প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,০২,০৩

0
483

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প,০২,০৩
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|২|

ভীষণ পৌষের আশ্চর্য এক দুপুর। সিঁড়ি ঘরের ফ্যাকাশে কাঁচ গেলে ধ্রুবর গায়ে এসে পড়ছে এক মুঠো সোনালি রোদ্দুর। বাদামী পেটানো চেহারাটায় ঝলমল করছে আদুরে মিষ্টি হাসির রেখা। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে কপালে। আমি বরাবরের মতোই মুগ্ধ চোখে চাইলাম। কিছুটা এলোমেলো, কিছুটা বিভ্রান্ত অনুভূতি নিয়ে চুপ করে রইলাম। আমাকে স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফুঁসে উঠল প্রিয়তা। আমাকে একহাতে পেছনে টেনে আমায় আড়াল করে দাঁড়াল। ধারালো কন্ঠে বলল,

‘ আপনি তো খুব অসভ্য মানুষ মশাই! কথা নেই, বার্তা নেই। বিনা নোটিশে ভাবি ডেকে ফেললেন? আপনার কোনো ধারণা আছে? আপনার একটা ভাবি ডাকে কারো এট্যাক ফ্যাটাক হয়ে যেতে পারে?’

ধ্রুবর শ্যাম সুন্দর চেহারায় বিস্ময় খেলে গেল। আকাশ থেকে পড়ার মতো আশ্চর্য হয়ে বলল,

‘ এট্যাক হয়ে যেতে পারে? মানে কী? আমার ভাবী ডাকার সাথে কারো এট্যাক হওয়ার কী সম্পর্ক?’

ধ্রুবর সরল প্রশ্নে জ্বলে উঠল প্রিয়তা। আমার দিকে চেয়ে প্রচন্ড ক্ষোভ নিয়ে বলল,

‘ দেখ, কেমন বেয়াদব ছেলে! মনে হচ্ছে, ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না! একে তো পাঁচ তলা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া উচিত রে নিশু?’

আমি প্রিয়তাকে টেনে আমার পেছনে দাঁড় করালাম। নিজেকে সামলে নিয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ভ্রু কুঁচকে বললাম,

‘ দেখো ধ্রুব….’

আমার কথা শুনে ধ্রুব ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে চাইল। আশেপাশে দেখে বলল,

‘ আমায় বলছ?’

‘ তুমি ছাড়া ধ্রুব নামে দ্বিতীয় কেউ আছে এখানে?’

ধ্রুব বিভ্রান্ত হয়ে বলল,

‘ সেটাই তো! এখানে তো ভাইয়া নেই। তুমি আমাকে ধ্রুব বলে ডাকছ কেন?’

ভীষণ বিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল আমার। এক রকম থম ধরা দৃষ্টিতে যন্ত্রের মতো প্রিয়তার দিকে চাইলাম। প্রিয়তা অবাক হলো তার থেকেও বেশি। ঝুলে পড়া চোয়াল নিয়ে চোখ বড় বড় করে চাইল। আমার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘ এই পাগল ছাগল কী বলে রে নিশু? ধ্রুবকে ধ্রুব ডাকবে না তো কী ডাকবে? প্রিয়তম?’

আমি প্রিয়তার দিকে চেয়ে চোখ রাঙালাম। ইশারায় চুপ থাকতে বলে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। সন্দিহান কন্ঠে শুধালাম,

‘ তুমি ধ্রুব নও?’

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল,

‘ আমি ধ্রুব হব কেন? আমায় ধ্রুবর মতো দেখায়?’

প্রশ্নটা করে উত্তরের আশায় আমার চোখে চেয়ে রইল ধ্রুব। এমন অদ্ভুত প্রশ্নের জবাব খুঁজে না পেয়ে চোখ পিটপিট করে চাইলাম আমি। প্রিয়তা ফোঁড়ন কেটে বলল,

‘ আহহা! কদু জিগায় আমায় লাউয়ের মতো দেখাচ্ছে, প্রিয়তমা? আপনার বাড়িতে আয়না টায়না নেই মশাই? আমাদের বাসায় আছে। দিব? দেখবেন? আজাইরা পাবলিক।’

ধ্রুব এবার বিরক্ত হলো। প্রিয়তাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে আমার দিকে চাইল। মৃদু হেসে বলল,

‘ তোমাকে কিন্তু আমার খুব পছন্দ হয়েছে ভাবী। তোমার চোখগুলো সুন্দর। খুব সুন্দর করে তাকাও।’

ধ্রুবর কথা শেষ না হতেই উত্তর দিল প্রিয়তা,

‘ এতোই যখন পছন্দ হয় তো নিজেই বিয়ে করে নিন না? এতো ভাবী ভাবী করছেন কেন?’

