দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব:৮,৯,১০শেষ
তামান্না জেনিফার
৮.
গ্রুপ বন্ধ করলেও ইনবক্সে ম্যাসেজ আসা বন্ধ হলো না ৷ ফেসবুকে এখন আমার গ্রুপটা নিয়েই তোলপাড় চলছে ৷ অনেকেই সাপোর্ট করে পোস্ট দিচ্ছে , তারা গ্রুপটি আবার ফিরে পেতে চায় ৷ নেগেটিভ পোস্টেরও অভাব নেই ৷ তারা বলছেন সবটাই ব্যবসা .. আমি মারিয়া আপুকে বললাম সবটা ৷ আপু বলেছিলেন দেখো , গ্রুপ থামলেও আঁধারের পথচলা থামবে না ৷ হলোও তাই ৷ আসলেই অভিজ্ঞতা একটা বড় জিনিস ৷ মারিয়া আপু জীবন যুদ্ধে অভিজ্ঞ ৷ আসলেই আমি নক পেলাম আবার ..
নক দিয়েছেন একজন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক ৷ নাম সফিউল আলম ৷ উনি লিখেছেন —
“শুনেছি আপনি একজন মেয়ে ৷ এও শুনেছি সুইসাইড ব্যুথ আপনি কখনোই বিক্রি করেননি ৷ বরং আপনি সবার ভালো চেয়েছেন , আত্মহনন থেকে ফেরাতে চেয়েছেন ৷ এবং অসংখ্যবার সফলও হয়েছেন ৷ আপনার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও আপনার উপস্থাপন আসলেও খানিকটা দৃষ্টিকটু ছিলো ৷ অন্তত যারা প্রথমবার দেখবে তাদের জন্য ৷ কিছু মনে করবেন না , আমি শুধু আমার মনের কথাটাই বললাম ৷
আমি সফিউল আলম ৷ সরকারী চাকুরিজীবী ৷ বয়স ৫৮ বছর ৷ হয়তো ভাবছেন এত বয়স্ক একজন মানুষ আপনাকে কেন ম্যাসেজ দিলো ! তার আগে বলে নেই , আমি ফেসবুক ব্যাপারটা এত ভালো বুঝি না ৷ তবে আমার ছেলে মেয়েরা দেশের বাইরে থাকে ৷ ওদের ছবি দেখাই আমার প্রধান উদ্দেশ্য ৷ ইদানীং আপনার গ্রুপ নিয়ে এত বেশি সবাই লিখছে যে আমিও দেখলাম ৷ সেখান থেকেই আপনাকে জানা আসলে ৷ যাই হোক , যে সুইসাইড ব্যুথের অস্তিত্বই নেই আমি সেটা কিনতে চাই না ৷ তবে এটা ঠিক আজকাল আর বাঁচবার ইচ্ছে হয় না ৷
আমার স্ত্রী গত হয়েছেন পনেরো বছর আগে ৷ তিন ছেলেমেয়ে আমার , ও কারোই প্রতিষ্ঠা বা বিয়ে দেখে যেতে পারেনি ৷ দুই ছেলে বিদেশে পড়তে গিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে গেলো ৷ মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিলাম দেশেই ৷ চেয়েছিলাম একটা সন্তান অন্তত কাছে থাক ! ওরাও চলে গেলো …
এখন আমার দিন কাটে এই স্মার্টফোন নিয়েই ৷ যতক্ষন অফিসে থাকি , ভালো থাকি ৷ বাড়িতে ফিরলেই শূন্যতা আমাকে গ্রাস করে ৷ এই নিস্তব্ধতা সহ্য করা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো ৷ আমার এখন কথা বলার একজন সঙ্গী প্রয়োজন ৷ অনেক ভেবে চিন্তে তাই দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবি ৷
