সাঁঝক বাতি-‘ নূরজাহান আক্তার (আলো) [২৪]

0
339

-‘সাঁঝক বাতি-‘
নূরজাহান আক্তার (আলো)
[২৪]

তখন বিকাল পাঁচটা। শিফা গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। দুপুরে খেয়ে দিগন্তের সঙ্গে ঝগড়া করে ঘুমিয়েছিল। দিগন্ত বাইরে থেকে এসে টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। শিফার উপর। পুরো ভর ছেড়ে দিলো। তার ঠোঁট শিফার গলায়। আদুরে স্পর্শ
দিতে ব্যস্ত। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে শিফা বিরক্ত হলো। মুখ কুঁচকে চোখ খুলে দিগন্তকে একবার দেখল। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। সে পুনরায় ঘুমিয়েও গেল। দিগন্তের সেটা সহ্য হলো না। সে
শিফার গলায় কামড় বসিয়ে দিলো। শিফা রেগে দিগন্তের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে ব্যর্থ হলো।ওর ধাক্কা খেয়ে দিগন্ত সরলোও না, নড়লোও না।সে হেসে শিফাকে বুকে টেনে নিলো। মুখভর্তি হাসি।
শিফা নিশ্চুপ। দিগন্ত নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে’ই আছে। চোখে তৃষ্ণা। শিফা উঠতে চাইলে মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। হাতের বাঁধন শক্ত করল।
মুখ উঁচিয়ে শিফার কপালে আদর দিলো। কথা নেই। চুপ করে কাজগুলো করে যাচ্ছে। শিফা ভ্রু কুঁচকে শুয়ে রইল। দিগন্তের প্রশস্ত বুকের উপর।ওর হার্টবিট দ্রুত গতিতে চলছে। অদ্ভুত লাগছে।
দিগন্ত একইভাবে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণা বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে যাচ্ছে। শিফা অবাক হলেও প্রকাশ করল না। বরং বিরক্ত নিয়ে বলল,

-‘বেহায়ার মতো তাকিয়ে আছেন কেন? আমাকে আগে দেখেন নি?’

-‘তোমাকে দেখার পিপাসা আমাকে কখনোই মিটবে না।’

শিফা নির্বাক। দিগন্তের চোখে অশ্রু! এ’ও কি সম্ভব! অথচ মুখে হাসি। ওর মনখারাপ নাকি শরীর খারাপ? কিছু হয়েছে? বোঝাও বড় দায়। দিগন্ত শিফার সদ্য ঘুম থেকে ওঠা দু’চোখের পাতায় আদর দিলো। তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,

-‘তোমার ঘৃণার চাহনি আমার জন্য অসহ্যকরণ বহন। মরে যেতে ইচ্ছে করে।’
-‘মরে যান।’
-‘কষ্ট পাবে না?’
-‘না। অন্তত ভালোবাসার নাটক বন্ধ হবে।’

-‘নাই বা ভালবাসলে! তবুও আমার প্রণয়ের সুঁতো ধরে টান দিও না। বুকে রক্তক্ষরণ হয়।’

কথাটা বলে দিগন্ত ওকে শক্ত জড়িয়ে নিলো। না অশ্রু দেখতে দিলো; না কিছু বলতে দিলো। তবে
শিফা শান্ত হয়ে গেল। দিগন্তের বলা কথাটা ওর বুকে গিয়ে বিঁধেছে। নারী মনেও আঘাত করেছে।
অভিনয়ের ছলে কেউ এসব বলতে পারে? এতটা নিখুঁতভাবে! গতকাল দিগন্ত একটা সবুজ শাড়ি এনেছিল। শিফাকে পড়ার অনুরোধ করেছিলো।
শিফা পড়ে নি। বরং বলেছিল, জোর করলে সে ফাঁস দিবে। ওই শাড়ির ফাঁসে’ই ঝুলবে ওর মৃত দেহ। প্রাণ ত্যাগ করবে তবুও পরবে না। দিগন্তও বুঝে গেছে, শিফাকে মানানো যাবে না। সে এতই ঘৃণা করে; মৃত্যুকে গ্রহন করতে প্রস্তুত তবুও ওকে না। এভাবে কতদিন? শিফাকে আঁটকে রাখতেও পারবে না। শিফাও পোষ মানবে না। সে অবাধ্য পাখি। মর্জিমতো চলে। সুযোগ পেলে’ই খাঁচার মায়া ত্যাগ করবে। পিছু ফিরে তাকাবে না।বড্ড
হৃদয়হীন! তাছাড়া, প্রতিটা কর্মের কর্মফল ভোগ করতে হয়। ভালো অথবা মন্দ। সেও করবে। তা যথাশীঘ্রই!শিফাকে চুপ থাকতে দেখে দিগন্ত বেশ কিছুটা সময় নিয়ে বলল,

