#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩২
লেখনী মাহীরা ফারহীন
টেবিলের ওপর হাত দুটো ভাজ করে তার ওপর মাথা রেখে বসে আছে ও। জানালার পর্দা উড়ছে বাতাসের ঝাপটায়। নিরব কামরা। অদ্ভুত শীতল পরিবেশ। দেয়াল ঘড়িতে ঘন্টার কাটা ছয়টা ছুঁতেই মৃদু শব্দে ঘন্টা বাজতে লাগল। রায়েদ মাথা তুলে চাইল। তারপর সোজা হয়ে বসল। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। ভালো লাগছে না এমনিই বসে থাকতে। কিছু করডেও ইচ্ছে করছে না। কাজেই উঠে গেল চেয়ার ছেড়ে। সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। রাবিত সোফায় বসে মোবাইলের স্ক্রিনে ডুবে আছে। ও দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছো ভাই?’
রায়েদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জুতা পরতে পরতে বলল,’একটু বাইরে থেকে বেরিয়ে আসছি।’ বলেই দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। রাবিত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, যাক এক ঘন্টার মধ্যে না আসলেই হলো। মাও তো এর মধ্যে ফিরবে না। এখন ও সময় মতো আসলেই হলো।’
.
.
রায়েদ প্রথমে নিজের সাইকেলটা বের করল। তারপর সাইকেলে উঠে ধীরে ধীরে বাম দিকের রাস্তা ধরে চলতে লাগল। রাস্তায় সবসময়ের মতোই যানবাহনের ভিড়। হইচই হচ্ছে ফলে শব্দদূষণ হচ্ছে। এসবের কোনো কিছুই যেন রায়েদকে স্পর্শ না করেই চলে যাচ্ছে। বিষন্নতার বেড়াজালে তমশাচ্ছন্ন মন। খালি খালি লাগছে সবকিছুই। ভাবছে, আহ দুইদিন আগে আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে গেল। তারপরও ক্যারোটের দেখা মিলেছে কিন্তু মাহীন যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। স্কুলে আসে যখন তাহলে আমি খুঁজে পাই না কেন? নাকি আমাকে এড়িয়ে চলছে? কিন্তু এতে আমাকে এড়িয়ে চলার মতোই বা কী হলো? এখনোও কী সেই একই রুল ফলো করবে, যে আমাকে কখনোই কিছু জিজ্ঞেস করবে না? কী ভেবে যে এমন করে কে জানে। মেয়েটাকে না দেখলেও তো কেমন কষ্ট হয়। ওফ! গত সপ্তাহে টানা কয়েকদিন চব্বিশ ঘন্টা ওকে চোখের সামনে দেখতে দেখতে হঠাৎ করেই যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল ও। এসব কথার যে কী মানে বের করেছে জানি না। কিযে চলছে ওর মাথায় যে কিছু জিজ্ঞেসও করে না, দেখাও দেয় না। ওর কী আমাকে দেখতে ইচ্ছে হয় না?’ ভাবতে ভাবতেই সাইকেল চালিয়ে সামনে চলেছিল। এত গাড়ির ভিরের মধ্যেও হঠাৎ খেয়াল করল রাস্তার অপর পাশ হতে দ্রুত গতিতে সাইকেল চালিয়ে মাহীন আসছে। যদিও গাড়ির ভিরের মধ্যে খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না ও। রায়েদ ওকে দেখা মাত্র যেন মনের আকাশে কালো মেঘের আড়াল থেকে এক টুকরো রোদ উঁকি দিল। ততক্ষণাৎ সাইকেল ঘোরালো এবং আরেকটু সামনে এগিয়ে গেল। একটা কালো মার্সিডিজের সামনে দিয়ে রাস্তার অপর পাশে চলে আসল। এবং উচ্চস্বরে মাহীনকে ডাক দিলো। মাহীন আরেকটু সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। ওর ডাকে পেছনে ফিরে চাইল। এদিক ওদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে অবশেষে রায়েদকে দেখতে পেলো। রায়েদও সাইকেল নিয়ে এগিয়ে গেল এবং মাহীনের পাশে এসে থামল। মাহীন কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। রায়েদ বলল, ‘হ্যালো!’
মাহীন হালকা হেসে বলল,’হ্যালো।’
‘হঠাৎ এখানে তুমি?’