একটা বয়সে ছেলেমেয়েরা বাবা মায়ের গার্জিয়ান হয়ে যায় ৷ আমার ছেলে মেয়েরাও তাই হয়েছে ৷ আমি প্রথমেই কথাটা বললাম আমার মেয়েকে ৷ ভাবলাম ওই আমার সবচেয়ে বেশি আদরের , ও নিশ্চয় বুঝবে ৷ কিন্তু ফলাফল হলো ভিন্ন ৷ ও কেঁদে কেঁদে একাকার অবস্থা করে ফেললো ৷ ওর জামাই আমাকে বললো “আব্বা আপনার বয়স হয়েছে , এখন ধর্ম কর্মে মন দেন ৷” পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি আমি , বুদ্ধি হবার পর রোজা বাদ দেইনি কখনো ৷ এই আমি যুবক বয়সেও যেমন ধর্ম কর্ম করেছি এখনও তাই করি ৷ আমি জানি আমার ধর্মে কোথাও আমার দ্বিতীয় বিয়েতে মানা নাই ৷ তারপরও আমি কথা বাড়ালাম না ৷ আমার দুই ছেলেকে বললাম ৷ ওরা অবশ্য কাঁদলো না তবে চিল্লাচিল্লি করলো অনেক ৷ এমনকি এটাও বললো আমার নাকি ভীমরতি হয়েছে ৷ আমার চরিত্রে সমস্যা দেখা দিয়েছে , আরো অনেক কিছু ৷ আমি আর এ বিষয়ে কথা বাড়ালাম না ৷
আমার নিজেরও মনে হলো নাতি নাতকুর হয়ে গেছে এখন আর এসব বলা মানায় না ৷ কিন্তু আমার একাকীত্ব কমলো না ৷ সারাজীবন রাত দশটার মধ্যে যে মানুষটা ঘুমাতাম , রাতের পর রাত তার বিনিদ্র রজনী কাঁটতে লাগলো ৷
অফিসের কলিগদের সাথে ব্যাপারটা শেয়ার করলাম ৷ তারা সবাই বললো আমার বিয়ে করাই উচিত ৷ ছেলে মেয়ে তো আর কাছে এসে থাকছে না বা আমাকেও নিয়ে যাচ্ছে না ৷ ওদের কথা না ভেবে আমার বিয়ে করাটাই যুক্তিসঙ্গত ৷
তারাই আমার জন্য মেয়েও দেখলো ৷ একজনকে আমারও পছন্দ হলো ৷ বিধবা , নিঃসন্তান ৷ বয়স ৩৫+ .. বলা যায় আমার অর্ধেক বয়সী ৷ কিন্তু বয়সটা নিয়ে আমার একটু সংশয় ছিলো ৷ বিয়ের কথা বলার আগেই তাই আমি মেয়ের সাথে সরাসরি কথা বললাম ৷ তাকে বললাম , “আপনি কম বয়স্ক কাউকে বিয়ে করতে পারবেন ৷ আমি যথেষ্ট বয়ষ্ক, আমার মৃত্যুর পর আপনাকে দীর্ঘ জীবন একা থাকতে হতে পারে ৷ ” উনি বললেন “সমবয়সীকেই বিয়ে করেছিলাম ৷ তারপরও সে তো চলে গেলো ! কখন কার মৃত্যু হবে কে জানে ! আপনার আগে আমিও চলে যেতে পারি ..”
বুঝলাম তার আপত্তি নাই ৷ আমার কলিগদের উপস্থিতিতে একদম ঘরোয়াভাবে আমি বিয়ে করে ফেললাম ৷
সমস্যাটা শুরু হলো তারপর থেকেই ৷ চিরকাল শুনেছি পিতা মাতা সন্তানকে ত্যাজ্য করে , আমার ক্ষেত্রে ঘটণা হলো উল্টা ৷ আমার তিন সন্তান আমাকে ত্যাজ্য করলো ৷ গত ছয়মাসে তারা আমার সাথে কোন যোগাযোগ করেনি , আমি করতে চেয়েও পারিনি ৷ আমার বর্তমান স্ত্রী লতাও অনেক চেষ্টা করেছে ৷ কিন্তু আমার দ্বিতীয় বিয়ের অপরাধ ক্ষমা করছে না তারা ৷
আমার আজকাল কিছুই ভালো লাগে না ৷ আমার এখন সার্বক্ষনিক কথা বলার মানুষ আছে , আমার অসুখে সেবা করার মানুষ আছে , আমার জন্য ঘরে অপেক্ষা করা মানুষ আছে .. তারপরও আমার ঘুম হয় না রাতে ! আমি সারা রাত জেগে বসে থাকি ৷ ফেসবুকে আমার ছেলেমেয়েদের হাসিখুশি ছবি দেখি .. ওদের ছবিতে হাত বুলাই ..
