#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল
#তানিয়া
পর্ব:৭
আদ্যর ঘুম আসছেনা তাই সে রুমে কিছুক্ষণ হাটাহাটি করলো।তার মাথায় বারবার মেহুর বেশ কিছু কথা ঘুরছে।তাদের বাসায় এত বড় বিড়াল আছে অথচ আদ্য তা জানতো না এ কেমন কথা? বিকেলে সে তার মাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো,
“আচ্ছা মা একটা প্রশ্ন করি,আমাদের এ বাড়িতে কি কোনো বিড়াল আছে এত্তবড়?”
আদ্য দুই হাত প্রসারিত করে বিড়ালের সাইজ দেখায়।ছেলের বিড়াল সাইজ দেখে লুৎফা হাসতে থাকেন।আদ্য বুঝতে পারে এভাবে সাইজ দেখিয়ে কথা বলাটা কতটা হাস্যকর ছিল তবুও মর্জিনার কথাটা মাথায় ছিলো বলে কথাটা বলে ফেলে।
“মা হেসো না তো। ভুল হয়ে গেছে আরকি।যাই হোক বলো না এমনি এ বাসায় বিড়াল আছে? ”
“কেনো বল তো?”
“বলো না মা আমার জানা লাগবে।”
“না এ বাসায় বিড়াল নেই তবে পাশের বাড়িটাতে একটা বিড়াল আছে। প্রায় রাতে সেই বিড়ালটা বেসুরো স্বরে কেঁদে উঠে। কিন্তু তুই কেনো জিজ্ঞেস করছিস, শুনেছিস নাকি বিড়ালের কান্না?”
“হুমম মা শুনেছি তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।”
তার মানে মর্জিনা মেয়েটা ভুল বলে নি।সত্যি এখানে বিড়াল আছে। কিন্তু এতো উঁচুতে বিড়াল উঠে কি করে সেটা ভেবে পায় না আদ্য!
রাতে ঘুম না আসলে আদ্য প্রায় সময় ছাদে থাকে।সেই হিসেবে আদ্য ছাদে চলে যায়। ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা হাটাহাটি করতে থাকে।তার নজর আটকে যায় দরজার দিকে।আদ্য মনে মনে ভাবে,
এতো রাত অবধি মর্জিনার ঘরে আলো জ্বলছে কেনো?কি করছে সে?
মনের প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আদ্য দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।বারি দিবে কি দিবে না চিন্তা করে করাঘাত করেই দেয়।দরজার আওয়াজ শুনে আঁৎকে উঠে মেহু।এতো রাতে তার ঘরে কে কড়া নাড়ছে?মেহুর মনে ভয় আর সন্দেহ দু’টোই কাজ করে।বিছানা পত্র ঠিক করে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল।যেই না শব্দ শুনলো ওমনি চমকে উঠলো।কে হতে পারে?যদি অচেনা কেউ হয় অথবা চোর ডাকাত হয়?এ বাড়ির ছাদে এত রাতে কে হবে?ভূত!ভূতের কথা মনে আসতেই মেহুর পুরো শরীর হিম হয়ে যায়।যদি সত্যি সত্যি ভূত হয় তবে তাকে তো মেরে ফেলবে।এ বাড়ির কেউ কি জানবে?না সে দরজা খুলবে না।শুনেছে ভূতকে তিনবারের বেশি ডাকলে সে জবাব দেয় না।তাই মেহু কে কে করতে থাকে?
“কে ঐহানে,কে?”
আদ্য উত্তর দেয়,
“আমি”
“আমিটা কেডা?”
