এল_এ_ডেইস পর্ব ২১

0
276

#এল_এ_ডেইস
পর্ব ২১
লেখনী মাহীরা ফারহীন

“cause I knew you were trouble when you walked in.
so shame on me now
Flew me to places i’d never been….
স্পিকারে টেইলর সুইফটের গান চলছে। রৌদ্রজ্জ্বল গ্রীষ্মের সকাল। ফুরফুরে দক্ষিণা বাতাসের ঝাপটায় পর্দা উড়ছে। অলস ভঙ্গিতে বিষন্ন মনে সিঙ্গেল সোফায় বসে আছে একটা মেয়ে। টি-টেবিলের ওপর একটা কমলা ব্রিটিশ সর্টহেয়ার বিড়াল তার মনিবের মতোই অলস ভঙ্গিতে বসে আছে। এমন সময় নাইম ড্রইংরুমে প্রবেশ করল। এবং ধমকের গলায় বলল,

“মাহীন! চর দিবো কিন্তু তোকে এখন। তোর কি মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে? আজকে তোর পিকনিকে যাওয়ার কথা আর তুই কিনা এখনো গ্যাট হয়ে বসে আছিস!” মাহীন ভ্রুক্ষেপহীন বসে রইল। নাইম পুনরাবৃত্তি করল, “মাহীন!”

এবার মাহীন বিরক্ত স্বরে বলল,”আমি পিকনিকে যাবো না। আমার শরীর খারাপ। আমাকে ডিসটার্ব করিস না তো।”

“ওহ তাই? তোর শরীর খারাপ? তো শরীর খারাপ হলে মানুষ টানা চার পাঁচ ঘন্টা টিভির সামনে বসে থাকে? আর তুই কি কোনো সার্কাসের বাঁদর সেজেছিস? এই ঘরে গরমের মধ্যে কাঠবিড়ালির স্যুট পরে বসে আছিস কেন?”

মাহীন পানসে কন্ঠে বলল, “হ্যা আমার শরীর খারাপ। আর আমার ঠান্ডা লাগছে তাই এটা পরে আছি।”

“ও রিয়েলি? পরশুদিন তোর পায়ে ব্যাথা ছিলো বুঝলাম। কিন্তু গতকাল পুরো তরতাজা হয়ে সারাদিন লাফালাফি করে বেড়াইলি। আজ আবার অসুস্থ কিভাবে হয়ে যাইস তুই? আর সকাল থেকে ফ্রেন্ডসের একটা সিজন শেষ করে ফেললি অথচ একবার হাসতে দেখলাম না। তোর তো মাথার বেড়াম হয়েছে।”

মাহীন সোফার একটা কুশন তুলে নিয়ে নাইমের দিকে ছুরে মেরে ঝাঁঝাল কন্ঠে বলল,
“তুই যা না এখান থেকে! আমাকে আর একবার জ্বালালে তোর খবর হবে কিন্তু!”

তখনই মিসেস নাসরিন বাগান হতে বড় স্লাইডিং ডোর দিয়ে ড্রইংরুমে প্রবেশ করলেন। তাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। রোদের মধ্যে সেই কখন থেকে বাগানে একনাগাড়ে কাজ করছিলেন। নাইম মাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে বলল,

“মা এখন তুমিই দেখো। এই মেয়েকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে পারছি না। পিকনিকের জন্য রেজিস্ট্রেশন করল। গত দুই সপ্তাহ লাফালাফি করল। পা মচকানোর পরও যাওয়ার জেদ ছাড়ল না। হাজারটা জল্পনা কল্পনা করে পুরো ঘর মাতিয়ে রাখল। আর এখন বলে কিনা পিকনিকে যাবেই না।”

মিসেস নাসরিন এগিয়ে এলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় এসে বসলেন। নাইম দেওয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে মুখ গোঁজ করে দাঁড়াল। মিসেস নাসরিন বললেন,

“মা তোর হয়েছেটা কী? বিষন্ন মনে বসে থাকলেই তো আর মানুষ অসুস্থ হয়ে যায় না। দুইদিন আগেই তো তোর ফ্রেন্ডরা সব তোর সাথে দেখা করে গেল। পরশু রায়েদ তোর সাথে দেখা করে গেল। তোর মন মেজাজ কত ভালো ছিলো। গতকাল সারাদিন গোছগাছ করলি, কত কি প্ল্যান করলি। আর আজকে হঠাৎ করে সব কিছু বাতিল? কেন?”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “মা আমি জানি। কিন্তু আমার শরীর ভালো লাগছে না। এবং এখন আমার এত লম্বা জার্নি করে যেতে ইচ্ছেই করছে না। তাহলে আমার কি করার আছে।?”

