#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল
#তানিয়া
পর্ব:২৩
বাড়ি ভর্তি মানুষ, চারদিকে আলোয় ঝলমল করছে কিন্তু মেহুর মনে হচ্ছে তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে এ মুহুর্তে এ বাড়ি থেকে বহু দূরে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। কিন্তু কোথায় যাবে,যদি যাওয়ার জায়গা থাকতো তাহলে হয়তো আজকের এত বড় অন্যায় চোখের সামনে দেখতে হতো না।মেহু মনে মনে শপথ করেছিল সে কাঁদবে না তবে চোখের জল এতটাই বেঈমান যে শুকানোর আগেই ভিজে উঠছে।
নিচের হৈ হট্টগোলের শব্দ উপরেও ভেসে আসছে। বাহির থেকে কত শত মানুষের আনাগোনা। কত অতিথির শুভেচ্ছা বার্তা।আহ্ কত আয়োজন করে অনুষ্ঠান হচ্ছে এ বাড়ির মেজ ছেলের এনগেজমেন্টের।মেহু এখনো কাউকে দেখেনি। না ছেলে আর না মেয়ে।
দুপুরের পর থেকে সে যে এ রুমে আবদ্ধ হয়েছে আর বের হয় নি।এমনকি কেউ এসে একটিবারের জন্যও জিজ্ঞেসও করে নি যে মেহুর মনের অবস্থা কেমন?কিই বা হবে জিজ্ঞেস করে যা হওয়ার তা তো একটু পর ঘটেই যাবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে মেহু নিচে যেতেই দেখতে পায় চারপাশে বাড়ি সাজানোর কাজ চলছে।কখন থেকে শুরু হয়েছে কে জানে কিন্তু এ সাতসকালেই যেভাবে সাজানো হয়েছে তাতেই মেহুর চক্ষু চড়কগাছ। অল্প সময়ে বাড়ির সাজ প্রায় বদলে গেছে। মেহু এখনো জানে না কি হচ্ছে এ বাড়িতে?যেভাবে শোরগোল হচ্ছে তাতে নিশ্চয়ই এ বাড়ির সবাই জেগে উঠেছে কাউকে জিজ্ঞেস করলে জানা যেত।
হুট করে ব্যস্ততার ভঙ্গিতে উপর থেকে নীলা নেমে আসতেই মেহু তার দিকে এগিয়ে যায়। মেহুকে দেখে নীলার মুখটা পাংশুটে হয়ে যায়। মেহু সরাসরি নীলাকে জিজ্ঞেস করে হঠাৎ বাড়ি সাজানোর কারণ কি?নীলা হাত কচলাতে কচলাতে বলে,
“মেহু একটা খবর তোমাকে জানানো হয় নি আসলে আজই আদ্যর এনগেজমেন্ট। সন্ধ্যার মধ্যেই অতিথি রা আসতে শুরু করবে।শুধু তাই নয় সোহানার বাবা সাজ্জাদ আঙ্কেল গতকাল ফ্লাইটেই উঠে পড়েছেন।মেবি সন্ধ্যার আগেই এসে পৌঁছেবেন।”
মেহু স্তব্ধ হয়ে যায়। তার কানে অন্য কথা গুলো যাচ্ছে না শুধু একটা কথায় বাজছে আজ সন্ধ্যায় আদ্যর এনগেজমেন্ট। মেহুর চোখ ভরে এলো।নীলা সেটা দেখে চোখ নামিয়ে বলে,
“আমরা কেউ কিছুই জানতাম না মেহু।একটু আগেই জানলাম।এমনকি মা নিজেও জানতো না।পুরো প্ল্যানটা করেছে বাবা নিজেই।ওনি হয়তো আগে থেকে সবটা ঠিক করে রেখেছিলেন।সাজ্জাদ আঙ্কেল আসলেই এনগেজমেন্টের কাজটা হয়ে যাবে তবে এত তাড়াতাড়ি হবে সেটা কল্পনা করিনি।মা নিজেও কান্নাকাটি করছেন বাবাকে বোঝাচ্ছেন কিন্তু বাবা যে একরোখা মায়ের কথাকে গ্রাহ্যই করছে না।তিনি নিজের মতো ডেকোরেশনের সবটা সামলাচ্ছেন।”