আমি কি জীবনকে আরেকটা সুযোগ দিয়ে খুব বেশিই অন্যায়করে ফেলেছি যে অন্যায় ক্ষমার অযোগ্য ?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম ৷ আমার মায়ের কথা মনে হলো ৷ মানুষটা তার সারাটা জীবন শুধু আমাদের কথাই ভাবলো ৷ আমরা বিনিময়ে তাকে কি দিলাম ? সন্তানেরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড্ড বেশি স্বার্থপর ৷ সুমা তো চলেই গেলো , আমারও একসময় বিয়ে হবে ৷তখন আমাকে চলে যেতে হবে অন্য আরেকটা সংসারে ৷ তখন মায়ের কি হবে ? কিভাবে থাকবে মা একা একা আমাকে ছাঁড়া ৷ আজকে আমি বুঝলাম আমি মা কে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবো না , মা ও এই একাকীত্বের ভার সহ্য করতে পারবে না ৷ তিনি তো আর সফিউল আলম আঙ্কেলের মতো বিয়েও করবেন না .. কাজেই আমাকে সারাজীবন আমার মায়ের কাছেই থাকতে হবে ৷ যদি কোনদিন বিয়ে করি আমার শর্ত থাকবে একটাই , আমার মা আমার সাথেই থাকবে … সবসময় !
আমি ম্যাসেজের রিপ্লাই দিলাম ৷ আমি লিখলাম ,
” বয়সে আমি আপনার মেয়ের মতোই হবো হয়তো ৷ আপনার লেখাটা আমি তাই আপনার সন্তান এবং আপনি দুটো দৃষ্টিকোন থেকেই দেখার চেষ্টা করলাম ..
প্রথমেই একটা কথা বলে নেই , আপনি কোন অন্যায় করেননি ৷ একজন একাকী মানুষের সঙ্গী পাবার ইচ্ছেটা কোন অন্যায় কখনোই না ৷ আপনার সন্তানেরা আপনাকে তাদের কাছে নেবার কোন ব্যবস্থা করেনি ৷ আমার ধারনা তারা দেশেও নিয়িমিত আসে না ৷ একাকীত্ব সহ্য করা সবার পক্ষে সম্ভবও না ৷ আপনি যা করেছেন তাতে তাই কোন অন্যায় নেই …
৯.
সন্তানেরা মাঝে মধ্যে ভীষণ স্বার্থপর হয় ৷ আপনার সন্তানেরাও স্বার্থপর ! যাদের জন্য আপনি জীবন দিয়ে দিচ্ছেন তারা আপনাকে বোঝেও না ৷ সে যাই হোক ৷ আমি আপনার জায়গায় হলে প্রথমেই ওদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা বন্ধ করে দিতাম ৷ আমার ধারনা আপনি প্রতিদিন একাধিকবার চেষ্টা করেন তাদের সাথে কথা বলার ৷ আমি বলবো , আপনি ওদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা বন্ধ করে দেন ৷
নিজের মতো করে বাঁচতে শেখেন ৷ অনেক করেছেন তাদের জন্য ৷ এবার নিজের জন্য কিছু করার সময় ৷ সারাজীবন তো স্বামী বাবা সন্তান হয়েই বাঁচলেন , জীবনের বাকী দিনগুলো মানুষ হয়ে বাঁচুন … আপনার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো ”
ম্যাসেজ সেন্ড করে দিয়ে আমি সফিউল আলমের আইডি ঘেটে ঘেটে তার তিন ছেলেমেয়ের আইডি বের করে ফেললাম ৷ তারপর তাদের ম্যাসেজে লিখলাম
“আপনার বাবা , একজন বাবা হবার আগেও একজন মানুষ ৷ আপনাদের মতো সব চাহিদাই তারও আছে ৷ সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তাও আছে ৷ মানসিক , শারীরিক দু’রকম চাহিদাই আছে ৷ না কি বাবা বলে তার কোন চাহিদা থাকাটা অন্যায় ? এভাবে দিনের পর দিন একজন বৃদ্ধ মানুষকে কষ্ট দিচ্ছেন , জানেন তো karma never loses an address ! আজ যা আপনার বাবার সাথে করছেন ঠিক তাই আপনি ফেরত পাবেন না তো ?
