#এল_এ_ডেইস
পর্ব ৩৮
লেখনী মাহীরা ফারহীন
ডিম ভাজার আকর্ষণীয় সুবাসে মম করছে সারা ঘর। পাউরুটি, ম্যাস পটেটো, ডিম এবং মাংস ভাজা তৈরি করা হয়েছে। রান্নাঘরে কাজ করার খুটখাট শব্দ হচ্ছে। সকালের মিষ্টি রোদ এসে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে প্রবেশ করে সিঙ্কের ওপর পরেছে। রোদের কিরণে চকচক করছে রুপালি সিঙ্ক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পানির বিন্দুগুলো হিরের মতো ঝিলিক দিয়ে উঠছে। রান্নাঘরের সঙ্গে লাগোয়া টেবিলে সব কিছু নাস্তার জন্য সাজানো হয়েছে। শুধু খাবার নিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা। ধীরে ধীরে এক পদশব্দ সিড়ি বেয়ে নেমে আসছে। এটা রাবিত না। রাবিত এতই লাফিয়ে লাফিয়ে চলাফেরা করে যে যেখান থেকে যায় সেখানে রীতিমতো ভূমিকম্প হয়ে যায়। তাও যখন সেটা কাঠের সিঁড়ি তখন তো কথাই নেই। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার পর দেখা গেল এটা রায়েদ। মিসেস রহমান রায়েদের দিকে সরাসরি মুখ তুলে চাইলেন। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলেন। রায়েদও হঠাৎ মায়ের মুখমুখি হয়ে যেতে কিছুটা বিচলিত হলো। তবে মাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে অবাকও হলো। মিসেস রহমান পেছনে ঘুরে কেতলি থেকে টার্কিশ চায়ের কাপে চা ঢালতে ব্যস্ত হলেন। এই চায়ের বিশেষত্ত্ব হলো একটি কেতলিতে পানি গরম করা হয়। তার ওপরে আরেকটি কেতলি বসিয়ে সেটায় চা ফোটানো হয়। মিসেস রহমানের হৃদয়ে কোনো হইচই হলো না। কোনো ক্রোধ ঝংকার তুললো না। পূর্বে রায়েদকে দেখলেই কোনো কারণ ছাড়া অদ্ভুত ভাবেই মনের কোণে রাগ এবং ঘৃনা দানা বাঁধত। মিসেস রহমান এতে নিজেই অবাক হয়ে যেতেন। এখন তেমন কিছুই হলো না। কোনো রাগ নেই কোনো ঘৃনা নেই। এতেও তিনি অবাকই হলেন। মনে মনে ভাবলেন,’কী হচ্ছে এসব ওর জন্য হঠাৎ করে আগের মতো অনুভূতি হচ্ছে না কেন? চাইলেও রাগ হচ্ছে না। রাগ হওয়ার কারণ কী তাই তো বুঝতে পারছি না। ওর জন্য আমার স্বামী মারা গেছে? এটা রাগের কারণ ছিলো? কিন্তু মা এবং সেলির এই কথাই তো ঠিক যে সেটা এক্সিডেন্ট ছিলো। আল্লাহ যখন যাকে তুলে নিতে চায় তখন তাকে নিয়ে যায়। এতে রায়েদের কোনো দোষ নেই। তাহলে আমি রায়েদের সঙ্গে এত নিষ্ঠুর ব্যবহারই বা কেন কারতাম?’ ভাবতেই ভাবতেই চা নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। রায়েদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জুতা পরছে। মিসেস রহমান রান্নাঘরের বারের পেছন থেকে বেরিয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। এবং চাগুলো নামিয়ে রাখলেন। একবার রায়েদের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন, ‘মনে হচ্ছে যেন যুগ যুগ পর ওকে দেখছি। ও যে কেমন আছে তাও তো কখনো খেয়াল করিনি। এই সকাল বেলায় না খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ওহ হ্যা আমি তো ওর শরীর স্বাস্থ্যরও খবর নেই না। শেষ কবে ওর আদর যত্ন করেছিলাম তাও মনে পরছে না।’
