#চলো_রোদ্দুরে,18,19
#ফাতেমা_তুজ
#part_18
নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে ভোর আর রাদ। মৃদু বাতাসে শরীর বার বার কেঁপে উঠছে। দু বাহু তে হাত বুলিয়ে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালায় ভোর। বিষয় টা চোখে পরলে ও তৎক্ষনাৎ কোনো কথা বলে না ছেলেটা। ওহ আড়চোখে দেখে চলেছে ভোর এর গতি পথ। বেশ অনেকক্ষণ পর মুখ খুলে ভোর। রাদ এর কাছে এসে চোখে চোখ রেখে বলল
_দুঃখিত।
মেয়েটার ছলছল চোখ বুকের ভেতর শীতলতা নামায় আবার কোথাও একটা কষ্ট ও অনুভব হয়। কাঁপা হাতে ভোর কে স্পর্শ করে। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দেয় এ স্পর্শে বিদ্যুৎ রয়েছে। কিছু টা ঝটকা মেরেই সরে যায়। ফলে বিব্রত হয় রাদ। মাথা টা নিচু করে বলে
_স্যরি। আমি আসলে বুঝতে পারি না।
_ঠিক আছে।
শুকনো ঠোঁট টা জ্বিভ দিয়ে ভিজিয়ে বলে
_কাঁদছিলে কেন তুমি?
_আসলে আমার ভালো লাগছিলো না। সব কেমন কেমন লাগছিলো।
_সত্যি? নাকি কিছু লুকাচ্ছো আমার কাছে?
মাথা টা নিচু করে ফেলে ভোর। গলা টা কাঁপছে। কান্না রা চোখ ফেঁটে বেড়িয়ে আসে। হঠাৎ এমন করায় ভ্রু কুঞ্চিত করে রাদ। প্রগাঢ় দৃষ্টি মেলে তাকায়। লক্ষ্য করে ভোরের আঁখি পল্লব ধীরে ধীরে উঠা নামা করছে। তাই মোলায়েম গলায় শুধায়
_মিথ্যে বলো না মেয়ে। মিথ্যে বলে কখনোই সমাধান হয় না। বরং সম্পর্ক গুলো নষ্ট হয়।
_ঐ ছেলে টা পার্সেল পাঠিয়েছে।
_কোন ছেলেটা?
_যে প্রথম দিন আমার হাত ধরেছিলো।
দু চোখ কিছু টা লাল হয়ে উঠে। কপালে কয়েক টা ভাঁজ পরেছে। নীরস হাসলো ছেলেটা। ভোরের দিকে একটু এগিয়ে আসলো। চোখ ফুলে গেছে একদম। এক গাছি চুল বার বার চোখে এসে লাগছে। ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠে। শীতলতার মাঝে রাদ এর উষ্ণতা এসে পরে গাঁয়ে। নিশুতি রাতে আঁধারে ডুবে আছে অর্ধচন্দ্র।
ম্রিয়মান আলো প্রস্ফুটিত হয়। দুজনের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ ভারী হয়ে পরেছে অনেকক্ষণ যাবত। কিছু টা ঝুঁকে কানের কাছে মুখ নিয়ে আসে রাদ। তাঁতে যেন মেয়েটার অন্তরআত্মা কেঁপে উঠে। চলে যেতে নিলেই হেঁচকা টানে কাছে নিয়ে আসে রাদ। এই প্রথম কিছু টা চেপে ধরে ভোর কে। ফিস ফিস করে বলে
_ঐ ছেলেটা তোমাকে পছন্দ করে। তুমি কি ওকে পছন্দ করো? মিথ্যে বলবে না একদম। লজ্জায় বলতে পারছো না এমন কিছু নয় তো?
বিস্ফোরিত চোখে তাকায় ভোর। এই মুহূর্তে রাদ কে বিরক্ত লাগছে ওর। এমন বাঁজে ধারনা কি করে করতে পারে? অবাক হওয়ার স্বরে বলল
_ডাক্তার সাহেব!
_তাহলে মিথ্যে কেন বলেছিলে ভোর?