ধ্রুব এবার থতমত খেয়ে গেলো। আমার দিকে অসহায় চোখে চেয়ে প্রিয়তার দিকে চাইল। এদের দুজনের কথা কাটাকাটিতে কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে চেয়ে থেকে ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,

‘ তুমি কী আমার সাথে ফাজলামো করছ ধ্রুব? তুমি ধ্রুব নও তো কে? ধ্রুবর ভূত?’

ধ্রুব হেসে বলল,

‘ ভূত হবো কেন? আমি ওর ভাই।’

আমি আর প্রিয়তা একে অপরের দিকে চাইলাম। চোখ ছোট ছোট করে ধ্রুবকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে প্রায় একই সাথে চেঁচিয়ে উঠলাম,

‘ ভাই!’

ধ্রুব মাথা নাড়ল। প্রিয়তা বিড়বিড় করে বলল,

‘ একদম বিশ্বাস করবি না নিশু। সব ভাঁওতাবাজি। বেয়াদবটা নির্ঘাত ফাজলামো টাজলামো করছে। এমনও হয় নাকি কখনও?’

ধ্রুবর গায়ে তখন সাদা কালো চেইক শার্ট। শ্যামলা মুখটিতে ভাসা ভাসা দুটো চোখ। স্বাভাবিকের তুলনায় ঘন তার আঁখি পল্লব। দুপুরের হালকা রোদ্দুরে স্বপ্নময় লাগছে তার চিবুক। মেদহীন আঁটসাঁট দীর্ঘ শরীর। কোথাও কোনো অমিল নেই। নেই কোনো ছন্দ পতন। আমি ধ্রুবকে আগাগোড়া নিরক্ষণ করে সন্দিহান চোখে চাইলাম। প্রচন্ড অবিশ্বাস নিয়ে বললাম,

‘ তোমরা জমজ?’

ধ্রুব মাথা নেড়ে বলল,

‘ না তো! জমজ হবো কেন? আমি ভাইয়ার থেকে তিন বছরের ছোট।’

আমার অবিশ্বাস এবার আকাশ ছুঁলো। এমনও হয় কখনও? তিন বছরের ছোট-বড় দুই ভাইয়ের মাঝে এতো মিল আদৌ সম্ভব? এ নিশ্চয় কোনো রূপকথা নয়? ধ্রুবর এমন অদ্ভূত ফাজলামোতে মেজাজ খারাপ হলো আমার। সুপ্ত রাগ নিয়ে বললাম,

‘ আমাকে তোমার পাগল মনে হয় ধ্রুব? ফাজলামো করছ? তুমি ধ্রুব নও। ধ্রুবর জমজও নও। তবে ধ্রুবর মতো দেখতে কী করে?’

ধ্রুব হতাশ হয়ে বলল,

‘ আমি আর ভাইয়া একদমই এক রকম নই। ভাইয়া আমার থেকে ফর্সা। ভাইয়ার চুল হালকা বাদামী, আমার চুল কালো। ভাইয়ার চিবুকে তিল আছে, আমার নেই। এই দেখো? কতো অমিল।’

কথাটা বলে ধ্রুব তার জিরাফের মতো লম্বা ঘাড়খানা নামিয়ে আমার মুখের সামনে ধরলো। আমি ধ্রুবকে সবসময়ই দূর থেকে দেখেছি। ওর চিবুকের কালো তিল খেয়াল করা হয়নি। আমি কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। তিন বছরের ছোট-বড় ভাইদের মাঝে এতো মিল হতে পারে বিশ্বাস করতে খানিক কষ্ট হলো। আমার চোখে মুখে অবিশ্বাস দেখে মুখ কালো করে সরে গেলো ধ্রুব। মন খারাপ করে বলল,

‘ ভাইয়ার স্বাস্থ্যটাও তো আমার থেকে ভালো। তুমি খেয়াল করোনি?’

