এল_এ_ডেইস পর্ব -২০

0
338

#এল_এ_ডেইস
পর্ব -২০
লেখনী- মাহীরা ফারহীন

নিরব, শান্ত পরিবেশটা ভেঙ্গে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে কামরার ভেতরে প্রবেশ করল রাবিত। বিছনার চাদর, বালিশ সব টানটান করে গুছিয়ে রাখা। ড্রেসিংটেবিলের ওপরও মাত্র অল্প কয়েকটা জিনিস সাজিয়ে রাখা আছে। শুধু পড়ার টেবিলটা একটু অগোছালো। রায়েদ বই খুলে নিজের টেবিলে বসে আছে। রাবিত এসে বিছানায় ধপ করে বসে পরল। বিরক্তির সঙ্গে উৎকন্ঠার মিশ্রণ লেগে আছে চোখে মুখে। বলল,

‘এ্যই জানো কি হয়েছে?’

রায়েদ বই থেকে দৃষ্টি না সরিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলল, ‘কি হয়েছে?’

‘মাহীনের এক্সিডেন্ট হয়েছে।’

রায়েদ ফট করে বই থেকে দৃষ্টি সরাল। বিস্ময় ভরা চোখে রাবিতের দিকে তাকায়। কেমন জানি একটা অস্থিরতার উদ্রেক ঘটল মনের অন্তরালে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এলো। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘এক্সিডেন্ট? কি করে হলো?’

রাবিত গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘হুম সেই লম্বা কাহিনি।’

রায়েদ অধৈর্য্য হয়ে বলল, ‘ওফ বল না কি হয়েছে? আজই তো স্কুলেই দেখা হল। সুস্থ স্বাভাবিক ছিল।’

রাবিত বলল, ‘না বাসায় আছে।’

রায়েদ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কিন্তু ওর হয়েছেটা কী বলবি তো?’

‘তুমি তো তোমার ইগো নিয়ে রাগ করে আছো ওর ওপর। শুনেই বা কি লাভ?’

রায়েদ আত্মসংবরণ করে অন্য দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, ‘সেসব অন্য কথা। আর আমি ওকে চিনি বলেই জানতে চাচ্ছিলাম।’

‘ও আসলে সাইকেল এক্সিডেন্ট করেছে। সাইকেল থেকে পরে গিয়ে পা মচকে গিয়েছে এবং হাতে পায়ে কয়েক স্থানে ছিলেও গিয়েছে।’

রায়েদ আলতো ভাবে উপরে নিচে মাথা নেড়ে বলল,’তুই এইসব এত ডিটেইলসে জানলি কি করে?’

র‌্যবিট বলল, ‘জানবো না আবার? শুনো নাই আজকের সকালেই মাহীনের কাছ থেকে ঠিকানা নিলাম ওর বাসায় যাব বলে। তো আমরা স্কুলের পরপরই ওর বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। কিন্তু তারপর তো ও ফোন করে খবর দিলো ওর এক্সিডেন্ট করেছে। সেই থেকে ওকে নিয়ে হসপিটাল যাওয়া এবং আবার ওর বাসায় যাওয়া। ওখানেই খাওয়া দাওয়া করে তারপর ফিরে এসেছি।’

রায়েদ বলল, ‘ওহ তাই তো বলি খাওয়ার সময়ও তুই বাসায় ফিরলি না কি করে। আধা বেলা তো ওর বাসায়ই কাটায় আসলি।’

র‌্যবিট বলল, ‘হুম তা ঠিক। যদিও আমি তো ভাবতেও পারিনি আধা ঘণ্টার জন্যে ওর বাসায় গিয়ে আধাবেলা থেকে আসব।’

রায়েদ বেদনা মিশ্রিত কন্ঠে বলল, ‘ইশ। ও তো দেখি লিম জুর লাইট ভার্সন। ওর সাথেও ঝামেলা কম হয় না।’

রাবিত বলল, ‘তা একদম পার্ফেক্ট বলেছো। বাই দ্যা ওয়ে। তুমি ওকে দেখতে যাবা না?’

রায়েদ থমকাল। গাঢ় কন্ঠে বলল, ‘আমি কিভাবে ওকে দেখতে যেতে পারি? আমার সাথে তো ওর কোনো বন্ধুত্ত্ব বা তেমন কোনো সম্পর্ক নেই।’

রাবিত ডানে বামে মাথা ঝাকাল। বলল, ‘মোটেও না। তোমারও যাওয়া উচিৎ এবং ওর সাথে এই মনোমালিন্য মিটিয়ে নেওয়া উচিৎ।’

রায়েদ অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, ‘কিসের মনোমালিন্য?’

