প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,২৫

0
410

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,২৫
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

ঘরে ফিরে হাতে-মুখে পানি ছিটিয়ে খাবার টেবিলে বসতেই পরিচিত প্রশ্নের মুখোমুখি হলো ধ্রুব৷ বাবা গম্ভীর মুখে শুধালেন,

‘ তোমার মায়ের কাছে শুনলাম সপ্তাহ দুই আগে মেয়েটির সাথে দেখা করেছ তুমি?’

ধ্রুব খাওয়া থামিয়ে সপ্রশ্ন চোখে বাবার মুখের দিকে চেয়ে রইল৷ মনে মনে এই মানসিক টানাপোড়েন থেকে মুক্তি চাইল। দীর্ঘ মানসিক টানাপোড়েনের পর খুব ক্লান্ত ধ্রুবর মন। এই ক্লান্তি আর বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে বিয়ে নিয়ে নতুন কোনো প্রশ্নবাণ তার পছন্দ হচ্ছে না৷ ধ্রুবর বাবা একটু থামলেন। পোড়-খাওয়া আর্মি অফিসারের তীক্ষ্ণ চোখে পড়ে নিতে চেষ্টা করলেন ছেলের চোখের গোপন কথা। গোপন ব্যথা। বললেন,

‘ তোমার মতামত কী? মেয়ের বাড়ি থেকে বারবার যোগাযোগ করা হচ্ছে। কী জবাব দেব আমরা? মেয়ে পছন্দ হয়েছে তোমার?’

খুব সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ধ্রুব। মাথা নুইয়ে খাবারে মনোযোগ দিলো। ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,

‘ সিনথিয়া ভালো মেয়ে।’

‘ শুধু ভালো মেয়ে? এই ভালো মেয়েকে কী বিয়ে করা যায়?’

ততক্ষণে টেবিলে এসে বসেছে আবির। আলোচনার বিষয়বস্তু শুনেই হাসি হাসি মুখটা বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। ভাবী হিসেবে সে নিশুকেই চায়। চায় মানে চায়। এই নিয়ে ধ্রুবর সাথেও বাকবিতন্ডা হয়েছে বহুবার। ধ্রুব অবশ্য হ্যাঁ, না কোনোরকম প্রতিবাদই করেনি। বরাবরের মতোই নিশ্চুপ থেকে নিজের কাজে মন দিয়েছে। যেন এই বিষয়ে তার কোনো আগ্রহ অবশিষ্ট নেই। আবির মুখ কালো করে বসে রইলো। ধ্রুব বাবার প্রশ্নে স্পষ্ট গাম্ভীর্য নিয়ে বলল,

‘ করা যায়। সিনথিয়া ওয়াইফ ম্যাটারেয়াল মেয়ে। কিন্তু আমার মনে হয় আমার কিছু সময় প্রয়োজন। মাত্র চাকরিতে জয়েন করলাম। কয়েক বছর যাক। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিই। নতুন মানুষের দায়িত্ব নিতে চাইছি না আপাতত।’

এতক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বাবা-ছেলের আলোচনা শোনার পর মুখ খুললেন মা। কঠিন কন্ঠে বললেন,

‘ সেটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিলো না? একটা মেয়ের জন্য ব্যাপারটা অপমানজনক। এসব নিশ্চয় তোমায় নতুন করে শেখাতে হবে না?’

ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মাথা নিচু করে খাবারে মন দিলো। হ্যাঁ, ভাবা উচিত ছিলো। অনেক কিছুই ভাবা উচিত ছিলো ধ্রুবর৷ অনেক কিছু গোছানো উচিত ছিলো। ধ্রুবর মতো মেপে মেপে কাজ করা মানুষের এতোগুলো ভুল হওয়ারও তো কথা ছিলো না কখনো। তবু হলো। ধ্রুবর আসলে কিচ্ছু ঠিকঠাক হচ্ছে না। উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম চারদিকে শুধু ভুলে ভুলে ছাওয়া। এলেমেলো ঘটনা প্রবাহে এলেমেলো সিদ্ধান্তের হাওয়া। ধ্রুব ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ সরি মা।’