আমি জবাব না দিয়ে সরু চোখে চাইলাম। এই ধ্রুবকে প্রতিদিনকার ধ্রুব থেকে কিছুটা পাতলা বলেই মনে হলো। কিন্তু বাকি সব একই রকম। সেই একই নাক। একই চোখ। একই চিবুক। একই রকম পেটানো চেহারা। আমি অসহায় কন্ঠে বললাম,

‘ জমজ না হয়েও ভাইয়ে ভাইয়ে এতো মিল হয়?’

ধ্রুব আমার থেকেও অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ আমাদের তো হলো!’

আমি সরু চোখে চাইলাম। হতাশ নিশ্বাস ফেলে বললাম,

‘ বেশ! বিশ্বাস করলাম। কিন্তু তোমার নাম কী? ধ্রুবর ভাই তারা? ধ্রুব তারা?’

ধ্রুব মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘ তারা কেন হবে? আমার নাম আবির। আবির হাসান।’

ধ্রুবর কথাটা ঠিক বিশ্বাস করতে না পারলেও তার মুখের অভিমানটুকু বেশ লাগল। ঠোঁটের কোণে অভিমান ঝুলিয়ে রেখে বাচ্চাদের মতো কথা বলতে দেখে মৃদু হাসলাম। সিঁড়ির ধাপ পেরুতে পেরুতে বললাম,

‘ তারা রাখলেই ভালো হতো। দুই ভাইয়ের খুব মিলতো। আবির টাবির বাদ। আজ থেকে তোমায় আমরা তারা বলে ডাকব। ধ্রুবতারা।’

আবিরও আমাদের পিছু পিছু নিচ তলায় নেমে এলো। দৌঁড়ে আমার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,

‘ ভাবী, রিক্সা নেবে?’

আমি মাথা নাড়তেই রাস্তা থেকে একটা রিক্সা ধরে উঠে বসল আবির। হাতের ইশারায় ডাকল,

‘ উঠে এসো।’

আমি অবাক হয়ে বললাম,

‘ উঠে এসো মানে? কোথায় যাব?’

‘ যেখানে যাচ্ছিলে সেখানে।’

‘ তাহলে তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

‘ তোমাদের সাথেই যাচ্ছি। আমার আপাতত কোনো কাজ নেই। ভাইয়ার সাথে ঝগড়া হয়েছে। ভাইয়ার আশেপাশে যাওয়া যাবে না। ভাইয়ের থেকে ভাবী সুইটেবল। উঠে এসো।’

আবিরের কথায় আমি হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলাম। চেনা নেই, জানা নেই ভাবী ডাকতে ডাকতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলা ছেলের সাথে আমি রিক্সায় উঠে যাব? অসম্ভব! আমি রিক্সা ছেড়ে সোজা হাঁটতে লাগলাম। গম্ভীর কন্ঠে বললাম,

‘ সামনেই টাউন হল। আমি হেঁটে যাব। রিক্সা ফিক্সার দরকার নেই।’

আমাকে হাঁটতে দেখে আবিরও দৌঁড়ে এলো কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘ তোমরা মেয়েরা খুব কম্পলিকেটেড। কখন কী চাও কিচ্ছু বুঝি না।’

আমি উত্তর দিলাম না। আবির আমাদের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে ভীষণ আনন্দিত কন্ঠে বলল,

‘ তুমি নাকি ভাইয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ। বিষয়টা সত্য?’

আমি চোখ ছোট ছোট করে চাইলাম। ভ্রু বাঁকিয়ে বললাম,

‘ তোমাকে কে বলল আমি তোমার ভাইয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি? তোমার ভাইয়া?’

