#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩৫
মাহীরা ফারহীন
অস্থির মনে অনবরত পায়চারী করে যাচ্ছে মাহীন। বারংবার বিছানায় পরে থাকা সেলফোনটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে। টঙ্কস অলস ভঙ্গিতে বিছানায় বসে গা চাটতে ব্যস্ত। খোলা জানালা দিয়ে পর্দা ভেদ করে এক ফালি রোদ এসে পরেছে মেঝেতে। সেই রোদের পরশ বিছানা পর্যন্ত পৌঁছেছে। হঠাৎ করে টেইলর সুইফটের ‘বিগিন এগেইন’ গানটা বেজে উঠতেই টঙ্কস চমকে উঠল। মাহীনও ততক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে সেলফোনটা হাতে তুলে নিল। কিন্তু ক্রিনে ডিস্টার্বার লেখাটা দেখে বিরক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আবারও সেলফোনটা বিছানায় অযত্নের সঙ্গে ফেলে দিলো।
‘মিউ।’ করে উঠল টঙ্কস।
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘আহা নারে যার ফোনের অপেক্ষা করছি তার ফোন না এটা।’ টঙ্কস লেজ নেড়ে আবার গা চাটতে লাগল। ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। মাহীন জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বেশ বাতাস হচ্ছে। পর্দা উড়ে আসছে ভেতরের দিকে। কিছুক্ষণ পর আবারও একই গান বেজে উঠতে মাহীন আবারও ছুটে গেল ফোনের কাছে। এবার সাইলোহ ফোন দিচ্ছে। হতাশ হলেও ফোনটা রিসিভ করল। বলল,’হ্যালো, সাইলোহ?’
ওপাশ থেকে বলল,’হ্যালো মাহীন। শোনো পরশু দিন আমরা সবাই ক্যারোটের বাসায় যাবো। তুমি আসতে পারবা তো?’
এক মুহূর্তের জন্য ভাবল, আজ জরুরি কাজ আছে, কাল রায়েদের সঙ্গে বাইরে যাবো। তাহলে তো পরশু দিন ফ্রি থাকবো।’ ভেবে বলল, ‘হ্যা ঠিক আছে। আমি যেতে পারবো। কিন্তু তোমরা করবাটা কী?’
ওপাশ থেকে সাইলোর লম্বা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা গেল শুধু। তারপর বলল, ‘আপনি তো র্যবিট আর ক্যারোটের সেটআপের দায়িত্ব আমাদের ঘারে চাপিয়ে দিয়ে গায়েবই হয়ে গিয়েছেন। তাই আমরাই সব কিছু সামলাচ্ছি। অনেক কষ্টে ক্যারোটকে রাজি করিয়েছি।’
মাহীন জিজ্ঞেস করল,’কী বলে?’
‘আরেহ আমরা ওকে বলেছি ব্লাইন্ড ডেটে পাঠাচ্ছি ওকে। প্রথমে রাজি না হলেও অনেক কসরত করতে হয়েছে। তবে র্যবিটের সঙ্গে যোগাযাগ করে ফেলেছি। ও সবকিছুই জানে। পরশুদিন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার সময় ওদের পাঠাবো ডেটে।’
মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কেন?’
ওপাশ থেকে খটখট শব্দ হলো। তারপর গেল,
‘বলে করেছি…যাই হোক।’
মাহীন ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এ্যই লাইনে সমস্যা হচ্ছে। আমি শুনতে পাইনি আবার বলো।’
ওপাশ থেকে এবার বলল,’মানে ক্যারোট অন্য সময় আসতে পারবে না। দুপুরে ও ব্যস্ত থাকে। বিকেলেও আসতে পারবে না। সন্ধ্যায়ও ওর দাদি আসতে দিবেন না। এজন্যেই আমাদের যেতে হবে। আমাদের সাথে ঘুরতে যাচ্ছে বলে বাড়ি থেকে বের হবে ও।’
মাহীন বলল,’ওরে বাবা কত প্ল্যান প্রোগ্রাম।’
তারপর ফোন কেটে দিলো। মাহীন ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরল। ভাবল, ওফ একেই এক সমস্যা নিয়ে দিন রাত ঘোরের মধ্যে আছি। তারপর আরেকটা জিনিস নিয়ে ভাবার সময় কোথায় আমার। ওরাই সামলাক ওটা। যেহেতু এই ব্যাপারটা ওদের কাউকে বলতে পারবো না সেহেতু এটা আমিই দেখি।’ তখনই ফোনটা আবার বেজে উঠল।মাহীনের ভাবনার জাল ছিঁড়ে গেল। টঙ্কস এসে মাহীনের মাথার কাছে বসেছিল। মাহীন এখন লাফ দিয়ে উঠে বসতেই বিড়ালটা চমকে উঠল। এবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো, রাবিত ফোন দিচ্ছে। সাথে সাথে কলটা রিসিভ করল।তারপর উৎসুক কন্ঠে বলল,’ওখানে কী অবস্থা? উনি রাজি হয়েছেন?’
