত ছাত্রী পেয়ে।”
মাহীনের ক্রোধে মুখটা লাল হয়ে যাওয়ার কথা তবে শ্যামলা গড়ন বলে তা স্পষ্ট ফুটে উঠলো না। নিজেকে সামলে নিতে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকল। ঘন ঘন শ্বাস নিচ্ছে। তারপর তিক্ত কন্ঠে বলল,
“শুধু মাত্র সাইন্সের ছাত্রী বলে নিজেকে সাইন্সের কাছে বিক্রি করে দেইনি যে সারাদিন সর্বক্ষণ সবকিছুতে সাইন্সের জয়জয়কার করব।”
রায়েদ কফির কাপটা হাতে নিয়ে এক চুমুক দিল। পরক্ষণেই মুখটা কুঁচকে ফেললো। মাহীন স্তম্ভিত হয়ে গেল। ও ভুলেই গিয়েছিল কফির কথা। রায়েদ কাপটা ততক্ষণাৎ নামিয়ে রেখেই ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,
“এত লবণ! তুমি আমার কফির সাথে কি করেছ!”
মাহীন শুকনো ঢোঁক গিলে বলল, “যে বানিয়েছে তাকে জিজ্ঞেস কর। আমি কিভাবে জানব?” বলেই উঠে দাঁড়াল ও হাতঘড়ির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তারপর মাথা তুলে বলল,
“ইতোমধ্যেই একটা ক্লাস মিস হয়ে গিয়েছে। এখন এত তর্কবিতর্ক করার সময় নেই।”
রায়েদ কফির কথা ভুলে বলল, “তাহলে বিগ ব্যা…” মাহীন কথার মাঝখান দিয়ে বলল, “প্রয়োজনে আগামীকাল আবার তর্ক করব তবে বিগ ব্যাং নিয়ে আমি কিছু করতে রাজি নই।”
রায়েদ বলল, “ভুলে যাচ্ছ বোধহয়, বিষয়বস্তু আমাদের আজকেই জমা দিতে হবে।”
মাহীন বলল, “মিসেস রে কে আমি সামলে নেব।”
চলবে ইনশাআল্লাহ।