আবির মাথা নাড়ল। ঠোঁট উল্টে বলল,

‘ ভাইয়ার বলতে হবে কেন? পৃথিবীর প্রায় সবাই জেনে গিয়েছে তুমি ভাইয়ার প্রেমে পড়ে একদম চ্যাপা শুটকি হয়ে গিয়েছ। ভাইয়ার বন্ধুরা থেকে মুদি দোকানদার, সব্বাই। মোড়ের দোকানের মামাকে ডেকে জিগ্যেস করো। বলে দেবে।’

আমি ভ্রু বাঁকিয়ে চাইলাম। আবিরকে আমি একদমই আবির বলে বিশ্বাস করতে পারলাম না। আবার তাকে ধ্রুব বলেও বিশ্বাস করতে পারছি না। নিজের এই বিভ্রান্তিতে নিজেই ভীষণ বিরক্ত হলাম। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললাম,

‘ আমি প্রেমে পড়লাম, আমি চ্যাপা শুটকি হলাম। অথচ আমার আগেই সারা দুনিয়া জেনে গেল? আশ্চর্য!’

আবিরও দাঁড়াল। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

‘ কষ্ট পেও না ভাবী। দেবর হিসেবে আমিও খুব লেইটে জেনেছি। তারপর তুমি। আমার ধারণা ঠিক থাকলে ভাইয়া জানবে সবার পরে।’

আমি আর অবাক হতে পারলাম না। বিস্ময়ের শেষ সীমানায় এসে ক্লান্ত হয়ে গেল দেহ। ভাইয়াও জানে না, আমিও জানি না তবে প্রেমের ব্যাপারটা জানে কে? পাড়া-প্রতিবেশী? কী আশ্চর্য! আমি ক্লান্ত কন্ঠে বললাম,

‘ দেখো আবির। আমি তোমার ইহকাল, পরকাল, আকাশ, বাতাস, মহাকাশ কোনো ভাইয়ের প্রেমেই পড়িনি। সুতরাং, আমায় বারবার ভাবী ভাবী ডাকবে না। আমার দেবরের অভাব নেই। তোমার মুখ থেকে ভাবী ডাক শোনার জন্য আমি মরে যাচ্ছি না। দুনিয়ার সবাই আমায় ভাবী ডাকলেও তুমি ডাকতে পারবে না। আরেকবার ভাবী ডাকলে দিব এক চড়।’

‘ আচ্ছা ভাবী।’

‘ আবার ভাবী!’

‘ সরি ভাবী।’

আমি এবার চোখ রাঙিয়ে চাইলাম। আঙুল তাক করে কটমট চোখে চাইতেই ফ্যাকাশে হাসল আবির। মন খারাপ করে বলল,

‘ তুমি কী সত্যি সত্যিই মারবে নাকি আমায়? কি আশ্চর্য! রেগে যাচ্ছ কেন? ভাবীকে ভাবী না ডাকলে ডাকবটা কী?’

আমাকে চোখ ছোট ছোট করে চেয়ে থাকতে দেখে কথার সুর পাল্টাল আবির। ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করে বলল,

‘ আচ্ছা যাও, ডাকব না ভাবী। আজ থেকে আপু ডাকব, নিশু আপু। আর মাঝে মাঝে একটু একটু ভাবী ডাকব। বেশি না মাঝে মাঝে। ঠিক আছে?’

আবিরের কথার ধরনে অতি দুঃখের মাঝেও হেসে ফেললাম আমি। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতেই বললাম,

‘ না। ঠিক নেই। তুমি আমায় কখনোই ভাবী ডাকবে না। আমি অলরেডি ম্যারিড। আমার বর আছে। তোমার ভাইয়ের সাথে কিছু হওয়ার সম্ভবনা আমার নেই।’

আমার কথায় থমকে দাঁড়াল আবির। অবাক হয়ে বলল,

‘ তুমি বিবাহিত?’

