দি সুইসাইড ব্যুথ,পর্ব : ৭
তামান্না জেনিফার
ও বাড়ি থেকে বের হতে মারিয়া আপুর বেশ ঝামেলাই করতে হলো ৷ অনেক নোংরা নোংরা কথাও শুনতে হলো ৷ তারপরও যখন আপু দৃঢ় ভাবে জানালেন তিনি চলেই আসবেন , তখন তারা তোতনকে আঁটকে দিলো ৷ তোতন তাদের মেয়ে , তোতন ফেলে আপু যেন যেখানে খুশি যায় !
জীবনে প্রথমবার আপু বোধহয় সাহসের কাজ করলো ৷ সপাটে চড় লাগালো তোতনের চাচার গালে , তারপর বললো “শুয়োর , তোর ঐ নোংরা হাতে আমার মেয়েকে ছুঁবি না .. তোর কপাল ভালো যে আমি তোকে পুলিশে দিচ্ছি না … ” মেয়েমানুষ আর মা এ দুয়ে বিস্তর তফাৎ ৷ করুণাময় যখন কোন মেয়েকে মা বানান , তার মধ্যে যেন শক্তির আধার ঢেলে দেন ৷ সন্তানের জন্য মা পারে না এমন কোন কিছু নেই এই পৃথিবীতে..
মারিয়া আপু চলে এলেন সকাল দশটায় ৷ একটা ব্যাগ হাতে , যার মধ্যে তাদের দুজনের কিছু কাপড় .. আর কিছুই নেই ৷ দোতালার আন্টি আঙ্কেল আর মা মিলে তাদের জন্য একটা তোষক আর হাড়ি পাতিলের ব্যবস্থা করে দিলেন ৷ মারিয়া আপুর নতুন যুদ্ধ শুরু হলো ৷ বেঁচে থাকার যুদ্ধ , বাঁচিয়ে রাখার যুদ্ধ…. মরে যেতে তো সবাই পারে , বেঁচে থাকতে পারে কজন ? বাঁচার জন্য লড়াই করতেই হয় ৷ একেকজনের লড়াইটা একেক রকম ৷ কারোটা প্রকট আবার কারোটা প্রচ্ছন্ন .. কিন্তু কারো জীবনই সহজ সরল গল্পের মতো না ৷ বাস্তব জীবনে সিনেমার মতো তিন ঘণ্টার শেষে ভিলেন ধরা পড়ে না ৷ ভিলেনরাই হয়তো জিতে যায় বারবার .. তারপরও যুদ্ধ করে করে নিজেকে আরো শক্তিশালী মানসিকতার করতে যে পারে সেই হলো মহানায়ক / মহানায়িকা..
মারিয়া আপুর বিজনেসও শুরু করা হলো ৷ ফেসবুকে পেজও ওপেন করা হলো , “তোতনের টুকিটাকি” নাম দিয়ে ৷ এলাকাতেই একটা স্কুলে তোতনতে ভর্তি করানো হলো ক্লাস ফোরে ৷ বছরের মাঝামাঝি সময় তাই খুব ভালো স্কুলে ভর্তি করানো গেলো না ৷ তাতে অবশ্য মারিয়া আপুর কোন মন খারাপ নেই ৷ বরং তিনি বেশ হাসিখুশিই আছেন ৷ মায়ের সাথে সাথে বেশ ভাব হয়েছে তার ৷ মায়ের জন্যেও ভালো হয়েছে , আমি সময় দিতে না পারলেও এখন তোতন আর আপু মা কে সময় দেয় ৷ একদিন দেখলাম মা বেশ জমিয়ে আমাদের আকিকার গল্প করছেন …
“জানো তো , সে এক বিরাট হট্টগোলের ব্যাপার হলো ৷ আমার শ্বশুর ওদের নাম রাখবেন রুমানা রুমা আর সুমনা সুমা .. বাড়ির সবারই তাতেই মত ৷ কিন্তু তোমার খালু গো ধরে বসেছে ৷ সে তার মেয়েদের নাম রাখবে কাব্যগ্রন্থের নামে … কবি মানুষ ছিলেন কিনা ! তিনি মেয়েদের নাম রাখবেন সঞ্চয়িতা আর সঞ্চিতা .. আমার শ্বশুর রাগে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছেন ৷ সবচেয়ে বিপদে পড়েছে আমার শ্বাশুড়ি ,না পারছেন ছেলের কথা রাখতে , না পারছেন স্বামীর কথা ফেলতে ! শেষে আমাকে এসে বললেন , বৌমা ওরা দুজনই গোয়ার , তুমি বরং মাঝের একটা পথ বাতলে দাও … আমি আর কি বলবো ! অনেক ভাবলাম , অনেক ভাবলাম .. ভেবেচিন্তে আমার শ্বশুরের কাছে গিয়ে বললাম , বাবা আমার একটা কথা আছে .. আমি চাই আমার মেয়েরা তাদের দাদার দেওয়া নাম আর বাবার দেওয়া নাম দুটাই পাক ৷ ওদের নাম হোক সঞ্চয়িতা রুমা , আর সঞ্চিতা সুমা… আমার শ্বশুর আমাকে খুব আদর করতেন ৷ আমার কথা ফেললেন না … রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা আর নজরুলের সঞ্চিতা আমার কন্যাদ্বয়ের নাম হলো.. হা হা হা ..”
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম .. আমার মা হাসছে ! কতদিন পর করুনাময় আমাদেরকে একটুখানি করুনা করেছে .. আমি মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানালাম করুণাময়ের কাছে ৷
এ সপ্তাহে নতুন কেস এলো না একটাও ৷ এটাও আমার জন্য আনন্দের ৷ ভাবলাম ফয়সালের খোঁজ নেওয়া যাক ৷ ছেলেটা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাচ্ছে তো !
