এল_এ_ডেইস পর্ব ১৯

0
300

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ১৯
লেখনীঃ মাহীরা ফারহীন

বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল কলিং বেল বেজেছে। মিসেস নাসরিন রান্নায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি হাত ধুয়ে ওড়না ঠিক করতে করতে এগিয়ে আসছেন তখন পুনরায় কলিংবেল বাজল। ‘কি ব্যপার এখন তো মাহীনের আসার কথা। কিন্তু ওর কাছে তো চাবি আছে।’ বিড়বিড় করতে করতে তিনি দরজা খুললেন। দরজার ওপাশে মাহীন নয় তার বদলে একদল ছেলেমেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ছেলেমেয়েগুলো সমস্বরে বলে উঠল, ‘হ্যালো আন্টি!’

মিসেস নাসরিন নিজেকে সামলে নিয়ে সরে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘তোমরা মাহীনের ফ্রেন্ড তাই না?’ ভেতরে এসো।’
ওরা সকলে সারি বেঁধে ভেতরে আসল। মোট পাঁচজন এসেছে। প্রথমেই লালচুলো এক রূপবতী মেয়ে ঢুকল যার হাতে একটা বড় খাঁচা। এর পর একটা ফর্সা ছেলে ভেতরে ঢুকল। এরপর চাইনিজ দেখতে ছোট খাটো একজন মেয়ে। এবং বাকি দুইজনকে মিসেস নাসরিন চিনতে পারলেন। গতবারও ওরা এসেছিল বাসায়।

লালচুলো মেয়েটা হাসি মুখে বললো, ‘আমি ক্যারোল।’

দুইজন ছেলের মধ্যে একজন বলল, ‘এবং আমি রাবিত মাদিহ।’
সোনালি চুলো মেয়েটা বলল, ‘এবং আমাকে তো চেনেনই। আমি জেনেট। আর ও লিম জু এবং ও নায়েল।’
নায়েল ও লিম জুর দিকে ইশারা করে বলল। মিসেস নাসরিন দরজা বন্ধ করে হাসি মুখে বললেন,

‘হ্যা হ্যা তোমাদের দুজন কে চিনি। আর তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন বসো বসো।’

ওরা সকলে জুতা পরা অবস্থায়ই ভেতরে সোফার দিকে গেল। মিসেস নাসরিন বিরক্ত হয়ে ভাবলেন, ওফ এদের এই এক সমস্যা। বাইরে পরার জুতা নিয়ে বিছানায়ও উঠে যায়। ধুর আবার ঘরটা পরিষ্কার করতে হবে এরা যাওয়ার পর।’ তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা মাহীন কোথায়?’
এই কথায় সকলের ভ্রু কুঁচকে গেল। নায়েল জিজ্ঞেস করল, ‘ওহ মাহীন এখনো বাসায় ফেরেনি? ওর তো আলাদাই আসার কথা ছিল।’

লিম জু বলল, ‘কিন্তু স্কুল ছুটি হয়েছে প্রায় আধাঘন্টা হয়ে আসছে। এতক্ষণে তো মাহীনের বাসায় এসে পরার কথা।’
মিসেস নাসরিনের কপালে চিন্তার গভীর রেখা ফুটে উঠলো। ভাবলেন, এই মাহীন আবার কোন পাগলামি করতে গেছে আল্লাহই জানে। ক্যারোল উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আন্টি আসলে আমরা এখানে এসেছি মাহীনকে একটা কিছু দিতে। এটা আমি গতকালই ওকে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু মাহীন একসেপ্ট করেনি। কারণ আপনি নাও একসেপ্ট করতে পারেন।’

মিসেস নাসরিন ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে এসে বললেন,’কেন কি দিতে চেয়েছিলা?’

ক্যারোল ওর খাঁচাটা দেখিয়ে বলল, ‘একটা বিড়াল। আমি ওকে বিড়াল গিফট করতে চেয়েছিলাম।’

মিসেস নাসরিন অবাক হয়ে বললেন, ‘বিড়াল!’