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালায়। ওর ছটফট দেখে কঠিন গলায় রাদ বলল
_হুসস। যেভাবে আছো সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকো। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিলে এক চুল ও ছাড়বো না। কেন মিথ্যে বললে তুমি?
শেষোক্ত কথা তে রাগ স্পষ্ট। কিঞ্চিত কেঁপে উঠে মেয়েটা। রাদ যেন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পরেছে। আরো জোড়ে চেপে ধরায় আহ করে আর্তনাদ করে উঠে ভোর। তাঁতে ও কোনো হের ফের নেই। মেয়েটা ভয় পায় এবার। রাদ এর বুকে হাত রেখে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে
_ব্যথা পাচ্ছি আমি।
_আরো ব্যথা পাবে তুমি। মেরেই দিবো একদম। মিথ্যে কেন বলেছো?
ঝমঝমে কাঁদে ভোর। রাদের হাত আলগা হয় এবার। তবে মেয়েটা সরে না। বরং রাদ এর বুকে ঝাঁপিয়ে পরে। অদ্ভুত শিহরনে ছেয়ে যায় ছেলেটার শরীর। পাশ থেকে বুনো ফুলের সুভাস নাকে আসে। ঝোঁপ থেকে ঝি ঝি পোকা রা গান গেয়ে চলেছে অবিরত সাথে বাতাসের ঝাঁঝালো শব্দ।
এই প্রথম মেয়েটার কপালে চুমু খায় রাদ। কেন করলো এমন জানা নেই। দুজনেই কেমন অদ্ভুত আচারন করছে। হারিয়ে ফেলার ভয় পাচ্ছে কি?
নাক টেনে ভোর বলতে লাগলো
_ আমি ভেবেছিলাম ছেলে টা এমনি তেই চলে যাবে। অথবা একটু একটু বিরক্ত করবে। ঝামেলা করে লাভ কি? তাই বলি নি। আপনি এতো ব্যস্ততার মাঝে আমাকে নিয়ে ছুটোছুটি করেন তাঁর উপর এসব উটকো ঝামেলা। আমার মনে হয়েছিলো না বলাই ভালো। তবে পার্সেল এ লাল রঙের শাড়ি দেখে আমার কেমন লেগে যায়। ভালো লাগছিলো না কিছু। সব কেমন কেমন লাগছিলো। আম স্যরি, আমি কখনো এমন করবো না ডাক্তার সাহেব,আর কখনো করবো না এমন।
মেয়েটার ছলছলে নয়নের রূপ যেন চাঁদের সৌন্দর্য কে ও হার মানিয়েছে। মেয়েটা কে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে। চোখের পানি তে শার্ট ভিজিয়ে ফেলে ভোর। মৃদু হাসে ছেলেটা। তবে একটু আগের আচারনের জন্য মোটে ও লজ্জিত নয় ওহ। ভোর হলো ওর কাছে আমানত স্বরূপ। সেখানে এক টা মিথ্যে অথবা এড়িয়ে যাওয়ার ফল অনেক ভয়ঙ্কর কিছু হতে পারে।
.
পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে থাকতে চেয়েছিলো রাদ। তবে ভোর বারন করেছে। আর প্রমিস করেছে কিছু হলে সোজা কল করবে।কাল মেহেদী সন্ধ্যা ছিলো সেই কারনে প্রচুর ব্যস্ততার মধ্যে সময় কেঁটেছে। আজ আবার হলুদ সন্ধ্যা। সকাল থেকেই নানান আয়োজন। তাই রাদ ও সম্মতি প্রদান করেছে। রনিত এর বাসায় আসতেই মৃদু চেঁচামেচি শুনতে পায় ওহ। ডয়িং রুমে আসতেই দেখে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে রূপ। ইশারায় রনিত কে প্রশ্ন করতেই রনিত বলল
_এই হারামি রোজ ভারসিটি যাবে অকারণেই। ক্লাস তো করবেই না। আজ ওর এক মাত্র বড় ভাইয়ের হলুদ সন্ধ্যা কাজ কর্ম না করে এখন ভারসিটি যাবে।
_বসে আছিস কেন রনিত? ওর মাথা টা ফাঁটিয়ে দে না।
_ব্রো।
রূপ এর কথায় মুখ চেপে হাসে রাদ। ছেলেটার মুখ টা দেখার মতো হয়েছে। কান থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে চোখ মারে রাদ। সঙ্গে সঙ্গে ছুট লাগায় রূপ। পেছন থেকে চেঁচাতে থাকে রনিত। রাদ বলল
_আরে ছাড় তো ওর কথা। এখন প্রচুর কাজ রয়েছে। একটু পর ইনায়ার বাসায় যাবো।
_ভাই একটা হেল্প করবি প্লিজ।
_কিসের হেল্প হু?