‘তুমি কি ভাবো আমি কিছুই জানি না? আমি সম্পূর্ণ ব্যাপারটাই জানি। ইভেন যেগুলো তুমি জানো না সেগুলোও জানি। মানে কি বলবো তুমি মানুষটাই এত জটিল যে প্রতিটা বিষয় কে ওভার থিংক করে দশ লাইন বেশি ভেবে পেঁচিয়ে পুচিয়ে ভুল বুঝে বসে থাকো। এখন তুমি যদি এক্সট্রা চিন্তা করে কাউকে ভুল বুঝে বাসো তাহলে অপর পক্ষ সেটা কিভাবে বুঝবে?’

রায়েদ বিরক্ত কন্ঠে বলল, ‘তুই কি বলতে চাচ্ছিস সোজাসুজি ভাবে বলবি? আমি কি এমন ওভার থিংক করলাম।’

‘আচ্ছা তুমিই বলো মাহীনও তো একটা মানুষ নাকি? ওর কোনো আত্মসম্মান নাই? ও আর কতবার আসবে তোমার কাছে? একবার তুমিই গুনে দেখো মাহীন কতবার তোমার শরণাপন্ন হয়েছে আর কতবার তুমি ওর কাছে গিয়েছ। অবশ্যই একটা না একটা সময় তো ওর থামারই ছিল। তবুও তো ও তোমার কথা ভেবে সাইলোহ ও নায়েল কে পাঠিয়েছিল। অবশ্য এটাকে তুমি অপমান হিসেবে ধরে নিবা এটা তে বোধহয় কাশ্মীন কালেও ওর মাথায় আসেনি। তাহলে তুমি ভাবস টা কি ওকে? তোমার কিন্তু এক্ষেত্রে ওর ওপর রাগ হওয়াটা মানায়ই না। বছরের পর বছর এভাবেই নিজেকে গুটায় রাখবা? কেউ নিজে থেকে এসে তোমার পাশে দাঁড়াল। কম তো করল না ও। তারপরও যদি তুমি ওর কাছ থেকেই আশা করে যাও নিজে কিছুই না করো তাহলে কিছুই হবে না। আমি সত্যি খুবই সারপ্রাইজড হইসিলাম যখন দেখলাম মাহীনের সাথে তোমার সম্পর্কটা বেশ সুন্দর একটা পর্যায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বাট তুমি কি করলা সব নষ্ট করে দিলা। আমি বলতে তো চাই না, তারপরও বলছি কিছু মনে কর না। মানুষের সাথে না মিশতে মিশতে তুমি খুব আনসোশাল হয়ে গেছ।’ বলে থামল। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রাবিত।

রায়েদ নিশ্চুপ ভাবে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বসে আছে। ও কিছুই বললো না। রাবিত আবার বলল,
‘এখন নিজেকে প্রশ্ন কর যে, আসলেও মাহীনের কোনো দোষ ছিল কিনা? অহেতুক তুমি আজ ওর সামনে আমাকে যেভাবে কথাগুলো বললা তাতে আমার কিছু না হলেও মাহীনের মনে হয়েছে যে তুমি ওর সাথে তেমনই বিহেইভ করছো যেমনটা অন্যদের সাথে করো। ও কি সেটা ডিজার্ভ করত? ওহ হ্যা তারপর তুমি নাকি আবার ওকে ইনসাল্ট করেছো। কী আশ্চর্য! হ্যা ও অনেক অদ্ভুত কিছু কান্ড করসে কিন্তু সেগুলো তোমার জন্যেই তো করেছে। তাহলে? তুমি অন্য সবার সাথে যেমন আচরণ করো তেমনটাই তো ওর সাথে করা উচিৎ না। আমি জানি অন্য সকলে যাই মনে করুক মাহীন কিন্তু তোমাকে ভালোই মনে করত। যেকোনো কারণেই হোক। এতকিছুর পরও তোমার ওমন আচরণে ও নিশ্চয়ই তোমাকে খুব অকৃতজ্ঞ মনে করল। এখন দয়া করে ওর সাথে গিয়ে দেখা করো। এবং যত মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং আছে সেগুলো ক্লিয়ার করো। এখন বলো যাবে তো এখন?’