রাবিতের ক্লান্ত কন্ঠস্বর শোনা গেল। ও বলছে,
‘হ্যা অবশেষে মা আমার সাথে পার্কে হাঁটতে যেতে রাজি হয়েছেন। তুমি তাড়াতাড়ি মিসেস বিঙ্গকে নিয়ে চলে আসো।’
মাহীন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তারপর বলল,’ঠিক আছে চিন্তা করো না। আমি ওনার সাথে ওখানে পৌঁছচ্ছি।’ বলেই লাইন কেটে দিল। এবং প্রায় সাথে সাথেই কনক্যাক্ট লিস্টটা বের করে মিসেস বিঙ্গের নম্বরটা ডায়েল করল। কিছুক্ষণ রিং হতেই রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে বলল,’হ্যা মাহীন। উনি কী রাজি হয়েছেন?’
মাহীন কিছুটা উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,’হ্যা। আপনি তৈরি আছেন তো?’
‘হ্যা আমি তো তৈরি। তাহলে তুমি বাইরে বের হও। আমি তোমাদের বাড়ির সামনে আসছি।’
মাহীন সায় জানাল। তারপর লাইন কেটে দিলো।
.
.
.
প্রায় বিশ মিনিট পরের কথা, রাবিত ও মিসেস রহমান পার্কের একদিকের রাস্তা ধরে হাঁটছেন। প্রচুর হইহট্টগোলে পরিপূর্ণ পার্ক। কারণ এই এলাকার সমস্ত ছেলেমেয়েরা বিকেল বেলায় এই পার্কেই এসে জড়ো হয়। তবে চারিদিক সবুজে ভরা। বড় বড় গাছ পালার মাঝখান দিয়েই ছোটদের জন্য খেলাধুলার সরঞ্জামও রয়েছে। মিসেস রহমান হাঁটতে হাঁটতে বলছেন,’আচ্ছা একটা কথা বল। তুই হঠাৎ করে আজ আমার সাথে পার্কে হাঁটতে আসার জন্য এত পাগল হলি কেন?’
রাবিত অভিমানী কন্ঠে বলল,’কেন তোমার সাথে হাঁটতে আসতে পারি না? কতদিন কোথাও তো যাওয়াই হয় না।’
মিসেস রহমান সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। রাবিতের দৃষ্টি বারংবার এদিকসেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পর দেখতে পেল ওদের থেকে বেশ দূরে মাহীন সহ একজন ফর্সা সোনালী চুলো মহিলা এবং একটা ছোট বাচ্চা রয়েছে। রাবিত সাথে সাথে মোবাইলটা বের করল। এবং মাহীনকে টেক্সট করল। মিসেস রহমান থেকে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে হাঁটছে রাবিত।
ওদিকে মাহীনের সেলফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ শুনে ও সেলফোনটা হাতে নিল। রাবিতের টেক্সট করা জায়গা অনুযায়ী দূরে গাছে ঘেরা পথটা দিয়ে ওরা হাঁটছে। মাহীন মিসেস বিঙ্গকে বলল,’আপনি ওই দূরে লাল ইটে বাঁধা পথের দিকে যান। দেখবেন ফর্সা মতো লাল টি-শার্ট পরা একটি ছেলে এবং একজন মধ্য বয়সি মহিলা। অবশ্য ছেলেটা আপনাকে ইশারা দিলে আপনি যাবেন। উনি সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। তারপর নিচে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্র্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ফ্র্যাঙ্ক প্রথমে কিন্তু তোমার কাজ। মনে আছে তো কী করতে হবে?’