আশে পাশে তাকায় রনিত। কাউ কে দেখতে না পেয়ে স্বস্তির দম ফেলে। ফিচেল গলায় বলে
_আমি ও যাবো ওকে হলুদ মাখাতে।
_যাবি?
_হুহ।
_ট্রিট?
_শালা প্রতি কথায় ট্রিট দে ট্রিট দে করিস। আচ্ছা দিবো, প্লিজ তুই ম্যানেজ কর। আর হ্যাঁ ইমরোজ স্যার মানে আমার হবু শশুর যেন আমাকে না দেখতে পায়। তাহলে এ জীবন টা সর্বনাশা হয়ে যাবে রে।
হেসে ফেলে রাদ। ইমরোজ কে প্রচন্ড ভয় পায় রনিত। অথচ তাঁর মেয়ে কেই বিয়ে করতে চলেছে।
হালকা সাজে সেজেছে ভোর। মেয়েটা যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলো রাদ এর ভেতর টা ধুমরে মুচরে যাচ্ছিলো। মনে পরে যাচ্ছিলো সেই দিন টির কথা। সব কিছু ঠিক থাকলে ভোর আজ অন্যের ঘরের বউ হতো? কাঁচা ফুলের গহনায় কি দারুন লাগছিলো ওকে। এখনো সেই সময় টা স্পষ্ট।
গাঁ শিউরে উঠলো ছেলেটার। মৃদু শির শির অনুভূতি হয়। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলছে ভোর। কিছু টা ঝুঁকে সিট ব্লেট লাগিয়ে দেয় রাদ। এমন টা নয় যে ভোর সিট ব্লেট লাগাতে পারে না। তবে মেয়েটা আজ ক্লান্ত। পরীক্ষা শেষ হতে না হতে কিছু অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করতে হয়েছে। হোস্টলে ফিরেই সাজ গোঁজ করতে হলো। সারা দিনের ধকল যেন ওকে অসুস্থ করে দেয়।
_অসুস্থ বোধ করছো তুমি?
_উহহু।
_তাহলে?
_ক্লান্ত লাগছে খুব।
_স্যরি।
_সমস্যা নেই। আপনি টেনশন করবেন না তো। আমি এখন ঠিক আছি। একটু ধকল গেলো আর কি।
_আরে সেটার জন্য নয়। কাল রাতের জন্য স্যরি। খুব ব্যথা পেয়েছিলে তাই না?
এক রাশ লজ্জা এসে ভর করে মেয়েটা কে। ব্যথা পেলে মানুষের মন খারাপ হয় তবে মেয়েটা কেন লজ্জা পাচ্ছে? ছেলেটার ভাবনার মাঝেই ভোর বলল
_না ঠিক আছে।
রাদ আর কিছু বলল না। ভোর যেন রাদ এর দিকে তাকাতেই পারছে না। অনাকাঙিক্ষত ভাবে হলে ও রাদ ওকে গাঢ় ভাবে স্পর্শ করেছে কাল। বিষয় টা অত্যন্ত লজ্জাদায়ক ই বটে।
রনিত কে ফুলের গাড়ি তে উঠাচ্ছে রাদ। ছেলেটা ভীষন ভয় পাচ্ছে। সেই কারনে পুরো ছদ্মবেশ নিয়েছে। মুখে মাক্স লাগিয়েছে এমন ভাবে যেন কোনো জোকার। হাসির রোল পরে গেছে একদম। সুপ্তি , রায়া অনেক আগেই ইনায়ার বাসায় অবস্থান করেছে। সাথে বাঁদরামো যেন না করতে পারে তাই রূপ কে ও নিয়ে নিয়েছে। এ দিকে ভোর বিব্রত বোধ করছে। তিন টে ছেলের মাঝে ওহ একা দাঁড়িয়ে। ভোর এর কাহিল অবস্থা দেখে রনিত এর উপর রেগে যায় রাদ। চেঁচিয়ে বলে
_ইচ্ছে হলে উঠ না হলে বসে থাক আমি গেলাম।
_আরে ভাই রেগে যাচ্ছিস কেন?