রায়েদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল, ‘আজ কিভাবে যাওয়া সম্ভব? এমনিতেও তোরা পুরো দল শুদ্ধ সারা বেলা ওর বাসায় ছিলি। মাহীনেরও তো রেস্ট নিতে হবে। এখন ও ঘুমিয়েও থাকতে পারে। এবং ওর বাসায় সকলেও ডিস্টার্ব হবে আমি গেলে।’

রাবিত আনন্দে লাফিয়ে উঠল। তবে আবার শান্ত হয়ে বলল, ‘হুম তা ঠিক। তাহলে আজ না গেলেও কাল যাও। তবুও দেখা করে আসো।’

বলে উঠে দাঁড়াল রাবিত। এবং গটগট করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। টেবিলের পাশের জানালা দিয়ে বাতাসের ঝাপটা আসছে। রায়েদ পেন্সিল দিয়ে একটা সাদা পৃষ্ঠায় খোঁচা দিচ্ছে। রাবিতের বলা কথাগুলো এখন সবকিছুকে নতুন করে ভেবে দেখতে বাধ্য করছে। বুকের ভেতর সেই চিনচিনে ব্যাথা আবার ফেরত এসেছে। ভাবছে, রাবিত তো ভুল কিছুও বললো না। মাহীনের পার্সপেক্টিভ থেকে তো একবারও ভেবে দেখিনি আমি। আসলে আমি মাহীনের জায়গায় থাকলে আরোও আগেই হাল ছেড়ে দিতাম। তাহলে ওকে অবশ্যই দোষ দেওয়া যায় না। আমি অহেতুক সেদিন ওর বন্ধুদের সামনে ওকে অপমান করলাম। এখন বুঝলাম আজ কেন ও আমার সাথে নিজে থেকে কথা বললো না। বলবে কেন, আমার কথাগুলোই ওর গায়ে লেগেছে। আমাদের মধ্যকার সুইট রিলেশনটাকেও তিক্ত করে দিয়েছি আমি। যদিও আগে হলে বা অন্য কারোও ক্ষেত্রে হলে আমি তেমন পাত্তা দিতাম না। তবে সব পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারার পরও তিক্ততাটা ঝুলায় রাখলে আমিই শান্তিতে থাকতে পারবো না। তবে আজ যাওয়া সম্ভব নয়। আর এমনিতেও ওর বাড়ি পর্যন্ত চলে যাওয়া আমার ক্ষেত্রে আসলেই ওড লাগে। তাছাড়া ওর সাথে আমার কিই বা এমন বন্ধুত্ত্ব আছে যে আমি ওকে দেখতে যেতে পারি? রাবিত না পুরো মিনিংলেস কথা বলে। যদিও এরপর দুইদিন মাহীন স্কুলে আসবে না। এবং এই তিক্ততা ঝুলায়ও বসে থাকতে পারবো না কারণ ঝামেলাটা তো আমিই লাগিয়েছি। এখন আমাকেই এসব ঠিক করতে হবে।’
.
.
.
.
পরের দিন বিকেল পাঁচটা বাজে। সূর্য ডুবতে অনেক দেরি এখনো। এর মধ্যে মাহীন দুপুরে লম্বা ঘুম দিয়েছে। ও এখন চুপচাপ বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে সেলেনা গোমেজের ব্যাক টু ইউ গানটা শুনছিল। ক্যারোলের দিয়ে যাওয়া বিড়াল সারাদিনে কয়েকবার ওর কামরায় উঁকি দিয়েছে। তবে বেশির ভাগ সময় সে নাকি ড্রয়িংরুমে বুক সেলফের ভেতর ঢুকে বসেছিল। বুক সেলফটাকেই বুঝি নতুন আবাসস্থল বানিয়েছে। হঠাৎ কামরার দরজাটা খুলে গেল। নাইম ভেতরে উঁকি দিলো। বলল, ‘এ্যই শোন তোর একজন ফ্রেন্ড আসছে। যদিও ওর নাম শোনার পর ব্যপারটা আমার অবিশ্বাস লাগছে।’

মাহীনের ভ্রু কুঞ্চিত হল। জিজ্ঞেস করল, ‘কেন আজ আবার কে এসেছে? কাল তো সকলে ঘুরেই গেল।’

‘আরেহ ওই যে সেই রহস্যময় ছেলেটা রায়েদ মাদিহ। সিরিয়াসলি তোদের মধ্যে না ঝামেলা চলছিল? কখন ঠিক হলো?’

