#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল
#তানিয়া
পর্ব:১১
আধ ঘন্টা হলো আদ্য আর মেহু মুখোমুখি বসে আছে। দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। মেহুর জ্ঞান আসার পর আদ্য শুধু একবার তাকে বলেছিল,যেন ভেজা কাপড়টা বদলে নেয়।নিচে গিয়ে আদ্য নিজেও কাপড় বদলে নেয়। উপরে এসে দেখে মেহু এখনো আগের মতো করে বসে আছে। তার চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।আদ্য এবার তার সামনে গিয়ে বসে আর তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করতে বুঝতে পারে মেহু মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে। আদ্য নিরবে মেহুকে চেয়ে থাকে।আদ্য বুঝতে পারে মেহুর এ দৃষ্টি যতটা না ভয়ের তার চেয়ে বেশি বিস্ময়ের।সে এখনো বিস্মিত যে আদ্য তার সামনে বসে আছে। সম্পূর্ণ নতুন অবস্থায় মেহু আদ্যর সামনে যা আদ্য হয়তো আগে দেখে নি, হয়তো বা দেখেছে না হলে এভাবে আজ আদ্যর সামনে মেহুকে পড়তে হতো না।মেহু বারবার যাকে ভয় পেতো ধরা পড়াবে বলে, সত্যি সত্যি তার সামনেই সে ধরা পরলো।তবে এতকিছু হঠাৎ করে হলো যে সে বিশ্বাস করতে পারছেনা। আদ্য আড়চোখে মেহুকে দেখছে।বৃষ্টিতে নিশ্চয়ই মেয়েটার সর্দি লেগেছে পরপর কয়েকবার হাঁচি দিয়েছে ঠিকই তবে এখনো কাপড় পাল্টায় নি।আদ্য বুঝতে পারছে এভাবে আরো কিছুক্ষণ থাকলে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে।তাই নিরবতা ভেঙে সে আবারও বলল,
“এ মেয়ে তুমি কি শুনতে পাও নি।তোমাকে বলেছি ভেজা কাপড়টা বদলে নিতে।তোমাকে বলার পর আমি নিজেই কাজ সেড়ে এলাম আর তুমি এখনো সেই অবস্থায় বসে আছো।অসুখ হলে তখন কি হবে?যাও এক্ষুনি কাপড় বদলে আসো।”
মেহু ঠাঁই বসে আছে। আদ্য বুঝলো সে থাকলে হয়তো মেয়েটা যাবে না তাই ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
আকাশ এখন ঝকঝকে চকচকে। দেখে বোঝাও যাচ্ছে না একটু আগে এমন আকাশ পাতাল কাপিয়া ঝড় হয়েছিল। তবে এখন চারপাশে কেমন জানি নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী যেন অচিনপুর হয়ে গেছে। কোথাও মানুষ নেই, পক্ষী নেই শুধু একটা যুবক বাইরে দাঁড়িয়ে আছে আর কিছু দূরে চার দেয়ালের মাঝে একটা মেয়ে বসে আছে।আচ্ছা মেয়েটা কি কাপড় বদলেছে নাকি এখনো সেই জায়গায় ঝিম মেরে বসে আছে? আদ্য কি এখন যাবে নাকি আরো কিছুক্ষণ সময় নিবে?
মেহু ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখছে।এ চারমাস নিজেকে যেভাবে আড়ালে রেখেছিল বাঁচানোর জন্য শেষ পর্যন্ত সে পারলো না।ঠিকই সে লোকটার সামনে তাকে পরতে হলো।কান্নায় সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছেনা।তার কপালটা এতটা খারাপ কেন?কেনো সে বারবার নিজের জীবনে আনন্দ পায় না,যখনি আনন্দ আসতে থাকে তখনি কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যায় যার মাশুল অনেক বড় হয়।মেহু কাঁদছে কিন্তু তার স্বরে আওয়াজ নেই।
আদ্য অনেক্ক্ষণ পর রুমে এসে দেখে মেহু বিছানায় পা তুলে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। আদ্য গলা খাকড়ি দিতেই মেহু নড়েচড়ে উঠলো।আদ্য তার সামনে একটা টুল নিয়ে বসলো।
“তা বলো কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তুমি এ বাড়িতে এসেছো?তোমার আসল নাম কি, বাড়ি কোথায়?”
আদ্য এক এক করে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে কিন্তু মেহু উত্তর না দিয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে।আদ্যর উচিত জোরসে একটা ধমক দেওয়া কিন্তু কি হলো কে জানে,এ মেয়ের সাথে ধমক দিয়ে কথা বলতেই যেন তার বাঁধা পাচ্ছে। এমন মিষ্টি মেয়ের সাথে মিষ্টি কথা ছাড়া ধমক দেওয়া বেমানান বিষয়। আদ্য খুব শান্ত স্বরে প্রশ্ন করলো,
“এ মেয়ে কি হচ্ছে শুনি,কথা বলো?যা যা জিজ্ঞেস করলাম তার উত্তর দাও।তুমি কোত্থেকে এসেছো আর তোমার উদ্দেশ্য কি?”