মা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিয়ের আলোচনা সেখানেই থেমে গেল। আবির খুশিতে আটখানা হয়ে দুই প্লেট ভাত বেশি খেয়ে ফেলল। কিন্তু ধ্রুবর খাওয়া হলো না। মুখটা তেঁতো তেঁতো ঠেকছে। গলা দিয়ে ভাত নামছে না। কিছুক্ষণ থালার খাবার নাড়াচাড়া করে উঠে গেল। নিজের ঘরের লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই হুহু করে ছুটে এলো এক পশলা দমকা হাওয়া। বুনো গোলাপের বন্য গন্ধ। রেলিঙে ভর দিয়ে অভ্যাস বশত সিঁড়ি ঘরের অন্ধকার কাচের জানালাটায় তাকাল ধ্রুব। এখান থেকে নিচের বারান্দার প্রায় গোটাটায় চোখে পড়ে। কিন্তু আজ নিচের বারান্দাটা খা খা শূন্য। নিশুকে চোখে পড়ছে না। কালও ছিলো না অবশ্য। ছিলো না পরশুও। তবু, আজ নতুন করে মনে হলো, ওই বারান্দাটায় নিশু নেই। নিশু যে প্রায়ই ধ্রুবর লতানো গাছ থেকে গোলাপ ছিঁড়ে কানে গুঁজতো সে ধ্রুবর খুব জানা। এই বারান্দায় বসেই দেখতো খপ করে দুটো ফুল ছিঁড়ে চুলে গুঁজে নিচ্ছে নিশু। প্রথম প্রথম ভীষণ রাগ হতো ধ্রুবর। তারপর ব্যাপারটা হয়ে গিয়েছিল নিয়মিত। সহনীয়। ধ্রুব খেয়াল করল গত দুই সপ্তাহে লতানো গাছের ডালটায় ঝেঁকে আছে বন্য গোলাপ। ফুলের ভারে ভারী ডালটা নুইয়ে পড়েছে নিশুদের বারান্দায়। ধ্রুবর মতো সেও বুঝি মনে মনে নিশুর কথায় ভাবছে? রেলিঙের গায়ে এলিয়ে পড়ে করছে নিশুর অপেক্ষা? ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লতানো গোলাপের ডালটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই মনে পড়ে গেল তার ভাগের গল্পের কথা। যে উপন্যাসে ঔপন্যাসিক ধ্রুবকে বলার অধিকার দেয়নি সেই উপন্যাসের সূচনার কথা। ভূমিকার কথা।

তখন শীতকাল। ধ্রুব পুলিশ ট্রেনিং শেষে সপ্তাহখানেক হলো ময়মনসিংহ ফিরেছে। এক বছরের বিচ্ছেদের পর পুরাতন বন্ধুদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ, আড্ডার ধুম পড়েছে। এমনই এক সন্ধ্যার আড্ডায় হঠাৎ এক বন্ধু খুব টিপ্পনী কাটল,

‘ কী বন্ধু? খুব চালু না? চাকরি পেয়েই সুন্দরী ললনা হাতিয়ে নিয়েছ।’