“আচ্ছা কেউ কি তোকে কিছু বলেছে? কারোও সাথে কোনো ঝামেলা লেগেছে?”

“না। কেউ কিছু বললেও আমার কিছু যায় আসে না তাছাড়া কেউ কিই বা ঝামেলা করবে? আমি শুধু নিজে থেকেই যেতে চাই না।”

মিসেস নাসরিন উঠে দাঁড়ালেন। নাইমের দিকে তাকিয়ে বললেন, “থাক ওকে ছেড়ে দে। ও যদি যেতে না চায় তাহলে আর কি করা।”

বলে উনি উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। নাইম মুখ বাঁকা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। মনে হলো মাহীনের পিকনিক যাওয়া না যাওয়া নিয়ে ওর থেকে বেশি নাইমের মাথা ব্যথা। টঙ্কস টি টেবিল থেকে নেমে এসে সোফার ওপর উঠল। মাহীনের পাশে এসে বসে বলল, “মিউ”

মাহীন একবার বিষন্ন দৃষ্টিতে ওর দিকে চাইলো তারপর বলল, “কি ব্যাপার একদিন আগেও তো আমার দিকে তাকায় দেখতি না। এখন ঠিক আমার সাথে ঘেঁষে বসে আছিস।”

“মিউ।”

“হ্যা হ্যা জানি তুই এই বাসায় আমাকে ছাড়া আর কাউকে চিনিস না।”
.
.
.
“এই জেনেট কিছু তো বলো?” বলল সাইলোহ।

জেনেট বলল, “কি বলবো? তুমি যেমন ফোন দিয়ে পাচ্ছো, ওর ফোন বন্ধ। তাহলে আমি ফোন দিলেও তো বন্ধই আসবে নাকি?”

কনক্রিটের রেলিঙের ওপর জেনেটের পাশেই লিও বসেছিলো। ও বলল, “আমি বুঝলাম না হঠাৎ করে ওর কি হলো। এমন তো না যে ও পিকনিকে যাওয়ার পরিকল্পনাই বাতিল করে দিয়েছে?”

দুইতলার খোলা করিডর দিয়ে অল্প কিছু ছেলেমেয়ে মাঝেসাঝে যাওয়া আসা করছে। বেশির ভাগ স্থান খালি। সাইলোহ চিন্তিত গলায় বলল,।

“কিন্তু ব্যাপারটা তো অদ্ভুত! হঠাৎ রাতারাতি ও পরিকল্পনা পাল্টে ফেললো? আর একবার আমাদের জানাতেও পারতো। কিন্তু তা নয় ফোন বন্ধ করে বসে আছে।”

নায়েল করিডর ধরে হেঁটে আসছে। এসে রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়াল এবং বলল, “কি খবর মাহীনের? এখনো কোনো খোঁজ খবর পাওনি?”

জেনেট বলল,”না পাইনি। সেটাই তো সমস্যা।”

নায়েল নিজের সেলফোন বের করে বলল, “থামো ওকে ফোন দিচ্ছি।”

সাইলোহ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “লাভ নেই। ওর ফোন বন্ধ।”

নায়েল বলল, “তো কি হয়েছে। প্ল্যান ‘চেরনোবিল’ রেডি আছে।’

সাইলোহ বলল, “হুহ? রাশিয়ার সিক্রেট এজেন্টের মতো কথা বলা বাদ দাও।”

“এটা মানি হাইস্ট রেফারেন্স। তুমি বুঝবা না। কিন্তু এই প্ল্যান চেরনোবিলটা আবার কি?” বলল জেনেট।

“আমার কাছে ওর ল্যান্ডলাইনের নাম্বার আছে।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো নায়েল।

বাকি তিনজন অবাক হয়ে চাইল। লিও ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুমি ওর ল্যান্ডলাইনের নাম্বার কোথ থেকে যোগার করলা?”