শেষের দিকের কথাটা একটু কঠোর শুনায় যা শুনে মেহু ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠে। আদ্য একটু ভড়কে যায়। এভাবে মেয়েদের কান্না দেখতে কোনো ছেলেরই ভালো লাগে না যদি আবার মেয়েটা হয় রূপবতী। আদ্য কিছু বলার আগে মেহু নিজেই মুখ খুলে,
“দেখুন আমি কিছু নিব না শুধু আমার সামান্য জিনিস আর বইখাতা নিয়ে চলে যাব।প্লিজ আমাকে যেতে দিন, আমি কিছু করি নি।”
বলে আবারও কান্না শুরু করে।আদ্য হতভম্ব হয়ে যায়। কি বলে এ মেয়ে? কিছুই তো বললো না একে ছাড়বে কীভাবে? এবার রাগ হলো ধমক দিতেই কান্নার বেগ যেন বেড়ে গেলো। আদ্য এবার টুলটা আরেকটু এগিয়ে নিলো আর মেহু সাথে সাথে কোণায় চলে গেলো।
“শোনো আমি তোমাকে ছাড়বো তার আগে আমি যা জিজ্ঞেস করছি সব বলো।নাহলে কিন্তু গোপন শত্রু বলে তোমাকে পুলিশে দিব। বলো যা যা জিজ্ঞেস করছি। ‘
মেহু পুলিশের কথা শুনেই আবারও ঠোঁট বাঁকায় কিন্তু আদ্য চোখ কটমট করে তাকাতে নিঃশব্দে কাঁদে। তারপর আদ্যর করা প্রশ্ন গুলোয় এক এক করে উত্তর দেয়।
কুষ্টিয়ার ছোট একটা গ্রামে মেহুর জন্ম।জন্মের প্রায় দশ বছর পর মেহুর বাবা মারা যান।এরপর মেহুকে মানুষ করার দায়িত্ব পড়ে তার মা মহুয়ার ওপর।গ্রামটা ছোট হলেও সেই গ্রামের স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন মহুয়া।স্বামীর মৃত্যুর পরও কোনোরূপ অভাব ছিল না তাদের কারণ মেহুর বাবা ছিলেন একজন ধনশীল মানুষ। তার সকল সম্পত্তি তিনি মেয়ের নামে রেজিস্ট্রি করে গিয়েছিলেন আর সেসব থেকে যা আয় হতো তাতেই মা মেয়ের সংসার দিব্যি চলতো।মেহুর বাবার আপন কোনো ভাই বোন ছিলো না তবে তার বাবার একটা সৎ ভাই ছিল।নাম মোজাম্মেল। মোজাম্মেল যেমন ছিল অসৎ তেমনি দুশ্চরিত্র। খুব অল্প বয়সে সে বাড়ির কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করে আর সেই খবর পৌঁছে যায় বাবার কানে।মোজাম্মেলের বাবা ছিলেন ন্যায়পরায়ণ মানুষ। তিনি পুত্রের কাজে মর্মাহত হয়ে সেই কাজের মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে তাকে ত্যাজ্য পুত্র করেন।সূত্র মোতাবেক সকল সম্পত্তি পায় মেহুর বাবা।মেহুর বাবাও নিজের পিতার মতো সৎ ছিল।বাবার মৃত্যুর পর যখন মেহুর বাবার ওপর সকল দায়িত্ব পড়ে তখন তিনি সেসব সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।এতটাই ব্যস্ত যে বিয়ে করেন ৩৫ বছর বয়সে সেই গ্রামের মেয়ে মহুয়াকে।এক দেড় বছরের মাথায় তাদের সংসারে আসে তাদের কন্যা মেহেরুন্নেসা জান্নাত ওরফে মেহু।এরপর হঠাৎ একদিন ট্রাক চাপায় মারা যান তিনি আর একা হাতে মেয়েকে মানুষ করেন মহুয়া।কিন্তু আফসোস হয় তখন যখন কিনা তাদের মা মেয়ের সংসারে নজর পড়ে মোজাম্মেলের।কোনো অভিভাবক না থাকায় মোজাম্মেল এসে কর্তৃত্ব শুরু করেন তাদের ওপর।কিন্তু মহুয়া যেমন শিক্ষিত ছিল তেমনি চালাক।সে মোজাম্মেলের বিষয়ে সবটা জানতো তাই সেসব বিষয় পাত্তা দিতো না।কিন্তু মহুয়া অন্তত রূপবতী ছিল যার একাংশ পেয়েছে মেহু।মোজাম্মেলের নজর পড়েছিল মহুয়ার ওপর।সেটা সে বুঝতো বলে নানা কৌশলে তার থেকে দূরে থাকতো। একদিন মোজাম্মেল তার কাছে মেহুর বিয়ের প্রস্তাব আনে।ছেলে স্বয়ং মোজাম্মেলের।এই হচ্ছে সেই ছেলে যার মাতা কিনা কাজের মেয়ে ছিল।ছেলেটাও পেয়েছিল বাবার মতো সব রকম বদঅভ্যাস।তর নামেও গ্রামে বিভিন্ন কুৎসা ছিল। যখন শুনলো তার ছেলের সাথে মেহুর বিয়ের কথা সাথে সাথে মহুয়া রেগে আগুন হয়ে যায় তারপর অপমান করে বাপ ছেলেকে বাইর করে দেয়।অপমানে মোজাম্মেলের কপালের রগ ফুলে উঠে।