হঠাৎ করেই রায়েদের জন্য মনের মধ্যে এক তীক্ষ্ণ চিনচিন ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। না খেয়ে রায়েদ বের হয়ে যাবে তাতে মোটেও মন সায় দিচ্ছে না। কী অদ্ভুত এক অস্থিরতা। সন্তানের জন্য মায়ের মন তো এভাবেই অস্থির হয়ে ওঠে। তবে এত দিন তার এই অনুভুতি গুলো যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। সেই এক্সিডেন্টের সাথে যেন রায়েদের প্রতি তার মমত্ববোধ চাপা পরে গিয়েছিল। শুধু মাত্র আজ নয় চারটা বছর টানা তিনি কখনো রায়েদের দিকে দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। ও খেয়েছে কী খায়নি সেটা তার মাথা ব্যথার কারণ ছিলো না। অথচ তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠছে শুধু আজকের রায়েদ না খেয়ে বের হয়ে যাচ্ছে বলে। রায়েদ দরজা খুললো। তখনই তিনি মিসেস রহমান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘রায়েদ, থাম!’ যদিও কথাটা তিনি কিছুটা স্বাভাবিক ভাবেই বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু কড়া ভাবেই মুখ দিয়ে কথাটা বেরিয়ে গেল। রায়েদ চমকে উঠে ধীরে ধীরে পেছন ফিরে তাকাল। চোখ মুখ ওর থমথমে। অপেক্ষায় রইল কোনো একটা সুক্ষ্ণ খুঁতের জন্য ধমক খাওয়ার। কিন্তু মিসেস রহমান সেসব কিছু না বলে, বললেন,’নাস্তা করে যা।’
রায়েদ যেন বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝটকা খেল। হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মায়ের কথাটা বুঝে উঠতেই কিছু সময় পার হয়ে গেল। হঠাৎ করেই কোথা থেকে যেন মিষ্টি সুবাসিত বাতাসের ঝাপটা ওকে ছুয়ে গেল। ওর মনে হলো অনেক অনেক বছর পর ওর খরায় পোড়া বুকের জমিনে বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে। মিসেস রহমান আবারও রান্নাঘরের বারের পেছনে চলে গিয়েছেন। রায়েদ এবার দ্বিধান্বিত হয়ে পরল। আসলেই টেবিলে গিয়ে বসবে কিনা বুঝতে পারল না। এখন ওর মনে নানান প্রশ্ন এসে কড়া নাড়তে লাগল। মায়ের হঠাৎ কী হলো? এটাই মূল প্রশ্ন। রায়েদকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিসেস রহমান পুনরায় দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
‘কী হলো শুনতে পাসনি? বসতে বলেছি তো।’ রায়েদ এবার আর দেরি না করে আবারও জুতা খুললো। এবং
ধীর গতিতে এগিয়ে আসল। টেবিলের একটা চেয়ার টেনে নিয়ে একমুহূর্ত দ্বিধা করে বসে পরল। মিসেস রহমান উচ্চস্বরে বললেন, ‘আম্মা! রাবিত! নাস্তা তৈরি।’