ফ্র্যাঙ্ক সায় জানিয়ে মাথা নেড়ে বলল,’ইয়েস মামা।’
তারপর ওরা এগিয়ে গেল। এবং মাহীন ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকল। ও যেতে পারবে না।
রাবিত খেয়াল করল মিসেস বিঙ্গ এবং তার ছেলে এদিকেই আসছেন। ও সঙ্গে সঙ্গে হাত নেড়ে ইশারা করল। উনি সেটা খেয়াল করে নিচে ঝুকে ছোট বাচ্চাটাকে কিছু একটা বললেন। পরমুহূর্তে বাচ্চাটা ছুটে আসল রাবিতের দিকে। হঠাৎ শক্ত করে ওর হাত আঁকড়ে ধরল। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,’আরেহ ভাইয়া! তুমি কতদিন পর আবার আসছ? মাঝে অনেক দিন আসোনি কেন?’
রাবিত হতবাক বনে গেল এক মুহূর্তের জন্য। এখানে বাচ্চাটার সঙ্গে আগে থেকে চেনা পরিচিত হওয়ার ভান করতে হবে মাহীন এমন কিছু তো আগে থেকে বলেনি।
তবে নিজেকে সামলে নিয়ে নরম কন্ঠে হাসি মুখে বলল,
‘অও! তুমি আমাকে মিস করসো? আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম তো কিছুদিন তাই আসা হয়নি।’ মিসেস রহমান পেছনে ঘুরে তাকালেন এবং থেমে গেলেন।
মিসেস বিঙ্গ তখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসলেন। মিসেস রহমান বললেন, ‘রাবিত এটা কে?’
রাবিত বলল,’আরেহ ও ফ্র্যাঙ্ক। আমার লিটল ফ্রেন্ড। প্রায় সময় এখানে দেখা হয়।’
সেলি ওদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। এবং রাবিতকে উদ্দেশ্য করে বললেন,’ওহ কেমন আছো তুমি?’
রাবিত হালকা হেসে বললো, ‘আমি তো ভালোই আছি।’ তারপর মিসেস রহমানের দিকে ইশারা করে বলল,’উনি আমার মা। দিলারা রহমান।’
মিসেস বিঙ্গ আন্তরিক হেসে বললেন,’হ্যালো মিসেস র্যহমান। আমি সেলি বিঙ্গ।’
মিসেস রহমানও হাসি মুখে বললেন,’হ্যালো মিসেস বিঙ্গ! আপনার সাথে বোধহয় রাবিতের প্রায়ই দেখা হয়।’
সেলি বললেন,’আমাকে সেলি বলবেন। এবং হ্যা আমি প্রায়ই ফ্র্যাঙ্ককে নিয়ে এখানে হাঁটতে আসি। এবং রাবিটও আসে। ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে ওর বেশ ভালো সম্পর্ক।’
মিসেস রহমান ফ্র্যাঙ্কের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘বাহ ভালোই তো। ওর কথা অবশ্য আগে কখনো রাবিত বলেনি আমাকে।’
ফ্র্যাঙ্ক রাবিতকে উদ্দেশ্য করে বলল,’ভাইয়া চলো না আমরা আইসক্রিম খেতে যাই।’ বলেই হাত ধরে টানতে লাগল। রাবিত তাড়াহুড়ো করে পেছনে ঘুরে বলল,
‘মা আমি আসছি।’ বলেই ফ্র্যাঙ্কের সঙ্গে ছুটে চলে গেল। এবং কিছুক্ষণের অন্তরে চোখের আড়ালে চলে গেল। মাহীন এদিকে একা একা ধীরে ধীরে হাঁটছে। রাবিত ওকে দেখা মাত্র ফ্র্যঙ্ককে নিয়ে ওর কাছে এসে পৌঁছলো। ওদের দেখা মাত্রই মাহীন উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল,’সব ঠিকঠাক মতো হয়েছে?’
ফ্র্যঙ্ক নিচ থেকে বলল, ‘এভরিথিং অন ফ্লিক!’
ওরা দুজন হাসল।
.
.
‘আপনাকে এর আগে কখনো দেখিনি এখানে আসতে। তেমন একটা আসেন না এদিকে?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন সেলি।
মিসেস রহমান বললেন,’আসি কদাচিৎ। তবে বেশির ভাগ সময় রাস্তায় হাঁটতে বের হই। পার্কে আসা হয় না।’
সেলি বললেন,’ওহ আচ্ছা। আমার ছেলেটাকে একাই প্রচুর সময় দিতে হয় তো। তাই প্রায় আমরা দুই মা ছেলে ট্রাভেল করে বেড়াই।’
মিসেস রহমান জিজ্ঞেস করলেন,’ওহ আর আপনার স্বামী? দেশের বাইরে থাকেন বা এমন কিছু?’