মাহীন চোখ কপালে তুলে বলল, ‘রায়েদ! হাউ অন আর্থ! ওর দিক থেকে আবার সাথে কী ঝামেলা চলছিল যদিও তা জানি না। তবে তা ঠিকই তো হয়নি। তাহলে ও আমাকে দেখতে আসলো কিভাবে?’

‘ও না নিজে থেকে কথাই বলতে আসে না। আবার তোকে দেখতে এসেছে। আসলে বলতো তোদের আসলেই কোনো ফ্রেন্ডশিপ ছিলো না? আর থাকলেও কি লেভেলে ছিলো?’ সন্দেহের গলায় বলল নাইম।

মাহীন অপ্রতিভ ভাবে বলল, ‘আরেহ ধুর যা বলেছিলাম তেমনই। তুই এখন ওকে আসতে দিবি? নাকি বাইরে অপেক্ষাই করতে থাকবে?’

‘ওহ হ্যা আচ্ছা ঠিক আছে।’ বলে নাইম দরজা খোলা রেখেই চলে গেল।

দ্রুত গতিতে ওঠা নামা করছে নিঃশ্বাস। এত দিনে এতবার রায়েদের মুখোমুখি হওয়ার পরও কখনো স্নায়ুর ওপর এমন ভাবে চাপ অনুভব করেনি যেমনটা এখন করছে। দ্রিমদ্রিম করে ডঙ্কা বাজচ্ছে বুকে।
ওর কাছে হয়তোবা রায়েদ শেষ ব্যক্তি যাকে ও এই সময়, এই পরিস্থিতিতে নিজের বাড়িতে আশা করবে। বিছানায় নেতিয়ে পরে থাকা ওড়নাটা নিয়ে গলায় জড়ালো। আশেপাশের সবকিছুই এলোমেলো হয়ে ছিলো। তাড়াহুড়ো করে সব ঠিকঠাক করে সোজা হয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর রায়েদ দরজায় এসে দাঁড়াল। মাহীনের গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। রায়েদ জিজ্ঞেস করল,
মে আই কাম ইন?’

রায়েদের গাঢ় কন্ঠ কানে আসতেই কেঁপে উঠল মাহীন।
কোনো ক্রমে নিজেকে শান্ত করে ভাবলেশহীন মুখভঙ্গি বজায় রাখার চেষ্টায় ছোট করে বলল, ‘হুম।’

রায়েদ ভেতরে প্রবেশ করল। তারপর ধীর পদক্ষেপে হেটে এসে ওর বিছানার পাশে বসল। খোলা জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের নরম সোনালি রোদের কিরণ সারা কামরায় হলদেটে ভাব ছড়িয়ে দিয়েছে। মাহীন কাঠ হয়ে বসে আছে।

রায়েদ নরম কন্ঠে বলল, ‘কেমন আছ?’

‘আছি আলহামদুলিল্লাহ।’

‘তোমার পায়ের কি অবস্থা?’

‘পা শুধু মচকে গিয়েছিল। তেমন কিছু না।’

এবার রায়েদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি এক্সিডেন্ট করলা কিভাবে?’

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আহ আমি তো বাসায় ফিরছিলাম। ওই রোডে অনেক জাম ছিলো তখন। সিগনাল দিয়েছিল তখন একদল বাচ্চা রাস্তা পার হচ্ছিল। তারপর আবার যখন সিগনাল দিল একটা বাচ্চা থেকে গিয়েছিল। ও আমার সাইকেলের সামনেই ছিল। তো ওর ওপর যেন সাইকেল না উঠে যায় তাই অন্য দিকে সাইকেল ঘুরাতে গিয়ে রাস্তার পাশের রেলিঙের সাথে ঢাক্কা খেয়েছি।’

রায়েদ বলল, ‘দ্যাটস টেরিবল। তোমার সাথে আবার হয়ও এমন ঘটনা।’

মাহীন মলিন চেহারায় বলল, ‘হুম।’

এবার ওরা দুজনেই চুপ। হঠাৎ করেই যেন সকল কথা ফুরিয়ে গেল। মাহীন অন্য দিকে তাকিয়ে, রায়েদও অন্য দিকে তাকিয়ে। অবশেষে রায়েদ শুকনো কন্ঠে বলল,
‘আসলে সরি সেদিনের ঘটনার জন্য।’

মাহীন অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের জন্য সরি বলছো?’

