#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩৬
লেখনী মাহীরা ফারহীন
উইকেন্ড ডেতে প্রতিটা দর্শনীয় স্থানেই পা ফেলা যায় না এমন অবস্থা নতুন কিছু নয়। আজও তেমনই এক অবস্থা। ক্যালিফোর্নিয়া সর্বদাই বড় বড় থিম পার্কের জন্যে বিশ্ববিখ্যাত। পরিষ্কার প্রগাঢ় নীল আকাশ। নীল আকাশের ক্যানভাসে সাদা সাদা রেখা। ফুরফুরে বাতাস বইছে। মাত্র রায়েদ ও মাহীন হাঁটতে হাঁটতে ডিজনিল্যান্ডের সামনে পৌছালো। এটা ক্যালিফোর্নিয়ার ‘এনাহেইম’ শহর। স্যান্টা মনিকা থেকে মেট্রোতে চল্লিশ মিনিট লেগেছে এখানে এসে পৌঁছতে। টিকেট কেটে ওরা দুজন গেটের দিকে এগিয়ে গেল। মিষ্টি উষ্ণ রোদে মেখে আছে চারিদিক। বিকেল পাঁচটা বাজে সবে। ডিজনিল্যান্ডের গেট একটি বড় প্রাসাদের মতো। এই প্রাসাদের তলদেশ হতেই ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। মানুষের ভিড় স্রোতের মতো ভেতরে প্রবেশ করছে। রায়েদ ও মাহীন ভেতরে প্রবেশ করল। সম্পূর্ণ জায়গাটিতে মার্বেল পাথরের মেঝে। ঠিক ডিজনি মুভি গুলোর ঘরবাড়ি মতো করে সারি সারি ঘরবাড়ি বানিয়ে একটি ছোটখাটো টাউন তৈরি করা হয়েছে। এদিক ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকা উজ্জ্বল সবুজ পাতায় ছাওয়া গাছগুলোর পাতাকে ছেঁটে চতুর্ভুজ আকৃতির করা হয়েছে। মাহীন উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,’আহ মনে হচ্ছে কোনো ডিজনি মুভির শহরে চলে এসেছি।’
রায়েদ বলল,’হুম আমি শেষ যখন এসেছিলাম তখনকার থেকে অনেক কিছুই পাল্টে ফেলা হয়েছে। যদিও প্রাসাদের মতো গেটটা একই রয়েছে।’
ওরা ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে। মাহীন বলল,’প্রিন্সেস মুলানের সেটটা যেখানে ওখানে গিয়ে আমরা ছবি তুলবো। এই জায়গা খুব সুন্দর।’
রায়েদ বলল,’ওইটা তো বোধ-হয় আশেপাশেই কোথাও রয়েছে।’
কিছুক্ষণ পরপরই এদিক ওদিক থেকে বিভিন্ন ডিজনি চরিত্র যেমন, মিকিমাউস, ওলাফ, জুটোপিয়ার ফক্সের পোশাক পরা মানুষদের দেখা যাচ্ছে। তাড়া সাধারণত ছোট বাচ্চাদের আদর করছে এবং তাদের সাথে খেলছে। কোথাও কোথাও কোনো না কোনো মুভির মিউজিক বাজচ্ছে মৃদু স্বরে। মাহীন কোলাহলের মাঝে কান পেতে শোনার চেষ্টা করে বলল, ‘এটা ‘আপের’ মিউজিক না?’
রায়েদ বলল,’হ্যা। ওইটাই তো মনে হচ্ছে।’
মাহীন সামনে ইশারা করে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল,
‘দেখো আপের বেলুন বাড়িটা!’
রায়েদ সামনের দিকে তাকাল। একটা বারো তেরো ফুট উঁচু নানা রঙের রঙিন বাড়ি। তারপর ছাদের চিমনি মুখ থেকে প্রায় শতশত রঙিন বেলুন উড়ছে। দূর থেকে দেখলেও এই নানা রঙের বেলুনের সমাহারটা চোখে লাগার মতো। রায়েদ বলল,’এবং দেখো বাড়ির দরজার সামনে বারান্দায় রাসেলও রয়েছে।’
মাহীন হেসে বলল,’হ্যা। কি কিউট বাচ্চাটা।’
ওরা সামনে এগিয়ে গেল। রায়েদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা তুমি তিনদিন আগে আমাদের বাসায় এসেছিলা। তাই না?’
