#অদৃষ্টচর
#written_by_Nurzahan_Akter_Allo
#Part_08
রাহীদ ওর আম্মুকে ফোন দিয়ে ওর আর রুপের বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে বললো। অনেক সময় তো নিলো। এভাবে আর কতদিন চলবে। এবার একটা পদক্ষেপ নেওয়াটাই উচিত হবে। রাহীদের আম্মু এই কথা তাৎক্ষণিকই রুপের আব্বু-আম্মুকে জানিয়ে দিলো। মেয়েকে নিয়ে উনাদেরও চিন্তার শেষ নেই। কত কি ঘটে গেল গত কয়েকদিনে। আর রাহীদ তো অচেনা কেউ না। বরং সে ছেলে হিসেবে যথেষ্ট ভদ্র। রুপের আব্বু-আম্মুর ফোন যখন কথা বলছিলো রুপ সব শুনেছে। সে রান্নাঘরে গিয়ে কড়া করে দুই মগ চা বানালো। রাহীদের রুম নক করে বললো,
–“ভাইয়া ছাদে যাবে?”
রাহীদ ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে টাওয়ালটা কেবল হাতে নিয়েছে। রুপের কথা শুনে রাহীদ দরজার দিকে তাকালো। রাহীদ মুচকি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। রাহীদ মুখ মুছে ফোনটা হাতে নিয়ে রুপের সাথে ছাদে গেল। দু’জনেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। রুপ চায়ের মগে একটাবার চুমুক দিয়ে সামনের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছে। রাহীদ ছাদের রেলিং ঘেষে, হাতে মগটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাহীদ জানে রুপ ওকে কেন এখানে নিয়ে আসলো। এমনি এমনি রুপ ওকে এভাবে ডেকে ছাদে আসবে না, এটা সে ভালো করেই জানে। রাহীদ চুপ করে আছে রুপের কথা শোনার জন্য। রুপ সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো,
–“আমি তোমার ফিলিংসকে সন্মান করি, ভাইয়া। আমি জানি তুমি বিগত আট বছর ধরে আমাকে ভালবাসো।”
রুপের কথা শুনে রাহীদ রুপের দিকে তাকালো। রুপ রাহীদের দিকে তাকালো না। রুপ খুব স্বাভাবিক ভাবে কথাটা বলে ফেললো। রাহীদের একটু একটু করে জমিয়ে রাখা ভালবাসার কথাটা তাহলে সে জানতো। তবুও এতদিন ওকে কিছু বুঝতে দেয়নি। রুপ আবারও বলে উঠলো,
–“আত্মীয়ের মধ্যে আত্মীয়তা করাটা আমি কেন জানি মানতে পারি না। তোমাকে আমি সেই স্থানে বসাতে পারবো না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমি তোমাকে মানিয়ে নিতে চায় না। তাই অনুরোধ রইলো খালামণির দেওয়া প্রস্তাবে আর না এগোতে।”
রাহীদ রুপের কথাটা মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনলো। নিজেকে একদম শান্ত রেখে সে বললো,
–“সময় লাগলে নে।”
–“না।”
–“এত নিষ্ঠুর ভাবে না শব্দটা কি না বললেই নয়?
–“মনের বিরুদ্ধে আর যাই হোক ভালবাসার জন্ম হয় না, তাই না?”
–“আমি তো তোর দিকে আমার এক হাত বাড়িয়ে দিয়েই আছি। তুই সময় নিয়ে একটা পা এগিয়ে সামনে এগিয়ে আয়। কোনো কাজই একদিনে নিখুঁত ভাবে হয় না। ঠিক তেমন দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে সুপ্ত অনুভূতি থেকে ভালবাসার জন্ম নিবে। একটাবার সুযোগ তো দেওয়া উচিত, তাই না?”
