#সেদিনও_জ্যোৎস্না_ছিল
#তানিয়া
পর্ব:৬
আদ্য এখন অনেকটা ফ্রী সময় কাটাচ্ছে। এতদিন বাসার বাহিরে থাকায় এখনো অফিসে যাওয়া হয় নি।বাসায় থাকে এটা ওটা করে।তবে খুব শীঘ্রই কাজে জয়েন করবে সে!
সেদিনের পর থেকে মেহু খুব একটা আদ্যর সামনে যায় না।সে সবসময় চেষ্টা করে আদ্যর থেকে দুইশ হাত দূরে থাকতে।আমেনাও আদ্যর কোনো কাজে সহজে মেহুকে পাঠানোর চেষ্টা করে না।আসলে যতই মেহু অচেনা কেউ হোক এ অল্প সময়ে মেহুকে আমেনা নিজের মেয়ের মতো ভেবে নিয়েছে। তাই সেদিনের চড়ের আঘাতটা আমেনা নিজেও অনুভব করেছে।তাছাড়া মেহু এখন বাসার কাজ,বাইরের কাজ যথাসাধ্য দ্রুত সময়ে শেষ করে তাড়াতাড়ি নিজের পড়াটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।রাতের সময় সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন মেহু নিজের পড়াটা শুরু করে।প্রায় রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময়টা তার দুটো কি তিনটা হয়! তবুও সকালে উঠতে সমস্যা হয় না।কারণ স্বপ্নের চূড়াটা যত উঁচু হবে পরিশ্রমের সীমানাটা তত গাঢ় হবে।এ সত্যিটা মাথায় স্থায়ী হলে আর কোনোকিছুর প্রয়োজন পড়ে না।
এক বাড়িতে আছে, তার সত্ত্বেও খুব একটা দেখা হয় না দুজনের।মেহু বারবার এড়িয়ে যায় আদ্যকে।তবে কখনো কখনো আদ্যর সামনে পড়তে হয় তখন মেহু চোখ নামিয়ে চলে যায় আর আদ্য তিক্ততার চাহনিতে অন্য দিকে সরে দাঁড়ায়।
প্রতিদিনের ন্যায় আজও মেহু খুব সকালে উঠে কোচিং এর জন্য বের হবে এমন সময় পেছন থেকে ডাক আসে,
“এ মেয়ে এত সকালে তুমি কোথায় যাচ্ছো?”
আওয়াজ শুনে মেহুর হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। কি উত্তর দিবে সে? মেহু অনেকটা জড় বস্তুর ন্যায় পেছনে ফিরে তাকায়।যা ভেবেছিল তাই, আদ্য।
“জ্বে আমি.. আমি…”
“কি আমি আমি করছো উত্তর দাও এতো সকালে পোটলা নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
“জ্বে এইডা পোটলা না ময়লা।আমি সকাল বেলা একটা কাম করি।প্রথম থেইকা করি।খালাম্মা আমারে অনুমতি দিছিলো এহোন সেই কামে যায়। ”
“কি কাজ? আর আমাদের বাসায় থেকে অন্য কোথাও কাজ করার কি দরকার আছে শুনি?”
“আসলে স্যার আমি এ বাড়িতে আওনের আগে যে বাসায় কাম করতাম সেই দিকে একটা বাচ্চারে স্কুলে আনা নেওয়ার কামটা করতাম।কিন্তু বাড়ির মালিক চইলা যাওয়ায় আমি এ বাড়িতে আইয়া পরি।কিন্তু হেই বাচ্চার মা আমারে ছাড়তে চায় না তাই আমি তাগো বাচ্চারে দিয়া আসি।তয় খালাম্মা রে কইছি বাইরে কাম করলেও ঘরের কামে হেলা দিমু না।স্যার দেরী হইয়া যাইতাছে আসি?”