_দ্বীপ ওকে নিয়ে ফুলের গাড়ি তে উঠে পর তো।
_ ওকে তুই চিন্তা করিস না। আমি এখনি উঠে যাচ্ছি।
_শেষ মেশ বর হয়ে যাবো ফুলের গাড়ি তে?
রনিতের কাছে আসে রাদ। ভ্রু কুটি করে বলে
_তোর শশুর মশাই যে সিকিউরিটি রেখেছে এতে আর কোনো উপায় নেই। অন্য কোনো গাড়ি নট এলাউ। তাছাড়া তুই তো ওনার সামনা সামনি হতে নারাজ। যদি হতে চাস তাহলে বলতে পারিস আমি এখনি নিয়ে যাচ্ছি।
_না নাহহ আমি ঠিক আছি। ফুলের গাড়ি ই বেস্ট।
মেকি হাসি দিয়ে গাড়ি যে চরে বসে। দ্বীপ বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে সব ঠিক ঠাক জানায়। ফুলের গাড়ি ধোঁয়া উড়িয়ে চলে যায়। শ্বাস ফেলে রাদ। ভোরের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় মেয়েটা একদম জমে গেছে। রাদ বলল
_কি হলো যাবে না হলুদ দিতে?
_যেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া একটু পর তো সবাই ছেলের বাড়ি তেই চলে আসবে। শুধু শুধু জার্নি করে কি লাভ?
মেয়েটার কথা গুরুত্ব দেয় রাদ। সত্যিই তো একটু পর ই সবাই চলে আসবে রনিত কে হলুদ লাগাতে। তাঁর থেকে বরং এখানে থাকাই ভালো। পুরো মন্ডপ খালি প্রায়। ভোর কে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে রাদ। কেন যেন রাদ কে কখনোই বাজে মানুষ মনে হয় না ওর। এক মুহুর্তের জন্য ও মনে হয় না একা পেয়ে রাদ ওর ক্ষতি করবে। এমন কেন হয়! তবে কি অনাকাঙিক্ষত সেই বন্ধনের কারনেই এমন শুভ্র অনুভূতি আর বিশ্বাস?
চলবে
#চলো_রোদ্দুরে
#ফাতেমা_তুজ
#part_19
রনিত কে বকা ঝকা করছেন রেবা। ছেলেটা মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। মাত্র ই ইনায়া কে হলুদ দিয়ে ফিরেছে ওহ। অবশ্য সেটার জন্য বকা খাচ্ছে না। বকা খাচ্ছে রূপ কে নেশা করিয়ে দিয়েছে ইনায়ার কাজিন। সেই থেকে ছেলে টা উল্টো পাল্টা বকে চলেছে। কখনো নেশা না করায় পাক্কা মাতাল হয়ে গেছে। রেবা চলে যান। রাদ এসে রনিত কে নিয়ে যায় গার্ডেনে। ওঁদের দুজন কে দেখেই একটু দূরে সরে যায় ভোর। রাদ দেখলে ও কিছু বলে না। রনিতের পিঠ চাপরে বলে
_তুই তো সাথেই ছিলি, রূপ কে ওয়াইন খাওয়ালো কি করে?