মাহীন ইতস্তত করে বলল, ‘হ্যা গিয়েছিলাম তো।’
রায়েদ বলল,’হুম জানালা দিয়ে দেখলাম তুমি, রাবিত এবং দাদি বসে খুব জরুরি কিছু আলোচনা করছিলা। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে তুমি আমার সাথে না দেখা করেই চলে গেলা।’
মাহীন জ্বিব কামড়াল। তারপর কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে অবশেষে বলল,’হ্যা গিয়েছিলাম মিসেস মাদির সঙ্গে কথা বলতে। পরে রাবিতও আমাদের জয়েন করেছিল।’
রায়েদ বলল,’তো সেদিন তুমি দাদির সাথে যেই কথা বলতে যাচ্ছিলে সেটা তোমার বাকিই ছিলো?’
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। রায়েদ চোখ সরু করে ওর দিকে চাইল। বলল,’উমহু তুমি আসলে কী করছো বলোতো? অন্য কোনো কারণে তুমি ওখানে গিয়েছিলা। যেটা তুমি আমাকে বলছো না।’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘অন্য আর কী কারণ থাকতে পারে।’
রায়েদ সামনের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘হ্যা এর আগে যতবার এভাবে বলেছো যে, তুমি কিছুই করছো না। ততবারই দেখা গিয়েছে তুমি আসলে কিছু একটা তো ঘটনা ঘটাচ্ছ।’
মাহীন অবশেষে বলল,’আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। আমি তোমার বাসায় অন্য কারণেই গিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার সাথে দেখা করিনি কারণ আমি তখন তোমাকে ব্যাপারটা জানাতে চাইনি।’
রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, ‘তাহলে এখন বলো।’
মাহীন ইতস্তত করে বলল,’এখনো বলতে পারবো না। দেখো তুমি আমাকে দুই মাস সময় দাও। তারপর আমি তোমাকে শান্তিতে সব বলবো। তখন জানলে তোমার যেমনটা লাগবে এখন জানলে আর ওমন লাগবে না।’
রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলল,’দুইমাস! মনে হচ্ছে অনেক বড় কিছু করছো। আল্লাহই জানে কী করছ।’
মাহীন কিছুই বললো না। দেখা গেল ওদের থেকে কিছুটা দূরেই ‘মুলান’ মুভির সেটটা শুরু হয়েছে। মাহীন প্রসন্ন কন্ঠে বলল, ‘দেখো আমরা মুলানের কিংডোমে পৌঁছে গিয়েছি।’
বলে আগে আগে এগিয়ে চললো। এই জায়গাটার পরিবেশটাই অন্য রকম। ঘরবাড়িগুলো মাটির। কিছু কিছু ঘরের ওপর খড়ের ছাদ। মাঝে লম্বা লম্বা ঝুলন্ত পাতাওয়ালা গাছে ঘেরা বড় একটা ঐতিহাসিক চাইনিজ বাড়ি। ঠিক প্রাচীণ চাইনিজ বাড়িগুলো যেমন হতো সেরকম। এর পাশের সবুজ পানির একটা কৃত্রিম পুকুরও রয়েছে। রায়েদ বলল,’তো এখানেই ছবি তুলবা তুমি?’
মাহীন নিজের সেলফোনটা হাতে নিয়ে বলল,
‘হ্যা।’ তারপর একজন মধ্য বয়সি মহিলাকে দেখে বলল,’এক্সকিউজ মি।’
মহিলা থেমে দাঁড়ালেন তার সাথে আরেকজন ফর্সা লোকও থেমে দাঁড়াল। মাহীন বলল, ‘আপনি কী আমাদের কিছু ছবি তুলে দিতে পারবেন?’
মহিলা আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, ‘অবশ্যই।’ বলে মাহীনের হাত থেকে মোবাইলটা নিল। মাহীন ও রায়েদ পাশাপাশিই সেই সবুজ পানির কৃত্রিম পুকুরটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলা একটা ছবি তুলে বললেন,
‘আরেহ তোমরা এত দূরে দূরে কেন? একসাথে লেগে দাঁড়াও।’
ওরা আসলেই পাশাপাশিই দাঁড়িয়ে ছিল তবুও কয়েক ইঞ্চির দূরত্বে। এবার ওরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াল। মহিলা ছবি তুলছেন। ওনার সাথে থাকা লোকটা বলল,
‘হেই তোমরা কী ধরনের কাপল? সিরিয়াসলি তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে দুজন অপরিচিত মানুষ প্রয়োজনে ছবি তুলতে হচ্ছে বলে তুলছে।’
মাহীন কিছুটা বিচলিত হলো। রায়েদ এক মুহূর্ত দ্বিধা করে ওর ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। মাহীন ওর বাহু জড়িয়ে ধরে হাসি মুখে দাঁড়াল। এবার মহিলা আরো কয়েকটা ছবি তুলে মোবাইলটা ফেরত দিতে দিতে বললেন,’ইট ওয়াজ এ লিট!’