র‌াবিত বলল, ‘আসলে মাহীনের যে হ্যামস্টার টা ছিলো তা ক্যারোট…থুরি ক্যারোলের সাইকেলে চাপা পরেই খুন..মানে মারা গিয়েছিল।’

ক্যারোল এবার অনুনয়ের স্বরে বললেন, ‘দেখেন প্লিজ মানা করে দেবেন না। আমি এখনো নিশ্চিত নই মাহীন আমাকে আসলেই ক্ষমা করেছে কিনা। তাই দয়া করে বিড়ালটাকে ফিরিয়ে দিয়েন না।’

জেনেট ওর সাথে তাল মিলিয়ে বলল, ‘হ্যা দয়া করে বিড়ালটাকে একসেপ্ট করে নেন। নাহলে ক্যারোলের অনেক সমস্যা হয়ে যাবে।’

মিসেস নাসরিন বিভ্রান্ত কন্ঠে বললেন, ‘এখন মাহীনকে যেহেতু বিড়ালটা দিতে চাচ্ছো। ওতো নাও রাজি হতে পারে আমি এখন কিভাবে রাজি হয়ে যাই?’ সুক্ষ্ণ ভাবে প্রস্তাবটা এড়িয়ে যেতে চাইলেন।

নায়েল বলল, ‘না না। মাহীন আগেই বলেছে ওর কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা শুধু যদি আপনি একসেপ্ট না করেন সেটায়।’
মিসেস নাসরিন বিরক্ত হয়ে ভাবলেন, বুঝেছি এবার। আমার সামনে যেন না পরতে হয় এজন্যেই বাসায় আসছে না। আজকে বাসায় আসুক খালি। ওর একদিন কি আমার একদিন।’

ক্যারোল বিড়ালের খাঁচার দরজাটা খুলে দিল। এবং বিড়ালটাকে বাইরে বের করে এনে হাতে নিয়ে মিসেস নাসরিনের সামনে এসে দাঁড়াল। জুলজুল চোখে চেয়ে বলল,

‘আপনি ওকে একসেপ্ট করবেন না?’

মিসেস নাসরিন কিছু বলার আগেই দরজা খুলে গেল। নাইম ভেতরে প্রবেশ করল। ঘরে হঠাৎ এতগুলো ছেলেমেয়েকে বসে থাকতে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর মিসেস নাসরিন বললেন,

‘ওরা মাহীনের ফ্রেন্ড। এখানে এসেছে মাহীনকে বিড়াল গিফট করতে।’

নাইম চোখ ছানাবড়া করে বলল, ‘বিড়াল! ওয়াট দ্যা হেল ইজ দিজ! বিড়াল।’

র‌্যবিট বলল, ‘কেনো ব্রো বিড়ালে কি তোমার এলার্জি আছে?’

নাইম দ্বিধান্বিত কন্ঠে বলল, ‘না মানে..তখনই ওর ফোন বেজে উঠল। কথা বাদ দিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে দেখে মাহীনের কল। ফোনটা ধরে কানে ধরল। বলল, ‘হ্যালো। তুই কোথায় আছিস? কোথা থেকে ফোন দিচ্ছিস?’

তখনও নাইম দরজাটাও লাগায়নি। ওপাশ থেকে মাহীনের কন্ঠ শোনা গেল। মাহীন উত্তেজিত কন্ঠে বলছে, ‘ভাইয়া আমার একটা ছোট খাটো এক্সিডেন্ট হয়েছে। আর…’

এতটুকু বলতেই নাইম উত্তেজিত কন্ঠে বললো, ‘কি! এক্সিডেন্ট হয়েছে? কোথায়? কিভাবে?’

ও বাংলায় কথা বলছে দেখে মিসেস নাসরিন তো বুঝলেন ওর কথা কিন্তু বাকিরা বুঝতে পারলো না। মিসেস নাসরিন উৎকন্ঠিত গলায় বললেন, ‘কি হয়েছে? কার এক্সিডেন্ট হয়েছে?’