সেলি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,
‘আসলে আমার স্বামী বেঁচে নেই। কয়েকমাস আগে ক্যান্সার তাকে কেঁড়ে নিয়ে গেছে।’
মিসেস রহমান দুঃখিত কন্ঠে বললেন,’আই এম সরি।’
সেলি হালকা হাসার চেষ্টা করে বললেন,’নাহ ঠিক আছে। আমি এখন সামলে উঠেছি।’
তারপর একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করলেন,’আচ্ছা আপনার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলেন?’
ওনারা ধীরে ধীরে হাঁটছেন। লাল ইটে বাঁধা রাস্তার পাশে লম্বা গাছের সারি। বাতাসে গাছের ডালপালা দুলছে। লাল ইটের চিপা থেকে কোথাও কোথাও ছোট ছোট বুনো গাছ বেড়ে উঠছে। মিসেস রহমান এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন। তারপর বললেন,’আমি আমার শাশুড়ী এবং আমার এক ছেলের সঙ্গে থাকি।’
সেলি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,
‘ওহ আপনার এক ছেলেই?’
মিসেস রহমানকে কিছুটা বিচলিত দেখাল। তিনি ঘনঘন শ্বাস নিতে শুরু করেছেন। বললেন,’হ্যা।’ তার কন্ঠে সুক্ষ্ণ দৃঢ়তা ছিলো।
সেলি বলল,’ওহ এবং আপনার স্বামী?’
এখন মিসেস রহমানের অস্থিরতাটা বৃদ্ধি পেল বোধহয়। তিনি লম্বা এক শ্বাস ফেলে বললেন,’আমার স্বামী চার বছর আগে কার এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন।’
এবার সেলি তার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। অর্থপূর্ণ কন্ঠে বললেন, ‘যার যাওয়ার সময় হয় তাকে তো চলে যেতেই হয়। এতে কারোর কোনো হাত থাকে না। হয়তো কার এক্সিডেন্ট একটা অছিলা ছিল। যেমনটা আমার হাসবেন্ডের ক্ষেত্রে ক্যান্সার ছিলো।’
মিসেস রহমান অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে চাইলেন সেলির দিকে। কিন্তু কিছু বললেন না। তারপর কিছুক্ষণ তারা নিশ্চুপ ভাবেই হেঁটে গেলেন। অবশেষে মিসেস রহমান জিজ্ঞেস করলেন,’তো আপনি এবং আপনার ছেলে একাই থাকেন। তাহলে আপনি কী করেন?’
সেলি বললেন,’আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট।’
মিসেস রহমান সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। সেলি বললেন,’আপনার ছেলের সাথে দেখা হলে প্রায়ই ও নিজের সমস্যার কথা আমাকে বলে। ফ্র্যঙ্কের সঙ্গে কথা বলে, খেলেও।’
মিসেস রহমান হালকা হাসলেন। বললেন,’ওহ তাই। ও অনেক উদ্যমি। প্রতিদিন বাসায় এসে আমার কাছে ও কী করে না করে সবই উগলে দেয়। তবে আপনার কথা কখনোই বলেইনি।’
সেলি শ্রাগ করে বললেন,’কি জানি। আমার কথা মনে থাকে না বোধহয়।’ বলে চুপ করে গেলেন। সামনে রাস্তার পাশে একটা মস্ত আইসক্রিমের মতো দেখতে আইসক্রিম ভ্যান। এর সামনে ছেলেমেয়েদের বেশ ভির দেখা গেল। রাবিত ও ফ্র্যাঙ্ক আইসক্রিমের অছিলায় গেলেও আসলে তাঁরা এর ধারের কাছেও নেই।
সেলি অবশেষে আবার কথা শুরু করলেন, ‘এই পার্কে আসি এবং দেখি আজকালকার ছেলেমেয়েদের কত সমস্যা। কেউ কেউ একা বিষন্ন ভাবে বসে থাকে। অনেকের সঙ্গে মাঝেমাঝে কথাও বলি। দেখা যায় বেশির ভাগেরই পারিবারিক সমস্যা। অবশ্য অনেকের অন্যান্য সমস্যাও থাকে। খারাপও লাগে ওদের জন্য। কিন্তু এর চেয়ে বেশি আর কীই বা করতে পারি?’