নায়েল একটা নাম্বার ডায়েল করে বলল, “গত সপ্তাহে দিয়েছিলো।”

রিং হতে হতে কিছুক্ষণ পর কলটা রিসিভ হলো। নায়েল স্পিকারে দিয়ে রাখল। ওপাশ থেকে শোনা গেল একটা
ছেলের কন্ঠ, “হ্যালো কে বলছেন?”

নায়েল বলল, “আমি নায়েল, মাহী…পাশ থেকে সাইলোহ উচ্চস্বরে বলল, “হেই ন্যইম, মাহীন কোথায় তাড়াতাড়ি বলো!”

ওপাশে কিছুক্ষণ নিরবতা তারপর শোনা গেল বাংলা ভাষায় কথা বলছে দুজন। তারপর নাইম উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “হ্যা মাহীন বাসাই আছে। এবং ও অসুস্থ হওয়ার নাটক…” কথা থেমে যায় এবং খটখট শব্দ হয়। এরপর মাহীনের কন্ঠ ভেসে আসে,

” হ্যালো। সরি গাইস আমি অসুস্থ তাই তোমাদের জয়েন করতে পারবো না।”

সাইলোহ উত্তেজিত কন্ঠে বলল, “হোয়াট দ্যা হেল ইজ গোইং অন মাহীন! তুমি না বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলা? আর গতকালও তো যাওয়ার কথায়ই অটল ছিলা। আর আজ এত অসুস্থ হয়ে গেলা যে পিকনিক বাতিলই করে দিলা?”

সাইলোহ থামতেই জেনেট জিজ্ঞেস করল, “কোনো ভাবে এটা ওর জন্য না তো?”

মাহীন ক্লান্ত স্বরে বলল, “অবশ্যই না জেন। ওর জন্য কেন হতে যাবে? আমি আসলেই অসুস্থ বলে আসতে পারবো না।”

লিও বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। গত কয়েকদিনে ওর ওপর দিয়ে যা গিয়েছে এমন হতেই পারে যে আসলেই ও অসুস্থ। তুমি প্যারা নিও না। রেস্ট করো।”

মাহীন মলিন স্বরে বলল, “থ্যাঙ্কস লিও।”

নায়েল বলল, “আচ্ছা এক মিনিট! তোমার ফোন বন্ধ করে রাখার কারণ কি?”

মাহীন জ্বিব কামড়াল। আমতা আমতা করে বলল, “আসলে গতকাল রাতে একদম চার্জ তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিলো তাই চার্জে লাগিয়েছিলাম। কিন্তু সকালে উঠে দেখি আসলে সুইচটাই অন করিনাই। বন্ধ ছিলো। তারপর চার্জে লাগিয়ে দিয়ে আর মোবাইল অন করা হয়নি এখনো।”

নায়েল সন্দেহের স্বরে বলল, “তোমার কি মনে হয় আমাদের এই কাহিনি বিশ্বাস করা উচিৎ?”

মাহীন ভাবলেশহীন ভাবে বলল, “দেখো বিশ্বাস না করলেও বা কি হবে? আমি তো আর পিকনিকে আসছি না।”

সাইলোহ বলল, “ওকেই অলরাইট। তুমি রেস্ট নাও। আমরা রাখছি।”

বলে লাইন কেটে দিলো। মাহীন ল্যান্ড ফোনটা নামিয়ে রেখে ভাবল, আমি যখন একবার স্থির করেছি পিকনিকে যাবো না। তখন যাবো না সে যেই বাহানাই হোক না কেন। আর যার জন্যেই হোক না কেন। টঙ্কস গুটি গুটি পায়ে হেঁটে এসে মাহীনের পায়ের মধ্যে মাথা ঘষে বলল,”মিউ!”

মাহীন ওর দিকে চেয়ে বলল, “কি?কোথায় মিথ্যা বললাম? তুই বেশি বুঝিস।”

“মিউ”

“তাই বুঝি? এই বল না তোর আগের মালিকের ডিভোর্সটা কিভাবে হয়েছিলো?”

“মিউ”

“আরেহ ধ্যাৎ তোকে কে বলসে এত গোপনীয়তা বজায় রাখতে?”

