#আজি_বিজন_ঘরে,০৮,০৯
৮.
প্রচুর ঐশ্বর্যের মাঝে বড় হওয়া মনোয়ারা যখন তাদের বাড়িতে আশ্রিত লজিং মাস্টারকে বিয়ে করলো তখন বাবা তাকে বাড়ি থেকে বাহির করে দিলেন। ভাই তো পারলে তখনি তাদের খুন করে ফেলে। কি যে কষ্টে কেটেছে সেই সময়। দুজন মিলে বস্তির মত বাড়িতে উঠলো। তার কাছে যে অল্প কিছু টাকা আর গয়না ছিল তাও শেষ হয়ে গেল কিছুদিনের মধ্যে। বছর ঘুরতেই সেই লোকটা পালিয়ে গেল। তখন সে ফিরে এসেছিল আবার। কিন্তু তাকে আর কেউ আগের মত ভালবাসতো না। বাবা তার সব সম্পত্তি ভাইকে লিখে দিয়েছেন। এ বাড়িতে তার অবস্হান কাজের লোকের মত হয়ে গেল। ভাই তাকে দেখতেই পারতো না। সেও অবশ্য কারো সামনে যেত না। নিজের মত করে থাকতো।
ওদের সুখী পরিবার দেখে হিংসায় তার শরীর জ্বলে যেত। তখন সে দিনের পর দিন ঘরে বসে কিভাবে এদের ক্ষতি করবে সেই পরিকল্পনা শুরু করলো। রোদেলা ছিল বড় আদরের। সে যে প্রেম করছে সেটা সে সহজে ধরে ফেলল। আর সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগালো। তাকে প্ররচণা দিতে শুরু করল। মেয়েটা বাড়ি ছাড়লো তার বুদ্ধিতেই কিন্তু কেউ কিছুই জানলো না। সে মাঝে মাঝেই চুপ করে ওর বাসায় যেত। তারপর তার স্বামীকে বুদ্ধি দিতে শুরু করল যেন টাকা চায়, স্বম্পত্তির ভাগ চায়। দিনের পর দিন এই অশান্তি রোদেলা সহ্য করতে পারলো না। গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল। এতে অবশ্য তার সুবিধাই হল। রিজভী দেশ ছাড়লো। ভাই তখন হার্টের সমস্যায় ভুগছে, ভাবীর মানসিক অবস্হা ভালো না। তখন নতুন ফন্দি আটলো। রাতের বেলা রোদেলার কাপড় পরে মুখ ঢেকে ঘুরতে শুরু করলো রোদেলার মত হাসতে লাগল। ওর গলায় ভাবিকে মা মা বলে ডাকা শুরু করল। ভাবির এমন অসুস্হতায় তার ভাই আরও ভেঙ্গে পড়লেন। তারপর সে ভাইকেও ভয় দেখাতে লাগল। তার দুর্বল হার্ট বেশীদিন এমন প্রেসার সহ্য করতে পারলো না। ভাই মারা যাবার পরে অবশ্য সে কিছুদিনের জন্য চুপ থাকল। ভাবির সেবা যত্ন করতে লাগল মন দিয়ে। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে ভাবিকেও রাত্রে ছাদে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।
পুরো রাজত্বই তার দখলে চলে এল। রিজভী ফেরত আসলেও তাকে মাথায় করে রাখলো।সব কিছুই ঠিক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে বিয়ে করতে চাইলো। এই কথায় অবাক হলেও ভালো মানুষের মত তিনি বিয়ে করতে বললেন। ভাবলেন এই বুড়ো ছেলেকে কে বিয়ে করবে?
কিন্তু এখন তাকে নতুন করে আবার সব কিছু ভাবতে হবে। দুপুরবেলা এবাড়ির সবাই নিজ নিজে কাজে ব্যস্ত। মনোয়ারা এঘর ওঘর হেটে বেড়াচ্ছেন অনেক্ষন ধরেই। রিজভী অফিসে আর নতুন বউ গেছে তার ইউনিভার্সিটি। এদের মধ্যে যদি কোনো সন্দেহের বীজ বুনে দেয়া যায় কেমন হবে তাহলে?