রায়েদ ধন্যবাদ জানালা। ওনারা চলে গেলেন। মাহীন ও রায়েদও আবার হাঁটতে শুরু করল। মাহীন ভুলেই গিয়েছে যে ও রায়েদের বাহু জড়িয়ে ধরে আছে। রায়েদ খেয়াল করল বিষয়টা কিন্তু কিছুই বললো না। ওদের সামনে দিয়ে মিকিমাউসের স্ক্রুজ ম্যাকডাকের পোশাক পরা কেউ যাচ্ছে। রায়েদ বলল,’মাহীন দেখো স্ক্রুজ ম্যাকডাক। একে ছোট বেলায় আমি এত ভয় পেতাম যে এখানে এলেই শুধু আতঙ্কে থাকতাম কখন না সামনে এসে পরে।’
মাহীন হেসে বলল,’তাই? লিটল মার্মেইডে যে একটা ডাইনি ওয়ালা অক্টোপাস ছিলো ওকে আমার খুব ভয় লাগলো।’
‘ওকে অনেকেই ভয় পেত।’ বলল রায়েদ।
এবার ওরা ‘কারস’ মুভির সেটের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। এখানে কারস মুভির বিভিন্ন গাড়িতে করে সকলে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। জায়গাটাকে গাড়ি ঠিক করার দোকানের মতো সাজানো হয়েছে।
সামনে হাওয়াই মিঠাই তৈরি হচ্ছে।মাহীন হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘চলো না আমরা হাওয়াই মিঠাই নেই।’
রায়েদ সেদিকে তাকিয়ে বলল,’হ্যা চলো।’ ওরা এগিয়ে গেল সেখানে। স্নো হোয়াইটের মতো পশাক পরা একজন কিশোরী হাওয়াই মিঠাই তৈরি করছে। এখানে ছেলে মেয়েদের বেশ ভির রয়েছে। ওরা দুজন একটাই হাওয়াই মিঠাই কিনল। রায়েদ সেটা ধরে রেখেছে। মাহীন বলল,’হাওয়াই মিঠাই দেখে অকুয়ামারিন এর কথা মনে পরল। দেখেছ ওটা?’
রায়েদ বলল,’হ্যা দেখেছি। অকুয়ামারিনের কটন ক্যান্ডি খাওয়ার দৃশ্যর কথা মনে পরেছে?’
মাহীন মুখে হাওয়াই মিঠাই দিয়ে সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। রায়েদ বলল,’ওটা বেশ ক্রিন্জি না?’
মাহীন হালকা হেসে বলল,’তা বটে। তবুও ওটা আমার অতি পছন্দের মুভি। ওটা দেখার পর ফ্লোরিডা কী ভালোটাই না লেগেছিল।’ শেষ কথাটা আফসোসের সঙ্গে বলল।
রায়েদ হেসে বলল,’তারপর তুমি জানতে পেরছ যে ওটা অস্ট্রেলিয়ায় শুট করা হয়েছিল?’
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। রায়েদ বলল,’আগে অনেক মুভি দেখা হতো। এখন কদাচিৎ দেখা হয়।’
মাহীন জিজ্ঞেস করল,’হলে গিয়ে দেখো?’
রায়েদ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ‘শেষ গিয়েছিলাম বোধহয় গত বছর ডিসেম্বরে।’
মাহীন হতাশ কন্ঠে বলল, ‘আমি কখনো হলে গিয়ে মুভি দেখিনি।’
রায়েদ অবাক হয়ে বলল,’সিরিয়াসলি? মানে তুমি কখনো মাছ ধরতে দেখোনি কাউকে। এবং মুভি হলে গিয়ে মুভিও দেখোনি?’