“মিউ মিউ”

“এই নাহ মোটেও না। তুই তো দেখি শয়তান মিনসে। আমার বিড়াল হয়ে আমার গোপন কথা সবাইকে বলে দিতে চাস!”

নাইম আবার নিচে নেমে এসেছে। কিছুক্ষণ পূর্বে ওর হাত থেকে টেলিফোন কেঁড়ে নেওয়ার পর উপরে চলে গিয়েছিল। মাহীনকে টিভির সামনে কর্ণার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

“ওরে ওরে এখন তো দেখি তোর জ্বর এত বেড়ে গিয়েছে যে টিভির সাথে চোখ লাগিয়ে টিভি দেখছিস। র‌্যাচেল তো তোর চোখের মধ্যে ঢুকে যাবে।”

মাহীন পুনরায় নিজের সোফায় এসে ধপ করে বসে পরল। তারপর মুখ গোমড়া করে বলল, “মুখ বন্ধ কর। আমার ভাল্লাগছে না।”

“তোর কখনিই বা ভাল্লাগে? তো কি অজুহাত দিলি তোর বন্ধুদের?”

“আমি কোনো অজুহাত দেইনি। আমি অসুস্থ ওইটাই বলেছি।”

তখনই টঙ্কস লাফ দিয়ে সোফা থেকে নামল এবং চোখের পলকে নাইমের পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। নাইম ভয়ে লাফ দিয়ে পিছে সরে গেল। তারপর ঝাঁঝাল কন্ঠে বললো,

“এ্যই এ্যই দূরে যা দূরে যা। আমার কাছে আসবি না খবরদার বলছি।” তারপর মাহীনের দিকে ফিরে বলল, “এ্যই মাহীন তোর বদ বিলাই কে বেঁধে রাখ। আমার পায় পায় কেন জড়ায়?”

টঙ্কস গিয়ে আরোও নাইমের পা ঘেঁষে দাঁড়াল। নাইম এবার লাফ দিয়ে দূরে সরে গিয়ে ধুপধাপ পদক্ষেপে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। টঙ্কস এবার সোফার ওপর উঠে মাহীনের কোলে এসে বসল। তারপর বলল, “মিয়াউ”

মাহীন জবাবে বলল, “সাব্বাশ ব্রো! তোকে আমি এর পুরষ্কার স্বরুপ টুনা খাওয়াবো।”

“মিউউ।” বলে টঙ্কস মাহীনের হাতে মাথা ঘষে দিলো। মাহীন ভাবতে লাগল, আচ্ছা সবাই যাচ্ছে কিন্তু আমি যদি এখন সত্যি সত্যি না যাই তাহলে আবার আফসোস হবে। এখনো সময় আছে হাতে রেডি হবো নাকি? এমনিতেও ও গেলো কি গেলো না তাতে আমার কি? শুধু আমি এর পর জীবনেও ওর সাথে কথা বলবো না। মিথ্যাবাদী!’
তার কিছুক্ষণ পর ওদের কলিংবেলটা বেজে উঠলো। টঙ্কস সাথে সাথে মাহীনের কোল থেকে লাফ দিয়ে নিচে নামল। এবং দরজার দিকে ছুটে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার ছুটতে ছুটতে ফিরে এসে মাহীনের পায়জামা খামচাতে লাগল। মাহীন জিজ্ঞেস করল,

“কি হয়েছে রে? কে এসেছে?”

তখনই ভেতরে থেকে মিসেস নাসরিনের কন্ঠস্বর শোনা গেল, “এ্যই মাহীন দেখ তো দরজায় কে এসেছে।”

মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। আবারও কলিং বেল বেজে উঠল। টঙ্কস আগে আগে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল। মাহীন ভাবলেশহীন ভাবে দরজাটা খুলে দিলো। এবং দরজা খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ! দরজার বাইরে রায়েদ মাদিহ দাঁড়িয়ে আছে। যাকে হয়তো এই সময় ঘরের সামনে কস্মিনকালেও ও কল্পনা করতে পারে না। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মাহীন। অবশেষে রায়েদ ওর মুখের সামনে তুড়ি বাজাতে চমকে উঠল। মাহীন খাপছাড়া ভাবে বলল, ” তুমি এইসময়? এইখানে? আমার বাসায়? আর তুমি এখানে কেনোই বা আসছো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

রায়েদ আমুদে গলায় বলল, “না বোঝার তো কিছু নেই। সোজা কথা আমি তোমাকে নিতে এসেছি। নাহলে তো তুমি ঘর থেকে বের হওয়ারই নাম নিচ্ছো না।”

মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমাকে নিতে এসেছো মানে? কোথায় নিতে এসেছো? আমাদের আবার কোথায় যাওয়ার কথা?’