নাইম ফোনটা স্পিকারে দিলো। মাহীন ওপাশ থেকে ইংলিশেই বলছে, ‘আরেহ আমার সাইকেল সাইডওয়াকের রেলিঙের সাথে ঢাক্কা খেয়েছে। এবং আমি সাইকেল শুদ্ধ পরে গিয়েছি। বাম পায়ে খুবই ব্যথা করছে। আমি হাঁটতে পারছি না। বোধহয় পা মচকে গিয়েছে। এবং হাতে টাতে বেশ খানিকটা ছিলেও গিয়েছে।’
মিসেস নাসরিন মাথায় হাত দিয়ে উদ্বিগ্নতার সমেত বললেন, ‘ইয়া আল্লাহ! এই মেয়েটা শেষ পর্যন্ত এক্সিডেন্ট করেই ছেড়েছে। বার বার বলেছি সাবধান হতে কিন্তু…’

নাইম মাঝখান দিয়ে মাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা এখন একটু থামো তো।’ তারপর ফোন কানে দিয়ে বলল, ‘এ্যই তুই এখন কোথায় আছিস তাড়াতাড়ি বল আমি আসছি।’

বাকি সকলে উঠে দাঁড়াল। জেনেট ও নায়েল সমস্বরে বলল, ‘আমরাও সাথে আসছি।’

তারপর সাথে সাথে ক্যারোল ও লিম জুও বলল,
‘এবং আমরাও।’

র‌্যবিট বলল, ‘অবশ্যই আমিও।’

নাইম বাসায় প্রবেশ করে জুতাই এখনো পায়ের থেকে খোলেনি। ও সেভাবেই বেরিয়ে গেল। পেছন পেছন ছেলেমেয়েরাও বেরিয়ে গেল। ক্যারোল খাঁচা শুদ্ধ বিড়ালকে এখানে রেখেই কেটে পরল। ওরা সকলেই নিজ নিজ সাইকেল নিয়ে এসেছিল। নাইমও নিজের সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পরল। লিম জু অবশ্য নিজের সাইকেল আনেনি। ও ক্যারোলের পেছনে বিড়ালের খাঁচা ধরে বসেছিল। এখন এমনিই বসল। মাহীন যেই জায়গাটার কথা বলেছে সেখানে পৌছুতে ওদের বড়জোড় দশ বারো মিনিট লাগল। এর মাঝে আবার রাস্তায় বেশ জামও ছিলো। সেই রাস্তায় পৌঁছে বেশ কিছুক্ষণ ভিড়ের মধ্যে দিয়ে সাইকেল চালানোর পর দেখা গেল মাহীন রাস্তার সাইডের ফুটপাথের বেঞ্চিতে বসে আছে। ওর পাশে একজন গোলাপি ফর্সা বৃদ্ধা বসে আছেন। বেঞ্চির পাশে ওর সাইকেলটা কাত হয়ে পরে আছে। প্রচুর সোরগোল হচ্ছে চারিদিকে। এই রাস্তার দুইপাশেই সারি সারি শুধু বিখ্যাত ব্র্যান্ড গুলোর দোকান। ফলে এখানে পায়ে হাঁটা মানুষের প্রচুর ভির থাকে। মাহীনের বেঞ্চির পাশে একটা বড় তাল গাছ। মাহীন অবাক হয়ে দেখল যে ওকে সাহায্য করতে শুধু ওর ভাই না বরং গোটা এক বাহিনী আসছে। ভাবল, এসব কি? ওরা কোথা থেকে আসল? জেনেট আর নায়েল না? ওরা তো আছেই সাথে দেখি ক্যারোট লিম এবং র‌্যবিটও উপস্থিত। অবিশ্বাস্য!’ ওরা সকলে এসে মাহীনের সামনে সাইকেল থামাল। নাইম লাফ দিয়ে সাইকেল থেকে নামল। বৃদ্ধা মহিলার হাতে মাহীনের ছোট ফার্স্টএইড বক্স। নাইম ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,

‘তোকে চড়টা আমি দেব নাকি মায়ের জন্য বাঁচায় রাখব বল?’

নায়েল বলল, ‘নেইম আমার মনে হয় ওকে এখন বকাঝকা না করে আগে দেখা উচিৎ ওর পায়ে আসলে কতটা লেগেছে।’

মাহীন নিশ্চুপ। কেমন এলোমেলো বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ওরা সকলে ওকে ঘিরে ধরল। নাইম ও লিম জু হাঁটু গেড়ে বসেছে মাহীনের সামনে।

নাইম বলল, ‘ইশ তোকে একবার ডাক্তার না দেখায় বাসায় যাওয়া হবে না আজকে।’

মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘ডাক্তার?’

নাইম ধমক দিয়ে বলল, ‘চুপ! তুই কোনো কথা বলবি না।’

লিম জু বলল, ‘হ্যা হসপিটাল থেকে একবার ঘুরে গেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে ক্ষতটা কোন পর্যায় আছে।’

জেনেট জিজ্ঞেস করল, ‘মাহীন তুমি তো উঠে দাঁড়াতে পারবা না। এবং ওকে সাইকেল করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’

র‌াবিত বলল, ‘আরেহ একটা ট্যাক্সি ডাকলেই তো হয়।’

রাস্তায় শতশত গাড়ি আসা যাওয়া করছে এর মধ্যে একটা ট্যাক্সি পাওয়া খুব একটা কঠিন ঠেকল না। ট্যাক্সিতে মাহীনকে নাইম ও নায়েল দুইদিক থেকে ধরে উঠতে সাহায্য করল। নাইম বৃদ্ধ মহিলার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানাল। বিদায় নেওয়ার পর ট্যাক্সির কাছে এসে দাঁড়াল। নাইম ট্যাক্সিতেই মাহীনের সাথে বসবে এবং বাকিরা নিজ নিজ সাইকেলে। মাহীনে সাইকেলটা গাড়ির ডিকিতে রাখা হয়েছে। গাড়িতে ওঠার পূর্বে নাইম বলল,

‘এক মিনিট, আমার সাইকেলের কি হবে? ওটা কোথায় রাখি?’

র‌াবিত বলল,’আমার কাছে একটা আইডিয়া আছে। যেহেতু লিম জু নিজের সাইকেল আনেনি ও আমার সাইকেলটা নিতে পারে এবং আমি তোমার সাইকেলটা সাথে নিয়ে যাচ্ছি। কারণ তোমার সাইকেলটা বেশ বড় লিম চালাতে পারবে না।’

লিম বলল, ‘আমার কোনো সমস্যা নেই।’

নাইম বলল, ‘ওফ ভালো বুদ্ধি তো।’ বলে ও গাড়িতে উঠে বসলো এবং গাড়ি এগিয়ে চললো জামের মধ্য দিয়ে। এদিকে বাকিরা সাইকেল নিয়ে এগিয়ে গেল গাড়ির পেছন পেছন। নাইম দৃঢ় স্বরে বলল,

‘এ্যই এখন বল। তুই এক্সিডেন্ট করলি কিভাবে?’

মাহীন ইতস্তত করে বলল, ‘দেখ আমি এবার কিছুই করতে যাইনি। আমি তো বাসাই ফিরছিলাম এই ভিরের মধ্যে ট্রাফিক লাইট জ্বলছিল তখন থেমেছিলাম। কতগুলো বাচ্চা রাস্তা পার হচ্ছিল। যখন সিগনাল ছাড়ল তখনও একটা বাচ্চা ফুটপাথে ওঠেনি। এবং ও আমার সামনেই ছিল। সাইকেল যেন ওর ওপর না উঠে যায় এইজন্য আরেকদিকে সরতে গিয়ে রেলিঙের সাথে এসে ঢাক্কা খেয়েছি।’

নাইম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আর কি বলার আছে এক্ষেত্রে।’

পি..পি করে তীক্ষ্ণ শব্দ হচ্ছে হর্ণের। গরমটাও আজ বেশ পরেছে। বাইরে কড়া রোদ। গাড়ির জানালাগুলো খোলা। নাইমের ফোন বেজে উঠল। মিসেস নাসরিন ফোন দিচ্ছেন। মাহীন কলটা দেখেই শুকনো ঢোঁক গিললো। নাইম ফোন রিসিভ করে স্পিকারে দিল। ওপাশ থেকে মিসেস নাসরিন উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, ‘মাহীনকে পেয়েছিস? ওর এখন কি অবস্থা?’