আদ্যর কেন জানি কথা গুলো বিশ্বাস যোগ্য মনে হলো না তাই সে চিন্তা করলো এ বিষয়ে তদন্ত করবে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও আদ্য যাওয়ার অনুমতি দিল।মেহু অনুমতি পেতেই সর্পিল গতিতে চলে গেলো। আদ্য বেশ কিছু সময় সেদিকে তাকিয়ে রইলো।
বাসার সবাই এখনো ঘুমে।আদ্যর একটা অভ্যাস ঘুম ভেঙে গেলো শত চেষ্টায়ও তার চোখে ঘুম আসবে না।তখন বিছানা ছেড়ে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করে। তবে বেশিরভাগ সময় ছাদে উঠে। কারণ ছাদে উঠলে ওপরের খোলা আকাশটা খুব কাছে মনে হয়।এ সময় আপন মনে আকাশের নিচে থাকতে আদ্য স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।আজও ব্যতিক্রম হলো না।এত সকালে যেহেতু কেউ উঠে নি, হাঁটতে হাঁটতে আদ্য ছাদে চলে যায়।
অনেক দিন পর ছাদে উঠে আদ্য অবাক হয়ে যায়। ছাদের পরিবেশ এতো সুন্দর হয়েছে তা আদ্যর জানা ছিলো না।চারপাশে ফুলের বাগান তার মধ্যে রয়েছে হরেক রকমের ফুল।পাশাপাশি বিভিন্ন পাখি এসে বসেছে ফুলের আনাচকানাচে। আদ্যর প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হলো এসব কারসাজি কার পরে বুঝলো নিশ্চয়ই কাজের মেয়েটার।আদ্য মানতে বাধ্য দেখতে কালো হলে কি হবে শৌখিনতায় তার রুচি ভালো!আদ্য ফুলগুলো হাত দিয়ে ধরে ধরে দেখে। বাহ্ সকালের স্নিগ্ধ বাসাতে ফুলের সুবাস চারদিকে ম ম করছে।
হঠাৎ দরজার দিকে নজর পড়তে আদ্যর চোখ গুলো ছোট ছোট হয়ে যায়। এগিয়ে যায় দরজার কাছে।হাত বাড়ায় দরজার হাতলে।
তালাবদ্ধ কেনো ঘরটা? এ ঘরে তো মর্জিনা নামের মেয়েটা থাকে।আশ্চর্য মেয়েটা ঘরে তালা দিয়ে কি বুঝাতে চাইলো তার ঘরে চোর ঢুকতে পারে?সে কি জানে না এ বাড়িতে চোর ঢুকার উপায় নাই। তাছাড়া ছাদেও তেমন কেউ আসে না তারপরও ঐ মেয়েটা দরজায় তালা দিল।ও কি আমাদের ওপর ভরসা করে না নাকি ওর ঘরে এমন কিছু আছে যা আমাদের নজরে আমতে চায় না?কি সেটা?
আদ্য তালা ধরে মনে মনে উক্ত কথা ছাড়াও আরো অনেক কিছু ভাবতে থাকে।
না মেয়েটাকে ভরসা করা যায় না।আলাদা করে মেয়েটাকে ধরতে হবে খুব শক্ত করে ধরতে হবে।পেটের মধ্যে কি লুকিয়ে এসেছে তা জানতে হবে।কোনোভাবে গুপ্তচর হলে তো ধরা তাকে পরতেই হবে।
আসলে আদ্যর ধারণা মর্জিনা নামের মেয়েটা কোনো গুপ্তচর। ব্যবসার জন্য তাদের অনেক গোপন শত্রু রয়েছে হয়তো তাদের মধ্যে কেউ মর্জিনাকে এ বাড়িতে পাঠিয়েছে নতুবা ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে মর্জিনার এ বাড়িতে আগমন।আজ আসুক এ বিষয় নিয়ে তাকে কথা বলতেই হবে।
মেহু দ্রুত বাসায় এসে নিজেকে আয়নায় পরখ করে নেয়।কারণ তার মনে হয় আদ্য নামের ছেলেটা অনেকটা গোয়েন্দা ধাঁচের। কোনোভাবে তার পরিকল্পনা টের পেলে হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে ছাড়বে।ভালোমতো নিজেকে দেখে তাড়াতাড়ি করে নিচে চলে যায়। রান্নাঘরে যেতেই দেখে আমেনা খালা কফি বানাচ্ছে।
“খালা কফি তৈয়ার করো কার লাইগা?”