“ওমা তুমি এমন ড্রামা করো না মাঝে মাঝে মনে হয় যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারো না। আমরা পিকনিকে যাবো ভুলে গেছ?”

মাহীন পুনরায় বিস্মিত হতে বাধ্য হলো। “কিহ? মানে তুমি পিকনিকে যাচ্ছো?” কথাটা কিছুটা বিস্ময় ও উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল।

“অবশ্যই। আমি না পরশু দিন বলে গেলাম। তোমার তো পা মচকে গিয়েছিল, রেট্রোগ্রেড এমনেশিয়া হয়ে গিয়েছে এটা তো বলো নি।”

মাহীন বিব্রত বোধ করল। ইতস্তত করে বলল, “কি যা তা বলছো। আমি ভুলে যাবো কেন?”

রায়েদ বলল, “যা দেখছি তার পরিপ্রেক্ষিতে বললাম। এই একটা ইনভিটেশন আর ফেললাম না। ধরে নাও এখন পর্যন্ত তুমি যা যা করেছো তার একটা থ্যাঙ্কস গিভিং এটা।”

মাহীনের ঠোঁটের কোণে হাসি আরেকটু হলে এসেই পরছিলো আনন্দে কিন্তু খুব কষ্টে শেষ মুহুর্তে নিজেকে সংযত করে স্বাভাবিক ভাবে বলল,

কিন্তু গতকাল সন্ধা পর্যন্তও তো তুমি রেজিস্ট্রার করোনি। ” বলেই জ্বী কামড়াল। এই কথাটা ওর বলার কথা ছিলো না।

রায়েদ বলল, “হুম তোমার কাছে এসব খবর যায় কিভাবে বলোতো? আমি সন্ধার পরে রেজিস্ট্রার করেছি।”

“ওহ ভালোই তো। কিন্তু তুমি আমাকে নিতে আসলা এই ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে পারলাম না।”

“আমি না এসে তো উপায় ছিলো না। শুনলাম তুমি নাকি হলিউডে অডিশন দেওয়ার জন্য এক্টিং প্র্যাকটিস করছো। এমন কেন করলে বলোতো?”

তখনই ভেতর থেকে মিসেস নাসরিনের কন্ঠস্বর ভেসে আসল, “মাহীন কে এসেছে?”

“রায়েদ এসেছে। আমি কথা বলছি। ”

বাংলায় বলল যেন রায়েদ না বুঝতে পারে। তারপর খেয়াল হতেই দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ” ইয়ে মানে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছ। ভেতরে আসো। ”

রায়েদ ভেতরে প্রবেশ করে ভাবলেশহীন মুখে বললো,
” থ্যাঙ্ক ইউ বললাম না কারণ তুমি ভুলেই গিয়েছিলা। আর বুঝতেই পারছি তুমি কিভাবে মেহমানদারি করো।”

বলে সোফায় গিয়ে বসল। মাহীনও সোফার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবছে, কিরে বাবা রায়েদ কবে থেকে এতো সার্কাস্টিক কথাবার্তা বলে? আমার তো মাথার বেরাম হয়ে যাবে দেখছি। টঙ্কস মাহীনের পা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। রায়েদ বলল, “হ্যা তো এখন বলো?”

“কি বলবো?”

“যে এই একদিনের মধ্যে কি এমন ঘটে গিয়েছে যে তোমার পিকনিকে না যাওয়ার জন্য অসুস্থ হওয়ার নাটক করতে হলো।”

মাহীন বলল, “দেখো প্রথমত আমি কোনো নাটক করছি না। আমি আসলেই অসুস্থ বোধ করছিলাম বলে যেতে চাচ্ছিলাম না।”

“তো এখন যেতে চাচ্ছো?”