“এ মেয়ে তুমি কি গলা শুনে বুঝতে পারছো না আমি কে?আমি আদ্য এবার দরজাটা খুলো।”
আদ্য নামটা শুনে মেহুর বুকে হাতুড়ি পড়া অবস্থা। এতো রাতে এ ছেলে এখানে কি করছে?তাছাড়া মেহুর মুখটা অনেকটা কালি মুছে গেছে। এ মুহুর্তে তো তার সামনে যাওয়া যায় না।কি করবে মেহু? মেহু বিছানায় বসে চিন্তা করছে কিন্তু কাজের সময় চিন্তা গুলো বেড়াতে চলে যায় তাই তাদের কোনো সাড়াশব্দ থাকে না।এদিকে আদ্য দরজায় আঘাত করতেই থাকে।মেহু একটা বুদ্ধি বার করে।সে মুখে খানিকটা কালি মেখে ঘরের আলোটা বন্ধ করে দেয়।ভালো করে ঘোমটা টেনে দরজা খুলে আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায় যাতে তার মুখটা বোঝা না যায়। দরজা খুলে দাঁড়াতে আদ্য হুঙ্কার দিয়ে উঠে।
“কি এমন কাজ করছিলে যে ডাকার সাথে সাথে দরজা খুলতে পারছো না।”
“জ্বে বিছানা ঠিক করতাছিলাম।”
“আজকেও কি বিড়াল বিছানা নষ্ট করেছে।”
আদ্যর প্রশ্নে মেহুর কথা বন্ধ হয়ে যায়।
“কি হলো আজো কি বিড়াল ঢুকেছিলো?”
“না স্যার কেমনে ঢুকবো তালা দিছিলাম।তয় সারাদিন ঘর পরিষ্কার করার সময় পাই নাই তাই একটু সাফ করতাছিলাম।তা এতো রাতে আফনে এহানে কি করেন?”
“আসলে আমার ঘুম আসছিলো না।আর ঘুম না আসলে আমি বেশিরভাগ সময় ছাদে হাটাহাটি করি।তাছাড়া তোমার ঘরের আলো জ্বলা দেখে ভাবলাম তুমি কাজ করছো তাই জানতে এলাম।”
“না স্যার কাম ছিলো। হে গুলান শেষ হইছে।অহোন ঘুমামু।আফনেও যান ঘুমায় লোন।”
আদ্য মেহুকে দেখার চেষ্টা করে কিন্তু অন্ধকারে মেহুকে নজরে আসেনা।আরকিছু বলার নেই তাই আদ্য চলে যায়। কি মনে করে পেছনো ফিরে তাকায়।
“শোনো রাত জাগবে না।সারাদিন পরিশ্রম করে রাতের ঘুমটা দরকার।নাহলে তো ঘরের কাজে অবহেলা করবে।যাও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো।তাছাড়া তোমার তো আবার সকালো অন্য কাজ আছে। ”
কথা শেষ করে আদ্য সিড়ির দিকে পা বাড়ায়।আদ্যর কথা শুনে মেহু ভয় পেয়ে যায়। মেহুর বারবার মনে হচ্ছে আর কেউ না হোক এ লোকটার হাতে সে ধরা পড়বে।তাই অনেক সাবধানে কাজ করতে হবে।
আসলে মেহু নিজের পড়া নিয়ে বসেছিলো।ভেবেছিলো ঘন্টাখানেক পড়বে তারপর ঘুমোতে যাবে।কিন্তু এমন সময় আদ্য চলে আসায় তার সমস্যা হয়ে গেলো। মেহু ভাবছে তার পক্ষে রাতের বেলা পড়া রিস্ক হবে।আজকে না হয় একটা অজুহাত দিলো কিন্তু রোজ রোজ তো এক অজুহাত খাটে না।সে চিন্তা করলো কি করা যায়?
আজ মেহুর অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। সে তাড়াহুড়ো করে আমেনা খালার কাজ থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেলো।রুমের জানলা থেকে আদ্য সবটা লক্ষ্য করলো।কি ভেবে জানি আদ্য আজ মেহুর পেছন ধরলো।দ্রুত হাটায় মেহুকে ধরতে আদ্যর সমস্যা হলো না।আদ্য জানে মেহু কোনো এক বাড়ির বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে আসে তাই মেহুর কথাটা কতোটা সত্যি সেটা যাচাই করতেই আসলে আদ্যর পিছু নেওয়া।আদ্যর মনে হচ্ছে তাদের বাড়িতে আসার ক্ষেত্রে মেহুর কোনো উদ্দেশ্য নেয় তো!