_আমি কি করবো। সবাই তো আমাকে ও চেপে ধরেছিলো। আর তুই তো জানিস রূপ কতো টা ফাজিল। মেয়ে দের সাথে ফ্লাটিং করছিলো। সেই সুযোগেই
_হুম বুঝলাম। তবে তুই যে কতো বড় গাঁধা সেটা ও বুঝেসি। যাহ কাউ কে দিয়ে লেবু পানি খাওয়া ছেলে টা কে। ইসসস ছেলেটা কি সব বলছিলো।
_যাচ্ছি।
রনিত চলে যায়। হেসে ভোর এর পাশে এসে দাঁড়ায় রাদ। ভোর কিছু বলছে না। তবে কেমন উসখুস করছে। কিছু টা ঝুকতেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কেউ। বিস্ফোরিত চোখে তাকায় রাদ। সুপ্তি হেসে চলেছে। রাদ এর দু চোখে রাগের স্ফুলিঙ্গ। মেয়ে টার চুলের মুঠি ধরে কিছু টা দূরে নিয়ে আসে। বলে
_এটা কি হলো?
_আবার কি এটা টেস্ট করলাম জাস্ট।
_কিসের টেস্ট।
_এই যে ভোর তোকে লাভ করে কি না।
বিস্মিত চোখে তাকায় রাদ। সুপ্তির দুষ্টু দৃষ্টি অনেক কিছু ইঙ্গিত করে। তৎক্ষনাৎ মেয়েটার হাতে চিমটি কেঁটে রাদ বলল
_এসব কি বলছিস তুই? ওর আমার মাঝে সম্পর্ক টা আবার এক্সপ্লেইন করবো আমি?
_আরে দোস্ত রাগ করিস না। শোন বাঙালি মেয়েরা অন্য রকম হয়। তাই দেখলাম ওর মধ্যে কোনো ফিলিং আছে কি না।
_তো কি বুঝলি?
_শূন্য। বি কজ ওর চোখে কোনো প্রকার জেলাসি ছিলো না। একদম ই সহজ আর প্রজ্জ্বল দৃষ্টি। ভারী মিষ্টি মেয়ে টা।
হাসে রাদ। ভোর চার পাশ টা দেখে চলেছে। কাঁচা হলুদ এর গন্ধ নাকে এসে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলে ছেলেটা। সেদিনের অনুভূতি টা কেমন জেগে উঠে। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় পরে থাকা সেই মেয়েটির গাঁ থেকে কাঁচা হলুদের মিষ্টি সুবাস নাকে এসে লাগছিলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অব্দি জানান দিচ্ছিলো সেই সময় টুকু শুভ্র।
_এই রাদ।
সুপ্তির কন্ঠে ঘোর ভাঙে ওর। কিছু টা হতচকিয়ে যায়। মেয়েটা দারুন এক হাসি দিয়ে বলল
_ভোর কে ভালোবাসিস?
এক মুহুর্ত থমকে দাঁড়ায় ওহ। রাদ এর ভঙ্গিমা বুঝতে পেরে ছুট লাগায় সুপ্তি। চেঁচিয়ে বলল ছেলেটা
_কাজ টা ঠিক করলি না সুপ্তি। এর জন্য বেশ বড়সড় মার খাবি।
_আমাকে পেলে তো।
ততক্ষনে রাদ এর পাশে এসে দাঁড়ায় ভোর। হালকা হাতে স্পর্শ করতেই দু হাত পিছিয়ে যায় রাদ। অন্যমনস্ক থাকার কারনে ভয় পেয়েছে খুব। হেসে ফেলে ভোর।
_হাসছো কেন?
_হঠাৎ ভয় পেলেন ডাক্তার সাহেব। সাইন্স এর স্টুডেন্ট রা ও ভয় পায়?
_অবশ্যই পায়। আসলে একটু অন্যমনস্ক ছিলাম।
_ওহহ আচ্ছা।
_কিছু বলবে?
_হ্যাঁ হলুদ এর অনুষ্ঠান তো প্রায় শেষ।ভাইয়া তো হলুদে মাখামাখি। আর তো হলুদ দিবে না কেউ। এবার যাই আমরা? রাত দশটা বাজতে চললো যে।
_আজ কে তো তুমি হোস্টেল এ ফিরছো না।
_মানে? সমস্যা হবে না।
_ছুটি নিয়ে এসেছি।
_তাহলে আমি থাকবো কোথায়?