মাহীন নিরাশ কন্ঠে বলল, ‘আরো অনেক কিছুই সকলে সাধারণ ভাবেই করে থাকে যেটা আমি কখনো করিনি।’
রায়েদ বলল,’ওয়েল এখানে ভালো ভালো হলের অভাব নেই। কখনো গিয়ে দেখিও।’
মাহীন বলল, ‘অবশ্যই। কেমন হয় যদি আমরা মুভি দেখতে যাই?’
রায়েদ ওর দিকে ভ্রু উঁচু করে তাকাল। মুচকি হেসে বলল,’অসাধারণ হয়।’ তারপর একটু থেমে আবার বলল,’তোমার অসম্পূর্ণ ইচ্ছাগুলো বোধহয় আমাকে নিয়েই পূরণ করবা।’
মাহীন ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি বজিয়ে রেখে বলল,’সম্ভবত।’
ওরা হেঁটে চলেছে একটি ব্রিজের ওপর দিয়ে। ছোট কাঠের ব্রিজ। তার নিচে কৃত্রিম সবুজ পানির পুকুর। তার ওপাশে স্নো হোয়াইটের সেই বাড়ি এবং তার সামনে অনেকগুলো ছোট ছোট বামন দাঁড়িয়ে আছে।
মাহীন বলছে,’আমার মনে হচ্ছে ক্যালিতে আসার পর তোমার সাথেই সবচাইতে বেশি ঘুরতে যাওয়া হয়েছে আমার।’
রায়েদ মুচকি হেসে বলল,’ওহ কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে মাত্র কয়েকবারই একসাথে সময় কেটেছে আমাদের।’
মাহীন বলল,’হুম তা ঠিক তবে খেয়াল করে দেখ সেই কয়েকবারই কিন্তু অন্যদের তুলনায় বেশি।’
তখন প্রায় ছয়টা বিশ বাজে সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সময় সূর্য যেই সোনালি রোদ বিকিরণ করছে তার আলোয় চারিদিকের সবকিছুকেই সোনালি লাগছে। নীল আকাশে ছন্নছাড়া তুলোর মতো ছোট ছোট মেঘ। সরাসরি অস্তগামী সূর্যের আলো গায়ে পরলে অদ্ভুত সুন্দর লাগে। মনটাও স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে ওঠে। রায়েদ বলল,’হিয়ার উই গো এগেইন!’
মাহীন বলল,’ঠিক আবার আমরা এবং সূর্যাস্ত মুখোমুখি।’
রায়েদ বলল,’এটা আমাদের তৃতীয় বার একসাথে সূর্যাস্ত দেখা।’
ওরা ডিজনিল্যান্ডের মাঝে থাকা ছোট লেকটার সামনে দাঁড়িয়ে। লেকের ওপারে বড় ফেরিস হুইল এবং রোলারকোস্টার টা দেখা যায়। মাহীন হঠাৎ উত্তেজিত কন্ঠে বলল,’রায়েদ! ফেরিস হুইল!’
রায়েদ অবাক হয়ে বলল,’তুমি ফেরিস হুইলে উঠবা?’
মাহীন উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘হ্যা। চলো ফেরিস হুইল থেকে সূর্যাস্ত দেখি।’
রায়েদ বলল,’তাহলে তাড়াতাড়ি চলো। ওটা এবার চালু হয়ে সূর্য ডোবার পর নিচে নামবে।’
ওরা দ্রুত গতিতে হাঁটতে লাগল। গোলাকার ছোট লেকটা পার করে ফেরিস হুইলের সামনে এসে দাঁড়াল। ওটাকে এখন বিশাল চাকার মতো দানব বলে মনে হচ্ছে। ফেরিস হুইলের কেন্দ্রতে মিকিমাউসের একটা মুখের একটা মূর্তি। ওরা টিকেট কাটলো পাশের কাউন্টার থেকে। তারপর হুইলের একটা বুথে উঠে বসল। রায়েদ জিজ্ঞেস করল,’তোমার ভয় লাগে না তো?’