প্লিজ , আপনার বাবাকে বাবা না ভেবে একজন মানুষ হিসেবে ভাবুন আগে ৷ মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে , আপনি কি জানেন উনি ইদানীং আত্মহত্যার কথা ভাবছেন ? ”
সেম ম্যাসেজ কপি করে তার তিন সন্তানকেই পাঠালাম ৷ হয়তো আমার ম্যাসেজ খুলেও দেখবে না ৷ স্প্যাম ম্যাসেজে পরে থাকবে ৷ তারপরও দিলাম ৷
সন্ধ্যায় অবাক হয়ে দেখলাম ম্যাসেজ এসেছে সফিউল আলমের মেয়ের আইডি থেকে ৷ আমাকে লিখেছেন
” আঁধার , আপনার গ্রুপ সম্পর্কে আমি জানি ৷
আপনি যেভাবে বলছেন আমি আসলেই সেভাবে ভাবিনি ৷ শুধু নিজের দিকটাই ভেবেছি ৷ স্বামীর কাছে , শ্বশুড়বাড়ির কাছে ছোট হয়ে যাবো ৷ সবাই মন্দ বলবে … আমি অধম সন্তান তাই বাবার কষ্টটা বুঝিনি ৷ আমি অবশ্যই বাবার সাথে কথা বলবো ৷ ভাইদেরও বোঝাতে চেষ্টা করবো ৷
আপনার গ্রুপটার জন্য খুব খারাপ লেগেছে ৷ কেউ কিছু ভালো করতে চাইলে সবাই যেন তার পেছনেই লাগে ৷ তবে আমার বিশ্বাস এমন একটা দুটা গ্রুপের চলে যাওয়া আমার সদিচ্ছাকে শেষ করে দেবে না ৷ আপনার জন্য শুভ কামনা …”
আমি কিছু বললাম না , শুধু একটা স্মাইলি দিলাম ৷ উনি নিজেই যখন বুঝতে পেরেছেন আমার আর কথা বলার দরকার কি !
পরদিন সকালে সফিউল আলম সাহেবের ম্যাসেজ পেলাম আবার ৷ তিনি লিখেছেন
“আপনি বোধহয় এনজেল.. আমার মেয়েটা একটু আগে আমাকে কল দিয়েছিলো ৷ খুব কাঁদলো , সরি বললো .. বললো ওর ভাইরাও আমার সাথে আবার যেন আগের মতো সহজ হয়ে যায় সে ব্যবস্থা করবে ৷ আপনি কি করেছেন জানি না , কিন্তু আমার মন বলছে এর পেছনে কলকাঠি আপনিই নেড়েছেন ! নয়তো এত দিনেও যা পারিনি একদিনে তা কিভাবে হলো ৷ আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া থাকলো ৷ এখন থেকে আমার প্রত্যেক মোনাজাতে আপনি থাকবেন …”
আমি আবারও কিছু বললাম না ৷ শুধু একটা স্মাইলি দিলাম ৷ এবার আসলে আমার বলার কিছু ছিলোও না ..শুধু গলার কাছটায় কেমন যেন একটা দলা পাকানো অনুভূতি হলো ৷
***********
রিমশা আজ বেড়িয়েছে অনেক দিন পর ৷ দীর্ঘদিন ঘরে থাকতে থাকতে রিমশার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো ৷ আজ তাই গাড়িটা নিয়ে বের হয়েছে ৷ ড্রাইভারকে নেবার ইচ্ছা ছিলো না , কিন্তু তার একা বের হওয়ার উপর কঠিন নিষেধ আছে তার বাবার ৷
কোথায় যাবে রিমশা জানে না ৷ ভার্সিটির দিকে যাওয়া যায় ৷ সেকেন্ড ইয়ারের পর আর পড়াশোনা করেনি রিমশা ৷ আর ভার্সিটিতে যায়নি ৷ ওর কাছে এই জায়গাটাই বিষাক্ত লাগতো …
হঠাৎ করে পড়াশোনা ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্তে রিমশার বাবা খুব রাগ হয়েছিলো ৷ কিন্তু রিমশা নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলো ৷ ও আর পড়বে না …
ভার্সিটিতে গিয়ে একটু খোলা জায়গা দেখে রিমশা সেখানে ঘাসের উপর বসে পড়লো ৷ ও যেখানে বসেছে সেখান থেকে সেই জায়গাটা দেখা যাচ্ছে যেখানে শোভন আর সঞ্চিতা বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতো ৷ রিমশা যেন সব দেখতে পারছে … চোখের সামনে সবটাই দৃশ্যমান !