_আমার সাথে।
কথা টার উল্টো মানে বুঝে ভোর। দুটো শুকনো ঢোক গিলে তুতলানো স্বরে বলল
_কিহহ বলছেন কিহহ ডাক্তার সাহেব!
আমি আপনার সঙ্গে না মানে
_আরে বোকা মেয়ে পাশের রিসোর্ট টা নেওয়া হয়েছে অতিথি দের জন্য। আমরা ও সেখানেই থাকছি। একটা পার্ট আমাদের বন্ধু মহলের জন্য রাখা হয়েছে।
_কিন্তু আমি তো আপনাদের বন্ধু মহলের একজন নই।
_তো? তুমি আমার একজন। আর সেই কারনে ইনডাইরেক্ট হলে ও আমাদের বন্ধু মহলের একজন।
উজ্জ্বল হাসে মেয়েটা। সুশ্রী মুখে হালকা হালকা হাসি। ঠিক যেন স্বর্গ থেকে আসা কোনো রূপকুমারী।
.
আড্ডায় মাতোয়ারা পুরো রিসোর্ট। তবে বেশির ভাগ অতিথি রাই বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। শুধু জেগে আছে ইয়ং জেনারেশন। আর তাঁদের মধ্যে ভোর ও একজন অন্যতম সদস্য। রাদ এর বন্ধু মহলের একটা সাইট খুব ভালো। এদের কাছে ধনী দরিদ্রের বিভেদ খুব ই কম। মেডিকেল এর স্টুডেন্ট কি না। এদের দায়িত্ব মানুষ কে সুস্থ করা সেই কারনেই বোধহয় সবার মধ্যে অন্য রকম ভাবনা। লুকোচুরি খেলবে বলে ঠিক করেছে সুপ্তি। এর মধ্যে ইনায়ার কল আসে। বেচারির বোকা বোকা চেহারা দেখে সবাই এক সুরেই বলে উঠলো ” ইসস “।
ক্রন্দনরত চেহারায় ইনায়া বলল
_আমি সবাই কে মিস করছি। তোরা আমাকে রেখে চলে গেলি হারামির দল।
_চিল। তোর বাসর রাতে ভাগ বসাবো আমরাই।
রায়ার দুষ্টুমি ভরা মুখে এমন কথা শুনে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হয় ইনায়ার। তবু ও নিজেকে সামলে বলল
_আসিছ দিবো নে ভাগ।
_ভালোই তো ইনায়া। আমাদের দোস্ত কে কেড়ে নিয়ে একা একাই
কথা টা পরিপূর্ন করতে পারলো না সুপ্তি। তাঁর পূর্বেই ওর মুখ টা চেপে ধরলো দ্বীপ। ছেলেটার হাতে কামড় বসিয়ে বলল
_কথা টা শেষ করতে দে।
_ছিই সুপ্তি তুই অশ্লীল।
_একদম।
রায়া আর দ্বীপ জুটি বেঁধেছে। দুজনে পারে ও বটে। সুপ্তির ঠোঁটের কোনে ব্যঙ্গপূর্ন হাসি। কিছু বলবে তাঁর পূর্বেই রাদ চোখ পাকায়। মেয়েটা থেমে যায়। এঁদের ঝগড়ার সুযোগে ফোন নিয়ে আড়ালে চলে আসে রনিত। ইনায়ার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে। এক অদ্ভুত অনুভূতি বিরাজ করছে। বিয়ের পূর্বে এটাই হয়তো শেষ কথা।
সুপ্তি বেশ কিছুক্ষণ রায়া আর দ্বীপের কথা শুনে। শেষ মেশ রেগে যায়। দ্বীপ আর রায়ার সাথে মারামারি করতে থাকে। মেয়েটা অদ্ভুত, একদম ই বাচ্চা সুলভ আচারন। হাসে ভোর, এখানে থাকা প্রতি টি সদস্য ওর খুব পছন্দের। আর অন্যতম সেরা হলো রাদ।
_কি ভাবছো।