বন্ধুর কথায় গোটা আড্ডামহলে হৈ হৈ পড়ে গেল। সবার মুখে মুখে ধ্রুবর প্রেম বিষয়ক কথা। চায়ের কাপ আর সিগারেটের সুখটানের থেকেও উপাদেয় সব কল্পনা মেশানো জল্পনা। ধ্রুব অবাক হলো। বন্ধুদের হাসি-ঠাট্টার আদ্যোপান্ত বুঝতে না পেরে প্রচন্ড বিরক্ত হলো। ধ্রুবর বিরক্তিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মোবাইলে এক স্থিরচিত্র দেখালো রবি। সবার হাত ঘুরে ঘুরে ছবিটা ধ্রুবর হাতে আসতেই চমকে উঠল ধ্রুব। প্রচন্ড বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এক সুন্দরী ললনার দিকে চেয়ে আছে ধ্রুব। লম্বা চুলের রূপবতী মেয়েটির ঠোঁটে মিহি, মিষ্টি হাসি। সে-ও হাসি হাসি চোখে মুগ্ধতা মেখে চেয়ে আছে ধ্রুবর পানে। রোমান্টিক চোখে দেখলে এ এক অনবদ্য রোমান্টিক ছবি। অথচ ধ্রুব এক লহমায় বুঝে ফেলল গোটা ছবিটা রঙ চঙ মিশিয়ে এডিট করেছে রবি। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দুই একদিন যাবৎ সে খেয়াল করছে চারতলার বারান্দায় বসে বই পড়ে একটি মেয়ে। মেয়েটির নাম জানে না ধ্রুব। আগ্রহবোধ করেনি। চেহারাটাও স্পষ্ট খেয়াল নেই তার। কখন যে আনমনে বারান্দার দিকে চোখ গিয়েছিল, সেটাও ঠিক মনে নেই তখন। ধ্রুবর এই আত্মপক্ষের সহজ স্বীকারোক্তি কিছুতেই বিশ্বাস করল না বন্ধুরা। সত্যের থেকে মিথ্যায় রস বেশি। সুতরাং তারা মিথ্যার রসটায় শুষে নিলো নিশ্চিন্ত মনে। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ফেলল ধ্রুব প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। বিষয়টাকে খুব একটা পাত্তা দিলো না ধ্রুব। শান্ত হয়ে রইলো। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালেই বন্ধুরা ক্ষেপাবে ভেবে চুপ করে রইল। কিন্তু ঘটনাটা সেখানেই চুপ করে রইলো না। কীভাবে কে জানে? পুরো ক্যাম্পাস ফলাও হয়ে ছড়িয়ে গেল, ধ্রুব প্রেম করছে। ভার্সিটির ছাত্র থাকা অবস্থায় ভালো ক্রিকেট খেলতো ধ্রুব। ক্রিকেটে নাম-ডাক ছিলো। অনুষ্ঠানে উপস্থাপনাও করেছে অসংখ্যবার। ডিপার্টমেন্টের আনুষঙ্গিক কাজ, মোটামুটি ভালো ছাত্র হিসেবে স্যারদের স্নেহ আর পুলিশ ক্যাডারে সুযোগ হওয়ার পর বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছিল সে। সেই পরিচিতিই যেন গলায় ফাঁস হলো এবার। পুরো ক্যাম্পাসে তার প্রেমের উপাখ্যানটা একদম রসালো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। মুখে মুখে প্রচার হতে হতে ব্যাপারটা তিল থেকে তাল হয়ে গেল। ময়মনসিংহ ফেরার পর প্রিয় স্যারের সাথে দেখা করতে গিয়েই বুঝল, ঘটনা অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছে। স্যাররা পর্যন্ত মুখ টিপে হাসছেন। একজন যুবক স্যার, যিনি একসময় এই ডিপার্টমেন্টেরই বড় ভাই ছিলেন, তিনি মুখ টিপে হাসির পর্যায়টা উতরেই গেলেন একসময়। গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ফেললেন,

‘ রূপের মায়া বড় মায়া বৎস৷ রূপের মায়ায় আমাদের ভদ্র সদ্র ছেলেগুলোও ডুবে পানি হয়ে যাচ্ছে!’