সেদিন যখন শোভনের বুকের মধ্যে বরফের মতো মিশে যেতে দেখেছিলো সে সঞ্চিতাকে , সেদিন ওর মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিলো ৷ ন্যায় অন্যায় ভালো মন্দ এ সকল কিছুর উর্দ্ধে চলে গিয়েছিলো সে ৷ মনের মধ্যে হিংসার দগদগে ঘাঁ … ভয়ঙ্কর সেই ঘাঁয়ের যন্ত্রনা …
সেদিন বাড়ি ফিরে রিমশা একটা সিদ্ধান্ত নেয় ৷ যা হবার হবে , এদের দুজনকে আলাদা সে করবেই … সঞ্চিতার একটা ছবি জোগার করে সে ৷ তারপর সেই ছবির সাথে নিঁপুন দক্ষতার সাথে জুড়ে দেয় আরেকটা ছেলের ছবি ৷ তারপর একগাদা নোংরা কথা লেখে সঞ্চিতার সম্পর্কে ৷ লেখে সঞ্চিতা চরিত্রহীন ! সেই চিঠি সে টাইপ করে যাতে হাতের লেখা বোঝা না যায় ৷ তারপর দু কপি করে এক কপি পাঠায় শোভনের কাছে আরেক কপি শোভনের বাড়িতে তার বাবার কাছে !
শোভন হয়তো ব্যাপারটা ইগনোর করতো , কিন্তু পরিবারের চাপে সে সঞ্চিতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ৷ হাসিখুশি প্রানোচ্ছ্বল সঞ্চিতা এরপর একদম চুপচাপ হয়ে যায় ! রিমশা সেই নিষ্প্রান সঞ্চিতাকে দেখে মনে মনে পুলকিত হয়ে যায় !
রিমশার মনের ক্ষতটা যেন ওদের আলাদা করেও শুকায়নি ৷ এবার সে সঞ্চিতার আরো একটা ছবি ইডিট করে , নোংরা একটা ছবিতে রূপান্তরিত করে সেই সাধাসিধে সাধারণ ছবিকে ৷ তারপর ক্লাসের প্রত্যেকটা ছেলেমেয়ের কাছে সেটা পৌছাবার ব্যবস্থা করে খুব যত্ন করে , যেন কেউ না বোঝে কাজটা কে করছে !
রিমশা ভেবেছিলো মেয়েটা এতে অপমানিত হবে ! সবার কাছে ঘৃণার পাত্র হবে ! হলোও তাই ..
কিন্তু এরপর কি হতে পারে একুশ বছরের রিমশার মাথায় সে পর্যন্ত চিন্তা যায়নি ৷ প্রচন্ড রকম অপমানিত হবার পর সেই ধিক্কার , সেই ঘৃণা সহ্য করতে পারেনি সঞ্চিতা … ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে নিজের জীবনটা শেষ করে দিয়েছে …
এত কিছুর পর শোভনও তার হয়নি ৷ শোভনকে তার বাবা মা বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে সঞ্চিতার মৃত্যুর পর ৷ রিমশা না পেয়েছে শোভনকে , না পেয়েছে সুখ ! শুধু হিংসার আগুনে জ্বলে একটা তরতাজা প্রানের খুনী হয়েছে সে …
১০.
সবকিছু রিমশার চোখের সামনে ভাসছে ৷ রিমশার মাথাটা ভীষণ ঘোরাচ্ছে ৷ ভীষণ ক্লান্তি লাগছে , মনে হচ্ছে এই ঘাসের মধ্যেই শুয়ে পড়লে আরাম পেতো সে ….
তারপরও সে সেখান থেকে উঠে দাঁড়ায় ৷ ভালো লাগছে না এই খোলা হাওয়াও ! মনের মধ্যে অশান্তি থাকলে কি আর খোলা হাওয়ায় মন জুড়ায় ?
নীলক্ষেতের কাছে সিগন্যালে গাড়িটা থেমে আছে ৷ গাড়ির জানালা দিয়ে রিমশা স্পষ্ট দেখছে সঞ্চিতা বই দামাদামি করছে ৷ ফুটপাতের বইয়ের দোকানে দাঁড়ানো লাল পেড়ে কালো শাড়ি পরা মেয়েটা সঞ্চিতাই ! এই মুখ চিনতে রিমশার ভুল হবার কথা নয় ৷ তারপরও নিজের চোখ আবার ডলে নেয় রিমশা ৷ ভুল দেখছে না তো সে ! না না এই তো সঞ্চিতা … সঞ্চিতা কি তাহলে বেঁচে আছে !