প্রায় একমাসের মধ্যে মহুয়ার মৃত্যু ঘটে। ঠিক সেই ভাবে যেইভাবে মারা গিয়েছিল মহুয়ার স্বামী। যখন মেহু অনাথ হয়ে গেলো ঠিক তখনি মোজাম্মেল আর আজগর এসে বাসা বাঁধলো তার ঘরে। প্রথমে খুব মিষ্টি ব্যবহার করতো কিন্তু পরে বুঝতে পারলো তাদের উদ্দেশ্য কি?যখনি মেহুর ইন্টার পরীক্ষা শেষ হলো ঠিক তখনি মোজাম্মেল আজগরের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য তোড়জোড় করে। মেহু নিজেকে বাঁচানোর অনেক প্রক্রিয়া করে কিন্তু আফসোস সেই সুযোগ হয় না।কিন্তু মহুয়ার স্কুলের একজন শিক্ষিকা যিনি মেহুর মায়ের মৃত্যুর পর মেহুর দেখাশোনা করেন তিনি অনেক চেষ্টা করেন মেহুকে রক্ষা করার এমনকি থানা পুলিশও করেন কিন্তু মোজাম্মেল টাকার জোরে থানাকেও কিনে নেন।মেহুর বাঁচার পথ সবটা বন্ধ করে দেয় কিন্তু মেহুর জেদ ছিল সে পড়বে।অনেকদূর যাবে পড়ালেখায় তাই খুব বুদ্ধি খাটিয়া বিয়েতে রাজি হয়।মোজাম্মেল তো সেই খুশি! সে ছেলের বিয়ের জন্য সব আয়োজন শুরু করে।যথারীতি বিয়ের দিন আসলে হুট করে বৌ গায়েব হওয়ার খবর পাওয়া যায়। চারদিকে হইচই শুরু হয়।ততক্ষণে মেহু সেই শিক্ষিকার মাধ্যমে কুষ্টিয়া ছেড়ে ঢাকার পথে পাড়ি জমায়।আর আস্তে আস্তে সে জড়িয়ে যায় এ ঢাকা শহরের মানুষের মধ্যে। আর নিজের আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে বাছাই করে আদ্যদের বাড়িকে।সেই রোজ সকালে এডমিশনের কোচিং পড়তে যায়,সারাদিন ঘরের কাজ আর রাতে নিজের পড়া।সবটা মিলে খুব ভালো সময় কাটাচ্ছিল কিন্তু এখন হয়তো সেটা সম্ভব না।
আদ্য খুব আগ্রহ আর মনোযোগ নিয়ে মেহুর কথা গুলো শুনতে থাকে।আদ্য মুখের ওপর বিস্ময়ের ছাপ ফেলে যখন শুনে মেহু বিয়ের পিড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে শুধু নিজেকে বাঁচানোর জন্য। মনে মনে মেহুর সাহসিকতার প্রশংসা করে।
মেহু নিজের জীবনের দুর্ভোগের কথা শেষ করে নিরবে চোখের জল ফেলতে থাকে।এভাবে হুট করে তাকে অতীত নিয়ে কথা বলতে হবে সেটা মেহু ভাবতে পারেনি।যতটা না ভয় পাচ্ছে নিজের পরিচয় প্রকাশে তারচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে আশ্রয় হারানের কথা চিন্তা করে।
আদ্য এক দৃষ্টিতে মেহুর দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো নড়চড় বা হা হুতাশ নেই। মেহুর প্রতিটি কথা শোনার পর কীভাবে কথা বলবে আদ্য বুঝতে পারছেনা।সে চুপচাপ টুল ছেড়ে উঠে গেলো।আস্তে আস্তে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়।উল্টো দিকে তাকিয়ে শুধু বলল,
“আজ আমাদের মধ্যে যা হয়েছে তা কখনো এ বাড়ির কেউ জানবে না।তুমি যেমন করে এতদিন দিন কাটাচ্ছিলে শুধু তেমন করে দিন পার করো।তোমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তোমার যদি কোনো হেল্প লাগে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবে।আমি তোমার পাশে আছি।আর হ্যাঁ আবারও বলছি এ বিষয়টা আর কাউকে জানানোর দরকার নেই। তোমার উদ্দেশ্য পূরণ হলে সেদিন সবাই সবটা জানবে আর তখনি এখান থেকে তোমাকে চলে যেতে হবে।কথাটা যেন মনে থাকে। ”
কথা শেষ করে পেছনে না তাকিয়ে আদ্য চলে যায় আর মেহুর কানে তখনো আদ্যর বলা কথা গুলো বাজতে থাকে।মেহু এখনো বিশ্বাস করতে পারছেনা এ জাদরেল লোকটা তাকে কি বলে গেলো!
,
,
,
চলবে……