অন্য কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ করে আদ্য রাস্তা গুলিয়ে ফেলে।এ মুহুর্তে আদ্য যে জায়গাতে এসে দাড়িয়েছে সেটা তিন রাস্তার মোড়।মর্জিনাকে খুজতে এসে সে এলোমেলো ভাবনায় মশগুল ছিলো আর এতটাই মশগুল যে মর্জিনা নামের মেয়েটা তার চিন্তার ফাঁকে কোনদিক দিয়ে গেলো আদ্য সেটা টেরই পেলো না।রাগে সে পা দিয়ে ছোট একটা পাথরের টুকরাকে কিক করে।সাথে সাথে একটা মেয়েলি আর্তনাদ শোনা যায়। আদ্য আওয়াজ শুনে সেদিকে এগিয়ে যায় বুঝতে পারে তার কিক দেওয়া পাথরটা এ মেয়ের গায়ে লেগেছে।
“I am sorry,extremely sorry!actually আমি একজনকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে চলে আসি।কিন্তু হুট করে হারিয়ে ফেলায় তার রাগটা পাথরে দেখালাম।সরি।”
আদ্য বারবার সরি বলছে ঠিকই আর যাকে সরি বলছে তার কোনো হা হুতাশ নেই। আদ্য চোখ তুলে তাকাতে দেখে একটা বোরকা পরিহিত মেয়ে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
“আমি সরি বললাম তো।আপনি চুপ করে আছেন কেন?”
আদ্য যার সাথে কথা বলছে সেটা যে আদ্যর অনুসন্ধান করা সেই মেয়ে যদি আদ্য বুঝতো তাহলে কি এত গুলো সরি সে পেতো?এদিকে আদ্যকে দেখে মেহুর আধমরা অবস্থা। আদ্য তাকে ফলো করছিলো এতক্ষণ আর মেহু টেরই পায় নি।কতো বড় সর্বনাশ এখন ঘটতে যাচ্ছিলো যদিনা সে মোড় না ঘুরাতো।কিন্তু এখন কি করবে?উত্তর দিবে যদি ধরা পড়ে যায় কিন্তু কীভাবে ধরা পড়বে সে তো আর বাড়ির ভাষায় কথা বলবে না সে বলবে সচরাচর অফিসিয়ালি ভাষায় যে ভাষায় আদ্য তাকে চিনবে না।চুপ করে থাকলে তো হবে না, মেহুকে কেটে পড়তে হবে তবে উত্তরটা দিয়েই।
‘না সমস্যা নেই। আমি ব্যাথা পাই নি।আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না।”
মেয়েটির কথায় আদ্য স্বস্তি ফিরে পায়।হঠাৎ তার নজরে আসে বোরকাটা।সে রঙটা দেখে ভ্রু কুঁচকালো।এমনকি মেয়েটার চোখের দিকে তাকালো।মেহু তাড়াতাড়ি উত্তর দিয়ে চলে যেতেই আদ্য পেছন থেকে ডাক দেয়।
“এক্সিইউজ মি. একটু দাড়ান।”
“আবার কি?”
বিড়বিড় করে মেহু বলে উঠে। মেহু পেছনে ফিরে তাকায়।আদ্য সামনে এসে দাঁড়ায়।
“যদি আমি ভুল করে না থাকি তবে আপনিই সেই মেয়ে যে আমাকে রিকশাওয়ালা ডেকেছিলেন তাই না?”
ব্যাটা দেখি সেদিনের কথাটা ভুলে যায় নি।মা গো স্মৃতি শক্তি এতো পাওয়ারফুল। কি উত্তর দিবে মেহু এখন?
“কি হলো চুপ করে আছেন কেনো?তার মানে কি আমার ধারণাই সত্যি আপনিই সেই মেয়ে? ”
নিশ্চুপ মেহু।উত্তর দেওয়ার মতো কোনো কথা সে জোগাড় করতে পারছে না।
“কি হলো বোবা নাকি?সেদিন তো খুব বকবক করছিলেন এখন কি বোবা হয়ে গেলেন।”
“হ্যাঁ বোবা হয়ে গেলাম।কি শুনতে চান বলুন তো?হ্যাঁ আমিই সেই মেয়ে তা কি হয়েছে এখন?কি করবেন শুনি?একে তো পাথর ছুড়ে পায়ে ব্যাথা দিয়েছেন আবার এখন এসেছেন পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে।হ্যাঁ আমিই সেই মেয়ে এখন কি করবেন বলুন?”