মাহীন এবার শান্ত কন্ঠে বলল, ‘তোমার বাসায়ই যাচ্ছিলাম।’
রায়েদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমার বাসায় হঠাৎ? আমার সাথে দেখা করতে?’
মাহীন শ্রাগ করে বলল,’ আমি আসলে মিসেস মাদির সঙ্গে দেখা করতে আসছিলাম।’
রায়েদ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,’মানে আমার মা?’
‘না তোমার দাদি।’
রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর বলল,
‘ওনার সাথে আবার কী কথা আছে তোমরা? ‘
মাহীন গাঢ় কন্ঠ বলল,’উম তোমাকে বলবো না। ওনাকেই বলবো।’
রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর বলল,’আচ্ছা চলো আমার সাথে।’
মাহীন প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’তোমার বাসায়?’
রায়েদ সামনের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,’না বাসায় না। অন্য একটা জায়গায়।’
মাহীন এবার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,’কিন্তু কোথায়?’
রায়েদ আমুদে গলায় বলল, ‘চলো তাহলেই দেখবা।’ বলেই সাইকেল চালানো শুরু করলো। মাহীনও দাঁড়িয়ে না থেকে ওর সাথে সাথে সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে গেল। ওরা এখন ডান দিকের রাস্তা ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনের রাস্তাগুলোও একই রকম। পাশাপাশি সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় দুইজনই নিশ্চুপ রইল। ওরা প্রায় পনেরো মিনিট পর প্যাসিফিক পার্কের সামনে এসে থামল। মাহীন সাইকেল থেকে নামার পূর্বেই জিজ্ঞেস করল,’আমরা পার্কে এসেছি?’
রায়েদ সাইকেল থেকে নেমে বলল,’এসেছি তো প্যাসিফিক পার্কে। কিন্তু আমরা ঠিক পার্কে যাবো না।’ মাহীন আর কিছু বললো না। ওরা দুজনই পার্কের সামনের পার্কিং এ সাইকেল রেখে আসল। স্যান্টা মনিকার সবচাইতে বড় আর্কষণ গুলোর মধ্যে একটি হলো প্যাসিফিক পার্ক। নানা দেশ থেকে নানান বর্ণের, ভিন্ন ভিন্ন কালচারের মানুষ এখানে প্রতিনিয়ত ঘুরতে আসে। ফলে প্রচন্ড ভির থাকে। তাও আবার বিকেলের সময়টাই হচ্ছে ভির হওয়ার আদর্শ সময়। চারিদিক মানুষে গিজগিজ করছে। পার্কের সামনে ওরা দাড়িয়ে আছে। দূর থেকেও সেই ল্যান্ড মার্ক ফেরিস হুইলটা দেখা যায়। রোলার কোস্টার এবং অন্যান্য রোমাঞ্চকর জিনিস তো আছেই। পার্কের পাশেই রয়েছে প্যাসিফিক পার্ক ব্রিজ। এই ব্রিজ সোজা প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে এগিয়ে গিয়েছে। যদিও ব্রিজটা খুব বেশি একটা লম্বা নয়। রায়েদ সেই দিকেই এগিয়ে গেল। যদিও সূর্য ডুবতে কিছু সময় হাতে রয়েছে তবুও আকাশে ইতোমধ্যে কমলা, গোলাপি এবং বেগুনি রঙের মিলন ঘটেছে। সন্ধ্যায় পার্কের পরিবেশ আরোও জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে উঠে। ব্রিজের কাছে পৌঁছে একবার থামল। পুরোটা সময় মাহীন রায়েদের দিকে আগ্রহভরা দৃষ্টিতেই তাকিয়ে রয়েছে। মাঝে মাঝে দৃষ্টি সরিয়ে চারিদিকের পরিবেশও উপভোগ করছে। কাঠের তক্তা বসানো চওড়া ব্রিজ। দুপাশের কালো কাঠের রেলিং দেওয়া যদিও তা খুব বেশি উঁচু নয়। ব্রিজ থেকে প্রায় চৌদ্দ পনেরো ফুট নিচে সাগরের ঢেউ আছরে পরার শব্দ শোনা যায়। গাঢ় নীল প্রশান্ত মহাসাগর কখনোই প্রশান্ত থাকে না। বেশির ভাগ সময়েই সাগর উত্তাল থাকে শুধু ভাটার সময় ছাড়া। সাগরের গাঢ় নীল রঙ এখন আকাশ ও সূর্যের আলোয় কমলাটে দেখাচ্ছে। ওরা দুজন ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে। মাহীন নিজের পকেট থেকে সেই কালো চিরকুটটা বের করল। আজ ও এটা সাথে করিয়েই এনেছিল। যদিও তা রায়েদকে দেবে এমনটা ওর পরিকল্পনায় ছিলো না।