“আর কইস না।আদ্য বাবাই নাহি কফি খাইব মাথা ধরছে এর লাইগা কফি বানাই।এদিহে মেলা কাম পইড়া আছে ক তো দেহি কি করি?একটা কাম কর, তুই কফিটা দিয়া আয়।আমি ততক্ষণে রান্নাটা চাপায় দিই।”
আমেনা খালার কথা শুনে মেহু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।ঢোক গিলে আবারও জিজ্ঞেস করে,
“কি কও খালা,আমি যামু?খালা তুমি তো জানো আমি ওনারে বাঘের মতো করে ডরাই অহোন আমি গেলে ওনি যদি রাইগা যায় তহোন তো আবারো তুলকালাম ঘটবো।”
“কিছুই হইবো না তুই শুধু কফিটা নিবি,টেবিলে রাখবি সুড়সুড় কইরা চইলা আসবি।আর প্যাচাল পারোনের সময় নাই যা তো অহোন।”
অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেহু কফির মগটা হাতে নিল।সে কচ্ছপের গতিতে হাঁটতে হাঁটতে আদ্যর রুমে গেল।আগে বাহির থেকে রুমের ভেতর উঁকি দিতেই দেখে আদ্য আশেপাশে কোথাও নেই। মেহু দৌড়ে টেবিলের ওপর কফিটা রেখে যেই না পেছন ফিরতে যাবে অমনি তার পেছনে আদ্য দাঁড়িয়ে থাকে।ভ্রু একটা তুলে নাক মুখ কুঁচকে আদ্য মেহুকে দেখে আর আদ্যর চাহনিতে মেহুর আত্মা পাখি বাই বাই অবস্থা।
“বাহিরের কাজটা শেষ হলো?”
মেহু চোখ বড় করে ফেলে।বাহিরের কাজ মানে?কোন কাজ, ওনি কি জানেন মেহু কোন কাজে গেছে? কীভাবে জানেন? ওনি তো মাত্র আসলো এরমধ্যে কী ওনি মেহুর কাজ সম্পর্কে জেনে গেছেন?
“কি হলো প্রশ্ন করছি উত্তর দিচ্ছো না কেন?যে কাজে সকালে বের হয়েছিলে সে কাজটা কি হলো?”
মেহু মাথাটা নাড়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু মনে হচ্ছে সেটা পাথর হয়ে গেছে। তাছাড়া দৌড় দিয়ে বের হওয়া সম্ভব না, তাহলে লোকটা সন্দেহ করতে পারে।অনেক কষ্টে মাথা নাড়ায় মেহু।তারপর যেই না বের হবে সাথে সাথে আরেকটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় আদ্য।
“সকালে ছাদে গিয়েছিলাম হাঁটতে। দেখলাম তোমার দরজাটা তালা মারা।তা আমি যতদূর জানি এ বাড়িতে কখনো চোর ঢুকে না।আবার এ বাড়িতে নিশ্চয়ই কেউ চোর না তাহলে তোমার ঘরে তালা দেওয়ার অর্থটা বলো?”
মেহু এ বিষয়টা নিয়ে ভয়ে ছিলো।কারণ একজন কাজের লোকের ঘরে নিশ্চয়ই উচ্চ মানের বই থাকবে না। মেহু ভয়ে থাকত যদি কেউ তার ঘরে ঢুকে ভুল করে বইগুলো হাতে পায়।সেই ভয়ে মেহু ঘরে তালা দেয় কিন্তু এখন কি উত্তর দিবে?