উত্তরটা জানতেই আদ্যর চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।একে তো চুরি তার ওপর সিনা ঝুরি। আবার গর্ব করেও কথা বলে।
“ইউ স্টুপিড তার মানে তুমিই সেই মেয়ে। তোমার সাহস দেখলে আমি বারবার অবাক হয়।এতো সাহস পাও কোথায়?আমার সাথে এভাবে কথা বলতে ভয় করছেনা?”
“কে হে আপনি যে ভয় পাবো।আপনার সাথে কি আমি ঝগড়া করতে গিয়েছি নাকি আপনিই আগ বাড়িয়ে ঝগড়া করতে আসলেন।একে তো দোষ করেছেন তার ওপর বড় বড় ভাষণ!”
“আমি দোষ করেছি?”
“অবশ্যই তা নয় তো কি?এমন ভাবে পাথর ছুড়লেন সোজা এসে আমার হাঁটুতে।যদি পাথরটা মাথায় লাগতো তাহলে?”
“তাহলে তো ভালোই হতো।আমার সাথে অন্যায় করার ফল পেতে।তাছাড়া তোমাকে কেনো এতবার সরি বললাম।ওটা তোমার প্রাপ্য ছিলো।যা হয়েছে একদম ভালো হয়েছে।”
“কিইই ভালো হয়েছে? আপনি তো আস্ত একটা বদলোক দেখছি।মেয়েদের মতো খুব ভালো ঝগড়া শিখেছেন।তা অভ্যাস আছে নাকি ঝগড়ার মধ্যে? ”
‘কি বললে তুমি আমি ঝগড়াটে।তুমি ঝগড়াটে।কথার আন্দাজে বোঝা যায় কেমন মেয়ে তুৃমি?”
‘ভালোই তো।তাহলে চিনে রাখুন কেমন আমি।তাছাড়া সরুন তো অনেক দেরী হয়ে গেছে। ফালতু বকার সময় নেই। ”
এক প্রকার ধিক্কার জানিয়ে মেহু আদ্যকে এড়িয়ে চলে যায়। রাগে অপমানে আদ্যর সারা শরীর জ্বলতে থাকে।একটুখানি মেয়ে তার আবার চ্যাটাং চ্যাটাং কথা। আদ্য পারলে এক চড়ে মেয়েটার দাঁত ফেলে দিতো।একে তো মর্জিনাকে পেলো না তার ওপর এ মেয়ের সাথে ঝগড়ায় হারলো।রাগে ক্ষোভে আদ্য স্থান ত্যাগ করলো।
এদিকে মেহু তো ভয়ে একাকার তবে একদিকে মজা পেয়েছে।সেদিন ব্যাটা চাচির হাতে তাকে মার খাইয়েছিল এখন বুঝবে অপমান কতো কষ্টের জিনিস। তবে আদ্য তাকে ফলো করতে করতে এতদূর আসবে সেটা ভাবে নি মেহু।আজকে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে গেলো।না তাকে এবার পথ পরিবর্তন করতে হবে।
আদ্য রাগান্বিত মুড নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।একে তো মর্জিনা নামের মেয়েটাকে হারালো তার ওপর ঐ মেয়েটা এবারও তাকে অপমান করলো।না এভাবে মেয়েদের হাতে অপদস্ত হওয়ার কোনো মানে হয় না।এবার ছাড় পেয়েছো মামণি পরেরবার এমন শিক্ষা দিব তোমায়…..।
সকাল নয়টা বাজতেই চারদিকের পরিবেশটা হইহট্টগোলে পরিপূর্ণ হলো।আজ থেকে আবারও সবার দৈনন্দিন কাজ শুরু হবে।সবাই যার যার কাজে চলে যাবে।আদ্যও বেশকিছু সময় রেস্টে কাটালো এখন সেও অফিস কাজে মনোযোগী হবে।তবে তার মাথা থেকে কোনোভাবে মর্জিনা নামের মেয়েটার চিন্তা যাচ্ছে না।
,
,
,
চলবে……..