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিসেস মাদিহ দেয়াল ধরে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে কামরা থেকে বের হলেন। তিনি টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতেই তার চোখে মুখে বিস্ময় খেলে গেল। তখনই কাঠের সিঁড়িতে শব্দের ঝড় তুলে লাফাতে লাফাতে রাবিত নিচে নেমে আসল। রায়েদের সামনেও মিসেস রহমান এক কাপ লালচে টার্কিশ চা রেখে গিয়েছেন। রায়েদ এখন গভীর মনোযোগে চা সীপ করতে ব্যস্ত। রাবিতেরও ভাইকে টেবিলে দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই ধীরে ধীরে দুদিকে ঠোঁট প্রসারিত হয়ে গেল। সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে গেল। দাদি এসে বসেছেন। তিনিও রায়েদকে এখানে সকলের সাথে বসে থাকতে দেখে মিটিমিটি হাসছেন। তাঁর ভাজ পরা চামরা হাসির রেশে আরোও কুঁচকে গিয়েছে। রাবিত এসে প্রায় ঝাপ দিয়ে রায়েদের পাশের চেয়ারে বসল। রায়েদ বসে তো আছে ঠিকই। কিন্তু কিছু বলার বা এক দন্ড হাসারও সাহস পাচ্ছে। বারবার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভয় এসে খোঁচা দিচ্ছে। মনে মনে ভয় হয় কখন না হঠাৎ করে মায়ের মন ঘুরে যায়। কখন না ওকে ভৎস্যর্না দিতে শুরু করেন। তাই একদম থম মেরে মূর্তির মতো বসে রয়েছে। নড়ছেও পর্যন্ত না। মিসেস রহমান বাকি জিনিসগুলো নিয়ে এসে টেবিলে রাখলেন এবং নিজের চেয়ারে বসলেন। রাবিতের মুখে হাসি লেগেই রয়েছে। ও আগেভাগে পকেট থেকে নিজের সেলফোনটা বের করল। রায়েদ ওর পাশে বসেই আঁড়চোখে দেখলো ওয়াটস আ্যপ খুলেছে। কাকে যেন কি একটা টেক্সট করছে। তখনই মিসেস রহমানের ধমকে চমকে উঠল দুজনেই। রায়েদের বুক ধড়ফড় করে উঠল। তবে মিসেস রহমান ধমকটা দিচ্ছেন রাবিতকে। তিনি বলছেন,
‘কতবার বলেছি না খাওয়ার সময় মেবাইলটা যেন হাতে না থাকে! রাখ এখনই রাখ।’
রাবিত শুকনো ঢোক গিলে মোবাইলটা পকেটে রেখে দিল। এবং নাস্তায় মনোযোগ দিল।
.
.
.
বিস্তৃত নীল আকাশের বুকে বিরাটকার কৃষ্ণকায় মেঘ এসে ভিড়েছে। সকালেও রোদ উঠে ছিল পূর্ণদ্যমে। এখন রোদের আর তেমন একটা তেজ নেই। স্কুলের সামনের অরিগন এস গাছগুলোর ডালপালা বাতাসে দুলছে। চত্ত্বরের দেয়াল ঘেঁষে ফুটে আছে বেগুনি রঙের ডগলাস আইরিশ। মাহীন অস্থির ভাবে স্কুলের দ্বিতীয় তলার করিডর ধরে পায়চারি করছে। এক ঘন্টা পূর্বে রাবিতের একটা ম্যাসেজ এসেছিল যে, তুমি বিশ্বাস করবা না কী ঘটেছে!’ এতটুকুই। এরপর মাহীন উদ্বিগ্ন হয়ে আরোও ম্যাসেজ দিয়েছে। কিন্তু এই ছেলের কোনো খবর নেই। কোনো উত্তরও আসেনি। নায়েল হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসছিল। মাহীনকে দেখে থেমে গেল। কনক্রিটের রেলিঙের ওপর উঠে বসে বলল,
‘হেই গুড মর্নিং!’
‘মর্নিং’ ছোট করে বলল মাহীন।
‘ইউ লুক ফাসট্রেইটেড। হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
‘জানি না। এমনিই পায়চারি করছি।’ হতাশ শোনাল ওকে।
‘ওহ আই সি।’ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,
‘বাই দ্যা ওয়ে তোমার পরীক্ষার প্রস্তুতি কেমন?’