মাহীন ইতস্তত করে বলল, “ইয়ে না মানে। আমি… ”

ওর কথার মাঝখান দিয়ে রায়েদ বলল, “হ্যা এখন যখন তুমি জেনে গেছো যে আমি যাচ্ছি তখন তো তুমি চোখের পলকে সুস্থ হয়ে যাবাই। এবং যেতেও রাজি হয়ে যাবা যদিও ব্যাপারটা একসেপ্ট করতে একটু কষ্ট হচ্ছে তোমার।” বলে দুষ্টু হাসি ফুটে উঠলো ওর ঠোঁটে।

মাহীন দৃঢ় স্বরে বলল, ” মোটেও না। তোমার যাওয়ার সাথে আমার কি সম্পর্ক?” বলেই মনে মনে ভাবল, ওফ খোদা! কোথায় ফেসে গেলাম। রায়েদ যাচ্ছে আর আমি পিকনিকে যাবো না তা কি করে হয়! ধুর বাল! আমি এখন কিভাবে হঠাৎ করে বলি যে আমি সুস্থ হয়ে গিয়েছি এবং পিকনিকে যাবো। ওফ আমার কাঁদতে ইচ্ছা করছে। ” মাহীন মুখটা কাঁদো কাঁদো করে দাঁড়িয়ে ছিলো দেখে রায়েদ মুচকি হেসে বলল,

” আরেহ তোমার এত প্যারা নেওয়ার কি দরকার? আমি তো জানি আসল ঘটনা। এমন সব কান্ড করো যে শেষে কাঁদতে ইচ্ছে করে তাই না? এই যেমন এখন একটু হলেই কেঁদেই ফেলবা। ” তারপর থেমে আবার বলল, ” আচ্ছা যাও রেডি হয়ে আসো। পিকনিক বাস ছাড়তে কিন্তু আর বেশি দেড়ি নেই। পরে দেখবা আমার পিকনিকে যাওয়া নিয়ে এত কাঠখড় পুরোনোর পরও অবশেষে আগুন নিভে গেল। আর তুমি এই গরমে কাঠবিড়ালির স্যুট কেন পরে আছো?”

মাহীনের এতক্ষণে এটা মনে করে মুখটা লজ্জায় রক্তবর্ণ হয়ে উঠল। ও শ্যামলা দেখতে বলে বোঝা যায় না কিন্তু এই মুহূর্তে হয়তো ও একটু বেশিই টমেটোর মতো হয়ে গিয়েছে যে ওর গালের লালচে ভাবটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। আমতা আমতা করে বললো,

” উম আসলে গত হ্যালোইনে টেইলর সুইফট একটা কাঠবিড়ালির স্যুট পরেছিলো। তাই…”

রায়েদ মাঝখান দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তো সুইফটি, আজ কি হ্যালোইন?’

” না আমার আরকি ঠান্ডা লাগছিলো সকালে তাই হাতের কাছে এটা পেয়ে এটাই পরে নিয়েছি। আর এটা নিয়ে এমন করার কি আছে?”

” হুম না কিছু নেই। কিন্তু কাঠবিড়ালির স্যুট পরে তোমাকে বড় বিড়াল লাগছে আর টঙ্কস কে ছোট বিড়াল।”

টঙ্কস উচ্চস্বরে বলল, “মেয়াউ!”

মাহীন এবার শুধু চট করে বলল, “আমি রেডি হয়ে আসছি।”

