#অনুভূতির_শীর্ষবিন্দু 🍁🍁
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_24
নক্ষত্রের বাসা থেকে ফেরার পর তিতিক্ষার সময়টা ভালোই যাচ্ছিলো। নবিন পড়াশোনা শেষ করে একটা জব পেয়েছে। অফিসের যাতায়াতের সুবিধার জন্য অফিসের পাশেই দুই রুমের একটা বাসা নিয়েছে। তিতিক্ষা আর বিভা নিজে গিয়ে নবিনের রুম সাজিয়ে দিয়ে এসেছে। এজন্য নবিনকে ওদের ট্রিট দিতে হয়েছে। তিতিক্ষার আপাতত পড়াশোনার চাপ নেই। বুটিক ঘরেই সে সময় দিচ্ছে। নক্ষত্রের সাথে খুনশুটি, চুপিচুপি দেখা করা, ঘুরাঘুরি, ভাইবোনদের সাথে আড্ডা দিয়েই ওর দিন কাটছে।
দুই সপ্তাহ পর….!!
সবটা ঠিকই ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে দমকা হাওয়ার মতো শান্তি নামক সুখপাখি ওদের জীবন থেকে উড়ে গেল। কালকে রাতে নক্ষত্রকে অনেক বার ফোন দেওয়ার পরও সে ফোনটা রিসিভ করেনি। কেন রিসিভ করেনি, সেটা তিতিক্ষার অজানা। তিতিক্ষা মনে মনে নক্ষত্রকে এত এত বকা দিলো। মনের মধ্যে এক রাশ অভিমান নিয়ে সে ঘুমিয়ে পড়লো। পরেরদিন সকালবেলা নক্ষত্রের আব্বু, আম্মু আর অদ্রি তিতিক্ষাদের বাসায় উপস্থিত হয়েছে। তিতিক্ষা মুচকি হেসে উনাদের সালাম দিলো। নক্ষত্রের আব্বু সালামের উত্তর দিলো। তিতিক্ষা ওদের মুখের দিকে তাকালো। কারো মুখে হাসির ছিটে ফোঁটাও নেই। মামনি এসে উনাদের সাথে কথা বললো। কেন জানি অজানা একটা ভয় এসে তিতিক্ষার মনে হানা দিচ্ছে।
কি হয়েছে? ভয়ংকর কিছু? সবার মুখের এই অবস্থা কেন? অদ্রির চোখের অঝরে অশ্রু ঝরছে। ওর গালে মারের দাগ স্পষ্ট। ঠোঁটের কোণা কেটে ফুলে গেছে। নক্ষত্রের আম্মু চোখ মুখ ফুলে আছে। নক্ষত্রের আব্বু শান্ত কন্ঠে তিতিক্ষার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তিতিক্ষা আম্মু নবিন কি বাসায় আছে? ওকে ডেকে দাও । বলো, ওর সাথে আমরা কথা বলতে এসেছি।”
–“জ্বি আব্বু।”
তিতিক্ষা নবিনকে ডাকতে গেল। মামনি কিছু বুঝতে পারছে না। নবিন এসে উনাদের সামনে দাঁড়ালো। নবিনের দৃষ্টি অদ্রির দিকে। নবিন কিছু একটা আঁচ করতে পারলো। সে মাথা নিচু করে সামনের সোফাতে বসলো। নক্ষত্রের আব্বু আগে কথা বললো,
–“আমরা কেন এসেছি? আশা করি, তুমি ভাল মত বুঝতে পারছো। এসবের কি খুব প্রয়োজন ছিলো?”
নবিন মাথা কিছু বলতে যাবে, তার আগে নক্ষত্রের আম্মু মুখ খুললো,
–“তোমার এত বড় স্পর্ধা কিভাবে হলো যে আমার মেয়ের সাথে রিলেশনে জড়িয়েছো? লজ্জা করে না তোমার? বিন্দু মাত্র লজ্জাবোধ, বিবেক, বুদ্ধি, শিক্ষা আছে কি তোমার? যে বাসায় তোমার বোন যাবে, সে বাসার মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো। এই তোমার শিক্ষা?”