অথচ ধ্রুব তখনও নিশুকে ভালো করে চোখের দেখাও দেখেনি। হঠাৎ দেখলে চিনতে পারার উপায় পর্যন্ত নেই, রূপ তো বহু দূরের গল্প। ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। সব বিরক্তি গিয়ে পড়ল অজ্ঞাত ওই মেয়েটির উপর। নিশ্চয় মেয়েটিই কোনো স্বীকারোক্তি দিয়েছে? নয়তো একদম মূল ছাড়া আচমকা একটা ঘটনার ডালপালা ছড়ানোর কারণ কী? তার পরপরই একদিন সার্কিট হাউজের সামনে আবিরের সাথে রিকশায় দেখা দিল সেই মেয়ে। ধ্রুব প্রথমে ভেবেছিল আবিরের কোনো মেয়েবন্ধু হবে। ঘুরতে এসেছে। কিন্তু আবিরের মুখে ভাবী ডাকটা শুনেই ঘটনা পরিষ্কার হয়ে গেল। ধ্রুবর সন্দেহটা তখন অকাট্য বিশ্বাসে পরিণত হলো। নিশ্চয় এই মেয়েরই ছড়ানো সব গুজব। আবিরকে পর্যন্ত হাত করে নিয়েছে? আশ্চর্য! ধ্রুব তখনও ব্যাপারটা গিলে নিয়েছিল। বাবার সামনে ধরা খাওয়ার আগ পর্যন্ত এইসব ফালতু বিষয়ে কোনো রকম ঝামেলা করতে ইচ্ছে হয়নি তার। কিন্তু একদিন সকালে, পরিচিত এক মুদি দোকানদার, যার থেকে ধ্রুবর বন্ধুরা সিগারেট টিগারেট কেনে, সে ধ্রুবকে চূড়ান্ত লজ্জায় ফেলে দিয়ে বাবার সামনেই এক গাল হেসে ফেলল। হাসি হাসি কন্ঠে টিপ্পনী কাটল, ‘ মামা?মামী কিন্তু একদম এক নাম্বার।’ ঠিক সেই মুহূর্তে ধ্রুবর ইচ্ছে করছিল মাটির সাথে মিশে যেতে। এতো রাগ হলো সেদিন! ইচ্ছে হলো নিশুকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে। এতোবড় সাহস মেয়েটার! ধ্রুবর নামে গুজব ছড়ায়! তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, নিশুকে ধরতে হবে। গুজব ছড়ানোর স্বাদটা মিটিয়ে ছাড়বে একদম! ডিপার্টমেন্টের পূর্ব পরিচিত মামাকে ম্যানেজ করে নিশুর সকল ডিটেইলস জোগাড় করল ধ্রুব। ভেবেছিল, নিশুকে কল করে একটু ধমকাধমকি করবে। কিন্তু ‘শাপে বর’ পাওয়ার মতো সিঁড়িতেই দেখা দিয়ে দিলেন সেই মহারাণী। আবির ভেবে তার কাছেই তার বিচার পেশ করা হলো। ধ্রুব এতো আশ্চর্য হয়েছিলো সেদিন। মেয়েটির ভয়ার্ত মুখ দেখে দমফাটা হাসিও পেয়েছিলো। সেদিনই ছিলো নিশুর সাথে ধ্রুবর প্রথম দেখা। প্রথম কথা। সেদিনই নিশুকে মনোযোগ দিয়ে দেখল ধ্রুব। মনে মনে বুঝল, এই মেয়ের পক্ষে এমন গুজব ছড়ানো অসম্ভব। তবুও! মেয়েটিকে এমন কবুতরের ছানার মতো থরথর করে কাঁপতে দেখেই কৌতুক বশত একটু ভয় দেখিয়েছিল ধ্রুব। নাম্বার যেহেতু পেয়েছে, ভয়টা আরেকটু দৃঢ় করতেই, একদম অযথায়, ছোটখাটো একটা হুমকিও ছুড়েছিল ক্ষুদেবার্তায়। ধ্রুব ভেবেছিল এখানেই ইতি হবে গল্পটার। কিন্তু গল্পের ইতি হলো না। কেমন অদ্ভুতভাবে ঘুরে গেল সব চরিত্র। এই চরিত্র পরিবর্তনে দায় কী ধ্রুবর একলার? সকল দোষে দোষী কেবল ধ্রুব? নিশুর কোনো দোষ নেই? একটুও না? দীর্ঘশ্বাস ফেলল ধ্রুব। সেদিন রাতে আর ঘুম হলো না তার। এই নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকার রেখে কেন জানি ঘুমোতে ইচ্ছে হলো না।