রায়েদের দিকে বারিয়ে ধরল সেটা। রায়েদ চিরকুটটা দেখে একটুও অবাক হলো না। যেন ও প্রস্তুতই ছিলো এমন কিছুর জন্য। ধীরে ধীরে হাত বারিয়ে ওটা হাতে নিলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ ভাবে চিরকুটটার দিকে চেয়ে থাকার পর বলল,’এটা আমারই লেখা।’
মাহীন বলল,’আমি জানি। সেদিন পিকনিকে প্রায় বলেই দিয়েছিলাম তোমাকে এটার কথা। কী জন্য জানি আর পুরোটা বলা হয়নি।’
রায়েদ নির্বিকার চিত্তে বলল, ‘তোমার ছিপে টান পরেছিল বলে।’
‘ওহ হ্যা।’
রায়েদ ঘনঘন শ্বাস ফেলছে। মাহীনের দিকে তাকাচ্ছেও না। গভীর সাগরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মাহীন বলল,’তুমি চাইলে এর ব্যাখ্যা দিতেও পারো নাও দিতে পারো। আমি কিছু বলবো না।’ বলে অন্যদিকে চাইল। রায়েদ এবার ওর দিকে দৃষ্টি ফেরাল। বলল,
‘আচ্ছা একটা কথা বলোতো। এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও তুমি আমাকে কখনো কোনো কিছু নিয়ে প্রশ্ন করোনি কেন?’
মাহীন বিচলিত ভাবে বলল,’আমার কাউকে কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে ভালো লাগে না। আর তুমি তো সেখানে এই কারণেই সকলকে এড়িয়ে চলতে, তাই না?’ বলে থামল এবং দূরে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে লম্বা এক শ্বাস ফেলে বলল,’আর কারোও যদি বলার মতো এমন কোনো ঘটনা থাকেও। তাহলে আমি আশা করি যে সে যখন আমাকে নিজে থেকেই বিশ্বাস করে বলতে পারবে তখনই বলবে।’
রায়েদ আবার হাঁটতে শুরু করল এবং বলল,’চলো তোমাকে আমি কিছু বলি।’
মাহীনও ঘুরে ওর সাথে হাঁটতে শুরু করলো। ওরা ব্রিজের শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলেছে। ব্রিজের ওপর অল্প কয়েকজন মানুষ আছে। রায়েদ প্রলম্বিত শ্বাস ফেললো। তারপর শান্ত কন্ঠে বলতে শুরু করল,
‘চার বছর আগের ঘটনা। ঘটনাটা এমন ভাবে শুরু হয়েছিল যেমনটা বেশির ভাগ পরিবারের রোজকার ঘটনা। বলেছিলাম না আমরা আগে বাবার সাথে প্রায়ই মাছ ধরতে যেতাম। পিকনিকেও যেতাম। কিন্তু সেই সময় বাবা কাজের চাপে খুব একটা সময় দিতে পারছিলেন না। বাবার শরীরটাও একটু খারাপ ছিলো। তো বেশ কয়েকমাস ধরে আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার জন্মদিনের দিনটার জন্য। বাবাও আমাকে বলেছিলেন এট লিস্ট ওই দিনটায় উনি আমাকে এবং রাবিতকে নিয়ে বাইরে যাবেন। যদিও জন্মদিন আমাদের বাসায় কখনোই পালন হতো না। আমিও জন্মদিন প্রিয় মানুষ ছিলাম না। যাই হোক, এখন সেইদিনটা আসলোও। কিন্তু বাবা আবার সেইদিন একটু অসুস্থ ছিলেন। তাই দেখে আমি আর কিছু বলিনি। তবে একটু মনতো খারাপ ছিলোই। তাই বাবা আবার আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। এদিকে মা রাগারাগি করছিলেন অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও বাইরে যাওয়ার জন্য। এবং আমাকেও বকা দিচ্ছিলেন। যদিও আমি বাবাকে বলছিলাম না থাক দরকার নেই যাওয়ার। তবুও উনি আমাকে নিয়ে বের হয়েছিলেন। মা রাবিতকে আসতে দেননি সাথে। এবং জানো কী হয়েছে?’ বলে থামল। মাহীনের হৃদয়ে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। ও কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে ও কী শুনবে এর পর। অস্থিরতা এবং অজানা এক ক্লেশপূর্ণ অনুভূতি চোখের কোণে পানির সঞ্চার করছে। ঘনঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রায়েদের দিকে।