আমি মাথা নাড়লাম। আবির অবিশ্বাস নিয়ে বলল,

‘ দেখে তো বুঝা যায় না।’

এতোক্ষণের মৌনব্রত ফেলে ফুঁস করে নিশ্বাস ফেলল প্রিয়তা। আবিরের প্রত্যুত্তরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

‘ তুমি যে আবির, সেটাও তো দেখে বুঝা যায় না।’

আবির চোখ রাঙিয়ে তাকাল। প্রিয়তাকে চোখ দিয়ে ঝলসে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল,

‘ তুমি বিবাহিত হয়েও ভাইয়ার দিকে চেয়ে থাকতে কেন? এ তো অন্যায়। ঘোর অন্যায়।’

আমি আকাশ থেকে পড়ার মতো বিস্ময় নিয়ে বললাম,

‘ আমি চেয়ে থাকি? মিথ্যা কথা। আমি কেন চেয়ে থাকব? আমার বর রেখে তোমার ভাইয়ার দিকে চাইব থাকব কেন? তোমার ভাইয়াই বোধহয় হা করে চেয়ে থাকে। নয়তো সে জানলো কী করে আমি চেয়ে থাকি? কই? আমি তো জানি না।’

আবির কিছু বলার আগেই ধমকে উঠল প্রিয়তা। ভীষণ রসিয়ে রসিয়ে বলল,

‘ সেটাই তো! আমাদের ভাইয়া কত হ্যান্ডসাম জানেন? আমাদের ভাইয়ার সামনে আপনার ভাইয়া তো কিছুই না। জাস্ট কিছুই না। এসব আলতো ফালতু লজিক দেখিয়ে খবরদার আমার বোনকে ভাবী বানাতে আসবে না।’

আবির উত্তর দিল না। অসহায় কন্ঠে শুধাল,

‘ ভাবী! তুমি সত্যিই বিবাহিত?’

ওর মুখে ভাবী ডাক শুনেই চোখ-মুখ শক্ত করে চাইলাম আমি। আবিরের মুখখানি দেখাল আরও করুণ। চোখ-মুখ কালো করে বলল,

‘ আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

আমি আর প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বিড়বিড় করে বললাম,

‘ ওহে শ্যাম! তুমি যে ধ্রুব নও। সে তো আমাদেরও বিশ্বাস হচ্ছে না!’

#চলবে….

প্রেমিক-অপ্রেমিকের গল্প
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|৩|

ভীষণ বর্ষায় যেমন ঝুপ করেই বৃষ্টি নামে ঠিক তেমনই আচমকা সন্ধ্যা নামে এই শহরে। রাস্তার কোণের ওই প্রেমীযুগলরা ভালোবাসার ঘোর কাটিয়ে হাতে-মুখে লাজুক লাজুক সন্ধ্যা মাখে। আকাশের রঙ পাল্টায়। রঙ পাল্টায় ছোট্ট এই শহরের রূপ। আনন্দমোহনের সামনে জমজমাট আড্ডা বসে। টং দোকানে ফাঁকা হতে থাকে একে একে ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। কেউ-বা সুর তুলে গিটারে। কারো আড্ডায় রমরমা হাসি-গল্পের চাপ। শাড়ি পরা কোনো রূপসীর কোমল হাতটা আচমকাই চেপে ধরে কেউ। দু’জন দু’দিকে মুখ ঘুরিয়ে ধুরুধুরু বুকে হাসে মৃদু মৃদু। তাদের হাসিতে কেটে যায় বিষণ্ণতা। সন্ধ্যা নামক উদাসীনতা! আমি আর প্রিয়তা রেলিং-এ ঠেস দিয়ে সন্ধ্যা দেখি। পোষা কবুতরের ঘরে ফেরা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলি। মস্তিষ্কে অনবরত চলতে থাকে ধ্রুব-আবিরের জল্পনা! রূপকথার গল্পের মতোই লাগে মস্তিষ্ক ধাঁধানো গল্পটা। গলির মোড়ের ল্যাম্পপোস্টটা জ্বলে উঠে। নিয়ন আলোটা ঝাপটে পড়ে প্রিয়তার ভীষণ ক্লান্ত মুখটিতে। প্রিয়তা ঠোঁট উল্টে বলে,

‘ এই ধ্রুব-আবিরের কেচ্চাটা তো কিছু বুঝতে পারছি না রে নিশু? ব্যাটা আমাদের সাথে কোনো মাইন্ড গেইম টেইম খেলছে না তো?’

আমি ক্লান্ত চোখে চাইলাম। উদাস কন্ঠে বললাম,

‘ বুঝতে পারছি না। লোকটা অদ্ভুত। তার বলা গল্পটাও অদ্ভুত। একই রকম দেখতে দুটো লোক আদৌ সম্ভব?’