চমকে উঠে মেয়েটা। গাঢ় কমলা রঙে সজ্জিত হয় ওর গাল। কিছু টা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। ভরাট গালে শাহাদাত আঙুলের স্পর্শ দেয় রাদ। কেন এমন করলো ওর জানা নেই। ভোর বলল
_কিছু বলবেন।
_অনেক কিছু বলবো।
_বলুন।
_না মানে।
তুতলে যায় ছেলেটা। মাঝে সাজে কি সব ভঙ্গিমা করে বসে ভাবতে ও পারে না। নিজ ভাবনা কে সাইটে ফেলে ভোর কে নিয়ে ঝিল এর পাশে আসে। রিসোর্ট এর দক্ষিণ পাশে বিশাল ঝিল। একটা সাইটে একটা দোলনা রাখা। কিছু টা সি বিচ এ থাকা দোলনার মতো। কাঠের খাম এর উপর বেশ সুন্দর আর্টিফিশিয়াল ফুল আর বাতি দ্বারা সজ্জিত। মেয়েটা কে নিয়ে সেখানে বসে। হাত দুটো মেলে দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয় ভোর। মুখে বলে
_এতোক্ষন পর এখানে নিয়ে আসলেন আমায়? ইসস কি সুন্দর জায়গা টা।
_খেয়াল ছিলো না।
_ ডাক্তার সাহেব শ্বেত পদ্ম।
কথা টা বলেই চলে যায় ভোর। ঝিলের পাড়ে এসে দাঁড়ায়। যেই না নামতে যাবে তখনি হেচকা টান মেরে কাছে নিয়ে আসে রাদ। সামান্য ভ্রু কুঁচকে বলে
_কি করছিলে কি?
_শ্বেত পদ্ম। আমার খুব ভালো লাগে। আমি নিবো ঐ টা।
_এই শীতের রাতে ঝিলে নামবে তুমি?
_কিছু হবে না আমার।
_একদম নয়।
মুখ টা বাংলার পাঁচের মতো করে ফেলে ভোর। প্রচন্ড খারাপ লাগে ছেলেটার। মিন মিনিয়ে বলল
_আমি নিয়ে আসছি।
_এই না। একদম যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
কথা টা বলার সময় পাংশুটে বর্ণ ধারন করে ওর মুখ। বিষয় টা পরিলক্ষিত হতেই ঝিলে ঝাঁপ দেয় রাদ। বিষয় টা এতো টা দ্রুত ঘটে যে ভয় পেয়ে যায় ভোর। মৃদু কন্ঠ টা মুহুর্তেই চিৎকারে পরিণত হয়। ডাক্তার সাহেব বলে আর্তনাদ করে উঠে।
শ্বেত পদ্ম তুলে নিয়ে আসে রাদ। ভোরের দু চোখে পানি তে টুইটম্বুর।অভিযোগ করে বলে
_আমার চাই না শ্বেত পদ্ম। আপনি কেন এমন টা করলেন ডাক্তার সাহেব?
_আরে কাঁদছো কেন তুমি? আসো আমার সাথে।
_আসবো না।
_শ্বেত পদ্ম না তোমার খুব প্রিয়?
রাদ এর হাত থেকে ফুল টা ঝটকা মেরে নিয়ে নেয় ভোর। সর্বশক্তি দিয়ে দুমরে মুচরে ফেলে দেয় ফুল টা। অনাদরে পরে থাকে নেতিয়ে যাওয়া শ্বেত পদ্ম। হালকা স্বরে বলে
_চাই না আমার ফুল। এতো রাতে কেউ ঝাঁপ দেয়? যদি কিছু একটা হয়ে যেতো।
বাক শক্তি হারিয়েছে রাদ। ভোর কে কি বলবে বুঝতে পারে না। মেয়েটার মুড যখন তখন পরিবর্তন হয়। আচ্ছা বিপদ হলো তো। মাটি তে পরে থাকা ফুলের দিকে তাকায় রাদ। বড্ড খারাপ লাগছে ছেলেটার। বা হাতে কান টা ধরে ফিস ফিস কন্ঠে ফুল টার উদ্দেশ্য বলল
_স্যরি।
চলবে