ভোরবেলা ঘুমিয়ে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেশ বেলা হয়ে গেল ধ্রুবর। জানালা ভেদ করে কড়া রোদ এসে পড়ছে গায়ে। চোখের উপর হাত মেলে উঠে বসল ধ্রুব। জানালাটা ঠাঁ করে খোলা। কাল রাতে জানালাটা বন্ধ করা হয়েছিল। নিশ্চয় কল্প খুলেছে। অর্থাৎ সকাল সকাল ঘুম ভেঙেই কল্পর বাঁদরামো শুরু হয়ে গিয়েছে। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আলস্যে জড়ানো শরীরটাকে একটু তাড়া দিয়েই অফিসের জন্য তৈরি হয়ে গেল। বসার ঘর পেরিয়ে খাবার টেবিলের দিকে যেতেই দেখল কল্প পা ছড়িয়ে কাঁদছে। কল্পর কান্নার ভিন্ন ভিন্ন ধরন আছে। তার এই কান্নার ধরন বলছে, বাঁদরামো করার যথোপযুক্ত বিষয় না পেয়ে তার কান্না পাচ্ছে। সুতরাং সে কাঁদবে। বাঁদরামোর নতুন বিষয় পেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার কান্না থেমে যাবে। কোনো উপায় অবলম্বন করতে হবে না। অল্পবিস্তর ডাক্তারী সরঞ্জাম নিয়ে তার পাশেই মুখ গম্ভীর করে বসে আছে আবির। মানুষ কাঁদলে তার হার্টবিট এবং পার্লস রেট কেমন হয়, কেমন বেগে চলে কল্পকে নিয়ে সেসব গবেষণা করারই প্রয়াস চালাচ্ছে আবির। কল্প মাঝে মাঝেই কান্না থামিয়ে মনোযোগ দিয়ে আবিরের কান্ড দেখছে। মাঝেমাঝেই এটা-ওটা চট করে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। তারপর যখন কান্না থেমে যাওয়ার ব্যাপারটা উপলব্ধি হচ্ছে তখন আবারও হাপুস নয়নে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে। ধ্রুবকে বসার ঘরে আসতে দেখেই কান্না থেমে গেল কল্পর। ভীষণ উৎসাহ নিয়ে বলল,

‘ আমি অসুখ।’

ধ্রুব চেয়ার টেনে বসতে বসতে গম্ভীরমুখে উত্তর দিল,

‘ গুড।’

কল্প খুশিতে ঝুমঝুমিয়ে উঠল। সে জানে তার বড় ভাইয়া বেশি কথা বলে না। তাই ধ্রুবর থেকে ‘গুড’ শুনেই সে আপ্লুত। যদিও গুড অর্থটা সে ঠিকঠাক জানে না।

বসন্ত পেরিয়ে বৈশাখে পদার্পনের আয়োজন করছে প্রকৃতি। মাথার উপর সোনার থালার মতো দগদগে সূর্যটার কী দুঃসহ তেজ! ঘড়ির কাটা দশটায় গড়াতেই কড়কড়ে রোদে পুড়ে যাচ্ছে শহুরে দোকান, পিচ ঢালা পথ-ঘাট। ধ্রুব বাসা থেকে বেরিয়েই রিকশা নিলো। গরম তাওয়ার মতোই তেতে আছে প্রকৃতি। দু’মিনিটেই গরমে সিদ্ধ হওয়ার জোগার। রিকশাটা ক্যাম্পাসের কাছাকাছি যেতেই চোখে-মুখের বিরক্তিটা উবে গেল ধ্রুবর। অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে গেল মন। ক্যাম্পাসের মূল ফটকের সামনেই কপালে আড়াআড়ি হাত রেখে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে সফেদ শাড়ি পরিহিতা নিশিতা। নাকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। কপালে বিরক্তির চিন্হ। এই দগদগে গরমে দাঁড়িয়ে থাকতে বেচারির কষ্ট হচ্ছে। ধ্রুব আশেপাশে তাকাল। কোথাও কোনো রিকশা নেই। হুট করে পেয়ে যাওয়ার সম্ভবনাও ক্ষীণ। ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রিকশা থেকে নেমে পুরো ভাড়াটা মিটিয়ে দিয়ে বলল,

‘ ওই সাদা শাড়ি পরা আপাকে নিয়ে যাও। আপার সাথে ভাড়া নিয়ে কোনোরূপ ঝামেলা করবে না। যা দেবে, তাই নিয়ে চুপচাপ পৌঁছে দেবে, ঠিক আছে?’