মেহু নীলার বাকি কথা না শুনেই দৌড়ে রান্নাঘরে চলে গেলো।আমেনা খালা কি জানে এসব?তাহলে তাকে কেনো ডেকে তুললো না?রান্নাঘরের চৌকাঠে দাঁড়াতে দেখে আমেনা খালা শাড়ির আঁচলে মুখ ডেকে কান্না করছে।মেহুকে দেখেই তিনি চোখ মুছেন।মেহু সপ্রশ্নে তাকাতে তিনি চোখ নামিয়ে কান্না করে দেন।
মেহু রান্নাঘর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে এ বাড়িতে যা হচ্ছে তাতে মেহুর কিছু যায় আসেনা।মেহু চা নাশতায় মনোযোগী হয়।বাইরের এত মানুষ কাজ করছে নিশ্চয় সবার জন্য নাশতার ব্যবস্থা করতে হবে।মেহু সেদিকটা সামলাতে ব্যস্ত। আমেনা মেহুকে দেখে ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। মেহু মাঝে মাঝে বিরক্তর শব্দ করে যেন আমেনা অকারণে কেঁদে তার কাজে বাঁধা দিচ্ছে। আদ্য শাওয়ার নিয়ে নিচে আসতেই হকচকিয়ে যায়। এসব দেখার প্রস্তুতি সেই নেয়নি।তবে নিচে এসে সবচেয়ে যেটা আকৃষ্ট করলো সেটা হলো মেহুর স্বাভাবিক ভাবভঙ্গি। সে কতো সহজে ডেকোরেশন মানুষগুলোর সাথে কথা বলছে তাদের ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে কীভাবে কি করলে সুন্দর হবে!
কথার মাঝে আদ্যকে দেখে হেসে দেয়।তারপর অন্যদিকে গিয়ে কাজ করতে থাকে।আদ্য বুঝতে পারছে না এ মুহুর্তে তাদের বাসায় কি হচ্ছে?
নাশতার টেবিলে লুৎফা আসেনি।মোটামুটি বাকিরা এসেছে। শাহেদ খাওয়ার মাঝখানেই বলে,
“আদ্য তুমি কি জানো এত আয়োজন কার জন্য? এগুলো সব তোমার আর সোহানার এনগেজমেন্টের আয়োজন।সাজ্জাদ আজ সন্ধ্যার মধ্যেই এ বাড়িতে চলে আসবে আর ও এলেই তোমাদের এনগেজমেন্টের কাজটা সেরে ফেলবো।তাছাড়া অন্য কিছু নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।আমি একাই সবটা সামলাবো।টাকা থাকলে কখনো কাজের মানুষের অভাব পড়ে না।তাই বলে তোমরা প্রস্তুতি ছাড়া থাকবে না খাওয়ার পর এক্ষুনি তুমি আর সোহানা শপিং এ যাবে সাথে নীলা আর সূচীকেও নিয়ে যাবে।যা যা কেনার সব কিনে আনবে।তোমার মা অযথা আমার ওপর রাগ করছেন তার ধারণা আমি অন্যায় করছি।আরে বাবা আমি যদি অন্যায় করতাম তাহলে একেবারে বিয়ের কাজটাই সেরে ফেলতাম এনগেজমেন্ট কেন করছি?যাই হোক কে কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না।তুমি এক্ষুনি রওনা হও।”
সূচী জানালো তার কাজ আছে সেই অযুহাতে সে যাবে না সিদ্ধান্ত নিলো।বেচারি নীলা আহত চোখে সূচীকে দেখছে।তার নিজেরও যেতে ইচ্ছে করছেনা কিন্তু শ্বশুরের মুখের ওপর চট করে সে তো আর না বলতো পারে না।যতই হোক শাহেদ তার শ্বশুর আর শাহেদকে সে বড়ই ভয় পায়।
বাবার কথায় আদ্য চমকালো না।যা চমকানোর সে আগেই চমকে গেছে। নীলা তাকে যখন জানালো আজই তার এনগেজমেন্ট তখন সে কয়েক মুহূর্তের জন্য নিরব হয়ে গেলো আর অবাক হলো এমন একটা বিষয় জেনেও মেহু কীভাবে সহজ হয়েছে। তাকে দেখে মেহু যেভাবে হাসলো তাতে কি ছিল, রাগ,ঘৃণা নাকি উপহাস?