লাইব্ররীতে ঢুকতেই তিনি ফুলের গন্ধে অভিভূত হলেন। রিজভীর মায়ের দোলনচাঁপা অনেক পছন্দের ছিল। কিন্তু এঘরে এ ফুল কোথা থেকে এল? পাশের ঘরটায় গুনগুন করে কেউ শব্দ করছে। মনে হচ্ছে কেউ কবিতা পড়েছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন। ঘরে কোনো আলো নেই। দিনের আলোর একটু আলো গিয়ে পড়ল বিছানা বরাবর। খাটের মাথার কাছে কেউ বসে। ঠিক দেখছেন কি? এতো রিজভীর মা। তিনি ওখানেই পড়ে গেলেন। জ্ঞান হারানোর আগে তার মনে হল কেউ জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে।
মেরী যখন তাকে খুঁজে পেল তখন তার হাত পা প্রায় ঠান্ডা। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে। সে তাড়াতাড়ি করে ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে তাকে হাসপাতালের নিয়ে গেল। রিজভী খবর পেয়েই ছুটে গেল হাসপাতালে। ডাক্তার বলল স্ট্রোক করেছেন । আর একটু দেরি হলে বাঁচানো যেত না। ব্লাড প্রেসার অনেক হাই। তবে বাহাত্তর ঘন্টা দেখতে হবে। মেরী আর শফিকে হাসপাতালে ফুপুর কাছে রেখে বাসায় ফিরলো। অনেক রাত হয়ে গেছে।
নিজের ঘরে ঢোকার আগে সে দাঁড়ালো। মেরী বলেছে ফুপু তার ঘরের সামনে পড়ে ছিলেন। বিছানার দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো তারপর তার ভুল ভাঙ্গলো। একটা পাতলা চাদর রাখা। অর্পার এসি তে ঠান্ডা লাগে। তাই সে চাদর গায়ে ঘোরে। তিনি অফিসে যাবার পরে এসেছিল হয়তো। এখানে রেখে গেছে ভুলে। বিছানায় বসে চাদরটা হাতে নিয়ে গালে ছোয়াঁলেন। মিষ্টি ফুলের গন্ধটা তাকে জড়িয়ে ধরলো।
-আপা ভাইজান আসছে।
টগরের কথা শুনে অর্পা নিচে নেমে এল।
রিজভী তাকে দেখেই কাঁদতে লাগলো। এত বড় একজন মানুষ বাচ্চাদের মত কাঁদছে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। পাশে গিয়ে বসতেই রিজভী তাকে জড়িয়ে ধরলো।
-আমার সাথেই কেন এমন হয় বলতে পারো?
-আপনি প্লিজ শান্ত হন। কিচ্ছু হবে না ফুপির। শফি সাহেব ফোন করেছিলেন। এখন অবস্থা অনেকটাই স্টেবল।
তিনি অর্পাকে ছেড়ে দিলেন।
-সত্যি বলছো।
-আপনি কল করেন।
-তুমি এখানেই বস। কোথাও যাবে না। আমি এক্ষুনি আসছি।
তিনি ড্রেসার থেকে কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গেলেন।
৯.
স্বজনের সাথে ইউনিভার্সিটিতে দেখা হয়ে গেল অর্পার। তাকে দেখে সে এগিয়ে এল। সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তারপর তো আর ওমুখো হয়নি। এমনকি মাকে ফোনও করেনি।
-কেমন আছে ভাইয়া।
-ভাল। তোর কি খবর?
-এইতো… পরীক্ষা ছিল আজ। তুমি এখানে?
-তোর সাথে দেখা করতেই এলাম। সবাই বলাবলি করছে এক বয়স্ক লোককে বিয়ে করেছিস? মা তো সেটা শুনে চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে গেছে।
-মাকে বলো আমি ভাল আছি। বয়স বেশি হলেও উনি একজন মানুষ। মানুষের মত দেখতে পিশাচ না।
-বাসায় এসে মাকে দেখে যাস। তোরই তো মা।
-আচ্ছা দেখি।
মায়ের অসুস্হতার কথা শুনে মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। সে কি যাবে? রিজভীকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে। আজকাল রিজভীর সাথে তার সম্পর্কটা অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। সুন্দর একটা বন্ধুত্ব। দুজন প্রায়ই ঘুরতে বাহির হয়, মুভি দেখে, শপিং করে।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে অর্পাকে না দেখে রিজভী অবাক হয়ে গেল। ও তো জানে সে এই সময় ফেরে। প্রতিদিন তো এখানেই থাকে।
-টগর।
-জ্বি ভাইজান।
-তোর আপা কই?