নাইম মাহীনের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘হ্যা ও ভালোই আছে। তবে ওর পায়ে বোধহয় ভালোই আঘাত লেগেছে। হাঁটতে পারছে না। তাই ওকে আমরা একবার ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে বাসায় আসছি।’

মিসেস নাসরিন বললেন, ‘ ঠিক আছে তাই কর। আর মাহীনকে দে তো।’

নাইম ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘কি বলার বলো। ফোন স্পিকারই আছে। মহারানী সবই শুনছে।’

মিসেস নাসরিন ডাকাতের মতো বললেন, ‘মাহীন তুই খালি আজকে বাসায় আয় তারপর তোর একদিন কি আমার একদিন।’ মাহীন কিছুই বললো না।

মিসেস নাসরিন আবার বলল, ‘কি হলো ও কিছু বলে না কেন?’

নাইম বলল, ‘কিভাবে বলবে? ভয় মুখ শুকায় গেছে তো। আচ্ছা রাখি। বাসায় গিয়ে ওকে দেখে নিও।’

এরপর ও কল কেটে দিলো। ওরা আর কিছুক্ষণ পর সিটি হসপিটালের সামনে থামল। ওদের গাড়িটা থামার পাঁচ মিনিট পর বাকি সকলের সাইকেলও সেখানেই এসে থামল। সাইকেলগুলো সব পার্কিংয়ে রেখে ফিরে আসল ওরা। মাহীনকে ধরে নাইম ও নায়েল ভেতরে নিয়ে গেল। সাথে সাথে বাকিরাও রয়েছে। ভেতরে গিয়ে ডিউটি ডাক্তারকে দেখাতে বেশি সময় লাগলো না। তারপরও প্রায় আধাঘন্টা ওরা হসপিটালে থাকল। এখান থেকেই মাহীনের ছিলে যাওয়া জায়গাগুলো পরিষ্কার করে ড্রেসিং করে দিল। এবং ডাক্তার জানাল, ওর পা শুধু মচকে গেছে। খুব গুরুত্বর কিছু নয়। দুইদিন বেড রেস্টে থাকতে হবে। এবং এরপরও কিছুদিন পায়ের ওপর বেশি চাপ যেন না পরে। এরপর নাইম বিল পরিশোধ করল এবং ওরা সকলে বাইরে বেরিয়ে আসল। এখানে যেভাবে এসেছিল। সেভাবেই সোজা মাহীনের বাসায় ফিরে চললো। এখন প্রায় দুপুর পৌনে তিনটা বাজে। রাস্তায় জাম থাকায় ওদের প্রায় পনেরো মিনিট লাগল বাসায় পৌছতে। মাহীন গাড়ি থেকে বের হয়ে নাইম ও নায়েলের বাহুতে ভর দিয়ে খুরিয়ে খুরিয়ে হেঁটে চললো। গাড়ির হর্ন পেয়েই মিসেস নাসরিন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেতরে প্রবেশ করে মাহীন কে সোজা ওর কামরায় নিয়ে যাবে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নাইম মাহীনকে পাঁজা কোলা করে উঠিয়ে নিয়ে গেল। ওর কামরায় ঢুকে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিল। মিসেস নাসরিন খেয়াল করলেন বাকি সকলেও আবারও জুতা পরেই ওপরে মাহীনের কামরায় উঠে আসল। মিসেস নাসরিন ওর বিছানার একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন। বিছানার সামনে নাইম দাঁড়িয়ে এবং অপর পাশে বাকি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। মাহীন যতটা সম্ভব ততটা অসহায় মুখভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। কামরায় পিনপতন নীরবতা। মিসেস নাসরিন কটমট দৃষ্টিতে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দৃঢ় স্বরে বললেন,

‘তোকে কিছুই বলবো না। দুই দিন পর তোর পিকনিক। আর তুই এখন বিছানায় পরে আছিস। পিকনিক যাওয়ার তো কোনো উপায় নেই। পিকনিক বাতিল তোর।’

মাহীন সঙ্গে সঙ্গে অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘না,না,না,না মাঅআআআআ! প্লিজ দেখো আমার তো কোনো দোষ ছিলো না। এটা তো জাস্ট এক্সিডেন্ট ছিলো। তারপর সম্পূর্ণ ঘটনাটা সবিস্তারে খুলে বলল।’ তারপর আবার বলল, ‘এখন বলো অন্য কেউ আমার জায়গায় থাকলে কি করতো?’ বলে বন্ধুদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,
‘তোমরা কি করতা বলো?’