মিসেস রহমান গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়লেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,’কত পরিবারে কত রকমের সমস্যা থাকে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারোর কিছু করারও থাকে না।’
সেলি বললেন,’এইসব পারিবারিক সমস্যার কারণে দেখেছি অনেক কিশোর কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। পারিবারিক সমস্যার কারণে ডিপ্রেশন, ট্রোওমায় ভোগে। অনেকের ক্ষেত্রে সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যায়। অনেকের অন্য কোনো মানসিক সমস্যা দেখা দেয় হয়তো। বড়দের ক্ষেত্রেও এমন সমস্যা দেখা দেয়।’
মিসেস রহমান বললেন,’তা ঠিক। আমার স্বামী যখন মারা গেলেন তখনকার সময়গুলো যে কিভাবে কেটেছে আমার আসলে কিছুই মাথায় নেই। মাঝে মাঝে ভাবি রাবিতের ওপর দিয়ে কি গিয়েছে, মায়ের ওপর দিয়ে কি গিয়েছে।’
সেলি ভ্রু কুঁচকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,’আপনি কী সেই সময়ের কথা মনে করতে পারেন না?’
মিসেস রহমান বললেন,’পারি। তবে সে অনেকদিন আগের কথা। কোনো কোনোদিন বোধহয় ঘোরের মধ্যে থাকতাম। তখন যে বাসায় কার সাথে কী হচ্ছিল তা বলতে পারি না।’
সেলি শান্ত কন্ঠে বলল, ‘আপনি একটা মানসিক ট্রোওমার মধ্যে ছিলেন।’ তারপর থেমে আবার বললেন,
‘তখন কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাননি?’
মিসেস রহমানের বুক চিরে লম্বা এক নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসল। উনি স্তিমিত কন্ঠে বললেন,’না। আমি তো সময়ের সাথে সাথে সামলে উঠেছিলাম।’
সেলি এবার কিছুটা সাবধানতার সঙ্গে বললেন,
‘আমার কী মনে হয় জানেন তো আপনার সেই সময় একবার অবশ্যই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিৎ ছিলো। আপনি না হলেও আপনার পরিবারের সদস্যদের এটা করা উচিৎ ছিলো। কারণ…বলে একটু থামলেন। মিসেস রহমান আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তারপর সেলি বলে গেলেন,’কারণ অনেক সময় হয়তো আমরা আমাদের ডিপ্রেশন এবং ট্রোওমাকে পাত্তা দেই না। তবে সেটা আমাদের মস্তিষ্কের কোন অংশে যে প্রভাব ফেলবে তা কেউ জানে না। মস্তিস্ক বড়ই রহস্যময় ও স্পর্শকাতর এক জিনিস। আপনি হয়তো বুঝতেও পারবেন না যে, আপনার মস্তিষ্কে কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা রয়েছে। তবে সেটা অন্যদের চোখে ধরা দেবে।’
মিসেস রহমান এবার ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। জিজ্ঞেস করলেন,’আমার মধ্যে কী কোনো অস্বাভাবিকতা আছে বলে মনে হয়?’
সেলি হাসলেন। বললেন,’তা তো আমি বলতে পারছি না। তবে আমি আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলিনি। আমার সাইকিয়াট্রিস্ট জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। এমন অনেক রোগী দেখেছি, যারা একদম স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা ভাবনা করছে। তবে তাদেরও কোনো মানসিক সমস্যা রয়েছে হয়তো যেটা তাদের আপনজনদের কাছে ধরা দেয়। এই যেমন পিটিএসডি, বাইপোলার বা ডিসথেমিয়ার রোগী।’
মিসেস রহমান সায় জানিয়ে মাথা নাড়লেন। বললেন,
‘তা ঠিক। যদিও সে সময় কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাইনি। এমনিতে সব ঠিকঠাকই চলে। তবে আমার মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে। মাঝে মাঝে ব্ল্যাকআউট হয়ে যায় সবকিছু। কারো কারোও জন্য অকারণেই অস্বাভাবিক অনুভূতি হয়।’
সেলি এবার চিন্তিত স্বরে বললেন,’যেমন?’
মিসেস রহমান এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বললেন,’যেমন অকারণেই হয়তো কারোও ওপর অত্যন্ত রাগ হয়। আমি এই জিনিসটা অনেক লম্বা সময় ধরে খেয়াল করছি। আমার মন ভালোই আছে। কিন্তু হঠাৎ করেই কাউকে দেখলে আমার রাগ হয়। তাকে জাস্ট সহ্য করতে পারি না। তখন মাথাও ঝিমঝিম করে।’
সেলি বললেন, ‘কাকে দেখলে? কোনো নির্দিষ্ট মানুষ?’