‘দেখো সেদিন যে কথাগুলো আমি তোমার ফ্রেন্ডদের সামনে বলেছিলাম সেটার জন্য। আমার সত্যিই ওটা বলা ঠিক হয়নি।’

মাহীন আলতো করে মাথা নাড়ল। কিছুটা ইতস্তত করে বলল, ‘তাহলে তুমি গতকাল সকালে হঠাৎ করে অমন ব্যবহার করলা কেন আমার সাথে? আমি জানি সকলের সাথেই অমন ব্যবহারই করো। সেদিন কেন অপমান করলা তা জিজ্ঞেস করলাম না। কিন্তু যখন ঘুরে ফিরে আবার খারাপ ব্যবহারই করবা তখন ভালো ব্যবহারই বা করার মানেটা কী?’

রায়েদ ধীরে ধীরে শান্ত কন্ঠে বললো, ‘দেখো প্রথমত আমিই হয়তো তোমাকে বুঝতে ভুল করেছিলাম। যখন সাইলোহ ও নায়েল আমাকে ইনভাইট করতে আসল। তখন আমি ভেবেছিলাম যে, তুমিও অন্যদের মতো দূরে সরে গেছ। তোমারও আমার প্রতি মন উঠে গিয়েছে। আমার গায়ে লেগেছিল ব্যাপারটা। তাই আর নিজে আসোনি।’

মাহীন চোখ ছোট করে চাইল। বলল, ‘তুমি বিষয়টাকে এমন ভাবে নিয়েছো আমি তো ভাবতেও পারিনি। আমি তো…দেখো তখন পর্যন্ত প্রতিবার তোমার সাথে দেখা করতে আমিই গিয়েছিলাম। কিন্তু একটা মানুষ আর কতবার নিজে থেকেই চেষ্টা করে যেতে পারে? সবকিছুরই একটা লিমিট আছে তাই না?’

‘তোমার কথাও ভুল নয়। তবে আমি এভাবে ভেবে দেখিনি। এবং পরে আবার তুমিই উল্টে আমার ওপর রাগ করে থাকতে পারো তাও ভেবে দেখিনি।’

মাহীন পানসে গলায় বলল, ‘রাগ করবো না কেন। কী বলাছিলা মনে নেই। থাক যা হয়ে গিয়েছে হয়ে গিয়েছে।’

‘ব্যাপারগুলো কি জট পাকিয়ে গিয়েছিল তাই না?’

‘তা তো বটেই।’ তারপর একটু থেমে ইতস্তত করে বললো, ‘আচ্ছা যেই ঘটনা থেকে এইসব জটের সূত্রপাত সেটা একটু টেনে আনি। সাইলোহ আর নায়েল তোমাকে ইনভাইটটা করেছিলো বলেই তো সমস্যা তাই না? তাহলে এখন আমি বলছি। তুমি পিকনিকে আসবে?’

বলে মাহীন উৎসুক দৃষ্টিতে সরাসরি ওর চোখের দিকে চেয়ে রইল। রায়েদ ওর কাঠবাদামের মতো কালো চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে বিচলিত বোধ করল। অন্য দিকে দৃষ্টি ফেরাল দ্বিধা নিয়ে। তারপর ইতস্তত করে বলল,

‘ঠিক আছে।’

মাহীন প্রথমে বিস্মিত হয়ে গেল। একই সঙ্গে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো, ‘সত্যি! সিরিয়াসলি তুমি আসলেই যাচ্ছো?’

রায়েদ মুচকি হেসে বলল, ‘তাই ধরে নাও।’

তীব্র আনন্দে ভরা পানির স্রোত বুকের ভেতর দিয়ে বয়ে গেল। বর্ণিল ফুলের মিষ্টি মিষ্টি সুবাস মেশানো বসন্তের হাওয়া ছুঁয়ে গেল ওকে। বলল, ‘তুমি জানো তো আমরা পিনাকেল মাউন্টেইন যাচ্ছি?’