মাহীন হেসে বলল,’ভয় লাগবে কেনো? আমার তো ছোট বেলা থেকেই ফেরিস হুইল এবং রোলারকোস্টার দুটোই পছন্দ।’
রায়েদ বলল,’এখন বলো আবার রোলারকোস্টার এ উঠবা। আমার কিন্তু মাথা ঘোরে।’
মাহীন বলল,’ঠিক আছে ঠিক আছে। চিন্তা করো না। আমরা রোলারকোস্টার এ উঠবো না।’
তখনই একটা জোরে যান্ত্রিক শব্দ হলো। এবং ফেরিস হুইলটা চলতে শুরু করল। ওদের বুথের বাম দিক দিয়েই পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে এনাহেইম শহরের ঘরবাড়ি এবং আকাশ গিয়ে দিগন্তে মিশেছে। আকাশের বুক থেকে লাল টকটকে সূর্যটা যেন ধিরে ধিরে শহরের মধ্যেই পিছলে পরে যাচ্ছে। আকাশের বর্নিল পটভূমিতে সোনালি রোদে মাখা মেঘগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। মাহীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ রায়েদের দিকে দৃষ্টি ফেরাল। দেখলো রায়েদ ওর দিকেই আবিষ্টমনে তাকিয়ে আছে। মাহীন বলল,’এর আগেও বলেছি না আমি সূর্যাস্ত, সূর্যোদয় থেকে বেশি সুন্দর নই। আমার দিকে তাকিয়ে না থেকে ওদিকে দেখো।’ রায়েদ মাহীনের হাত দুটো ধরল। আমুদে গলায় বলল, ‘ওহ তাই? তোমাকে কে বলেছে তুমি সূর্যাস্ত থেকে কম সুন্দর।’
মাহীন লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিলো। সূর্যের সোনালি আলো সরাসরি ওদের ওপর পরেছে। মাহীনের গালে হালকা লালাভা ফুটে উঠলো। ফেরিস হুইলটা ঘুরছে। ধীরে ধীরে বুথটা উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। মাহীন বলল,’আমি আগে থেকেই জানতাম আমাকে খুন করার একটা মতলব তোমার ছিলো। এখন দেখছি সেটা ইমোশনালি খুন।’
রায়েদ হাসল এবং বাইরে ডুবন্ত সূর্যের দিকে দৃষ্টি ফেরাল।কিছুক্ষণ পর সূর্য সম্পূর্ণ অদৃশ্য হয়ে গেল। তবে কিছুক্ষণ পূর্বে যেখানে অবস্থান করছিল সেখানটায় লাল আবির ছড়িয়ে দিয়ে গিয়েছে। লাল আকাশের বুকে সোনালী আঁচড়। মাহীন প্রসন্ন কন্ঠে বলল,
‘তিনবার সূর্যাস্ত দেখা এবং একবার সূর্যোদয় দেখা হলো।’
রায়েদ আমুদে বলল,’সিমস লাইক তোমাকে নিয়ে এখন আবার সূর্যোদয় আবার দেখা লাগবে।’
মাহীন মুচকি হেসে বলল,’সূর্যোদয়টাও প্রতিদিনই হয়। দুঃখের বিষয় হলো সেটা ধরতে হলে কিছু কাঠখড় পোড়াতে হয়।’
রায়েদ বলল,’তা বৈকি।’ তারপর হঠাৎ মাহীনের দিকে চেয়ে থেকে ভাবনায় ডুবে গেল, কিছু কিছু মানুষ এমনই যাদের পারসনালিটিটাই অন্য রকম। তারা একবার কিছু বলে দিলে মনে হশ সেটা যতই অসম্ভব হোক না কেন সে ঠিকই উতরে যাবে। মাহীনও ঠিক সেরকম। ওর সাথে থাকলে মন হয় সবই সম্ভব। ও ঠিক জাদুর মতো কাজ করে। ওর অওরাটাই ম্যাজিকাল। যখন থেকে ওর সাথে দেখা হয়েছে তখন থেকেই মনে হয়েছিল ও যেভাবেই হোক আমার জীবনের রঙই পাল্টে দেবে। আমার বেরঙ জীবনের কতশত রঙের সমাহর ঘটিয়ে দিলো। আসলেই ওকে এখন আর সন্দেহ করার সাহস হয় না। ও যাই করছে ভেবে চিন্তেই করে। শুধু যে ওর দ্বারাই সব সম্ভব তাই নয়। এখন তো আমারও মনে হতে শুরু ওর জাদুর প্রভাবে ওকে ভালোবেসে ফেলাটাও আমার জন্য অসম্ভব নয়।’
সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ার পর ওরা ডিজনিল্যান্ডে আর থাকলো না। এখান থেকেই কাছাকাছি কোনো রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার করেই তারপর ট্রেন ধরবে ঠিক করল ওরা। ডিজনিল্যান্ডের আশেপাশের এলাকা অতি জাঁকজমকপূর্ণ। চারিদিকে যতই এগিয়ে যায় রাস্তার দুপাশে থাকা গাছগুলো মরিচ বাতিতে জর্জরিত। ওরা ওখানেই একটা টার্কিশ রেস্টুরেন্টে ঢুকল। মূলত মাহীনের ইচ্ছায়। কাঁচের দেয়ালের পাশেই একটা টেবিলে বসেছে ওরা। কাঁচের দেয়াল ভেদ করে ওদের পাশ দিয়েই ফুটপাথ ধরে মানুষজন এগিয়ে যাচ্ছে। ফুটপাথের পাশের গাছগুলোর মরিচ বাতিগুলো ঝলমল করছে। রেস্টুরেন্টটাও বেশ জমজমাট। মাহীন প্রফুল্ল কন্ঠে বলছে,
‘তো এবার তুমি আমাকে টার্কিশ খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিবা।’
রায়েদ মুচকি হেসে বললো,
‘ওয়েল ঠিক আছে। মেনুতে দেখা যাক এখানে কী কী আছে।’ বলেই ও মেনুটা হাতে তুলে নিল।
মাহীনও টেবিলে রাখা আরেকটা মেনু হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। তারপর মেনুটা মুখের সামনে ধরে রেখেই বলল,’ইসকেন্দার কেবাব কেমন?’
রায়েদ বলল,’উম মজা তো।’
‘তাহলে এটা নিব।’
রায়েদ বলল, ‘ইনেগোল কোফতে?’
এক মুহূর্তের জন্য মেনুটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে বলল,’কোফতা আমার ভয়াবহ পছন্দ! যেমনই হোক আমি নিব।’
রায়েদ মুচকি হাসল। এবার মাহীন জিজ্ঞেস করল,
‘আচ্ছা তোমার কী পছন্দ?’
রায়েদ একটু ভেবে বলল,’মান্তি।’
‘এটা খেতে কেমন?’
‘এটা একধরনের ডাম্পলিং। বিফ দিয়ে তৈরি করা হয় তবে একটু ক্রিমি ক্রিমি হয়।’
মাহীন বলল,’এটাও অর্ডার দাও।’
রায়েদ সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল।
মাহীন আবার বলল,’এবং মেনেমেনটাও অর্ডার দিবো।’
রায়েদ বলল,’এতগুলো খাবার তুমি আদৌ শেষ করতে পারবা তো?’
মাহীন বলল,’তুমিও তো আছো সাথে।’
রায়েদ হালকা হেসে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওরা এরপর খাবার অর্ডার দিল। এবার মাহীন জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা তুমি কখনো তুরস্ক গিয়েছো?’
রায়েদ বলল,’নাহ। আমরা টার্কিশ ঠিকই। টার্কিশ বলতেও পারি ঠিকই। কিন্তু সেই দেশের সিটিজেন না।’
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। তারপর বলল,
‘আচ্ছা আমাকে কিছু ইউনিক টার্কিশ ফ্রেজ শিখাও।’
রায়েদ হাসল। বলল,’তুমি আমার কাছ থেকে টার্কিশ শিখবা?’
মাথা জোড়ে জোড়ে ডানে বামে মাথা নেড়ে বলল,
‘না এখন না। আমি বলছি শুধু কয়েকটা ফ্রেজ শিখাও।’
রায়েদ কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর হাসি মুখে বলল,
‘বলো ‘গুলে গুলে গ্যদিন।’
মাহীন ততক্ষণাৎ বলল,’গুলে গুলে গ্যদিন!’
রায়েদ বলল,’চমৎকার! এটার ঠিক মানে হলো যে ‘আগামীকালও আরেকটা নতুন দিন। মানে নতুন আশা। এমন মোটিভেশনাল ক্ষেত্রেই এটা ব্যবহার করা হয়।’
মাহীন উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,’আরেকটা শেখাও!’
রায়েদ এবার কিছুক্ষণ ভাবার পর ঠোঁটের কোণে সুক্ষ্ণ ফিচেল হাসি টেনে বলল,’সেনি সেভিওরুম।’
মাহীন চোখ সরু করে তাকাল। বলল,’সেনি সেভিওরুম?’
রায়েদ বলল,’হ্যা এটার মানে গেট ওয়েল সুন।’
মাহীন ভাবালু কন্ঠে বলল,’এটা বেশ শোনা শোনা একটা বাক্য।’
রায়েদ প্রশ্ন করল,’কোথায় শুনেছ?’