মিসেস রহমানকে বিভ্রান্ত দেখা গেল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলেন। ভাবছেন, ওনাকে আমি চিনিও না অথচ এত কথা বলে দিচ্ছি। তা কী ঠিক হবে? আজই মাত্র প্রথম দেখা। কিছুই জানি না ওনার সম্পর্কে। যদিও তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। কিন্তু আমার সমস্যা কী আসলেও মানসিক সমস্যার মধ্যে পরে? কখনো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু আসলেও কী রায়েদকে দেখলেই আমার যে অদ্ভুত এক রাগ হয় ওর প্রতি এটা কী স্বাভাবিক নাকি কোনো মানসিক সমস্যা? যতবারই ভাবার চেষ্টা করি ওকে দেখলেও শান্ত থাকবো। তাও তো পারি না। তাহলে এটা কী ওনাকে জানানো উচিৎ না? যেহেতু উনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। এবং এমনিতেও ঘটা করে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো আমার হবে বলে মনে হয় না।’
সেলির ডাকে চমকে উঠলেন মিসেস রহমান। তার চিন্তা ভাবনায় ছেদ পরল। সেলি এখনো প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। মিসেস রহমান অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলেন,’রায়েদকে দেখলে।’
‘রায়েদ কে?’
মিসেস রহমান একমুহূর্ত দ্বিধা করে বললেন,
‘আমার আরেক ছেলে।’
সেলি বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকালেন। যদিও তিনি এটা পূর্বেই জানতেন তবে মিসেস রহমানের সামনে তাকে অপরিচিতার ভানই ধরে থাকতে হবে। কিছুক্ষণ একই ভাবে চেয়ে থাকার পর অবশেষে বললেন,’আপনি তো প্রথমে বলেছিলেন আপনার এক ছেলে!’
মিসেস রহমান বিচলিত এবং বিব্রতবোধ করলেন। প্রবল বেগে বাতাস হচ্ছে। হালকা ধুলাবালিও বাতাসের সঙ্গে উড়ে আসছে। সূর্যের আলোর তেজ কমেছে। মেঘেরা সূর্যকে বারবার ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে। মিসেস রহমান নিশ্চুপ রইলেন। কিছুক্ষণ পর অবশেষে বললেন,’ওকে আমার ছেলে বলে মানতেই কষ্ট হয়। এমন অনুভূতির কারণ আমি নিজেও বলতে পারবো না।’
সেলি এবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ধীরে ধীরে শান্ত কন্ঠে বললেন,’বুঝতে পারছি। এটা আপনার জানারও কথা নয়।’
মিসেস রহমান ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালেন। প্রশ্ন করলেন,’মানে?’
এবার সেলি শুষ্ক ঠোঁটের ওপর থেকে জ্বিব বুলিয়ে নিয়ে ঠোঁট জোড়া ভেজালেন। কিছু একটা বলার জন্য লম্বা শ্বাস ফেলে প্রস্তুত হলেন। এবং শান্ত গলায় বললেন,
‘আসলে সবই ঠিক আছে কিন্তু তবুও কিছু একটা ঠিক নেই। আমি জানি না আপনার এবং আপনার ছেলের মধ্যে কী হয়েছিল। তবে নিজের ছেলের প্রতি এমন অনুভূতি হওয়াটা মোটেও স্বাভাবিক নয়। এবং আপনার অন্যান্য সমস্যা যেমন মাঝে মাঝে ব্ল্যাকআউট হয়ে যাওয়া এসবও স্বাভাবিক নয়। আপনাকে সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে একটা পরামর্শ দিবো।’ বলে একটু থামলেন। তারপরও ইতস্তত না করে পরিষ্কার ভাবে বললেন,’আপনি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখান।’
মিসেস রহমান কিছুক্ষণ ভাবলেন। তার কপালে চিন্তার স্পষ্ট রেখা। তিনি বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর মৃদু কন্ঠে বললেন,’দেখি।’
সেলি চোখের কোণ দিয়ে একবার মিসেস রহমানকে দেখলেন। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে ভাবলেন, বুঝেছি ওনার সমস্যাটা আসলে তেমন কিছুই না। যদি এখন ম্যহীন এবং রাবিট ওনাকে রাজি করিয়ে আমার কাছে অফিশিয়ালি আনতে পারে তাহলেই হবে। কারণ শুধু কাউন্সিলিং এ কাজ হবে না। তাকে ঔষধ দেওয়া লাগবে। তার ‘অ্যমিগডালার’ কার্যক্রম ঔষধ ছাড়া ঠিক হওয়া মুশকিল।’
ইনশাআল্লাহ চলবে।