–“ভাইয়া, প্লিজ জোর করো না।”
–“একটু সময় নে, দেখবি ভাইয়া ডাকটাকে বিদায় দিয়ে শুধু রাহীদ বলে ডাকতে সক্ষম হবি।”
রুপ আর কথা বাড়ালো না। ওর চায়ের মগটা রেখে হনহন করতে করতে চলে গেল। রাহীদের খুব কষ্ট লাগলো। এতদিন ধরে ভালবাসে, এত সহজে কিভাবে হারাতে দিবে? এই নিষ্ঠুর মেয়েটা ওকে বুঝতেই চায় না। আর রাহীদও ওর ভালবাসার কথাটা ঠিক মতো প্রকাশ করতে পারে না। আর পাঁচজনের মতো ভালবাসার মানুষটাকে নিয়ে রোমান্টিক কোনো সিন তৈরী করতে পারে না। বার বার ভালবাসি বলে আহ্লাদ করতে পারে না। তবে সে রুপকে খুব ভালবাসে।
শ্রেয়ান বেশ কয়েকদিন পর বাসা থেকে বের হলো। আজকে ওর প্রোগ্রাম আছে। বাইক না নিয়ে সে গাড়ি নিয়ে বের হলো। শ্রেয়ানের একটা বন্ধুকে ওকে ফোন দিয়ে দেখা করতে বললো। সে ও জানালো প্রোগ্রাম শেষ করে দেখা করবে। এরপর শ্রেয়ান ওর ফোনটা সাইলেন্ট করে দিলো। প্রতিবারের মতোই এবারও সে ওর মাদকাপূর্ণ কন্ঠস্বর নিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করলো। ওর কন্ঠ শুনে শ্রেয়ানের ভক্তরা এত এত মেসেজ করছে। শ্রেয়ান খুব সুন্দরভাবে তাদের মেসেজগুলো পড়ে মেসেজের উত্তর দিতে থাকলো।
বেশ কয়েকদিন পরে রুপ কলেজে যাওয়ার জন্য বের হলো। ওদের গেট থেকে বের হতেই আদ্রিয়ান আর ওর দাদুর সাথে রুপের দেখা হলো। রুপ একটু অবাক হলো আদ্রিয়ানকে এখানে দেখে। রুপ আদ্রিয়ানকে আর ওর দাদুকে সালাম দিলো। আদ্রিয়ান সালামের উত্তর নিলো। আদ্রিয়ানের দাদু বললো,
–“বাহ্! তুমি তো খুব মিষ্টি দেখতে।”
–“ধন্যবাদ।”
–“আমার পাশের ছেলেটাও খুব সুদর্শন, তাই না?”
–“হুম।”
–“ওর জন্য মেয়ে দেখছি।”
–“ওহ।”
আদ্রিয়ান ওর দাদুর দিকে তাকালো। ওর দাদুর কি করতে চাচ্ছে সে বোঝার চেষ্টা করছে। আদ্রিয়ান কিছু বলার আগে ওর দাদু ওর কানে কানে বললো,
–“রুপ দেখতে মাশাআল্লাহ। এবার তুই কাজে লেগে পড়।”
আদ্রিয়ান একবার রুপের দিকে তাকালো। রুপ হয়তো উনাদের কথা শুনতে পায়নি। রুপের থেকে বিদায় নিয়ে ওর দাদু পাশের চায়ের দোকানে বসে পড়লো। আদ্রিয়ান রুপের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“তুমি এখানে?”
–“এইটা আমার বাসা। আমি এখন কলেজে যাচ্ছি।”
–“ওহ।”
–“আপনি এখানে কেন?”
–“আমি এই বিল্ডিংয়ের তিনতলাতে উঠেছি।”
–“ওহ! আমি এখন আসি তাহলে?”
–“ওকে।”
রুপ চলে গেল। আদ্রিয়ানের দাদু এসে আদ্রিয়ানের পাশে এসে দাঁড়ালো। আদ্রিয়ান ওর দাদুর দিকে তাকালো। আদ্রিয়ানের দাদু মাথা হ্যাং সূচক মাথা নাড়ালো। আদ্রিয়ান ঘাড় ঘুরিয়ে রুপের যাওয়া দিকে তাকালো। সেদিন আদ্রিয়ান রুপের দিকে একবার তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু আজ খুব ভাল ভাবে দেখলো। আদ্রিয়ানের দাদু আদ্রিয়ানের কাঁধে হাত রেখে বললো,
–“এই মেয়েটার সংস্পর্শে যে কোনো ছেলের প্রাণ সংশয় ঘটতে পারে। এই মেয়েটা কোনো ছেলের সহধর্মিণী হতে পারবে না। কারণ সে সহধর্মিণী হিসেবে যেকোন ছেলের জীবনে অভিশাপ স্বরুপ।”
আদ্রিয়ান ওর দাদুর কথা শুনে কিছু একটা ভাবলো। ওর মুখে গভীর কোনো চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আদ্রিয়ান ওর দাদুর দিকে তাকিয়ে বললো,
—“ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও। যত দ্রুত সম্ভব, আমি ওকেই বিয়ে করবো।”
আদ্রিয়ান কথাটা বলে চলে গেল। তবে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ওর দাদু আর কিছু বললো না৷ আদ্রিয়ানের কথা অনুযায়ী উনি রুপদের বাসায় গেল। কিছু কিছু কাজ ফেলে রাখতে নেই। কখনও কখনও ফেলে রাখা কাজটা আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রুপের আম্মু-আব্বু রাহীদের কথা উনাকে জানালো। এমন কথা শুনে আদ্রিয়ানের দাদুর কপালে ভাঁজ পড়লো। উনি আর কথা না বাড়িয়ে চলে আসলো। আর এই কথা আদ্রিয়ানকেও জানালো। আদ্রিয়ানে হসপিটালে যেতে হবে। এজন্য আর আপাতত কথা বাড়ালো না। সে রেডি হয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে চলে গেল।
রাহীদ ওর বাসায় চলে গেছে। তবে যাওয়া আগে বলে গেছে সময় নিতে। তবুও যেন ওকে না ফেরায়। রুপ কিছু বলেনি। ওর স্বভাব অনুযায়ী সে স্বাভাবিক হয়ে বসে ছিলো। আজকে সকালে রুপের সাদিফের সাথে দেখা হয়েছিলো। সাদিফ নরমাল ড্রেসে বাইক নিয়ে এসেছিলো। রুপকে দেখে হেসে কিছু বলার আগেই রুপ বললো,
–“কি সমস্যা? এখানে কি? আর আমার কাছে এসেছে কেন?”