নক্ষত্রের আব্বু উনার স্ত্রীকে থামতে বললেন। সবাই বসে ব্যাপারটা সামলাতে হবে। নক্ষত্রের আব্বু শান্তভাবেই কথা বলার জন্য উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু যেখানে মেয়েরা আগ বাড়িয়ে কথা বলে। সেখানে সু-শৃঙ্খলভাবে আদও কিছু হয় বলে উনার জানা নেই। অদ্রির পাশে তিতিক্ষা গিয়ে দাঁড়ালো। এদিকে নক্ষত্রের আম্মু থামছে না। নিজের ছেলেকে এমন করে কথা শুনাতে দেখে মামনি নক্ষত্রের আম্মু কথা ধরলো।
–“এভাবে কথা বলছেন কেন? আপনি কোন অধিকারে আমার ছেলের সাথে এভাবে কথা বলছেন?”
নক্ষত্রের আম্মু মামনির কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। উনি আরো কঠিন গলায় বললেন,
–“কেন বলছি? আপনার অসভ্য, বেয়াদব ছেলেকে জিজ্ঞেস করুন।”
একদিকে নক্ষত্রের আম্মু, অন্যদিকে মামনি দু’জনেই রেগে গেছে। নবিনের বাবা চেচাঁমেচি শুনে ড্রয়িংরুমে আসলো। তিতিক্ষার শরীর থরথর করে কাঁপছে। উনাদের চেচাঁমেচিতে বিভা, আহানও দৌড়ে আসলো। নবিনের আব্বু সোফাতে বসে নক্ষত্রের আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো,
–“ভাই কি হয়েছে? আমাকে খুলে বলুন। বেয়ান আগে আমরা সবটা শুনি। তারপর যা করার করবো।”
নক্ষত্রের আব্বু নবিনের আব্বুর দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবেই বললো,
–“কালকে সন্ধ্যায়, আমাদের এক প্রতিবেশী আমাদের বাসায় এসেছিলো। উনি বললো, কালকে নাকি অদ্রি আর নবিনকে একসাথে দেখেছে।
অদ্রি আর নবিনের মধ্যে যে রিলেশন আছে, আমরা জানতাম না। যদি জানতাম, তাহলে নক্ষত্র আর তিতিক্ষার মত ওদেরও মেনে নিতাম। কিন্তু ওরা ওদের সম্পর্কটাকে আরো কয়েকধাপ এগিয়ে গেছে। কালকে অদ্রি আর নবিন নাকি হসপিটালে গিয়েছিলো।”
নবিনের আব্বু নক্ষত্রের আব্বুর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। উনি ঘামছেন, নিজের মেয়ের অপরাধে কথা নিজেকে বলতে হচ্ছে। উনি যথেষ্ট স্পষ্টবাদী মানুষ। উনার কাছে ভুল মানে ভুলই। সেটা ছেলে করুক বা মেয়ে করুক। মিঃ আবরার পানিটা খেয়ে আবার বললো,
–“কালকে নবিন অদ্রিকে এবোর্শন করাতে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলো। ওরা সম্পর্কটা এবোর্শনের মতো জঘন্য ব্যাপার অবধি চলে গেছে। নবিন এসবের তো কোনো দরকার ছিল না। আমাদের ওই প্রতিবেশী এদের সব কথা শুনেছে। প্রমান সহ আমাদের দেখিয়েছে। ভাই আপনার মত অনুযায়ী বলুন, আমরা এখন কি করবো?”