রায়েদ বলল, ‘হ্যা জানি। কিন্তু আমি ভাবছি ডেডিসে পার্কে যাবো। কলোরাডো তে। অনেক দিন ধরে জায়গাটা দেখার ইচ্ছা ছিলো।’

মাহীনের মুখ থেকে হাসি হাসি ভাবটা চলে গেলো। আনন্দের হাওয়াটাও দিক পাল্টালো বোধহয়। পানসে কন্ঠে বলল,
‘ওহ ভালোই তো। কিন্তু রাবিত তো পিনাকেল মাউন্টেইন যাচ্ছে। তোমরা দুইজন তাহলে আলাদা হয়ে যাবে না?’

‘নাহ ও যেতেই পারে পিনাকেল মাউন্টেইন।’ বলে আর কিছু বললো না। অবশেষে ও উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘তাহলে আজ আসি। তোমার রেস্ট নেওয়া দরকার।
নিজের খেয়াল রেখো।’ বলে পেছনে ঘুরে দাঁড়াল।

মাহীনের মনে হলো ও কিছু একটা বলার জন্যে হলেও আবার ঘুরে দাঁড়াবে। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলবে, ও মজা করছিল। আসলে পিনাকেল মাউন্টেইনেই যাচ্ছে।
তবে ও তেমনটা করল না। এগিয়ে গিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। ঠিক বের হওয়ার পূর্বে ঘুরে দাঁড়িয়ে সত্যিই বলল, ‘আই ওয়াজ কিডিং।’ বলে বেরিয়ে গেল। মাহীন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। ওর কথাটার মর্মোদ্ধার করতে পেরে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।
.
.
.
রায়েদ কামরা ত্যাগ করেছে বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে। মাহীন ভাবছে, ওহ মাই গড! পুডিংএর সুবাস!
ওহ মা প্রায় ঘন্টাখানেক আগে পুডিং বানাতে বসে ছিলো না? এতক্ষণে তো হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে এখনো আমাকে খবর দিলো না কেন? কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ধরেই তো সুবাসটা আসছে। ভাবতে ভাবতে মাহীন পায়ের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে দিয়ে পা দুটো ধীরে ধীরে নিচে নামায়। বাম পাটা মেঝেতে ছোয়াতেই হালকা চিনচিন ব্যথা করে ওঠে। মাহীন ডান পায়েই সম্পূর্ণ ভর দিয়ে বাম পাটা হালকা মেঝেতে ছুঁইয়ে উঠে দাঁড়ায়। প্রথমে পা টলে উঠে। কোনো রকমে সামলে নিয়ে বিছানা ধরে ধরে ধীরে ধীরে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। বাম পাটা মেঝেতে ছোঁয়াতেই ব্যথা করছে। এভাবেই ও দরজাটা নিঃশব্দে খুলে বাইরে বেরিয়ে আসল। বাইরে আসতেই পুডিং এর কড়া সুবাস নাকে এসে ঠেকল। সিঁড়ির গোড়ায় গিয়ে দাঁড়াতেই হতবাক হয়ে গেল। দেখল ডাইনিং টেবিলে রায়েদ একটা চেয়ারে বসে আছে। পাশের চেয়ারে নাইম এবং ওদের মাঝে মিসেস নাসরিন দাঁড়িয়ে আছে। মাহীন ভাবল,
‘ওয়াট দ্যা হেল ইজ গোইং অন! রায়েদ সেই পনেরো মিনিট আগে বেরিয়েছে এখনো যায়নি? এখানে..ওহ.. ওহ মাই গড! আমার পুডিং! আচ্ছা তো রায়েদকে পুডিং দিয়েই আপ্যায়ন করা হচ্ছে। এইজন্যেই তো বলি পুডিং-এর সুবাস এত ছড়িয়েছে কেন।’ ভাবতে ভাবতে সিঁড়ির রেলিঙ ও অপর পাশের দেয়াল ধরে প্রতিটা ধাপ ভেঙে নেমে আসতে লাগল। অর্ধেক সিঁড়ি নেমেছে তখন নাইম এদিকে খেয়াল করল। চোখ রসগোল্লার মতো করে বলল,

‘ওহ মাই গড! মা দেখো তোমার মেয়ে দুই মিনিট নিজের কামরায় থাকতে পারে না। এই অবস্থায় সিঁড়ি ভেঙ্গে সে নিচে নামছে।’

মিসেস নাসরিন সহ রায়েদও মুখ ঘুরিয়ে এদিকে তাকাল। মাহীন ততক্ষণে তাড়হুড়ো করে সিঁড়ি থেকে নেমে গিয়েছে। মিসেস নাসরিন কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে তীব্র কন্ঠে বললেন,

‘তোকে আমি কি করব বল তো? গতকাল মচকানো পা নিয়ে তুই আজকে সিঁড়ি ভাঙ্গছিস। এভাবে তুই ঠিক হবি? পিকনিক যাওয়ার ইচ্ছা নাই?’