মাহীন হেসে বলল,’টার্কিশ ড্রামাতে।’
রায়েদ ভ্রু উঁচু করে বলল,’ওরে বাবা! তুমি টার্কিশ ড্রামা দেখ?’
‘আগে দেখা হত। এখন অনেকদিন যাবত দেখিনি। তাই টার্কিশ ভাষা শুনেই বুঝতে পারি এটা কোন ভাষা। এবং হালকা পাতলা কয়েকটা শব্দ এবং বাক্যও জানি।’
রায়েদ বলল,’তো সেনি সেভিওরুম শেখা হয়ে গিয়েছে?’
মাহীন বলল,’এটা তো অনেকবার শুনেছি। কিন্তু এটার মানে কী এমনই ছিলো?’ প্রশ্নটা যেন ও নিজেকে করল।
রায়েদ বলল,’ওহ তোমার সন্দেহ আছে?’
‘না না আমি তাই বলিনি।’
রায়েদ নিজের মোবাইলটা ক্ষণিকের জন্য বের করল। হয়তোবা সময় দেখল বা অন্য কিছু। তারপর সামনে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,’হ্যা তো যেটা বলছিলাম। তাহলে দশবার সেনি সেভিওরুম বলো।’
মাহীন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ‘দশবার?’
‘হ্যা।’
‘কিন্তু কেন?’
‘ওফ তুমি অনেক প্রশ্ন করো। এটা আমার প্রিয় একটা ফ্রেজ। তাই দশবার বললে তোমার মনে থাকবে।’
মাহীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করল,’ঠিক আছে।’ তারপর এক মুহূর্ত থেমে বলতে শুরু করল,
‘সেনি সেভিওরুম,
সেনি সেভিওরুম,
সেনি সেভিওরুম,
সেনি সেভিওরুম,
সেনি সেভিওরুম,
সেনি সেভিওরুম,
সেনি সেভিওরুম,
সেনি সেভিওরুম,
সেনি সেভিওরুম,
সেনি সেভিওরুম।’ বলে মাহীন আবার এক লম্বা নিঃশ্বাস বুক ভরে নিল। রায়েদ হাসল। বলল, ‘অন ফ্লিক!’
মাহীন হালকা হাসল। এরপরই ওদের খাবারগুলো দিয়ে যাওয়া হলো। ওরা তৃপ্তি করেই খাওয়া দাওয়া শেষ করল। সন্ধ্যা বাড়ছে। আর কাল বিলম্ব না করে ওরা দুজনে সাড়ে পৌঁনে আটটার দিকে ট্রেন ধরল।
.
.
.
.
(অতিরিক্ত অংশ)
মাহীন নিজের বিছানায় আরামসে শুয়ে রয়েছে। বেশ ক্লান্ত লাগছে। যদিও এনাহেইম পাশের এলাকার মতোই তবুও সেটা আরেকটা শহর। বাড়ি থেকে এতদূর শুধু আরেকজন মানুষের সাথে এর আগে যায়নি কখনো।মাহীনের হঠাৎ মনে পরলো সেই দুটো টার্কিশ বাক্যের কথা। সেগুলো এখনো অব্দি গুগল ট্রান্সলেট করা হয়নি। মাথায় এই ভাবনার আগমন ঘটতেই বিছানায় পরে থাকা মোবাইলটা হাতে নিল। তারপর প্রথম বাক্যটা ‘গুলে গুলে গ্যডিন’ ট্রান্সলেট করল। সেটা রায়েদ যা বলেছিল তাই মানে। এবার ‘সেনি সেভিওরুম’ ট্রান্সলেশন করল। এটার মানে দেখেই মাহীনের চোখ কপালে উঠল। আপনাআপনি মুখ দিয়ে উচ্চস্বরে বেরিয়ে আসল,’আই লাভ ইউ! এটার মানে আই লাভ ইউ! ও আমাকে দিয়ে দশ দশ বার আই লাভ ইউ বলিয়েছে। ওফ ওফ! কিন্তু রিয়েলি এটা কী সত্যি? ও আসলেই আমাকে পছন্দ করে তাহলে? কারণ শুধু আমাকে দিয়ে নয় বরং নিজেও বলেছে সেনি সেভিওরুম!
চলবে ইনশাআল্লাহ।