এটা শুনে তিতিক্ষার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। অদ্রি আর নবিন এমনটা করতে পারলো। নক্ষত্র তিতিক্ষাকে খারাপ ভাবে স্পর্শ করবে না। তাই বিয়ে করে ফেলছে। আর সেখানে নক্ষত্রের বোন বিয়ের আগে প্রেগন্যান্ট। এমন জঘন্য কাজ ওরা কিভাবে করতে পারলো? নবিন মাথা নিচু করে বসে আছে। নক্ষত্র এখানে উপস্থিত নেই। নক্ষত্র এখানে থাকলে কি বলতো? সে কার দিকে আঙ্গুল তুলতো, বোনের দিকে নাকি বউয়ের ভাইয়ের দিকে? বোনকে কি বলতে পারতো, তুই প্রেগন্যান্ট হয়েছিস কেন? নাকি ভাই হয়ে বলবে, বোন তুই রুম ডেট করেছিস কেন? নাকি বলবে, আর ছেলে পাস নি, নবিনকেই বা কেন? আসলেই কি বোনকে কি এসব বলা যায়? নক্ষত্র তাহলে কি করতো? নবিনের আব্বু এসব শুনে নবিনের গালে দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। অদ্রি এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। মামনি উনার হাজবেন্ডকে বলে উঠলো,
–“তুমি কেন আমার ছেলেকে মারলে? উনাদের কথা পরখ না করে কেন উনাদের সাপোর্ট করছো? উনি তো আমার ছেলের দোষ দিচ্ছে, এক হাতে তো তালি বাজে না।” (মামনি)
–“তুমি চুপ করো!”
–“কেন চুপ করবো? উনাদের মেয়ে কি ধোঁয়া তুলসি পাতা। আমার ছেলের কাছে কেন এসেছিলো? কে আসতে বলেছিলো? নিজেদের মেয়ের দোষ না দেখে কেন শুধু আমার উপর দোষ দিচ্ছে?”
নক্ষত্রের আম্মু উঠে দাঁড়ালো। মামনির দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আমার মেয়ের দোষ আছে বলেই কালকে থেকে ও আমাদের কাছে মৃত। আপনার ছেলের দোষ আছে বলে, আপনাদের জানিয়ে দিলাম। এছাড়া আপনাদের বাসায় আমরা পা ও রাখতাম না।”
মামনি একথার প্রতি উত্তরে বলে উঠলো,
–“আমরাই মানুষ চিনতে ভুল করেছি। না হলে আপনাদের মত মানুষের সাথে আত্মীয়তা করি? আর আপনারা পা না রাখলে আমরা না খেয়ে মরবো না।”
নক্ষত্রের আব্বু উনার স্ত্রীকে থামতে বলছেন। উনি কিছুতেই থামছে না। উনার মধ্যে যেন রাগের ফুলকি দাউদাউ করে জ্বলছে। উনি এবার বললো,
–“আপনাদের কোনো যোগ্যতায় নেই আমাদের সাথে আত্মীয়তা করার। আমার ছেলে আপনাদের ঘরে পা রেখেছে, আপনাদের সৌভাগ্য। এছাড়া কোনো দিক দিয়ে আপনাদের সাথে আমাদের যায় না। আজকে যদি আপনাদের সাথে আত্মীয়তা না করতাম, তাহলে হয়তো এসব ঘটতো না। খাল কেটে কুমির তো আমরাই ডেকেছি।”
তিতিক্ষা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। দুই পরিবারের ভাঙ্গনের শুরু। আচ্ছা, নক্ষত্র আর তিতিক্ষার বিচ্ছেদই কি এর চূড়ান্ত ফলাফল?
