জলছবি #৯ম_পার্ট

0
548

৯.
#জলছবি
#৯ম_পার্ট
#কাজী_সানজিদা_আফরিন_মারজিয়া
.
ছাদের ঠিক কিনার ঘেঁষে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়া। ছাদ মোটেও ফাঁকা নেই। বিয়ে বাড়ির ছাদ, ফাঁকা থাকার উপায় আছে কি?
একপাশে ছোট ছোট বাচ্চারা খেলাধুলো করছে, বড়দের কেউ আড্ডায় মশগুল, কেউ-বা আবার ছবি তোলায় ব্যস্ত। শ্রেয়াই কেবল একা এক বিষন্ন মন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
শ্রেয়াকে ভড়াট নারী কন্ঠের কেউ একজন বলল,
“দিদি, একটু সরে দাঁড়াবেন? এইখানটায় একটু ছবি তুলতাম!”
শ্রেয়া এক নজর তাকালো তারপর বিনাবাক্যে সরে দাঁড়ালো। একটু নয় বেশ অনেকখানি-ই সরলো সে। কাঁধ অব্দি ছোট চুলগুলো মৃদু বাতাসে উড়ে চোখেমুখে পড়ছে, তাতেও তার কোনো হেলদুল নেই। সবার এত আনন্দের মাঝেও তার চোখ ছলছল করে উঠছে বার বার। জিহ্ব দিয়ে শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিলো। বা’হাত থেকে ফোনটা ডান হাতে নিয়ে কাউকে কল দিলো। এটাই প্রথম নয়। এ বাসায় আসার পর থেকে মিনিমাম পঞ্চাশবার ফোন দিয়েছে প্রিয় মানুষটাকে। কিন্তু অপর প্রান্তের মানুষটা ফোন তুলছে না। মাঝখানে একবার তুলেছিলো। শ্রেয়াকে বেশ কিছু কড়া কথা শুনিয়ে আবার কেটে দিয়েছে। শুধু কেটেই খ্যান্ত হয়নি, ফোন বন্ধ করে দিয়েছে। এই যে এখনও ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। শ্রেয়ার পাতলা হলদেটে গালটা বেয়ে টসটসে এক অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়লো। নিরীহ টাইপ এই মেয়েটা ভীষণ ভালোবাসার কাঙাল। যাকে ভালোবাসে উজাড় করে ভালোবাসে। আর উজার করে ভালোবাসা বলতে ওই একটা মানুষকেই বোঝে সে। শ্রেয়ার গলা ধরে আসে। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। কিন্তু মন খুলে কাঁদতে পারছে না। এত মানুষের মাঝে কাঁদা যায় নাকি?
“কিরে? এখানে কি করিস একা একা?”
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিতে দিতেই শ্রেয়ার কাঁধে হাত রাখলো লুবনা। শ্রেয়া চমকে উঠে চোখের অশ্রু আড়ালে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। নিজেকে সামলে নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে জবাব দিলো,
“কি-ক-কিছু না!”
লুবনা ধরে ফেললো বিষয়টা। শ্রেয়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কাঁদছিস, শ্রেয়া? কাঁদছিস কেন?”
শ্রেয়া মিছে হাসার ভান করে বলল,
“ক-কই? না তো!”
“আমাকে মিথ্যে বলছিস কেন? রাহাত ভাইর সাথে কিছু হয়েছে?”
শ্রেয়া চুপ করে রইলো। লুবনার আর বুঝতে বাকি রইলো না। বলল,
“চল নিচে যাই। ওরা খুঁজতেছে।”
“আমার ভাল্লাগছে না। তুই যা।”
লুবনা শ্রেয়ার কথা শুনলো না। এক প্রকার জোর করেই নিচে নিয়ে এলো শ্রেয়াকে।
ফয়সাল, সৃজন আর নিষাদ সেলফি তোলায় মশগুল ছিলো। লুবনা আর শ্রেয়া গিয়ে চুপচাপ পাশে দাঁড়ালো। মলিন শ্রেয়াকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সবাই। সৃজন বলে,
“কিরে? এ এরাম হুনুমানের মতো মুখ কইরা আছে ক্যা?”