রিকশাচালক প্রত্যুত্তরে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। রিকশাটা সামনে থেকে সরে যেতেই একটু আড়াল হয়ে দাঁড়াল ধ্রুব। নিশুর চোখে পড়ে গেলেই সর্বনাশ। নিশুকে নিয়ে সিদ্ধান্তে হাজারখানেক ভুল করে ফেললেও নিশুকে চিনতে এক বিন্দুও ভুল করেনি ধ্রুব। নিশু খুব নীরব প্রকৃতির মানুষ। আত্মকেন্দ্রিক। সুপ্ত অথচ কী প্রখর আত্মসম্মানবোধ। নিশু যদি একটুও আঁচ করতে পারে রিকশাটা ধ্রুব ঠিক করে দিয়েছে তাহলে রোদে জ্বলে মরে গেলেও রিকশায় উঠবে না সে। ধ্রুব হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। দূরে দাঁড়িয়ে থেকেই নিশুর চলে যাওয়ার অপেক্ষা করল। নিশু ভাড়া ঠিক করে রিকশা নিয়ে চলে যেতেই হাঁটা পথে পুলিশ স্টেশনের দিকে রওনা হলো ধ্রুব। ছায়াহীন নিষ্ঠুর রাস্তায় সূর্যটা সত্যিই বড় জ্বালাচ্ছে!

ঘন্টাখানেক হলো পুলিশ স্টেশনে পৌঁছেছে ধ্রুব। কিন্তু কাজ কিছু হচ্ছে না। লাল ফিতার ফাইলটা নিয়ে ঘন্টাময় বসে থেকেও এক চিলতে মনোযোগ ধরে রাখতে পারছে না। তদন্তের কাজে এক জায়গায় যাওয়ার কথা, সেখানেও যেতে ইচ্ছে করছে না। পুরো পৃথিবী থেকে দূরে, এই পুলিশ স্টেশনের, এই চেয়ারটিতেই চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। ভাবতে ইচ্ছে করছে, সফেদ শাড়ি পরিহিতা খুব বিষণ্ণ, ঘর্মাক্ত এক রমণীকে। ধ্রুব কিছুক্ষণ কপাল চেপে বসে রইল। টানা কয়েক গ্লাস ঠান্ডা পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। নাহ! কিছুতেই নিশুকে ভাবা চলবে না। যেখানে আদ্যোপান্তই শূন্যস্থান, সেখানে এই অহেতুক ভাবনাটা বড় বোকামো, ছেলেমানুষি। কিন্তু মনকে বোঝানো দায়। ধ্রুব ঝিম ধরে বসে রইল। সিদ্ধান্ত নিলো, কোনো উপায়েই নিশুর কোনো খবরাখবর সে রাখবে না। মুখোমুখি হবে না। দেখা হলে চোখ বন্ধ করে রাখবে। কিছুতেই চোখে চোখ রাখবে না। চোখের আড়াল হলেই নিশ্চয় মনের আড়াল হবে নিশু? ভাবনাটা ভেবেও যেন স্বস্তি পেলো না ধ্রুব। খুব বুঝল, নিশুকে সে সম্মুখে যতটা ভালোবাসে। তার থেকেও বেশি ভালোবাসে যখন দেখে না। সফেদ শাড়ি মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঘর্মাক্ত, ক্লান্ত নিশুকে মনেপ্রাণে মন থেকে সরিয়ে দিয়ে কাজে মনোযোগ দিলো ধ্রুব। সারাটাদিন একটিবারের জন্যও নিজেকে প্রশ্রয় দিলো না সে। কিন্তু বিকেল হতেই এক অঘটন ঘটে গেল। ধ্রুবর সকল প্রতিজ্ঞা ভাসিয়ে দিয়ে তরুর কল এলো। ধ্রুবর প্রথমে ফোন তোলার ইচ্ছে হলো না। বাজতে থাকা ফোনের দিকে চুপচাপ চেয়ে রইল। কিন্তু তরু নাছোড়বান্দা। সে একে একে পাঁচবার কল দিয়ে ফেলল। একরকম বাধ্য হয়েই ফোন তুললো ধ্রুব। ধ্রুবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মুখ ছুটাল তরু,

‘ বুঝলি ধ্রুব? বিরাট আপদে আটকে গেছি। আপদ মানে ভয়াবহ আপদ।’

ধ্রুব হতাশ হয়ে বলল,

‘ কী হয়েছে?’