মাহীন অনুনয়ের স্বরে বলল, ‘মা, আমি হাঁটতে পারছি তো। তেমন সমস্যা হচ্ছে না। আর এমনিতেই সেই কালকের দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত বিছানায়ই বসে আছি। বিরক্ত লাগছে এখন। আর কতক্ষণ শুয়ে বসে থাকা যায় বলো?’ বলে ধীরে ধীরে নাইমের পাশের চেয়ারে বসলো। তারপর বলল,’হুম পুডিং দেখি হয়েও গিয়েছে। কিন্তু আমাকে কেউ বললো না।’

মিসেস নাসরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দাঁড়া দিচ্ছি তোকে।’

বলে রান্নাঘরের দিকে গেলেন। নাইম রায়েদেকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘হ্যা তো কি বলছিলাম। এটা কিন্তু জাস্ট একটা বোকামি ছাড়া কিছুই না।’

রায়েদ বলল,’সেটাই। ওর সম্পূর্ণ ক্যারিয়ারের ওপর দাগ পরলো এতে। এন্ড শেষ পর্যন্ত তো ওর আর লিগ জয়েন করাই হলো না।’

‘আমি বলছি ওর ক্যারিয়ার এখানেই শেষ। ইন্টারন্যাশনাল পর্যায় এমন ঘাড়ত্যারা আচরণ করলে তো চলে না।’

মাহীন ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। এবং বুঝার চেষ্টা করছে যে ওরা কি নিয়ে কথা বলছে। অবশেষে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা কার কথা বলছো?’

নাইম উত্তর দিলো, ‘ডি জোকোভিচ।’

‘ওহ’। বলে মাথা নাড়ল মাহীন। ভাবল, ওফ ব্যাডমিন্টন নিয়ে আলোচনা। এই ছেলেরা ঘুরেফিরে খেলাধুলায়ই কেন এসে আটকায়?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্যারোলের দিয়ে যাওয়া বিড়ালটার উদ্দেশ্যে চারিদিকে চোখ বুলাল। গতকাল সন্ধায় নাইম বিড়ালটার জন্য খাবার কিনে এনেছিল। এরপর ওর কামরায় রেখে চলে গিয়েছিল। পুরো সময় মাহীনের ড্রেসিং টেবিলের ওপর ঘাপটি মেরে বসে ছিলো। মাহীন খেয়াল করল, আবারও বুক কেসের মধ্যে ঢুকে বসে আছে। ভাবল, এই বিড়ালটা বুক কেসের মধ্যে কি পেয়েছে? ওখানে গিয়েই কেন বসে থাকে? এটার একটা নাম দেওয়া উচিৎ। বিড়াল বিড়াল কতক্ষণ করবো। কিন্তু কি নাম দেই? আহা হ্যারি পটারের কোনো ক্যারেক্টারের নাম!’ এদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,

‘হ্যারি পটারের কোনো ক্যারেক্টারের নাম বলতো। বিড়ালটার নাম দিব।’

নাইম বলল, ‘হ্যারি পটার থেকে দিবি? আচ্ছা তো মিনার্ভা ম্যাকগোনাগল।’

‘না একটু বেশিই বড় হয়ে যায়।’

‘লকহার্ট?’

‘নাহ এটাও কেমন জানি লাগে।’

রায়েদ বলল, ‘পিভস?’

‘খারাপ না বাট এটা উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়।’

রায়েদ আবার বলল, ‘টঙ্কস?’

‘ওহ হ্যা এটা বেশ। ছোট এন্ড বিড়ালের জন্য ঠিক আছে।’ উদ্ভাসিতমুখে বললো মাহীন।

নাইম বলল, ‘তুই নিজেও তো ভাবতে পারতি। হ্যারি পটার ভুলে গেছিস?’

‘ভুলে যাইনি। ভাবতে ইচ্ছা করছিল না তাই।’

‘ভাবতেও আলসেমি।’ বিড়বিড় করল নাইম। মাহীন উঠে দাঁড়াল। নাইম জিজ্ঞেস করল, ‘কি হলো? আবার উঠছিস কেন?’