নবিন আর অদ্রির ভুলের জন্য আজকে নক্ষত্র আর তিতিক্ষা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে। নক্ষত্রের আম্মু শব্দ করে কাঁদতে কাঁদতে নক্ষত্রের আব্বুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“তোমার ছেলের জন্য আজকে এই অঘটন ঘটলো। এবার তোমার ছেলে খুশি তো? আর কোনো পরিবার সে খুজে পেলো না? এই পরিবারের মেয়েকেই তার পছন্দ করতে হলো? আজকে পরের মেয়ের জন্য নিজেদের সন্মানটাই হারাতে বসেছি। এসব শুনে ওর কলিজাটা ঠান্ডা হলো তো? যার বোনের জন্য এত কিছু করলো। সেই তার বোনের গায়ে কংঙ্কের কালি লাগিয়ে দিলো। এরপরও কি সে এই বাসার মেয়েকে বিয়ে করবে? এই বাসার ছেলের জন্য আমার মেয়েদের গায়ে কালি লেগেছে। আমি আর এদের সাথে কোনভাবেই সম্পর্ক রাখবো না। আমি যেহেতু বলেছি না, তো না’ই। আমি এই বাসার মেয়েকে আমার ছেলের বউ করতে পারবো না। আমি নিজে ভেঙে দিলাম এদের সাথে সম্পর্কটা। আর নক্ষত্রকেও আমি ক্ষমা করবো না।
মিঃ আবরার উনার মিসেসকে ধমকে বললো,
–“এখানে নক্ষত্র আর তিতিক্ষার কি দোষ? ওদের টানছো কেন? মৃধা রাগের মাথায় বোকামি করো না, যার জন্য পরে তোমাকে পস্তাতে হয়। নক্ষত্র এখানে নেই, ওকে না জানিয়ে এত বড় সিদ্ধান্ত তুমি নিতে পারো না।”
নক্ষত্রের আম্মু চোখের পানি মুছে তিতিক্ষার দিকে তাকালো। উনার বুক ফেটে যাচ্ছে; তবুও কিছু করার নেই। নক্ষত্রের আম্মু তিতিক্ষার হাত রেখে ওদের এনগেজমেন্টের রিংটা খুলে নিলো। তিতিক্ষা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ এই রিংটা দিয়েই নক্ষত্রের নামের সাথে তিতিক্ষার নামটা বেঁধে দিয়েছিলো। তিতিক্ষার চোখের পানিতে ওর ওড়না ভিজে যাচ্ছে। ওর কান্নার কোনো শব্দ নেই। কিন্তু অবাধ্য বেহায়া চোখের পানি ঝরতেই আছে। বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছে। সবার চোখে পানি। কিন্তু কিছু করার নেই, পরিস্থিতি উল্টো দিকে মোড় নিয়েছে। নক্ষত্রের আম্মু মিঃ আবরারের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আমি জানি আমার ছেলে আমার অবাধ্য হবে না। যদি হয়েও থাকে, তাহলে এদের মত অকৃতজ্ঞ বেইমান ছেলে মেয়েদের জন্ম দেওয়ার অপরাধে আমি এই পৃথিবীর বুকে নিজের অস্তিত্ব রাখবো না।”
মামনি তিতিক্ষার চোখ মুছে দিলো। সোজা ভাবে দাঁড় করিয়ে বললো,
–“তুই কেন কাঁদছিস? তোর জন্য কি ছেলের অভাব হবে নাকি? তুই কাঁদবিনা, নক্ষত্রের থেকে ভালো ছেলে খুঁজে দিবো। জীবন কারো জন্য পড়ে থাকে না।”
এই কথা শুনে তিতিক্ষা আবার দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িলো। বেইমান শরীরটাও আর চলছে না। সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে। নক্ষত্রের হাসি হাসি মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। এই ঝড়টাতে সব লন্ড ভন্ড করে দিলো। ওর সব অনুভুতি এক নিমেষেই চূর্ণ বিচূর্ন হয়ে গেছে। মাথা ঘুরছে, চোখের পানির ঝাপসা দেখছে সবকিছু। আহান আর বিভা কাঁদছে। নবিন নিজেও কাঁদছে তিতিক্ষার অবস্থা দেখে। নবিন চোখের পানি মুছে মাথা নিচু করে বললো,