প্রিয়তা কিছুক্ষণ তেজি পায়ে পায়চারী করল। ঠোঁট কামড়ে চিন্তা করল। তারপর ধপ করে বিছানার কোণায় বসে পড়ে বলল,

‘ আমার মনে হয় দু’জনেই এক। নয়তো আমাদের উপর তলায় থাকে তবু কখনো চোখে পড়ল না কেন?’

কথাটা শেষ করেই জ্বলজ্বল করে উঠল প্রিয়তার ভীষণ আদুরে দুটো চোখ। আমার দিকে চেয়ে দুষ্টু দুষ্টু হাসল। আমি ভ্রু বাঁকালাম। ওর এই বিদঘুটে হাসির দিকে চেয়েই সন্দিহান কন্ঠে বললাম,

‘ কী ব্যাপার?’

প্রিয়তা এক লাফে আমার পাশ ঘেঁষে বসল। ঠোঁট টিপে হাসল। টেনে টেনে ডাকল,

‘ নিশু…. ‘

আমার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। ভ্রু বাঁকিয়ে ওর এই হাসির অর্থ বোঝার চেষ্টা করলাম। সতর্ক কন্ঠে বললাম,

‘ দেখ প্রিয়! খবরদার কোনো উল্টাপাল্টা প্ল্যানে আমায় টানবি না। আই অ্যাম নট এবেলএবল।’

প্রিয়তার হাসি চওড়া হলো। চোখে-মুখে তেলতেলে ভাব নিয়ে আরও একটু কাছে সরে এলো। ওর এমন ব্যবহারে হকচকিয়ে গেলাম আমি। কিছুটা সরে বসে চোখ ছোট ছোট করে চাইলাম। প্রিয়তা দাঁত বের করে হেসে বলল,

‘ এমন করছিস কেন সোনা? আমি কী তোর খারাপ চাই? দূর্দান্ত এক প্ল্যান পেয়েছি। তুই শুধু আমার সাথে চল। এই মুহূর্তে রহস্যের উত্থান আর দুধকা দুধ, পানিকা পানি হয়ে যাবে। ট্রাস্ট মি!’

আমি আরও একটু সরে বসলাম। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে শক্ত কন্ঠে বললাম,

‘ অসম্ভব! তোকে বিশ্বাস করার থেকে দুই মিনিট হেঁটে রেললাইনে মাথা দেওয়া উত্তম। তোর দুধকা দুধ আর পানিকা পানি নিয়ে দূর হ। আমার রহস্য উদ্ধারের প্রয়োজন নেই।’

আমার কথায় কাজ হলো না। প্রিয়তা সটান উঠে দাঁড়িয়ে পাড়ার গুন্ডাদের মতো তাকাল। জামার হাতে গোটাতে গোটাতে একটা পা তুলে দিল আমার উরুর পাশে। ওড়নার কোণা টেনে ধরে বলল,

‘ সবসময় ধমক দিয়ে আমায় চুপ রাখতে পারবে না সুন্দরী। রহস্যে রহস্যে মাথাটা ফেঁটে যাচ্ছে আমার। ভাত হজম হচ্ছে না। প্রেমিকের প্রেমময় কথা অসহ্য লাগছে। আকাশকে মাটি আর মাটিকে আকাশ লাগছে। দুনিয়ার সব কিছু কেমন ধ্রুব-আবির, ধ্রুব-আবির দেখছি। তুই যদি আমাকে সাহায্য না করিস তবে তুই শেষ। ডিপজলের মতো এক্কেরে মলম লাগিয়ে ছেড়ে দিব। উপরতলায় গিয়ে ডিরেক্ট দুলাভাই দুলাভাই বলে চিল্লাচিল্লি জুড়ে দিব। মাইন্ড ইট!’

আমি হতভম্ব চোখে চেয়ে রইলাম। প্রিয়তা আমার মুখের উপর ঝুঁকে এসে বলল,

‘ যাবি কি-না বল!’