ওরা কেউ কিছু বলার আগেই মিসেস নাসরিন ভারি কন্ঠে বললেন, ‘ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু তোর তো পা মচকে গেছে তুই এমনিতেও ওই পাহাড়ে পিকনিকে যেতে পারবি না।’

মাহীন বলল, ‘ডাক্তার তো বলেছে দুই দিন বেড রেস্টে থাকতে। এবং পিকনিকও দুইদিন পর। আমি ওখানে গিয়ে কোনো পাহাড়ে উঠবো না। এবং বেশি হাঁটাচলাও করবো না।’

মিসেস নাসরিন বললেন, ‘সেসব পরে দেখা যাবে। দেখো সাড়ে তিনটা বাজচ্ছে। কারোও খাওয়ার কোনো খবর নাই।’ তারপর বাকি সকলের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বললেন, ‘দেখো তোমরাও তো তখন থেকে ওর সাথেই ছুটে বেড়াচ্ছ। নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত তোমরা। আজ কিন্তু এখান থেকে না খেয়ে কেউ যাবা না। আমি নিচে খাবার বাড়ছি। তোমরা নিচে আসো।’
কামরা ত্যাগ করার আগে বললেন,’মাহীন তোর খাবার আমি ওপরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি। তখনই সকলে এসে লাফ দিয়ে ওর বিছানায় উঠে বসল। নাইম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমি নিচে গেলাম।’ বলে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

র‌াবিত বলল, ‘আল্লাহ আমরা তো ভাবতেই পারিনি কাহিনী এখান থেকে ওখানে পৌঁছে যাবে।’

লিম বলল, ‘ইয়াহ আমরা তো এখানে তোমার বিড়াল দিতে এসেছিলাম।’

মাহীনের কথাটা মনে পরতেই বলল, ‘ওহ হ্যা সেই বিড়াল! কোথায় ওটা?’

ক্যারোল বলল, ‘আমি তো যাওয়ার সময় এখানেই ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলাম।’

‘ওটাকে আমি বুক সেলফের তাকে বসে থাকতে দেখেছি ওপরে উঠার সময়।’ বলল নায়েল।

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আল্লাহ মা কি বলেছিল বিড়ালটা দেখে?’

জেনেট বলল, ‘আন্টি তো কিছু বলার আগেই তোমার ফোন এসেছিল। আর তো ক্লিয়ারলি কিছু বলাই হয়নি।’

র‌াবিত বলল, ‘এখন আন্টি তোমাকে পিকনিকে আদৌও যেতে দিবে তো?’

মাহীন মুখ গোঁজ করে বলল, ‘আমি জানি না। আহহহ! কিন্তু আমি যেভাবেই হোক মাকে রাজি করিয়েই ছাড়ব।’

কিছুক্ষণ পর মিসেস নাসরিনের ডাকে সকলে নিচে চলে গেল খাওয়া দাওয়া করতে। মিসেস নাসরিন মাহীনের খাবার ওর কামরায় দিয়ে গেলেন। মাহীন যখন খেলো তখন ওর কামরা সম্পূর্ণ খালি ছিল। খাওয়া দাওয়া শেষে আবারও সকলে ওপরে উঠে আসল। র‌াবিত হাতে করে বিড়ালটাকেও নিয়ে এসে জানালার উইন্ডোশীলে বসল। ক্যারোল জানালার পাশের সোফায় বসলো। এদিকে বাকিরা মাহীনের বিছানায় বসেছে।

জেনেট বলল, ‘আচ্ছা তুমি না আজকে স্কুলে ক্লিয়ারলি তখন কিছুই বলোনি তোমার সাথে রায়েদের দেখা হওয়ার বিষয়টা নিয়ে।আবার কোনো ঝামেলা হয়েছে?’

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আর বলো না! জানি না কী হয়েছে। অপমান তো ও আমাকে করেছে। রাগ করে থাকার কথা আমার। ও কী করতে কথা বললো না তাও জানি না।’

রায়েদের কথা কানে আসতেই র‌াবিত কান খাড়া করে এদিকে মনোযোগ দিল। যদিও ও জানালায় বসে ক্যারোটের সঙ্গে কথা বলছে।

নায়েল বলল, ‘কিন্তু হঠাৎ কেন? তোমার সাথে না ও ভালো ব্যবহার করতো? এমন নয় তো যে ওকে তোমার বদলে আমরা ইনভাইট করতে গিয়েছিলাম বলে মাইন্ড করেছে?’