নিষাদ বলে,
“চোখ দুইটা দেখে তো মনে হইতেছে বল্লায় কামড় মারছে।”
বন্ধুদের টিটকারি এই মূহুর্তে একটু ভালো লাগছে না তার। ফয়সাল ওদের থামতে বলে, লুবনাকে জিজ্ঞেস করলো,
“এই লুবু? কি হইছে ওর?”
“রাহাত ভাই ওর ফোন ধরছে না।”
নিষাদ মুখ বাঁকিয়ে বলে,
“এই বলদি মাইয়ার ফোন না ধরাই উত্তম। পাত্তা দিতে দিতে মাথায় তুলে ফেলছে। এখন তো ফোন ধরবেই না। বলদ একটা।”
শ্রেয়া মন খারাপের মাঝেও কটমটিয়ে তাকায়। ফয়সাল বলে,
“নিষু চুপ থাক।” তারপর লুবনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ফোন ধরে না ক্যান?”
লুবনা একবার শ্রেয়া দিকে তাকায় তারপর ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বলে,
“ঐযে তখন কল দিয়েছিলো না? শ্রেয়া ধরতে পারেনি। তাই জন্য নাকি!”
তিন বন্ধুই বিস্মিত! এই সিম্পল কারনে? ওরা ভয়ানক প্রতিক্রিয়া করার আগেই শ্রেয়ার ফোন বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মেয়েটার। বন্ধুদের বলল,
“দোস্ত ‘ও’ ফোন করেছে।” বলেই ফোন নিয়ে আড়ালে চলে এলো। চাপা কষ্টটা কই যেন উড়ে গেলো হুট করেই! এমনও হয়?
শ্রেয়া চলে যেতেই নিষাদ কিড়মিড় করে রাহাতের উদ্দেশ্যে বলল,
“এই হিপক্রেটটার সাথে শ্রেয়া সাত বছর যাবত টিকে আছে কেমনে?”
লুবনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“মেয়েরা এমনই, যাদের একবার আকড়ে ধরে, শত অবহেলার পরও তাদের আর ছাড়তে পারে না।”
সৃজন বলে,
“অমনি নিজেদের উপর ক্রেডিট নিয়ে নিলি, না?”
ফয়সাল বাঁকা হাসি হেসে বলে,
“মাইয়া গুলা তো এমনই। সুযোগ পাইলে এমনি এমনি ছাড়ে না। সুযোগের সৎ-ব্যবহার করে ছাড়ে।”
নিষাদ ফয়সালের সাথে হাই-ফাইভ দিয়ে বলে,
“এক্সাক্টলি দোস্ত। সুযোগ পাইছে আর ক্রেডিট নিজের ভাগে নিয়ে নিছে। স্বার্থবাদি মাইয়া মানুষ।”
লুবনা একা একা পেরে উঠে না। নোলকের খুব প্রয়োজন বোধ করলো। ও থাকলে নিশ্চই এতক্ষণে বেশ কিছু কড়াকড়া কথা শুনিয়ে দিতো। তবুও ফুঁসে উঠে বলে,
“দেখ সবাইকে তোদের মতো ভাববি না।”
সৃজন এর দিকে তাকিয়ে বলে,
“আর আপনি এত কথা বলছেন কেন? নিজেকে দিয়ে চিন্তা করেন ছেলেগুলা কেমন বেয়াদপ, ফাজিল হয়! কয়জনের সাথে ফ্লার্ট করিস, বল তো দেখি?”
নিষাদ কড় গোনে, এক, দুই, তিন, পাঁচ…!
লুবনা হেসে দিয়ে বলে,
“এক, দুই, তিন, পাঁচ! ওয়াও নাইস! সে কয়জনের সাথে ফ্লার্ট করছে কড় গুনে শেষ করতে পারছে না! আবার মেয়েদের ইমোশন নিয়ে কথা বলিস তোরা।”
নিষাদ ফিসিফিসিয়ে ফয়সালকে বলে,
“সৃজন শালায় আমাগো মানইজ্জত শ্যাষ কইরা ফেললো।”
ফয়সাল পারে না সৃজনকে চোখ দিয়ে মেরে ফেলে, এমন ভাবে তাকায়। সৃজন মাথা চুলকাতে চুলকাতে এদিক-সেদিক তাকায়।

.

রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই ঘুমাতে গেলো। নোলকও গেলো। ভয়ের কথা কাউওকে বললো না আর। অনুপমা দেবী অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলো অসুবিধে হবে কি-না? নোলক জানিয়েছে, না। কথাটা অবশ্যই সত্যি নয়। তার ভয় লাগছে ভীষণ। নিজের রুমে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বললো বেশ অনেক্ষণ। যতক্ষণ কথা বলেছে, ততক্ষণ ভয় দূরে ছিলো। যখনই কথা বলা শেষ হয়েছে তখনই আবার ভয় এসে ভর করেছে। নোলক রুমের দরজা খুলে বাহিরে এসে দাঁড়ালো। চারপাশে চোখ বুলালো। কি আশ্চর্য! এত বড় বাড়িটায় কেউ সজাগ নেই! নোলকের ভাবনা শেষ হতে না হতেই কারো দরজা খোলার আওয়াজ হলো। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলো, আদ্র। বোধহয় এই প্রথম আদ্রকে দেখতে পেয়ে মনেমনে খুশি হলো নোলক। আদ্র একবার নোলকের দিকে তাকিয়ে হাঁটা ধরলো। নোলক ডেকে জিজ্ঞেস করে,
“এই যে? কই যাচ্ছেন?”
আদ্র বুঝতে পারে নোলক ভয়ে আছে। চশমাটা ঠিক করে ছোট্ট করে বলে,
“ছাদে।”
নোলক লাজুক কন্ঠে বলে,
“আমিও যাবো।”
আদ্র মৃদু হেসে হাঁটা ধরে। সমান তালে পা মিলায় নোলকও। হাঁটতে হাঁটতেই বলে,
“একা একা ছাদে যাচ্ছিলেন, ভয় লাগতো না। আদ্র সিড়ি বাইতে বাইতে বলে,
“সকালে যে আমাকে ভিতুর ডিম বলেছিলো আমি তার মতো ভিতুর ছানা নই। অযথা ভয় পাই না আমি।”
নোলক মনে মনে বলে,
“বেটা ফাজিল, সুযোগ পেলেই খোঁচা মারে। ফাজিলের ফাজিল।”
ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আদ্র বলে,
“বকাটকা দিতে ইচ্ছে হলে জোরে জোরে বলতে হয়। মনে মনে বললে ভুতে ধরে।”
বলেই ছাদের মাঝে চলে যায়। নোলক ভাবে, ও যে মনে মনে বকা দিচ্ছিলো তা এই ছেলে জানলো কেমনে?
ভয়ে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সিড়ি ঘরের সামনেই। আদ্র মিটিমিটি হাসে। গলা ছেড়ে বলে,
“কেউ যেন ভয় না পায়। সে নিশ্চিন্তে আসতে পারে। আমি ভুত নই। ঘারও মটকে দিবো না আর কামড়েও দিবো না।”

নোলক তবুও যেন বিশ্বাস করতে পারে না। ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান দৃষ্টিতে চায়।
আদ্র এগিয়ে আসতেই সে দু’পা পিছিয়ে যায়। আদ্র ব্যাঙ্গ করে করে বলে,
“আরেহ বোকা, আসুন! ভয় নেই।”
নোলক থেমে থেমে বলে,
“দেখি, উল্টা ঘুরেন তো।”
আদ্র অনিচ্ছা সহিত উল্টো ঘুরে। নোলক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পায়ের দিকে চায়। আদ্র হালকা ঘাড় ঘুড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
“হয়েছে? এখন কি এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে?”
নোলক যখন সন্দেহমুক্ত হলো তখনই চট করে আদ্রর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদু আওয়াজে বলল,
“এবার হাঁটুন।”
আদ্র হেঁটে ছাদের কার্নিশে এসে দাঁড়ায় সাথে আসে নোলকও। ছাদের মোটা রেলিং এর সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
“আপনি খুবই বাচ্চা টাইপ। খানিক ইম্যাচিউরও। জানেন যে, ভূত-প্রেত বলতে কিছুই নেই। তবুও বাচ্চাদের মতো ভয় পান। এর কোনো মানেই হয় না।”
নোলক কোনো প্রতিবাদ না করে বলে,
“কিন্তু জ্বীন তো আছে!”