আমি একরকম বাধ্য হয়েই মাথা নাড়লাম। প্রিয়তা আমার অনুমতি পেয়েই আনন্দে ভেসে গেল। আমাকে ঝাপটে ধরে গালে জোরে একটা চুমু দিয়ে বলল,

‘ উফ! তুই কত্তো ভালো রে নিশু! গুড গার্ল।’

আমি ডানহাতের উল্টো পিঠে গাল মুছে চোখ-মুখ কুঁচকে চাইলাম। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে বললাম,

‘ মহিলা ডিপজল।’

আমার কথায় প্রিয়তার মাঝে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে আমাকে বগলদাবা করে মনের সুখে পাঁচ তলায় উঠে গেল। কিন্তু পাঁচতলার দরজার সামনে আসতেই সব কনফিডেন্স ফুঁস হয়ে গেল তার। ফট করে কলিং বেলটা চেপে দিয়েই আমার দিকে চাইল। অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ নিশু রে? বাড়িওয়ালী যে দজ্জালী! কেন এসেছি জিগ্যেস করলে কী বলব? আমাদের যদি পাঁচ তলা থেকে পটাক করে ফেলে দেয়? হায় আল্লাহ! আমার হার্ট এমন ধুরুধুরু করছে কেন? আমি বোধহয় আর বাঁচব না। হে আল্লাহ! হে খোদা! আমি এখনই মরতে চাই না। আমি সদ্য শিশু। অবলা নারী। বিয়েশাদী কিছু করি নাই। আমি এখনই মরে গেলে আমার বাচ্চাদের কী হবে? নিশু? দরজা খুললে সব দোষ তোর। আমি কিছু জানি না।’

প্রিয়তার আকস্মিক নাটকে তাজ্জব বনে গেলাম আমি। চোখ কটমট করে তাকালাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। মুখের সামনের দরজাটা হঠাৎ খুলে গিয়ে চোখের সামনে ভেসে উঠল থমথমে লম্বাটে এক মুখ। প্রিয়তা চট করে আমার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। আমি কী করব ভেবে না পেয়ে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। প্রিয়তা! পৃথিবীর সবচেয়ে অসভ্য মেয়েটা পেছন থেকে আলতো করে সালাম দিয়ে বাকি কাজটুকুও সেরে ফেলল। ভীষণ লক্ষ্মীটি হয়ে বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন? নিশু আপনাকে কিছু বলতে চায়।’

আমি এবার অকূল পাথারে পড়লাম। ভদ্রলোকের ভীষণ রাগী, গম্ভীর মুখটা দেখে আমার বাবার নামটা পর্যন্ত ভুলে গেলাম। মনে মনে প্রিয়তাকে অজস্র চড় দিয়ে আমতা আমতা করে বললাম,

‘ আঙ্কেল ছাদের চাবিটা দেওয়া যাবে? চাবিটা দরকার।’

এতটুকু বলেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। জীবনীশক্তির অর্ধেকটা ধ্বংস করে বাকিটুকুকে সম্বল করে চুপচাপ চেয়ে রইলাম। ভদ্রলোকের মুখখানা রাগী রাগী হলেও মোলায়েম কন্ঠে বললেন,

‘ রাতের বেলায় ছাদে যাওয়া ঠিক নয়। আর কখনো যাবে না। দাঁড়াও আনছি।’

আমি মাথা হেলিয়ে ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করলাম। ভদ্রলোক সামনে থেকে সরে যেতেই প্রিয়তা আফসোস নিয়ে বলল,

‘ আহহা! কাহিনী তো উল্টে গেল রে নিশু? আমি তো ভেবেছিলাম বাংলা সিনেমার মতোই নায়ক এসে দরজা খুলবে। নায়িকাকে দেখে চুল উড়বে। কল্পনায় ঘুরবে। আমি ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দেওয়ার বাহানায় নায়ককে চেপে ধরে বলব, আরেক নায়ক কই? বের করবি নাকি খতম?’

প্রিয়তার কথায় চোখ মুখ লাল করে চাইলাম আমি। পুরস্কার স্বরূপ তার পিঠে চমৎকার এক চড় বসিয়ে দিয়ে বললাম,

‘ শাট আপ!’