মাহীন বলল, ‘যদি এমন ভেবেও থাকে ও আমি তো এমন কিছু ভেবে তোমাদের কাজটা করতে বলিনি। আমার তো অন্য রিজন ছিলো। এর পূর্বে যতবার প্রয়োজন পরেছে আমিই গিয়েছিলাম লাইব্রেরিতে। রায়েদ তো আসেনি। আমি আর কতবার যাবো? তারপরও তো তোমরা হও আর আমি হই, ইনভিটেশন টা তো আমার পক্ষ থেকেই ছিলো।’

জেনেট বলল, ‘হ্যা তোমার কথায় যুক্তি আছে। তবে এখন ওকে নিয়ে মাথা ঘামায় লাভ নেই। কারণ ওর সাথে ভালো সম্পর্ক ধরে রাখা এত সোজা না। অতিরিক্ত সেনসিটিভ মানুষ ও। তাও তো তুমি চেষ্টা করছিলা এবং বেশ সফল হয়েছিলা।’

র‌াবিত মনে মনে ভাবল, ‘ওহ আচ্ছা ঝামেলাটা তাহলে এখানে। এখন বুঝতে পারলাম গোটা কাহিনী। ওফ এই ভাই না পুরাই জট লাগা সুতা। মাহীন কি ভেবে কি করল আর সে কি ভেবে বসে আছে।’

তখনই মাহীনের কামরার দরজা খুলে গেল। সাইলোহ ও লিও কামরায় প্রবেশ করল। সাইলোহ প্রায় ছুটে এসে মাহীনের পাশে বসে উৎকন্ঠিত স্বরে বলল, ‘আরেহ নায়েলের ফোন পাওয়া মাত্র আমরা রওনা দিয়েছি। তুমি ঠিক আছো তো?’

মাহীন স্মিত হাসল। বলল,’এখন অনেক ভালো আছি। আর আনন্দেও আছি। আমার আশেপাশে সবাই যে আছে।’
লিও বলল, ‘তোমার পিকনিক যাওয়ার চান্স নাকি কমে গিয়েছে? কিন্তু আসলেও পায়ে ব্যাথা নিয়ে তুমি পাহাড়ে কিভাবে যাবা?’

মাহীন চিন্তিত গলায় বলল, ‘সেটা এখনো বলতে পারছি না। দেখি কি করা যায়।’

সাইলোহ জানালার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘ওহ মাই গড র‌াবিত, ক্যারোট সবাই দেখি এখানে আছে।’

জেনেট বলল, ‘হ্যা আমরা স্কুল ছুটির পরপরই মাহীনের বাসায় এসেছিলাম। সেইখান থেকে সবকিছুতেই ওরাও সাথেই ছিল।’
.
.
.
নিচে মিসেস নাসরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় বসেছেন মাত্র। নাইম ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে পানি খাচ্ছিল তখন মিসেস নাসরিন ক্লান্ত স্বরে বললেন,

‘এ্যই নাইম এদের সমস্যা কি বলতো? আবার যেই দুইজন এসে হাজির হলো এরাও জুতা পায়ে দিয়েই ওপরে চলে গিয়েছে। ওফ সবাই যাওয়ার পর গোটা ঘরটাই আবার পরিষ্কার করতে হবে।’

নাইম ভাবলেশহীন মুখে বলল, ‘ওহ ওটা তো এখানে কমন ব্যাপার।’

‘ওহ হ্যা আর যা তো দেখে আয় এরা আবার জুতা পরে মাহীনের বিছানায় উঠে বসে নাই তো? মাহীনের তো কোনো হুস নাই। ও খেয়ালও করবে না।’ আতকে উঠে বললেন মিসেস নাসরিন।

নাইম শান্ত কন্ঠে বলল,’থাক না মা। আমার মনে হয় না ওরা বিছানায় উঠবে।’

‘আরেহ তুই ওদের চিনিস না। যা দেখে আয়।’ নাইম দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here