রায়েদ বলল,’আমাদের গাড়ির এক্সিডেন্ট হয়েছিল। এবং অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো? আমি বেঁচে গিয়েছিলাম কিন্তু আমার বাবা বাঁচতে পারেননি।’
এবার মাহীনের চোখের পানি টলমল করতে করতে গাল বেয়ে গড়িয়ে পরল। ও অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। রায়েদ ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর বলল,’কি হচ্ছে এসব? আমি আমার দুঃখের কাহিনী শোনাচ্ছি আর কানছো কিনা তুমি?’
মাহীন কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,’আমার চোখে পানি আসলে আমি কী করবো? আমি সহজে ইমোশনাল হয়ে যাই।’
রায়েদ বলল, ‘ওহ তাহলে তো আর বলা যাবে না। তোমার এই ঘটনা তো আমি জানতাম না।’
মাহীন হালকা হাসল। তারপর নিজের নাক টেনে বলল,
‘আচ্ছা এটা তো বলো এসবের মাঝে তোমার কী দোষ ছিলো যে মিসেস রহমান তোমার সাথে এমন আচরণ করেন?’
রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আমার মা এই ঘটনার পর মেন্টালি উইক হয়ে পরেন। একটা ট্রোওমার মধ্যে চলে যান। এবং এরপর হাসপাতাল থেকে যখন বাসায় ফিরি তখন থেকেই উনি আমাকে দেখতে পারেন না। ওনার কথা হচ্ছে, আমার বাবা আমার জন্যেই মারা গিয়েছেন।’ বলে থামল। এখন রায়েদের চোখের কোণে ক্ষীণ পানির কণা জমেছে। অনেক বছর পর একেএকে প্রতিটা স্মৃতি স্বরণ করে সেই সময়ের মতোই মনটা ক্লেশপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবুও বলে গেল,’এমনকি উনি তো এটাও বলেছিলেন যে, আমার বাবার জায়গায় আমি কেন মরে গেলাম না..মাহীন বলল,
‘থাক বুঝেছি। আর বলা লাগবে না।’ মাহীন রায়েদের দিকে তাকাল। রায়েদ অন্যদিকে চেয়ে আছে। মাহীন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখনই রায়েদ আবার বলল,’কিন্তু এটাই কী অনেকাংশে সত্যি না? আসলেই তো আমিও যদি সেইদিন মরে যেতাম তাহলে আমাকে আর এসব সহ্যই করতে হতো না। অথবা আমার বাবার বদলে আমি মারা গেলে এট লিস্ট বাবা তো বেঁচে থাকতেন।’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের চোখের পানি মুছল। তারপর আলতো করে রায়েদের চোয়াল ধরে এদিকে মুখ ঘোরাল। বলল,’আমাকে সবাই পাগল বলে, এদিকে তুমিও যে পাগল হয়ে বসে আছো সেই খবর আছে? এখানে কিভাবে তোমার দোষ ছিলো আমাকে বুঝাও? তোমার বাবার মৃত্যুতে তোমার দোষ ছিলো না এবং এতে কারোরই কোনো হাত ছিলো না। আল্লাহ যখন যাকে নিয়ে যেতে চায় তাকে নিয়ে যায়। এতে কী কারোর কিছু করার থাকে? তোমার বাবার আয়ু এই পৃথিবীতে অতটুকুই ছিলো। এটা তো তোমার দোষ না।’ বলে থামল। তারপর আবার বলল,’আর মিসেস রহমান এমনটা কেন বলেন জানো? কারণ আমাকে ভুল বুঝো না কিন্তু উনি আসলে এখনো মানসিক ভাবে স্টেবল নেই। সেই ট্রোওমার পর তার মাইন্ড এক জায়গায় আটকে গিয়েছে। এখন কী হয়েছে সেটা তো আমার পক্ষে বলা সম্ভব না। কিন্তু তার জন্য তুমি নিজেকে দোষারোপ করছো কেন?’