মাহীনও এবার কনক্রিটের রেলিঙের ওপর উঠে বসল। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,’এই তো ভালোই। তবে একটু নার্ভাস। এর আগে কখনো এই তল্লাটে পরীক্ষা দেইনি তো।’
নায়েল স্মিত হাসল। বলল,’তাতে কী হয়েছে। পরীক্ষায় আর কী এমন পার্থক্য হয়। প্রস্তুতি ভালো হলেই সব ভালো।’
মাহীন সায় জানিয়ে মাথা নাড়ল। পেছন থেকে কার যেন মৃদু ডাক শোনা গেল। মনে হলো কেউ মাহীন বলেই ডাকছে। ওরা দুজনেই কৌতূহলী চোখে ঘাড় ঘুরাল। দেখা গেল নিচে চত্ত্বরে হলুদ রঙের সামোহি লেখা স্ট্যাচুটার সামনে রায়েদ দাঁড়িয়ে। ওরা তাকাতেই হাত নাড়ল। মাহীন লাফ দিয়ে রেলিঙ থেকে নেমে গেল। ব্যস্ত কন্ঠে বলল,’বোধহয় ও আমায় ডাকছে। যাই দেখা করে আসি।’
‘ঠিক আছে। তবে সময় মতো ক্লাসে চলে এসো।’
মাহীন উপরে নিচে মাথা নাড়ল। এখান থেকেই রায়েদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল। করিডোর ধরে দ্রুত বেগে হেঁটে চললো। নিচে গিয়ে গেট দিয়ে লাল ইটে বাঁধা কয়েক ধাপের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসল চত্ত্বরে। যত এগিয়ে আসছে পরিষ্কার হয়ে উঠছে রায়েদের ভাবভঙ্গি। কোনো এক কারণে উদ্ভাসিত হয়ে আছে ও। মনের খবর নাকি চোখ দিয়েই প্রকায় পায়। রায়েদের মন যে কতটা উৎফুল্ল তা ওর চোখ দেখেই উপলব্ধি করা যায়। আনন্দে নেচে উঠছে চোখের তাঁরা। মাহীন ওকে দেখেই বুঝতে পারল কোনো আনন্দের কিছু একটা ঘটেছে। সুতরাং রাবিতের দেওয়া সেই অসমাপ্ত ম্যাসেজ কোনো সুসংবাদই বহন করছিল। ব্যাপারটা ভাবতেই মাহীনের মনটাও আনন্দে উপচে পরল। রায়েদের কাছে এগিয়ে যেতেই রায়েদ ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেললো। তারপর গাঢ় কন্ঠে বলল,’চলো আমার সাথে।’
বলেই ওকে নিয়ে প্রায় ঝড়েরবেগে হেঁটে চললো। হাঁটছে তো না যেন ছুটছে। মাহীন হতবাক হয়ে ওর সাথে ছুটতে ছুটতে জিজ্ঞেস করল,’কিন্তু কী হয়েছে? এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ আমাকে?’
‘কোথায় আবার লাইব্রেরিতে। চলো তারপর বলছি।’ ওরা চত্ত্বরের দেয়াল ঘেঁষে ফুটে থাকা সাদা ফ্রেসিয়া ও বেগুনি ডগলাস আইরিশ গুলোকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চললো। একসময় বড় পাইন গাছটাও পার হলো যেটা লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের সামনেই ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে নিজের সেই কোণার টেবিলের সামনে গিয়ে থামল রায়েদ। তারপর ঘুরে দাঁড়াল এক গাল হাসি নিয়ে। মাহীনের মুখেও হাসি। কী যে আসলে হয়েছে তা জানার জন্য আর ধৈর্য্য ধরে না যেন। রায়েদ তখনো ওর ডান হাতটা ধরে রেখেছে। মাহীন কিছু বলতে যাবে তখনই ওর হাত উঁচু করে ওকে গোল গোল দুই পাক ঘুরিয়ে অত্যন্ত উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলল,
‘আজ মা আমাকে নিজেদের সঙ্গে নাস্তা করতে বলেছেন! মানে আমি কতদিন পর মায়ের অনুমতিতেই তার তৈরি করা নাস্তা খেলাম। আমার কাছে এখনো সব কিছু অবিশ্বাস্য লাগছে!’
মাহীনের সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পরল। আনন্দে কিছুটা অদ্ভুত ভাবে ‘উইই’ শব্দ করে বলল,’রিয়েলি! আই কান্ট বিলিভ দিজ। তারমানে এটাই বলতে চেয়েছিল ও।’ অতি আনন্দে হঠাৎ মুখ ফসকে গেল। রায়েদ রায়েদের মুখে হাসি লেগে আছে ঠিকই তবে তার রেশ কমল। জিজ্ঞেস করল,’কে কী বলতে চেয়েছিল?’