সোহানা খুব আনন্দ করে শপিং করছে।হঠাৎ এনগেজমেন্টের আয়োজনে যেন তার কোনো সমস্যা নেই। খুব মন দিয়ে শপিং এর কাজটা শেষ করছে।আদ্যর কিছুই ভালো লাগছে না বারবার সোহানা তাকে এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে।আদ্যর ইচ্ছে করছে নিরিবিলি কোথাও গিয়ে খানিকটা একাকী সময় পার করুক কিন্তু আজ সেটা একেবারেই অসম্ভব।
বাসায় ফিরতে প্রায় বিকেল হয়ে গেলো।এরমধ্যে তাড়াহুড়ো করে যা কিনেছে তার সাথে শাহেদ নিজেও বেশ কিছু জিনিস সংগ্রহ করে রেখেছিল।শাহেদের কাজ দেখে সবার বুঝতে বাকি রইলো না এ কাজটা তিনি অনেক আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছিলেন শুধু মাত্র আদ্যর হ্যাঁ শব্দটা উচ্চারণ করতেই তিনি কাজের তোরজোর লাগালেন।তার মানে তিনি আগে থেকেই প্ল্যানিং করে রেখে ছিলেন সবটা।
সন্ধ্যা মিলতেই অতিথিরা আসতে শুরু করে।কতো বড় বড় মানুষ আসছে যারা এ শহরের কিছু বিশিষ্ট মানুষ। তাছাড়া সাজ্জাদ সাহেবও চলে এসেছেন।এখন শুধু অপেক্ষার পালা কখন শুরু হবে অনুষ্ঠান।
মেহু দুপুরের পর নিজের রুমে ঢুকেছে আর বের হয় নি।এরমধ্যে কেউ আশেপাশে ঘেষে নি কারণ মেহুর জন্য আজকের দিনটা কতটা কষ্টের সেটা সবাই জানে তাই সহানুভূতি দেখানোর মতো সাহাস কারো নেই। মেহুর সাথে লুৎফার একবারও দেখা হয় নি সকালে মেহু নাশতা নিয়ে গেলে তিনি শুধু একটা কথায় বলেন মেহু যাতে চলে যায়। মেহু জানে এ মানুষটা তার কথা ভেবেই এতটা অস্থির আর কষ্ট পাচ্ছে তাই নিরবে সরে আসে।তারপর নিজের রুমে যে ঢুকলো আর বের হয় নি।মেহু জানলার পাশে গুটিসুটি মেরে বসে রইলো।তার চোখ দিয়ে ক্রমাগত অশ্রু ঝরছে।
সোহানা আর আদ্য এখন ডায়াসে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের ওপর আলো ফেলা হয়েছে। হালকা আলো,তবুও আদ্য চোখ বুঝে নিলো।ইচ্ছে করছে নিকষ কালো আঁধারে বসে থাকতে কিন্তু সেটা সম্ভব না এখন তাকে এ ঝলমলে আলোয় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।আদ্য চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে কোথাও তার অতি প্রিয় মানুষরা আছে কিনা।দৃষ্টি ঘুরিয়ে কাউকে দেখলো না।না মাকে দেখলো আর না……।যার উদ্দেশ্য আদ্য এতকিছু করলো সেই মানুষটা উপস্থিত নেই। আদ্য ভেবেছিল শেষ মুহুর্তে মিরাকল ঘটবে কিন্তু এখন সবকিছু উল্টো হচ্ছে। আদ্যর কষ্ট হচ্ছে ভীষণ কষ্ট কি করবে সে?পালিয়ে যাবে কিন্তু এত লোকের সামনে পালাতে গেলে তো তার পরিবার লজ্জিত হবে, তার বাবা, সোহানা, সোহানার বাবা না আদ্য ভাবতে পারছে না তার মাথার দুপাশের রগগুলো দপদপ করছে।এ মুহুর্তে তার নির্জনতা দরকার খুব বেশি নির্জন।
শাহেদ আহসান খুব আনন্দে ডায়াসে উঠেই অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।