‘একটু রান্নাঘরে যাই।’ বলে পেছনে ঘুরে রান্নাঘরে ঢুকলো। এখানে ডাইনিং বা রান্নাঘর আলাদা নয়। টেবিল থেকে উঠেই সাদা টাইলসের বার পার করে রান্নাঘরে ঢুকল মাহীন। মিসেস নাসরিন একটা ছোট বাটিতে পুডিং তুলে রেখেছেন। মাহীন ওটা হাতে নিতেই মিসেস নাসরিন বাংলায় বললেন, ‘এ্যই তুই আগে বলিস নি কেন আজকে আবার রায়েদ আসবে? তাও ভালো পুডিংটা বানিয়েছিলাম।’

‘আমি তো নিজেই জানতাম না।’

‘আর তোর বন্ধুরা কেমন হ্যা? কালকে এরা সবাই ঘুরে গেল। সে সারা ঘরে এমনকি তোর রুমেও জুতা পরে ঢুকেছে। ওফ ঝামেলা এরা যাওয়ার পর আবার সারা ঘর পরিষ্কার করতে হয়েছে।’

মাহীন দৃষ্টি ফিরিয়ে টেবিলের নিচের দিকে চাইল। তারপর বলল, ‘কোই রায়েদ তো জুতা পরে নাই।’

‘ওর কথা বলছি না। গতকাল যারা এসেছিল ওদের কথা বলছি। রায়েদ তো দেখি নিজে থেকেই জুতা খুলে ভিতরে ঢুকেছে। এবং হ্যা ও তোর বাকি বন্ধুগুলোর থেকে কিন্তু আলাদা।’

মাহীন মনে মনে ভাবল, হ্যা আমি জানতাম। আলাদা তো লাগবেই।’ মুখে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা কেমন আলাদা?’

মিসেস নাসরিন পুডিং তৈরির সরঞ্জামগুলো ধুচ্ছেন। বললেন, ‘প্রথমত জুতা খুলে ঢুকেছে। তারপর আমাকে সালামও দিয়েছে। এবং তোর অন্য ফ্রেন্ডদের থেকে অনেক বেশি আন্তরিক এবং ভদ্র। তোর বাকি ফ্রেন্ডগুলো তো বেশিই উড়োনচন্ডী এবং কেমন জানি। বড়দের সাথে কেমন আচরণ করতে হয় সেটা ঠিকঠাক কেউই শিখেনি বোধহয়।’

মাহীন চোখ সরু করে ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইল।
‘ওহ ওয়েল আমি জানি ওদের তোমার একটু অদ্ভুতই লাগবে কজ ওরা আমেরিকান। এখানকার কালচারই আলাদা। এন্ড হয়তো রায়েদ হাফ টার্কিশ এন্ড হাফ পাকিস্তানি বলেই ওকে তোমার অন্য রকম লেগেছে।’
বলল মাহীন।

মিসেস নাসরিন বললেন, ‘হ্যা সেটা তো আছেই। রায়েদই বলল, ও টার্কিশ।’

‘বাই দ্যা ওয়ে গতকাল র‌্যবিট এসেছিলো ওকে তোমার আলাদা লাগেনি?’

‘ওহ হ্যা সেটাও আরেক কথা। এই র‌্যবিট কি রকম নাম রে?’

মাহীন ইতস্তত হেসে বলল, ‘আসলে ওর নাম রাবিত সেটাকেই সকলে বানিয়েছে র‌্যবিট।’

‘ওহ আচ্ছা। আহারে কি সুন্দর নামকে কি বানিয়েছে। এবং ও তো সবার মধ্যে ছিলো। আলাদা করে কি বুঝবো?’

‘ও কিন্তু রায়েদের ছোট ভাই।’

‘ওহ তাই নাকি? ইশ গতকাল ভালো করে খেয়ালই করিনি ওকে।’ আফসোস ভরা কন্ঠে বললেন।

মাহীন ভ্রু কুঁচকে ভাবল, ওয়াট দ্যা হেল? রায়েদের ছোট ভাই র‌্যবিট এটা শুনে মায়ের এখন আফসোস হচ্ছে গতকাল ভালো করে ওর আপ্যয়ন করা হয়নি? ওয়াও রায়েদের মধ্যে এমন আলাদা কি পেল মা?’
ভেবে রায়েদের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। রায়েদ এখনো নাইমের সাথে গল্পে মশগুল। মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

ইনশাআল্লাহ চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here