মাহীন ইতস্তত হাসল। তারপর আমতা আমতা করে বলল,’রাবিত আমাকে অর্ধেক ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল এটা বলে যে, কিছু একটা হয়েছে যেটা আমও বিশ্বাস করবো না। সেটাই বলছি বোধহয় এটাই বলতে চেয়েছিল।’
রায়েদ হালকা হাসল। বলল,’ওহ তাই তো বলি টেবিলের বসা মাত্র মোবাইল নিয়ে কী করতে বসেছিল ও। এবং বোধহয় সম্পূর্ণ ম্যাসেজ দিতে পারেনি কারণ খাওয়ার সময় মোবাইল ধরার জন্য মা ওকে ধমক দিয়েছেন।’
মাহীন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। আবারও যেন সেই কথাটা মনে করে অতিরঞ্জিত আনন্দটা মনে এসে ভর করল। কোনো দমকা হাওয়ার ঝাঁপটা যেন আনন্দে ভরা ফুলের সুবাস নিয়ে প্রবেশ করে মনকে পুলকিত করে দিয়ে গেল। বলল,
‘রায়েদ এই কথাটা বিশ্বাস করছো তো যে সময় আসলেই পাল্টায়। শুনতে মিরাক্যালের মতো হলেও তোমার মাও কিন্তু ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।’
রায়েদ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বলল,
‘তা হতেই পারেন। এখন বলো।’
মাহীন ওর পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বলল,’কি বলবো?’
‘এই যে তুমি আসলে কী করছ?’
মাহীন বসলো ওর পাশে। তারপর বলল,’পড়াশোনা। সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা তাই পড়াশোনা করছি।’
‘তা ভালোই। তবে আমি সেই কথা বলছি না।’
মাহীন জিজ্ঞেস করল,’তবে?’
‘এই যে আমার বাড়িতে কিছুদিন যাবত যেই অন্য রকম হাওয়া লেগেছে সেখানে তুমি কী করছো?’
মাহীন অপ্রস্তুত হলো। শুঁকনো কন্ঠে বলল,’তোমার বাড়ি তো সেই গত মাসে গিয়েছিলাম। সেখানে কী হচ্ছে আমি কিভাবে জানবো?’
‘মাহীন গত মাস থেকেই আমি খেয়াল করছি। আমার বাসায় কিছু একটা তো বদলেছে। এই রাবিত এবং দাদি সারাটাক্ষন মায়ের সাথে চিপকে থাকে। পারলে সপ্তাহে
তিন চার দিনই রাবিত ঠেলতে ঠেলতে মাকে হাঁটতে নিয়ে যায়। এবং এরা তিনজন একসাথে বসে দেখি মেডিটেশন করে। এসবের কারণ কী? এসবের সাথে তুমি কীভাবে জড়িয়ে আছ?’ গাঢ় কন্ঠ রায়েদের।
মাহীন শুকনো ঢোঁক গিললো। এতটা যখন রায়েদ বুঝেই ফেলেছে তখন মাছ দিয়ে শাক ঢাকার চেষ্টা করে লাভ নেই। মাহীন অপ্রতিভ ভাবে আমতা আমতা করে বলল, ‘আসলে..দেখো আমি জানি না তুমি ব্যপারটা কিভাবে নিবে। কিন্তু সত্যিই তোমাকে সবকিছু সামলে নেওয়ার পরই খুশির খবরটা দিতে চেয়েছিলাম।’
রায়েদের ভ্রুযুগল সূঁচালো হলো। জিজ্ঞেস করল,
‘কী ধরনের খবর?’
মাহীন প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে ইতস্তত করে বলল,
‘আমরা মিসেস রহমান কে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাচ্ছি। গত প্রায় এক মাস যাবত।’
রায়েদ স্থীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মাহীনের চোখে চোখে। ও একটুও অবাক হলো না দেখে মাহীন অবাক হলো। রায়েদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ‘এমন কিছু একটাই আমি আন্দাজ করেছিলাম। তবে তোমার মুখ থেকে শুনেই নিশ্চিত হতে চাইছিলাম।’
তারপর কিছুক্ষণের বিরতি। দুইজনের কেউই কোনো কথা বললো না। তবে নিজ নিজ মনে দুজনই ভাবছে।
বড় জানালা দুটো দিয়ে বাতাস আসছে শন শন শব্দে। কালো কাঠের সেলফগুলো রঙিন মলাটে মোরা বইয়ে সাজানো। রায়েদ এবার জিজ্ঞেস করল,’কিন্তু এইসব ঠিক করলে কীভাবে?’