নক দিতে গিয়ে দেখলাম স্বপ্নতারা আইডিটি ডিএক্টিভ করা ৷ চিন্তায় পরে গেলাম একটু .. আমার সেই পরিচিত সাইকিয়াট্রিস্ট কে কল করলাম ৷ উনি বললেন ফয়সাল কাউন্সেলিং করাচ্ছে , দুটো সেশন হয়েছে .. তার কথা শুনে ভালোই লাগলো , কিন্তু আরো একবার আমার ফয়সালের সাথে কথা বলা দরকার .. কিভাবে বলবো জানি না .. ওর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করিনি আমি মনের ভুলেই ..
এর মধ্যেই পড়লাম আরেক ঝামেলায় ৷ পুলিশি ঝামেলা ! কেউ একজন সাইবার ক্রাইমে মামলা করেছে আমার নামে ৷ আমি সুইসাইডকে প্রোমট করতেছি.. আমি পড়লাম অথৈ সাগরে ! এই অবস্থায় কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না ৷
মনে পড়লো অতসী রায়ের কথা ৷ একজন সুনামধন্য উকিল ৷ আমার সুইসাইড ব্যুথ গ্রুপের প্রথম দিককার কেস ছিলো উনারটা.. উপায় না পেয়ে উনাকে কল করলাম ৷ আমার কথা শুনেই ছুটে আসলেন তিনি আমার কাছে ৷ একদম বিপদের মুখ থেকে আমাকে বাঁচালেন ৷ তবে গ্রুপটি বন্ধ করে দিতে হলো আমার ৷ পূর্বের সকল সল্ভ করা কেসের প্রমান দেখিয়েও গ্রুপটি বাঁচাতে পারলাম না আমি !
বলা যায় আমি ভেঙেই পড়লাম এবার ৷ আমার জীবনের উদ্দেশ্য যেন হঠাৎ করেই হারিয়ে গেলো ৷
***********
রিমশার সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে ..অনার্সের প্রথম বর্ষ ৷ শোভন ছিলো এক ব্যাচ সিনিয়র ৷ প্রথমে কথা হয়েছিলো নোটের জন্য ৷ বেশ সাবলীলভাবে দুজনের কথা হতো ৷
রিমশা প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো ৷ একদিন শোভনই ওকে বললো “রিমশা , তোমাদের ক্লাসের সঞ্চিতা মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ , একটু খোঁজ নাও না ওর কি কারো সাথে রিলেশন আছে না কি ! ”
রিমশা শোভনের সেই কথা শুনে ভেতরে ভেতরে গুমরে গুমরে কেঁদে উঠেছিলো ৷ ক্লাসের কারো সাথেই তার বন্ধুত্ব নেই ৷ সঞ্চিতা মেয়েটাকে সে আগে কখনও খেয়ালও করেনি ৷ এবার খেয়াল করলো … ভীষণ দুরন্ত ছটফটে একটা মেয়ে সঞ্চিতা ৷ সারাক্ষন হৈ চৈ করছে , আড্ডা দিচ্ছে , গলা ছেড়ে গান গাচ্ছে .. ক্লাসে তার বন্ধু বান্ধবীর অভাব নেই ৷ রিমশা সবসময় খেয়াল করতো সঞ্চিতাকে .. আর মনকে বোঝাতে চাইতো মেয়েটা সুন্দর , দুরন্ত , চটপটে , শোভন তো ওকেই ভালোবাসবে এটাই স্বাভাবিক !
মনকে বোঝাতে চাইলেই কি আর মন বুঝবে ! মন বুঝতো না .. ওর প্রচন্ড হিংসা হতো ৷ বাড়ি ফিরে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাঁদতো ৷ তার মাথায় হাত বুলাবার কেউ ছিলো না ৷ তাকে সান্ত্বনা দেবারও কেউ ছিলো না ৷ তার কষ্টগুলোতে ভালোবাসার মলম লাগিয়ে দেবারও কেউ ছিলো না …
ধীরে ধীরে সময় গড়ালো ৷ সেকেন্ড সেমিষ্টারের শুরুতেই সবাই জেনে গেলো সঞ্চিতা আর শোভনের প্রেম কাহিনী ৷ ক্যাম্পাসে তাদের সারাক্ষন একসাথে দেখা যেতো ৷ ওরা আবার একসাথে আড্ডাও দিতো সবাই মিলে ৷ দূর থেকে ওদের দেখতো রিমশা ! নিজেকে সে আরো চুপচাপ করে ফেললো ৷
নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করে দিলো ৷ পড়াশোনা ছেড়ে দিলো ৷ শুধু পরীক্ষার আগে আগে ক্লাসে যেতো ৷ রেজাল্ট খারাপ হয়ে গেলো ৷
সেকেন্ড ইয়ার শুরু হলো এভাবেই ৷ ইয়ার চেঞ্জের রেজাল্ট দেখে রিমশার বাবা খুব রাগারাগি করলেন ৷ রিমশা তাই চেষ্টা করলো সব ভুলে পড়ায় মন দিতে … পারলো না ! এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতো সে সঞ্চিতা আর শোভনকে , কিন্তু সম্ভব হতো না ! বারবার যেন ওরা দুজনই চোখের সামনে আসতো ঘুরে ফিরে !
এক তরফা প্রেম বড্ড বেশি ভয়ঙ্কর হয় ৷ এক তরফা প্রেমের আগুনের উত্তাপও থাকে অনেক বেশি ৷ সেই উত্তাপ একজন মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয় ..
রিমশাও জ্বলে পুঁড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছিলো ..
চলবে