“ডিয়ার লেডিস এন্ড জেন্টেল ম্যান আজ আপনাদের সামনে আমার মেজ ছেলে আর আমার বন্ধুর সাজ্জাদের মেয়ের এনগেজমেন্ট ঘোষণা করছি।তাদের জীবনের আনন্দময় সময়ে আপনারা ভালোবাসা আর দোয়া দিয়ে সাথে থাকুন।এখন শুরু হবে আংটি বদল পালা।আপনাদের করতালি আশা করছি।”
সাথে সাথে চারপাশ থেকে বৃষ্টির গতির মতো করতালি বর্ষণ হলো।আদ্য আংটি নিতেই সোহানা হাত বাড়িয়ে দিলো।আদ্য আংটি পরানোর পর এবার তার পালা কিন্তু সে হাত বাড়াচ্ছে না।শাহেদ আদ্যর গা ঘেঁষে ফিসফিস করতে আদ্য হাত বাড়িয়ে দিলো।
লুৎফা রুমে বসেছিল তার প্রেসার বেড়ে গেছে। ঘরদোর অন্ধকার করে সেই শুয়ে পড়েছে।আমেনা একটু পর পর উঁকি দিচ্ছে।আদ্যর আংটি বদল দেখে আমেনা হু হু করে কাঁদতে থাকে।
বেশ কয়েকবার আমেনা ছাদে গিয়েছিল মেহুকে দেখতে তারও একি অবস্থা। সেও দরজা জানলা বন্ধ করে ভেতরে বসে আছে। আমেনা কয়েকবার দরজা বাড়ি দিতে মেহু হুংকার ছাড়ে।মেহুর হুংকারে আমেনা বুঝতে পারে সে কাঁদছে।কারণ যত বারই আমেনা মেহুর আওয়াজ শুনেছে ততবারই মেহুর গলাটা ভার মনে হচ্ছিল।আমেনা শুধু চাইছিল মেহু যেন নিজেকে ঠিক রাখে।অন্তত আদ্যর এমন কাজে যেন উলোটপালোট কিছু করে না বসে।তাই বারবার তার খোঁজ নিচ্ছিল।
অনুষ্ঠান প্রায় শেষ। অতিথিরা অনেক আগেই চলে গেছেন।তাছাড়া বাইরের আবহাওয়া খুব একটা ভালো না।ছোট খাটো একটা ঝড় হয়ে গেছে তাই কেউ বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ পায় নি।সাজ্জাদও লং জার্নি করে অনেকটা টায়ার্ড। তাই সে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে গেলো।শাহেদও হুট করে সব কিছু আয়োজন করাতে অনেকটা ধকল সামলেছে।এ মুহুর্তে আহসান ভিলা পুরো নিরবতায় ছেয়ে গেছে।কিন্তু দুজন মানুষ জেগে আছে দুই প্রান্তে।ঠান্ডা বাতাসটা গায়ে লাগতে বারবার শিউরে উঠছে মেহু।বুঝতে পারছে জ্বর আসতে শুরু করেছে।তবুও জানলা ছাড়তে ইচ্ছে করছেনা। এ বাতাসটায় তার শরীরের সকল ক্লান্তি আর অবসাদকে যেন দূরীভূত করছে তাই সেটাকে গায়ে মাখতে খুব আরাম পাচ্ছে মেহু।
ঠকঠক করে দরজায় টোকা পড়ছে।মেহুর সন্দেহ হচ্ছে কে হতে পারে?কারণ এত রাতে একজন মানুষ ছাড়া আর কেউ তার ঘরে আসে না তাহলে কি?মেহুর দরজা খুলতে ইচ্ছে করছেনা সেই শক্তি তার শরীরে নেই।আবারও আওয়াজ ভেসে আসছে।এতরাতে তার ঘরে আসার কারণ কি?নিশ্চয়ই নিচে কেনো যায় নি সেই কারণ জানতে?কিন্তু মেহুর সেসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা তার এ মুহুর্তে একা থাকতে ভালো লাগছে। কি হবে সেসব কথা বলে যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আজ এনগেজমেন্ট হয়েছে দেখতে দেখতে বিয়েও হয়ে যাবে তখন হয়তো মেহু আর এ বাড়িতে থাকবে না।ভাবতেই আবারও চোখ ভরে উঠলো।
,
,
,
চলবে…….