মাহীন এবার ধীরে ধীরে শান্ত ভাবে পুরো ঘটনাগুলো সবিস্তারে খুলে বললো। রায়েদ অতি মনোযোগের সঙ্গে শুনল। সব শোনার পর হঠাৎ ওর মুখে একখানা প্রশান্তি ময় হাসি ছেয়ে গেল। ওর হাসি দেখে মাহীনের মনের বিচলিত ভাবটাও কেটে গেল নিমিষেই। রায়েদ প্রসন্ন কন্ঠে বলল, ‘এখন আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে তুমি আসলেই কারো জীবনের গতি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখো। কিভাবে পারো?’
মাহীন মুখ টিপে হাসল। বলল,’তা কী করে বলি? আমার যা মন বলে হয় তাই করি। ব্যস।’ তারপর থেমে আবার বলল,’আর এখন পর্যন্ত আমার কোনো অদ্ভুত কাজকারবার বিফলে যায় নি এটা তো আল্লাহর অশেষ কৃপা।’
রায়েদ স্মিথ হেসে বললো,’আর আমারও ভাগ্য ভালো বলতে হবে যে তোমার সাথে দেখা হয়েছে।’
মাহীন হাসল। হঠাৎ আরেকটা অজানা কথা মনে পরে গেলো মাহীনের। যেটা শুধু ও নয় অনেকেই জানতে চায়। তবে সেটা নিয়ে এতদিন কোনোও প্রশ্ন করার সাহস হয়নি। তবে গত কিছুদিনে হয়তো করলেও করতে পারব। এখন হঠাৎ জানতে ইচ্ছে করল খুব। সাবধানে বলল,
‘আচ্ছা তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
রায়েদ আগ্রহী কন্ঠে বললো,
‘অবশ্যই বলো।’
মাহীন এক মুহূর্ত দ্বিধা করল। রায়েদ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরাসরি ওর চোখের দিকে। মাহীন জানালার দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে বলল,
‘আচ্ছা তোমার এবং বিলের মধ্যে কী হয়েছিল?’
রায়েদ শুধু ওর দিকে চেয়ে রইল। কিছু শুনেছে বলে মনে হলো না। তবে হঠাৎ ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। বলল,’অবশেষে তুমি আমাকে নিজে থেকে কিছু তো জিজ্ঞেস করলে।’
মাহীন মুচকি হাসল। রায়েদ এবার শান্ত কন্ঠে বলল,
‘বিল এবং আমার মধ্যে আসলে শুধুই ভুল বোঝাবুঝি লেগেছিল। যেটা এখনো ঝুলেই আছে।’
‘কী নিয়ে?’
‘আমার বাবা মারা গিয়েছেন সেটা ও শুনেছিল। তবে বাকি ঘটনাগুলো ওর অজানা ছিল। আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টাও করেছিল। তবে ওই কদিন আমি আমার ফোন বন্ধ করে বাহিরে গিয়ে বসে থাকতাম। ও আমার বাড়িতে এসেও আমাকে পেত না। এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ পর যখন আমাদের দেখা হয়।
আমি তখনো ডিপ্রেশনে ছিলাম। এবং ও এসে প্রথমে আমাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে ওরও একটা অভিমান ছিলো আমার ওপর যে, কেন আমি ওকে সবকিছু আগে জানালাম না। আমি কী ওকে বন্ধু মনে করি না। ও একবারও আমার মন মেজাজের অবস্থাটা বুঝতেই চেষ্টা করল না। তখন আমাদের বেশ একটা ঝগড়া লেগে যায়। ওই যে তখন থেকে দুজনই রাগ করে একে অপরের সাথে কথা বলা বন্ধ করেছি। সেটা এখনো অব্যাহত রয়েছে।’ কথাটা শেষ করে এক লম্বা নিঃশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে এল। মাহীন বেদনাহত এবং বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। ম্লানমুখে বলল,
‘একি কথা?ও কেমন বন্ধু হলো যদি তোমার খারাপ সময় তোমাকে বুঝতেই না পেরে তোমার পাশ থেকে সরে দাঁড়ায়।’
রায়েদ হালকা হাসল। মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘হয়তোবা এজন্যেই ওর আমার ওপর যতটা রাগ তার চেয়ে আমার ওর ওপর রাগ একটু বেশিই। সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত মনে হয় ছোট বেলা থেকে ওই ছেলেটা কীভাবে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো?’