–“বাচ্চা যেহেতু আমার। আমিই অদ্রিকে বিয়ে করবো।”
মামনি নবিনের মুখে এই কথা শুনে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
–“না! যে মেয়ে বিয়ের আগে পেট বাঁধাতে পারে। সে মেয়েকে আমি আমার সংসারে ঢুকতে দিবো না। কতটা বেহায়া হলে এমন কান্ড ঘটাতে পারে। এই মেয়েকে কিছুতেই আমি আমার বাসায় থাকতে দিবো না।”
–“তাহলে আমাকেই বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। ভুল যখন করেছি, ভুলটা শুধরানোর দায়িত্বটাও আমার। আমি অদ্রিকে ভালবাসি, তাকে মাঝ পথে ছাড়তে আমি পারবো না।” (নবিন)
নক্ষত্রের আম্মু অদ্রির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। কালকে অদ্রি উনি অনেক মেরেছে। এই প্রথম উনি অদ্রির গায়ে হাত তুলেছে। মারতে মারতে অদ্রিকে অঙ্গান করে তবেই উনি ছেড়েছে। রুমের দরজা আটকে থাকার জন্য মিঃ আবরার ধরতেও পারেনি। উনি ছেলে-মেয়েকে ভালোও বাসেন আবার শাসণও করেন। মা বলে যে অদ্রিকে ছাড় দিবে, তিনি এটা করেনি। নক্ষত্রের আম্মুর প্রচুর জেদ। যখন যা বলে, সেটা করেই ছাড়ে। উনি যখন ভালো মুডে থাকেন, তখন মনে হয় উনার মত মানুষ পৃথিবীতে নাই। কিন্তু যখন রেগে যান তখন উনি কাউকে ছাড় দেয় না। নিজের স্বামী-সন্তানকেও না। নক্ষত্র ওর মায়ের এই গুনটা খুব ভাল মতই পেয়েছে। এত কিছু নক্ষত্র জানে না। পরশু রাতে সে ঢাকাতে গেছে। ওকে এসবের কিছু জানানো হয়নি। নক্ষত্রের আম্মু অদ্রির দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
–“রাস্তা পথে তোর সাথে আমার দেখা যেন না হয়। এমন বিবেক, বোধহীন, নিলজ্জ, বেহায়া, আমার মেয়ে হতেই পারে না। তুই আমার কাছে মৃত। কাল সন্ধ্যায় থেকে তুই আমার কাছে মৃত হয়ে গেছিস, আর এখন তোকে মনে মনেই দাফন করে দিলাম।”
কথাটা বলে উনি মিঃ আবরারকে নিয়ে চলে গেল। অদ্রি মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে। একদিকে অদ্রি আরেক দিকে তিতিক্ষা কাঁদছে। কে কাকে কিভাবে শান্তনা দিবে? ড্রয়িংরুম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। এই ড্রয়িংরুমেই নক্ষত্রের সাথে ওর পথচলা শুরু হয়েছিলো। তাহলে আজকে এখন এই স্থানেই কি সব সমাপ্ত ঘটবে। উপস্থিত কারো মুখে কোন কথা নেই। বোনের এমন করুণ অবস্থার জন্য নবিনের মরে যেতে ইচ্ছা করছে। সে তো এমনটা চাইনি। তাহলে কেন এমনটা হলো? ভাইয়ের জন্য বোনের স্বপ্ন, ইচ্ছা, শখ, আহ্লাদ সব শেষ। পরবর্তীতে কিভাবে বোনের সামনে সে দাঁড়াবে? কোন বিবেক নিয়ে বোনের সাথে কথা বলবে? তিতিক্ষাই বা এমন ভাইকে আগের মত সন্মান করতে পারবে কি না কে জানে।
নবিনের আব্বু কাজি ডেকে আনলো। উনার উপস্থিতিতে বিয়ে অদ্রি আর নবিনের বিয়ে সম্পূর্ণ করলো। অদ্রির গলা ভেঙে গেছে কাঁদতে কাঁদতে। নক্ষত্রের আদরের বোনটা কি অবস্থা? নবিন সোফা থেকে উঠতেই, মামনি নবিনকে কড়া কন্ঠে বললো,