-আপা তো ঘরেই আছে।
সে কাপড় না পাল্টেই উপরে এল। দরজা খোলাই আছে। ঘরে কেউ নেই। তাহলে নিশ্চই ছাদে। ছাদে এসে দেখলো সে যা ভেবেছিল তাই।
-এই সময় এখানে কেন?
-তুমি চলে এসেছ? ওহঃ সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি আপনার আসার সময় হয়ে গেছে।
-তুমিটাই তো ভাল ছিল। আবার আপনি কেন?
অর্পা নিজে থেকেই রিজভীর হাত ধরে। তারপর চেয়ারে বসিয়ে দেয়।
-আমার কিছু জরুরী কথা বলার ছিল।
-কি কথা?
-আমার জীবনের কথা। যেগুলো আপনার জানা উচিত।
-আমি জানি।
-জানেন কিন্তু সবটা হয়তো জানেন না।
-আমি সবটাই জানি। রাজনের সাথে আমার কথা হয়েছে। তুমি এসব ভেবো না।
-আমাকে তো কখনও কিছু বলেন নি?
-বলে কি হবে? তোমার তো কোন দোষ ছিল না।
-কিন্তু আমি তো কোনভাবেই আপনার যোগ্য ছিলাম না।
-চুপ করে আমার কথা শোনো। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখলাম সেদিন আমার আপার মুখটা মনে পড়ে গেল। তারপর খোঁজ নিলাম। তখন মনে হল আপা নিজের কষ্ট নিজে চেপে রেখে মরে গেল। তোমার ক্ষেত্রে এমন কিছু না হোক। তোমাকে তো চেষ্টা করলেই বাঁচাতে পারি। এখন যাও চট করে রেডি হয়ে নাও।
-কোথায় যাব?
-সেটা গেলেই দেখতে পাবে।
জিগাতলার কাছে গাড়ি আসতেই সে চমকে উঠলো।
-আমরা কোথায় যাচ্ছি?
-তোমার বাসায়। তোমার মাকে দেখতে।
-আপনি জানলেন কি করে?
-জেনেছি। কিভাবে জেনেছি সেটা না জানলেও চলবে মনে হয়।
নিজের মাকে দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেল অর্পা। পুরো বিছানার সাথে লেগে গেছেন। শরীরে শুধু হাড় দেখা যাচ্ছে। সে মায়ের পাশে বসলো। রিজভী বাবার সাথে বসার ঘরে চলে গেল। মা তার হাতটা ধরল।
-আমার উপর রাগ করে কেন এমন করলি?
-আমি রাগ করিনি মা। শুধু নিরাপদে থাকতে চেয়ছি। আর আমার মনে হয়েছে উনি কুছু না হোক নিরাপত্তা দিতে পারবেন। তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমি অনেক ভাল আছি। তোমার এ অবস্হা কেন?
-সারাক্ষন টেনশন লেগেই থাকে।
– তুমি কি ডাক্তার দেখিয়েছ?
– ডাক্তার তো দেখছেই।
-আচ্ছা আমি বাবার সাথে কথা বলবো।
-আজ এখানে থেকে যা।
-এখানে আমার আর থাকা হবে না মা। তুমি চলো ওখানে।
-তা কি করে হয়। তুই রাজনকে মাফ করে দে। ছেলেটা কেমন হয়ে গেছে। বাসায় আসে না। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়।
-আমি তো তাকে জীবনেও মাফ করবো না মা। আজকের পরে আর এই কথা যেন না শুনি। আর পাপ করলে তো তার সাজা ভোগ করতেই হবে। ওর তো কোন সাজাই হয়নি।
চলবে……
এমি।