আদ্র তাচ্ছিল্য করে বলে,
“জ্বীন অযথা আপনার কাছে আসবে কেন? ইনফ্যাক্ট সে-ও আপনার মতো ছটফটানি তুরতুরি’র কাছে আসতে দশবার ভাববে!”
নোলকের খুব গায়ে লাগলো। মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে, তবে এবারও কোনো প্রতিবাদ করলো না। আদ্র’র চোখ এড়ালো না কিছুই। চাঁদের আলোয় অভিমানি মেয়েটাকে দেখে বরং হাসি পেলো তার। জিজ্ঞেস করলো,
“রাগ করলেন?”
“না!”নোলকের রুক্ষ জবাব।
আদ্র এক হাতে টি-শার্ট এর কোনা টানে আরেক হাত টাউজারের পকেটে রেখে দাঁড়ায়। এই চুপচাপ নোলককে একটু একটু ভালো লাগছে তার। আবার হুটহাট রেগে যাওয়াটাও তেমন খারাপ লাগছে না আজকাল।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে দুজনেই। নিরবতা ভেঙে নোলকই বলে,
“আমার আপুও বলে, আমার নাকি আরো বেশি ম্যাচিউর হওয়া প্রয়োজন।”
“আপনার আপু আছে?”
নোলকের ভয় এবং মন খারাপ দুটোই দূর হয়ে যায় হঠাৎ। বোনকে নিয়ে গল্প করতে তার ভালো লাগে। নোলক ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“হুম। আমার আপু বেস্ট আপু। সে খুব ব্রিলিয়েন্ট। এক হাতে সব সামলে নিতে পারে। আপনার মতো চুপচাপ। আই মিন ইন্ট্রোভার্ট। আপুও চশমা পড়ে। প্রচুর বই পড়ে। অনেক মিল। এত মিলের মাঝে সবচেয়ে বড় অমিল হচ্ছে আমার আপু আপনার মতো পঁচা না।”
আদ্র হাসে, হাসে তার চোখও। স্বচ্ছ কন্ঠে বলে,
“শান্ত বোনের অশান্ত বোন।”
নোলকও হাসে এবার। কথাটা খুব একটা ভুল বলেনি সে।
আশেপাশের বাগান থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ ভেসে আসে। নোলক আরেকটু কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায় আদ্র’র। দূর হতে রজনীগন্ধার ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে আদ্র’র। নোলকের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ বুঝে ঘ্রাণ শুকে নেয় ফুলের। চোখ মেলে নোলককে জিজ্ঞেস করে,
“তখন আমাকে উল্টো ঘুরতে বলেছিলেন কেন?”
নোলক একবার খুব সাবধানে আশেপাশে চোখ বুলায়। তারপর আদ্র’র একটু কাছে ঝুঁকে ফিসফিয়ে বলে,
“আমি শুনেছি ভুত-জ্বীনদের পা উল্টো থাকে। আর মাটি থেকে একটু উপরে হাঁটে। সেটাই পরিক্ষা করে দেখছিলাম।”
নোলকের কথা শেষ হতে না হতে আদ্র আওয়াজ করে হেসে উঠে। যেন এমন মজার কথা এর আগে কখনো শোনেনি সে!
নিস্তব্ধ পরিবেশে আদ্র’র হাসি মৃদু ঝংকার সৃষ্টি করে। নোলকের কানে সেই হাসি বারংবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে। নোলক এই প্রথম এতো মুগ্ধ হয়ে কারো হাসি শোনে! আশ্চর্য! কি আছে এই হাসিতে? কপালে চিন্তিত এক রেখা ভেসে উঠে মেয়েটার। পলকহীন নয়নে, আবছা আলোয় জলছবির মতো সুন্দর পুরুষটাকে দেখে! এ যেন সদ্য আঁকা এক জলছবি!……(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here