রুপের কথা শুনে সাদিফের আর কিছু বলা হলো না। যেটা বলার জন্য এসেছিলো, সে আপাতত কথাটাকে পেটে চালান করে দিলো। ওর আসার কারণ তো রুপ দেখাতে হবে। এজন্য সে ইনিয়ে বিনিয়ে মিমির কথা বললো। রুপের কোনো সমস্যা হচ্ছে নাকি? সেটা জানতে চাইলো। মিমিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। গত দুইদিন অত্যাধিক মার খেয়ে, ওর হাতের একটা একটা করে নখ তোলার পর সে বাকি দুই ডাক্তারের কথা বলেছে। ওই দুই ডাক্তার মিমি ভাই আর ভাবি। তাদের খোঁজ চলছে। তাদের পেলেও লকআপে ঢুকিয়ে তাদেরকেও আচ্ছামত আদর যত্ন করা হবে। এত গুলো মানুষ প্রাণ নিয়ে খেলার শখ মিটিয়ে দিবে। রুপ সাদিফের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“এখন আমার কাছে আসার কারণ কি, সেটা বলুন।”
–“এমনিতেই আসলাম।”
–“একজন দায়িত্বশীল পুলিশের বিনা কারণে একটা মেয়ের কাছে আসাটাকে কি শোভনীয় দেখায়?”
সাদিফ চুপ করে গেলো। সে বুঝতে পারে না এই মেয়েটা এত কাঠখোট্টা কেন? একটু ভালো করেও তো কথা বলতে পারে। সব সময় মুখে যেন তিতা কথা লেগেই থাকে। সাদিফকে চুপ করে থাকতে দেখে, রুপ সাদিফের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আপনার মনের মধ্যে আমাকে নিয়ে যে ভাবনার বাসাটা বানিয়েছেন, সেটাকে আউট করে ফেলুন।”
রুপ কথাটা বলে গটগট করে হেঁটে চলে এসেছে। সাদিফ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রুপ জানলো কিভাবে ওর মনের কথা? সাদিফের মনে এই কাঠখোট্টা মেয়েটাকে নিয়েই একটু একটু করে অনুভূতিরা এসে জমা হয়েছে। রুপকে দেখে প্রথম দিনই ওর ভালো লেগেছিলো। রুপ যে ব্যাপারটা এত সহজে সবটা বুঝে নিবে, সাদিফ ভাবতেও পারেনি। তবে এটাও ঠিক যে, একটা মেয়ে একটা ছেলের চোখের দিকে তাকালে, সে অনায়াসে সেই চোখের ভাষা বুঝে নিতে পারে। যদি মেয়েটার সিক্স সেন্থ প্রখর হয় তো।
শ্রেয়ানের বন্ধু আর শ্রেয়ান সামনাসামনি বসে আছে। শ্রেয়ান ওর বন্ধুর কাছে এসেছে। ওর বন্ধুই ওকে জরুরী তলবে আসতে বলেছে৷ শ্রেয়ানের বন্ধু নওশাদ শ্রেয়ানের হাত থেকে চুল গুলো নিলো। এরপর কিছু একটা পড়ে আয়নাকে ফু দিলো। নওশাদ আয়নাটা শ্রেয়ানের হাতে দিয়ে দেখতে বললো। শ্রেয়ান আয়নাকে কিছু দেখতে পেলো না। তবে দ্বিতীয়বার তাকাতেই আঁতকে উঠলো। দুধের মতো সাদা ধবধবে একটা সাপ। আর সাপের ছবিটা সরে গিয়ে যেখানে ভেসে উঠলো রুপের মুখের ছবি। শ্রেয়ান বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। শ্রেয়ান আতংকিত গলায় বললো,
–“রুপ কি কোনো সাপ? আর এই যুগের ছেলে হয়ে আমাকে এসব বিশ্বাস করতে হবে?”
–“উহুম, শোন আমার কথা। রুপ কোনো সাপ নয়।”
–“তাহলে সাপ দেখলাম কেন? এসবের মানে কি? কি হলো বল আমাকে?”
–“সে সাপ নয়। সে অন্য কিছু।”
–“অন্য কিছুর মানে কি নওশাদ? বলছিস না কেন ভাই?”
–“রুপ কোনো সাপ নয়। রুপ হলো ‘সর্পকেশী’।”
–“সর্পকেশী!”
To be continue…..!!