রিমশা দ্রুত গাড়ির দড়জা খুলে মেয়েটির কাছে গিয়ে দাঁড়ায় …
তারপর গলায় একগাদা বিষ্ময় নিয়ে বলে “সঞ্চিতা…”
মেয়েটি রিমশার দিকে ঘুরে তাকাতেই জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে সেখানে পরে যায় রিমশা …
**********
হঠাৎ করে এমন সব ঘটণা আমার সাথেই কেন হয় কে জানে ! মেয়েটার এখনো জ্ঞান ফেরেনি ৷ খুব বড়লোকের মেয়ে বোঝা যাচ্ছে ৷ মেয়েটির বাবা এসেছে , তারপর থেকে এখানে ডাক্তার নার্সদের ছোটাছুটি বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে ৷
আমি এখন এখানে বসে থাকবো না কি চলে যাবো সেটাও বুঝতে পারছি না ৷ আমার আসলে কি করা উচিত ? মেয়েটা বোধহয় সুমার পরিচিত ৷ আমাদের একই রকম চেহারা হওয়ায় ও আমাকেই সুমা ভেবেছে ৷ মৃত একজন মানুষকে চোখের সামনে জলজ্যান্ত দেখে বোধহয় মেয়েটা নিজেকে সামলাতে পারেনি ৷ আমি ওকে এটুকুও বলার সুযোগ পেলাম না যে আমি সঞ্চিতা নই ! ওর জমজ বোন সঞ্চয়িতা..
আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে ৷ সুমা আর আমার কলেজ পর্যন্ত একসাথেই পড়াশোনা ছিলো ৷ তারপর সুমা চান্স পেয়ে গেলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে , আর আমি ভর্তি হলাম ইডেন কলেজে ৷ কলেজ পর্যন্ত আমাদের বন্ধুবান্ধব সেম থাকলেও ভার্সিটিতে গিয়ে ওর অনেক নতুন বন্ধু হয়েছিলো ৷ যে রকম প্রানবন্ত মেয়ে ছিলো , সবার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারতো এক নিমেষেই , এতই মিশুক ছিলো !
এই মেয়েটাও বোধহয় সুমার ফ্রেন্ড ৷ আমার বোধহয় ওর জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপে’ক্ষা করাই উচিৎ !
***********
রিমশার জ্ঞান ফিরলো দীর্ঘসময় পর ৷ রিমশার বাবা ওর মাথার কাছেই বসে ছিলো ৷ ভদ্রলোক কান্নাকাটি করেছেন চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে ৷ চোখ মুখ কেমন ফুলে আছে ! রিমশা ধীরে ধীরে বললো “স..ঞ্চিতা..”
রিমশার বাবা ডেকে পাঠালেন সেই মেয়েটিকে , যে মেয়েটি ড্রাইভারের সাহায্য নিয়ে রিমশাকে হাসপাতাল পর্যন্ত এনেছে !
রিমশা আর মেয়েটি এখন মুখোমুখি …
—সঞ্চিতা !
—আপনি ভুল করছেন ৷ আমি সঞ্চয়িতা , ওর জমজ বোন ৷ সঞ্চিতা আমদের ছেড়ে গেছে দু’বছর আগে ..
এটুকু শুনতেই ডুকরে কেঁদে ওঠে রিমশা ৷ তারপর প্রথমবারের মতো নিজ মুখে তার বাবা আর রুমার সামনে স্বীকার করে সবটা …
রুমা যা স্বপ্নেও ভাবেনি , তাই হলো আজ !
তার সামনে হাসপাতালের সফেদ চাদরে শোয়া মেয়েটি আসলে তার সুমার খুনী !
দুই হাত জোর করে ক্ষমাপ্রার্থনা করছে খুনী মেয়েটি !
রিমশার দিকে তাকিয়ে রুমা বলে “আপনার কি মনে হয় না পুলিশের কাছে ব্যাপারটা বলা উচিত ? নিজের ভাগের শাস্তিটা ভোগ না করলে বাঁচতে পারবেন তো !”
**********
রিমশার বাবা কাঁদছে
পুলিশ হাসপাতালে এসে স্টেটমেন্ট নিচ্ছে রিমশার , সে আকুল হয়ে কাঁদছে..
আরেকজন আজ আকুল হয়ে কাঁদছে , সে রুমা , সে আমাদের আঁধার …আজ সে জানে তার সুমা কেন তাদের ছেড়ে চলে গেছে !
(সমাপ্ত)