তরু গম্ভীর মুখে বলল,

‘ আজ তোর আমার বাড়িতে দাওয়াত। আয়, দাওয়াত খেয়ে যা।’

‘ তোর বাড়ি মানে? কোথায় আছিস?’

‘ ময়মনসিংহেই আছি। টুনটুনির বাসায় আছি। আর এখানেই ফেঁসে গিয়েছি।’

ধ্রুব বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ অযথা পেঁচাবি না। কাহিনি বল। তুই এখানে কী করিস? ভাগ্নী পাহাড়া দিচ্ছিস?’

তরু হতাশ হলো। মুখ বিকৃত করে বলল,

‘ আরে ধুর! এই আপদের হঠাৎ শখ হয়েছে মেয়ের কাছে থাকবে। তো থাকবে, থাকুক। প্রয়োজনে সারাজীবন থাকুক। তাতে আমার বাপের কী? কিন্তু হঠাৎ এই আপদ আইন জারি করেছে আমাকেও তার সাথে থাকতে হবে। আর যে কদিন থাকব, বাহিরে যেতে পারব না। আমি নাকি রাস্কেল। ফুঁস করে টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়ে যেতে পারি। তুইই বল, এটা কোনো কথা?’

ধ্রুব জবাব না দিয়ে মৃদু হাসল। তরু দুঃখী কন্ঠে বলল,

‘ কিছুদিন আগে শখ করে সিলেট গিয়ে, শখ করে একটা চায়ের ফ্লাক্স কিনেছিলাম। সেই ফ্লাক্স ভর্তি চা আনার পরও আপদের মন ভরেনি। সে আমার প্যান্ট, শার্ট সব বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছে। এই কয়েকদিন আমাকে আদিম নর হয়ে থাকতে হবে। প্যান্ট,শার্ট পরা যাবে না। প্যান্ট, শার্ট পেলেই নাকি আমি ভেগে যাব। এটা আমার পানিশমেন্ট। আমি যে ধুম করেই আদম-হাওয়ার যুগে বসবাস করছি, বুঝতে পারছিস? চারদিকে শুধু হাওয়া আর হাওয়া। বাসায় দু’দুটো যুবতী ভাগ্নী৷ আমার একটা মানসম্মান আছে না?’

ধ্রুব বিস্মিত হলো। হালকা কেঁশে গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে বলল,

‘ শার্ট, প্যান্ট বাজেয়াপ্ত বলতে কী বুঝাতে চাইছিস? তোর দুলাভাই তোকে একদম বিবস্ত্র করে ছেড়ে দিয়েছে? উলঙ্গ হয়ে ঘোরাফেরা করছিস নাকি?’

তরু খুব গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ উঁহু। আমাকে একটা লুঙ্গি দেওয়া হয়েছে। জীবনের প্রথম লুঙ্গি পরায় লুঙ্গি কোথায় থাকছে। আমি কোথায় থাকছি কিছুই বুঝতে পারছি না, দোস্ত। মাঝে মাঝে দেখছি আমি আছি কিন্তু লুঙ্গি নেই। আবার দেখছি লুঙ্গি আছে আমি নেই। ভীষণ ফ্যাসাদে পড়ে গিয়েছি দোস্ত। বাচ্চাদুটো বাসায় ঘোরাফেরা করছে কখন কী অঘটন ঘটে যায়। আতঙ্কে অস্থির হয়ে আছি। তুই তাড়াতাড়ি দাওয়াত খেতে আয়।’

ধ্রুব যারপরনাই অবাক হয়ে বলল,

‘ তোর বস্ত্র হরণের সাথে আমার দাওয়াত খেতে যাওয়ার কী সম্পর্ক? আমি কী গিয়ে তোর লুঙ্গি ধরে থাকব?’