রায়েদ চোখ বুঝল। কিছুক্ষণ পর চোখ মেলে তাকিয়ে বলল,’এটা আমার মাথায়ও এসেছে। কিন্তু যখন এসব ঘটেছে না তখন আমাদের বয়স অনেক কম ছিলো। ওনাকে চাইলেও কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে পারতাম না। কিন্তু যেটা যেভাবে হয়ে গিয়েছে সেটাকে তো সেভাবেই মেনে নিতে হবে।’
মাহীন রায়েদের হাত থেকে সেই চিরকুটটা নিয়ে ভাজ করল। বলল,’এটা আমার কাছেই থাকুক। এটার এখনো কাজ বাকি আছে। যাই হোক এখন আমার কথা শোনো এই ব্যাপার গুলোয় হয়তো আমার করার মতো কিছুই নেই। কারণ সবকিছুতে তো আর চাইলেও সাহায্য করা যায় না। তবে আমি কিন্তু তোমার পাশেই আছি সে যাই হয়ে যাক না কেন।’
রায়েদ হালকা হাসল। বলল,’জানি।’ তারপর বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইল দুইজনই। অবশেষে রায়েদ বলল,
‘এখন বিশ্বাস হয়েছে যে আমি তোমাকে আসলেই বিশ্বাস করি?’
মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল,’আমি কখন বলেছি যে তোমাকে বিশ্বাস করি না। ওই দিন না নৌকায় বললাম।’
রায়েদ বলল,’আমি আমার তোমাকে বিশ্বাস করার কথা বলছি।’
মাহীন অবাক দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে বলল, ‘মানে তুমি বলতে চাচ্ছো যে এতক্ষণ তুমি আমাকে বিশ্বাস করো এটাই বোঝাতে চাচ্ছিলা?’
রায়েদ শ্রাগ করে বলল,’আর নয় তো কী?’ তারপর একটু থেমে বলল,’যাই হোক দেখো তো ব্যাপারটা কেমন হয়ে গেলো আমি তোমাকে কাঁদিয়ে দিলাম।’
মাহীন বলল,’ইশ এটা কোনো কথা হলো? সপ্তাহে তিন চারবার তো কাঁদা আমার জন্য কমন ব্যাপার।’
রায়েদ ভ্রু কুঁচকে বলল,’কী? তোমার জীবনে আবার কী এমন হয় যে সপ্তাহে তিন চারবার তোমাকে কাঁদতে হয়?’
মাহীন অন্য দিকে চেয়ে বলল,’না থাক। ওটা বলাটা অনেক ইমব্যারেসিং।’
‘কী এমন ইমব্যারেসিং ঘটনা ঘটে? বলো তো?’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হাসবে না তো?’
‘নাহ একদম হাসবো না।’
‘ আমার বই পড়ে এবং মুভি দেখে চোখে পানি আসে।’
রায়েদ হাসল। কিন্তু মাহীন ওর দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে চাইতেই হাসি থামিয়ে বলল,’মুভি দেখে আর বই পড়ে? সুপার ইমোশনাল তো তুমি।’
মাহীন বিব্রতভঙ্গীতে বলল,’তা বটে।’
দূর দিগন্তে সমুদ্র ও আকাশের মিলন স্থলে সূর্য অর্ধেক ডুবে গিয়েছে। বাকি অর্ধেকটা লাল টকটকে থালার মতো উঠে আছে। লাল টকটকে সূর্যের আলোয় সাগরে কাঁপা কাঁপা লালচে আলো পরেছে। আকাশের ক্যানভাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে বড় বড় ভেলার মতো মেঘগুলোও সোনালী কমলা রঙ ধারণ করেছে।
দূরে সূর্যের ওপর দিয়ে একঝাঁক সিগাল উড়ে যাচ্ছে।
ইনশাআল্লাহ চলবে।