–“তুমি এই মেয়েকে নিয়ে এক্ষুণি এই বাসা থেকে বেরিয়ে যাও। এই বাসায় আর ভুলেও এসো না। আমি আগে তোমাকে মানুষ ভাবতাম। কিন্তু তুমি অমানুষে পরিণত হয়েছে। মানুষ হলে এসব করার আগে বোনের কথাটা একটাবার হলেও ভাবতে। এমন নোংরা কাজে লিপ্ত হওয়ার আগে তোমার বুকটা কেঁপে উঠতো।”
নবিন মাথা নিচু করে ওর রুমে চলে গেল। ওর দরকারী জিনিসপত্র নিয়ে অদ্রিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তিতিক্ষা ওখানেই হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়লো। আচ্ছা! এটা কি খারাপ স্বপ্ন হতে পারে না? তিতিক্ষা মনে প্রাণে চাচ্ছে, এটা দুঃস্বপ্ন হোক। ঘুম থেকে উঠে যেন সব আগের মত পরিপাটি পায়। কিন্তু সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছে। আজকে যা ঘটে গেলে কোনটাই মিথ্যা গল্প বা দুঃস্বপ্ন নয়। তিতিক্ষার চোখে ফুলে গেছে। ফর্সা মুখে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে, বড় বড় টানা টানা চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
বিভা আর আহান তিতিক্ষার পাশে বসলে। ওদের চোখেও পানি। ওরা জানে নক্ষত্র তিতিক্ষাকে কতটা ভালবাসে। আচ্ছা! পবিত্র ভালবাসার পরিণতি এত ভয়াবহ হয় কেন? ভালবাসা এত কষ্ট পেতে হয় কেন? কষ্ট যদি পেতেই হবে তাহলে ভালবাসা নামক অদৃশ্য বিষ সবাই পান করে কেন? কেন ভালবাসার আগুনে দগ্ধ হতে হয়? আহান তিতিক্ষার মাথাতে হাত রাখলো। তিতিক্ষা কাঁদতে কাঁদতে ওর রুমে চলে গেল। রুমে দরজা আঁটকে বারান্দায় চলে গেল। দূরে একটা কোকিল ডাকছে। অন্য সময় হলে তিতিক্ষা মন দিয়ে কোকিলের ডাক শুনতো। কিন্তু এখন এসব বিষাদের মত লাগছে। সবকিছু তিক্ততায় ভরপুর।
তিতিক্ষার বারান্দায় বসে উচ্চ শব্দে কাঁদছে। বুকের ভেতরে মনে হচ্ছে, কেউ আগুনের লাভা ঢেলে দিয়েছে। নক্ষত্রকে ছাড়া তিতিক্ষা থাকবে কি করে? ওই ছেলেটা যে ও সব অনূভূতিতে গভীর ভাবে আবদ্ধ হয়ে আছে। সে কিভাবে থাকবে, ওই মানুষটাকে ছাড়া? এই কঠিন পরিস্থিতি কিভাবেই ওরা সামলে উঠবে? মাথা কাজ করছেনা, এসব সমাধান সে পাচ্ছেনা। তিতিক্ষা উচ্চ শব্দ কেদেই যাচ্ছে। এই কান্নার মাঝে নক্ষত্রকে চিরতরে হারানোর ভয়টা লুকিয়ে আছে। এই প্রতিটা অশ্রুর মাঝে, নক্ষত্রকে জন্য তিল তিল করে গড়ে তোলা, অনুভূতিরা লুকিয়ে আছে। নক্ষত্রের আম্মু তো ওদের এনগেজমেন্টটাও ভেঙে দিলো। এবার কি হবে? কি করে, সে নক্ষত্রকে পাশে পাবে? কিভাবে এক সাথে ওদের পথ চলা শুরু হবে? তিতিক্ষাই বা কিভাবে বাঁচবে নক্ষত্রকে ছাড়া? তিতিক্ষা ওর চুল গুলো টেনে কেঁদে বলে উঠলো,
–“হে আল্লাহ! এমনভাবে নিরবে জীবন্ত লাশে পরিণত না করে, আমাকে তুমি সরাসরি মৃত্যু দান করো। আমি আর নিতে পারছিনা। আমার মৃত্যুর মাঝেই সব কষ্টের সমাধান লুকিয়ে আছে।”
To be continue…..!!