‘ না। তুই দাওয়াত খাওয়ার নাম করে গেরিলা যুদ্ধার মতো লুকিয়ে চুরিয়ে আমার জন্য একটা প্যান্ট আর শার্ট আনবি। আমার দুলাভাই ভীষণ চালাক। তোকে হতে হবে ভীষণ চালাক স্কয়ার। জলদি আয়, কুইক।’

ধ্রুব যেন প্রমাদ গুণলো। শখ করে নিশুর বাসায় গিয়ে কেইস খাওয়ার কোনো ইচ্ছে তার নেই। নিশু তাকে দেখলেই ক্ষেপে যাবে। রাগের মাথায় ধ্রুবর মাথা ফাটিয়ে ফেলাও আশ্চর্য নয়। তাছাড়া নিশুকে ঘন ঘন দেখলে ধ্রুবরও খুব ঝামেলায় পড়তে হয়। সুতরাং, ধ্রুবর মাথায় বন্দুক ধরে ট্রিগার চেপে দিলেও ও বাড়িতে পা ফেলা ধ্রুবর নিষেধ। একদম হারাম জিনিসের মতো নিষেধ। ধ্রুব স্পষ্ট কন্ঠে প্রস্তাব নাকজ করল। বলল,

‘ আমার অনেক কাজ। কঠিন শিডিউল। গেরিলা যুদ্ধ করার সময় আমার নেই। তুই রবি বা অর্ককে ফোন কর।’

তরু আর্তনাদ করে উঠে বলল,

‘ অসম্ভব। রবি শালা বিরাট বেয়াদব। এর মুখে কোনো কন্ট্রোল নেই। আপদের সামনে আরেক আপদকে নিয়ে আসা মানেই বিস্ফোরণ। পরে দেখা যাবে, শেষ সম্বল হিসেবে লুঙ্গিটাও আমার নেই। ক্ষুদে বস্ত্র হারিয়ে আমি ভ্যাবা চরণ হয়ে ঘুরছি।’

ধ্রুব চোখ-মুখ শক্ত করে বলল,

‘ আমি পারব না।’

‘ অবশ্যই পারবি। সারা জীবন কেমিস্ট্রি পড়ে পুলিশ অফিসার হয়ে গেলি আর একটা সিম্পল দাওয়াত খেতে আসতে পারবি না? টুনটুনি আজ রান্না করছে। ওর রান্নার হাত দূর্দান্ত। বাচ্চাটা হঠাৎ করেই কেমন শান্ত হয়ে গেছে বুঝলি? এমনিতেও সে শান্ত বাচ্চা। তবুও হুট করেই উইক। খাওয়া-দাওয়া করছে না। দুলাভাই খুব দুশ্চিন্তায় আছে ওকে নিয়ে।’

শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে দুশ্চিন্তায় আনমনা হয়ে গেল তরু। ধ্রুব বুঝল চিন্তাটা আসলে দুলাভাইয়ের নয় তরুর নিজস্ব। নিশুকে নিয়ে সে চিন্তিত। একমাত্র ভাগ্নীকে যে তরু প্রাণাধিক ভালোবাসে তা তরুর ছোট্ট ছোট্ট আচরণেই স্পষ্ট। তরু যদি জানতে পারে তার প্রাণের ভাগ্নীর এই অবস্থার জন্য তার প্রাণের বন্ধুটিই দায়ী। তবে ব্যাপারটা কেমন হবে? ধ্রুব খুব অসহায়বোধ করল। তরুকে শেষবারের মতো নিষেধ করে বলল,

‘ রবিকে বলতে না পারলে অর্ককে বল। আমি যেতে পারব না। সত্যিই খুব ব্যস্ত।’

তরু স্পষ্ট রোষ প্রকাশ করে বলল,

‘ কদাপি নহে। তোকেই আসতে হবে। অর্কের নজরে সমস্যা আছে। বাসায় টুনটুনি আছে। ওকে আমি বাসায় ঢুকার পারমিশন দিতে পারি না। দেখা গেল, সে টুনটুনির দিকে বাঁকা চোখে তাকাল। আর সাথে সাথেই আপদ আমাকে কেটে কুটে নদীতে ভাসিয়ে দিল। অতি অবশ্যই লুঙ্গিটা নিয়ে তারপর ভাসাবে। খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। তুই এলে সবদিক থেকে সেইফ।’

হেসে ফেলল ধ্রুব। খাল কেটে কুমির আনা বুঝি একেই বলে? তরুকে সে কী করে বলবে? রবি বা অর্ক নয় ধ্রুব নিজেই মূর্তমান একটা সমস্যা। তার ভাগ্নির জন্য সবচেয়ে বড় রিস্ক!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here