বলেই ঝড়েরবেগে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল। নিজের কামরায় প্রবেশ করে ধাম করে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বড় করে নিশ্বাস ফেললো। তারপর নিজের কামরায় একবার চোখ বুলাল। সারা কামরা যুদ্ধ ক্ষেত্রের চেয়ে কম কিছু লাগছে না। গতকাল মধ্যরাতে নিজের দুই সপ্তাহ ধরে গুছিয়ে রাখা ব্যাগটা থেকে সমস্ত কাপড়চোপড়, জিনিস পত্র বের করে ফেলে রেখেছে। মিসেস নাসরিন সকাল থেকে ওর কামরায় একবারো আসেননি বলে রক্ষা। মাহীন ভাবল, ‘ইয়া আল্লাহ রহম করো আমার ওপর। আমি এত পাগল কেন? ওফ ওফ! আমি এখন দুই মিনিটে কিভাবে রেডি হবো? আর কিভাবে এই স্তুপ হয়ে পরে থাকা জিনিসগুলো ব্যাগে গুছিয়ে রাখব? ধুর ভাল্লাগে না! এবং আমি কিভাবে জানবো যে রায়েদ সেই সন্ধার পরে গিয়ে রেজিস্ট্রি করেছে। সেইদিন বলে গেল যে ও নিশ্চিত ভাবে আসবে। কিন্তু গতকাল মিসেস রে ফোনে বললেন ও এখনো রেজিষ্ট্রার করেনি। তাহলে আমি কি ভাববো? আর হঠাৎ করে মত পাল্টেছি শুনলেই ভাইয়া আমাকে এখন রায়েদের সামনে পচানো শুরু করবে। তার ওপর স্কুলে যাওয়ার পর বাকিদের পচানি তো আছেই। হঠাৎ করে ও যাচ্ছে শুনে আমিও পরিকল্পনা পাল্টে ফেলেছি শুনলে সকলেই বুঝে যাবে আমার না যেতে চাওয়ার কারণ কি ছিলো। ওফ কি ইমব্যারেসিং! ভাবতে ভাবতেই ঝড়েরবেগে শুধু ওর একেকটা কাপড় তুলছে ও যেনো তেনো ভাবে ব্যাগে ঠুসছে।

নাইম চুইঙ্গাম চিবাতে চিবাতে হেলে দুলে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। রায়েদকে সোফায় টঙ্কসের সাথে বসে থাকতে দেখে বলল, “হেই রায়েদ কি খবর! তুমি এখানে হঠাৎ?”

রায়েদ বলল, ” হ্যা আসলে আমি মাহীন কে নিতে এসেছি। নাহলে তো ও আর যেতো না।”

“ও আচ্ছা ভালোই। এট লিস্ট তুমি বুঝতে পেরেছো যে ও কি লেভেলের ড্রামা কুইন। দেখো এখন ঠিকি লাফাতে লাফাতে রাজি হয়ে গেছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তুমি হঠাৎ ওকে রাজি করালা কি করে?”

“সে মেলা কাহিনী। মূলত ওর অসুস্থ হওয়ার ভানটা আমি ধরতে পেরেছি দেখেই ও রাজি হয়ে গেছে।”

নাইম হেসে উঠে বলল, “আমার পাগল বোন। ও এমন সব অদ্ভুত কান্ড যে কি ভেবে করে, কেন করে সেটা আজও আমার কাছে রহস্যই থেকে গেল।”

“তারমানে ও সবসময় এমন উইয়ার্ড কাজকারবারই করতে থাকে?”

“তা বৈকি। তুমি ওর ক্লোজ ফ্রেন্ড হলে বেশি দিন না দুই সপ্তাহেই বুঝে যাবা ওর মতিগতি।”

রায়েদ মুচকি হেসে মনে মনে ভাবলো, “আমি ইতোমধ্যেই বুঝে গিয়েছি।”

সম্পূর্ণ সতেরো মিনিট পর মাহীন রেডি হয়ে কামরার বাইরে বেরিয়ে আসল। ছোট স্যুটকেস নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে নামতে ভাবল, ‘বুঝলাম না রায়েদের কি হয়েছে। একদিনের ব্যবধানে ওর কথাবার্তার স্টাইলই কিভাবে পাল্টে গেল? আমাকে কেউ কথায় হারাতে পারতো না, এখন তো দেখছি আমিই রায়েদের সঙ্গে কথায় পারবছি না।’

নাইম সিঁড়ির দিক থেকে উল্টো ঘুরে বসে আছে।
রায়েদকে উদ্দেশ্য করে বলছে, “তো ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর ছিলো যে ও শেষমেস কেকটা বানিয়েছিল। এবং রেড ভেলভেট কেকটা টমেটো ভর্তার মতো দেখতে হলেও ওর স্যার…”

মাহীন তড়িঘড়ি এসে পেছন থেকে নাইমের মুখ চেপে ধরে বাংলায় বলল, “খবরদার যদি আর কিছু বলেছিস তাহলে কিন্তু টঙ্কসকে তোর পিছনে লাগায় দিয়ে যাবো। তারপর দেখবো কে বাঁচায় তোকে।” এতটুক বলে আবার মুখে হাসি ফুটিয়ে নাইমের গলা জড়িয়ে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ইংলিশে বলল, “ভাইয়া, তোর সাথে আগামী চার দিন দেখা হবে না। আমাকে মিস করবি মনে হচ্ছে। ”