‘কি হলো তুমি চুপ করে আছো কেনো?তোমার সমস্যা কি বলবে?তোমাকে যাই জিজ্ঞেস করি তাতেই তুমি বোবা হয়ে যাও।নাকি অন্য কোনো কারণ আছে? ”
“না না অন্য কি কারণ থাকবো!আসলে জানেন স্যার কি হইছে আমার ঘরে ইয়া বড় একটা বিড়াল ঢুকে।হেইডা ঘরের বিছানায় হাগু কইরা দেয়।আফনে কন বিলাই হাগু করা বিছানায় কি ঘুমোন যায় তার ওপর সেসব সাফ করতে বড়ই কষ্ট হয়।তাই আমি কোথাও গেলে বা নিচে আইলে তালা দিয়া রাখি যাতে ঐ বিলাইটা ঢুকতে না পারে।
ভালা করছি না?”
মেহুর কথা শুনে আদ্য অবাক হয়।যত বড় সাইজের বিড়াল মেহু দেখালো তত বড় সাইজের বিড়াল আদৌ এ বাড়িতে আছে কিনা তা আদ্যর জানা নেই। সে বিস্ময়কর ভঙ্গিতে মেহুর দিকে তাকায়।মেহুকে আরকিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগে মেহু কাজের ব্যস্ততা দেখিয়ে দৌড়ে চলে যায়। মেহুর এহেন কান্ডে আদ্য বলদের ন্যায় চেয়ে থাকে।তবে তার মন থেকে সন্দেহ যায় না।সে ভেবে দেখে এ বড় বিড়ালটা তাকে খুঁজতে হবে।
মেহু আমেনা খালার কাছে এসে পানি খুজতে থাকে। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ আসছে না শুধু পানি পানি শব্দ ছাড়া।আমেনা খালা চট করে ফ্রীজ থেকে বোতল বের করতেই মেহু সেটা কেড়ে নিয়ে ঢকঢক করে গিলে নেয়।আমেনা খালা সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মেহুর দিকে চেয়ে থাকে।
“এ কি মাইয়া কি হইছে তোর? এমন কইরা ঠান্ডা পানি খাস ক্যান অসুখ হইবো তো?”
“খালা আগে জান বাঁচায় এরপর অসুখ। এহোন তো আমার পরাণ পাখি চইলা যাইতাছিলো।”
“ক্যান কি হইছে? খাড়া তুই আবার কোনো ভেজাল লাগাই আইসোস নি? মা গো মা তুই কি কইরা রাখোস ক তো?”
“ও খালা ঘ্যানঘ্যান কইরো না।দাঁড়াও কইতাছি ঘটনা কিতা?”
মেহু এক এক করে সব ঘটনা বলে।আর আমেনার মুখে কখনো ভয়,কখনো বিস্ময় আবার কখনো হাসি দেখা যায়। আমেনা সবচেয়ে মজা পেয়েছিল মেহুর বিড়াল সাইজ দেখে। এত বড় বিড়াল জঙ্গলে আছে কি না সন্দেহ? আমেনা খালা হাসতে হাসতে এ মাথা ও মাথা দৌড়ায় আর মেহু মুখটা কালো করে বসে থাকে।
“খালা খুব মজা লাগতাছে তাই না।তয় আমার ডর করে এ ব্যাডা আমার পেছনে পড়ছে।মনে হইতাছে আমি এবার যামু।”
“আরে মাইয়া ডরাই ক্যান?তয় তোমার এত বড় বিলাই দেহানো উচিত ছিলো না।আমি এত বছর এ বাড়িতে আছি কোনোদিন একটা ছোট বিলাইও দেখলাম না আর তুমি এত বড় বিলাই কই পাইলা?যাউক গা আমি দেখতাছি। তুমি দেখি একটা না একটা ভেজাল পাকাই রাখো।যাও ওদিকে কিছু থালাবাসন পইড়া আছে ধুইয়া লও।”
মেহুও নিজের বোকামিটা বুঝতে পারে তাই মাথায় গাঁট্টা মেরে থালাবাসন ধুতে চলে যায়।
,
,
,
চলবে……