মাহীন এবার নরম কন্ঠে বলল, ‘ও তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কেন ফ্রেন্ড হওয়ারও যোগ্য ছিল না। নাহলে এভাবে দূরে সরে যেত না।’ বলে থামল। রায়েদ আর কিছু বললো না। জায়গাটায় নিরবতা ছেয়ে গেল। জানালার সামনে থাকা অরিগন এস গাছটির ডালে বসে কোনো এক পাখি টিউ টিউ করে ডাকছে। রায়েদই অবশেষে বলল,
‘সে যাই হোক। ও চলে গেছে তো চলে গেছে। তুমি আছ না আমার আর কোনো কারোরি দরকার নেই।’
মাহীন হাসল। হঠাৎ রায়েদের মাথায় এক দুষ্টুমি বুদ্ধি খেলে গেল। ভাবতে লাগল, হুম মাহীন গত একমাস যাবত ওর কান্ডকার্বার সম্পর্কে কিছু জানায়নি। সুতরাং আমারও ওকে একটু বিরক্ত করাটা তো যায়।’
নিজেকে প্রস্তুত করল। লম্বা এক শ্বাস ফেললো। মাহীন নিশ্চুপ ভাবে ওর পাশের চেয়ারে বসে আছে। রায়েদ একটু এগিয়ে গিয়ে মাহীনের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘সো মাহীন তুমি তোমার বান্ধবীদের জানিয়েছো যে তুমি অফিশিয়ালি একটা রিলেশনশিপে আছো?’
মাহীন ভ্রু কুঁচকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের রিলেশনশিপ? কার সাথে রিলেশন?’
‘আমার সাথে।’ মাহীন চোখ বড় বড় করে তাকাল। বলল, ‘এ্যই আমি তোমার গার্লফ্রেন্ড কবে থেকে হলাম? কি বলতেসো তুমি?’
রায়েদ এবার মাহীনের দুই কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
‘ওই যে সেদিন এনাহেইমে তুমি আমাকে প্রপোজ করলা। আমি সেটা একসেপ্ট করেছি।’
মাহীন নড়েচড়ে বসল। তীব্র কন্ঠে বলল, ‘আমি কখন তোমাকে প্রপোজ করলাম? স্বপ্ন টপ্ন দেখছিলা নাতো?’
রায়েদ নিজের মোবাইলটা বের করে একটা রেকর্ডিং চালু করে মাহীনের কানে ধরল। সেখানে শোনা যাচ্ছে মাহীনের কন্ঠ। টানা দশবার সেনি সেভিওরুম বলে যাচ্ছে। মাহীনের হঠাৎ মনে পরল যে ও এই বাক্যটা আসলেই ট্রান্সলেট করেছিল। এবং এর অর্থ মোটেও সেটা নয় যেটা রায়েদ বলেছিল। মাহীন ঝট করে রায়েদের ফোনটা হাতে নিয়ে নিল। মুহুর্তেই রেকর্ডিং টা ডিলিট করে দিলো। রায়েদ চমকে উঠে তাকিয়ে রইল। মাহীন এবার পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে রায়েদের মুখোমুখি হলো। আমুদে গলায় বলল, ‘এটার কথা তো আমি বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ। এখন আমাকে ট্রিক করার শাস্তি হলো তুমি আমাকে যতই প্রপোজ করো না কেন আমি একসেপ্ট করবো না।’
রায়েদ হেসে বললো, ‘কিভাবে তুমি একসেপ্ট না করে থাকো সেই ফন্দিও আমার কাছে আছে।’
মাহীন চোখ সরু করে তাকাল।
চলবে ইনশাআল্লাহ।