নাইম ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,”উহ! কথা শোনো মেয়ের। তুই বিদায় হলে তো আমি প্রাণে বাঁচি। আবার মিস করা। ”

মাহীন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইল নাইমের দিকে। রায়েদ চাপা হাসল। নাইম বলল, “এ্যই মাহীন। তুই না তোর ব্যাগ দুই সপ্তাহ ধরে গুছিয়ে বসে আছিস। তাহলে তোর সাড়ে আধা ঘণ্টা লাগল কেন?”

সাড়ে আধাঘন্টা আবার কি জিনিস?”

“আধাঘন্টার অর্ধেক। এনিওয়েজ বল না?”

” আরেহ আমার রেডি হইতে সময় লাগসে এবং আরোও কিছু খুটি নাটি জিনিস গুছিয়ে নিতে।”

নাইম সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “ওহ তাই নাকি। কি জানি আমার তো মনে হইলো আজকের ভোর বেলায় নামাজ পড়তে উঠে তোর রুমে উঁকি দিয়ে দেখি তোর স্যুটকেসের মধ্যে বিস্ফোরণ হয়ে সবকিছু এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে।”

“লাস্ট মোমেন্টের প্যাকিংয়ের জন্য গতকাল দুনিয়ার জিনিস পত্র বের করছিলাম ওইগুলাই এদিক ওদিক পরেছিলো। ”

এবার নাইম উচ্চকণ্ঠে বলল, ” মা! কোই বাইরে আসো। মাহীন যাচ্ছে তো। ”

ক্ষণকাল পরেই মিসেস নাসরিন ব্যস্ত পায়ে বাইরে বেরিয়ে আসলেন। রায়েদ বলল,

“আসসালামু ওয়ালাইকুম আন্টি।”

মিসেস নাসরিন হাসি মুখে বললেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম বাবা। কেমন আছ?”

” এইতো আছি আলহামদুলিল্লাহ।”

এবার মিসেস নাসরিন মাহীনের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “আরেহ তুই সুস্থ আছিস? হঠাৎ করে যে পরিকল্পনা বদলে ফেললি?”

মাহীন তাড়াতাড়ি বলল, “মা হ্যা আমি এখন একদম সুস্থ। তুমি চিন্তা করো না। আমাদের এখনই বের হতে হবে নাহলে বাস মিস হয়ে যাবে।”

“এ্য? আচ্ছা ঠিক আছে আমাকে কিন্তু বাসে উঠে ফোন দিবি। আবার ওখানে নেমেও ফোন দিবি। আর তুই সবকিছু নিয়েছিস? ভালো করে দেখে নিয়েছিস তো? কিছু বাদ পরেনি তো?’

মাহীন বলল, “মা আমি সব নিয়েছি। তুমি চিন্তা করো না। ওখানে আমার সব ফ্রেন্ডরা থাকবে।”

বলতে বলতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। রায়েদও ওর সাথে সাথে এগিয়ে গেল। টঙ্কসও সাথেই আছে। মিসেস নাসরিন বললেন,

” আর তোর বিড়াল তো তোকে ছাড়া এখন অনেক জ্বালাবে।”

মাহীন বলল, “ভাইয়া কি করতে আছে। ওর ঘাড়ে চাপায় দাও।”

” আমার জীবনটা জাহান্নামে পরিনত করার আর কোনো পথ বন্ধ রাখলো ও।” বিড়বিড় করে বলল নাইম।

মাহীন ও রায়েদ দরজার বাইরে বেরিয়ে গেছে। মিসেস নাসরিন বললেন, ”রায়েদ দেখো বাবা তুমি নিজের খেয়াল রেখো এবং আমার পাগলি মেয়েটারও খেয়াল রেখো।”

রায়েদ মুচকি হেসে বলল, ”অবশ্যই আন্টি।”

মাহীন বিরক্ত হয়ে মনে মনে ভাবলো, ‘ওফ সবাই আমাকে পাগলি বলতে বলতে পচায়ে ফেললো।’
অবশেষে রায়েদ ও মাহীন বিদায় নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

চলবে ইনশাআল্লাহ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here