প্রিয়তা ‘শাট আপ’ হলো। কিন্তু পরিস্থিতি ‘শাট আপ’ হলো না। আমার হাঁটুর সাইজের এক বাচ্চা কৌতূহলী চোখে চেয়ে বলল,

‘ আমি নায়ক। নায়ক চিওমিও।’

প্রিয়তা আর আমি ভ্রু বাঁকিয়ে চাইলাম। প্রিয়তা চোখ-মুখ কুঁচকে হাঁটুতে হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়াল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

‘ চুচু?এটা আবার কেমন নাম?’

ছেলেটি গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ চুচু না। চিওমিও।’

প্রিয়তা চিওমিওকে খুব একটা পাত্তা দিল না। তার বাহু ধরে হেঁচকা টানে তাকে কাছে এনে বলল,

‘ এই চুচু, এই বাসায় ধ্রুব থাকে?’

বাচ্চাটা এবার আরও গম্ভীর হলো। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ভ্রু কুঁচকাল,

‘ তোমায় কেন বলব?’

প্রিয়তা বাচ্চাটার ডান গালটা শক্ত করে টেনে দিয়ে বলল,

‘ কারণ তুমি নায়ক। নায়কদের সব বলে দিতে হয়। বলো তো চিওচিও সোনা? ধ্রুব তোমার কী হয়?’

বাচ্চাটা প্রিয়তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাল। ধমক দিয়ে বলল,

‘ আমাকে চিওচিও বলবে না।’

প্রিয়তা মুখ ভেঙিয়ে বলল,

‘ একশো বার বলব। ধ্রুব কে, বলো? নয়তো শুধু চিওচিও না চিওপিও বলেও ডাকব।’

বাচ্চাটা উত্তর দিল না। সেই ভদ্রলোককে চাবি হাতে দরজার কাছে আসতে দেখেই গগনবিদারী চিৎকার করে উঠল। ধপ করে ফ্লোরে বসে একরকম গড়াগড়ি জুড়ে দিল। আমি আর প্রিয়তা চমকে উঠলাম। এই বাচ্চা যে প্রিয়তার থেকেও নাটকবাজ তা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক হতভম্ব হলেন তার থেকেও বেশি। বাচ্চাটা গগনবিদারী চিৎকারে সেকেন্ড কয়েক বিরতি দিয়ে কান্নার কারণ জানাল। বলল, ‘আমায় মেরেছে’। তারপর আবারও জুড়ে দিলো সেই চিৎকার। ভদ্রলোক অবাক হয়ে আমাদের দিকে চাইলেন। প্রিয়তার তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা। অসহায় চোখে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে ঠোঁট টেনে হাসার চেষ্টা করল। বলল,

‘ চাবি লাগবে না আঙ্কেল। আপনার কাছেই থাক। ও একা একা পড়ে গেছে। আমরা কিছু করিনি। কসম!’

কথাটা বলে এক সেকেন্ড দেরী না করেই ‘আসি’ বলে ফিরতি পথ ধরল প্রিয়তা। আমি কয়েক সেকেন্ড হ্যাবলাকান্তের মতো চেয়ে থেকে দ্রুত সিঁড়ি পেরুলাম। নিজেদের ঘরে এসে এক রকম কানে ধরে ফেললাম,

‘ যায় হয়ে যাক না কেন? এই ধ্রুব-আবির সংক্রান্ত কোনো ঝামেলায় আর জড়াব না। পৃথিবী উল্টে গেলেও না।’

কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা বেশিক্ষণ টিকল না। পরের দিন ক্লাসে যেতেই ভয়াবহ এক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। সবাই কেমন অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে। এদিকওদিক ফিসফাস আলোচনা চালাচ্ছে। তার থেকেও অদ্ভুত বিষয় বিভিন্ন ক্লাস থেকে সিনিয়ররা এসে এসে জানতে চাইছে, ‘নিশু নামের মেয়েটা কে?’ ক্লাসের ছেলেপুলে হাত উঁচিয়ে আমায় দেখিয়ে দিচ্ছে। সিনিয়ররা আমায় আগাগোড়া দেখে নিয়ে হৃষ্টচিত্তে আলোচনা করতে করতে বেরিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আমি আর প্রিয়তা কিচ্ছু বুঝতে না পেরে ভ্যাবলাকান্তের মতো বসে আছি!

#চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here