-‘আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারি না। পারলেও কখনো বলা হয় নি। নিজের অনুভুতি প্রকাশেও ব্যর্থ।হোক ভালো অথবা মন্দ। সব নিজের মধ্যে চাপিয়ে রাখতে পছন্দ করি। আমি এমনই।আমি
জানি, আমার বিনাশ নিশ্চিত। তবুও তোমাকেই ভালোবেসেছি। নিখুঁতভাবে। স্ব-যতনে! নিরবে! নিরন্তনভাবে! যেটা ব্যাখা করতে আমি অক্ষম।
আমার ভালোবাসায় নিদির্ষ্ট কোনো কারণ নেই। তোমাকে অকারণেই ভালোবেসে ফেলেছি। গাঢ় অনুভূতিতে আঁটকে গেছে। এমন হওয়ার কথা ছিলো না। তবুও হয়েছে। পৃথিবীতে এমন পুরুষ নেই, যে বুকের হাত রেখে বলতে পারবে; ‘আমি
বিনাকারণেই আমার প্রিয়সীর ভালোবাসা চাই না। সম্পর্কের পূর্ণতাও না।’ প্রনয়ের আসক্তিতে
উন্মাদ হওয়া পুরুষ একথা বলতেও পারবে না।
আমিও পারছি না। অথচ তা কখনো সম্ভব না।
আমার অতীত বিষেপূর্ণ। তবে বিষেপূর্ণ অতীতে
সুমিষ্ট পাওয়া ;তুমি। জেদ, জোর, রাগ, অথবা
লড়াই। যাই হোক আমাকে বিয়ে করার পন্থাটা দারুণ ছিলো। সেদিন মনে মনে হেসেওছিলাম, কেউ আমার জন্য এমন পাগলামিও করছে। তা হোক মিথ্যা অভিনয়। বা ভিন্ন কোনো আশায়।
সেদিন থেকেই প্রণয়ের সূচনা। জানতাম কখনো তোমাকে পাবো না। তাই কল্পনাতে আমার রাণী করে সুখী হবো ভেবেছিলাম। অপ্রকাশিত রাখতে চেয়েছিলাম। সময়ও কাটছিল। আর আমার এই অনুভূতিও বাড়ছিল। যা নিয়ন্ত্রণ করতেও ব্যর্থ।
একপর্যায়ে তোমাকে হারাতে গিয়ে নিজেই হেরে গেলাম। গাঢ় প্রণয়ে আসক্তও হলাম। জানো?
সময় বদলায়, মানুষ বদলায়, স্বপ্ন বদলায়,ইচ্ছে
বদলায়, হঠাৎ পরিস্থিতিও বদলায়। শুধু হৃদয়ের গহীনে থেকে যায়, নিস্বার্থ প্রণয় আর স্মৃতিটুকু।
আমি পাপী! পাপে পরিপূর্ণ। স্বীকারও করব। যা
ক্ষমার অযোগ্য। ক্ষমা করতে বলব না। করো’ও না ক্ষমা। যদিও ক্ষমা করা সম্ভব না। এখন এই কথাগুলো বলছি, তোমার সহানুভূতি পেতে নয়। তোমাকে দূর্বল অথবা ভালোবাসার আবদারেও নয়। তুমি শুধু মনে রেখো, একজন পাপীও খুব ভালোবাসে।পাপে পূর্ণ মনেও ভালোবাসা জন্মে। হাজারটা খুন করেও বেলাশেষে প্রিয়সীর ঘৃণার চাহনিতে গুমরে মরে। কষ্টও হয়! ব্যথাও পায়!
অশ্রুও ঝরায়! হেরে যাওয়ার অনেক গল্প থাকে। কিছু গল্প প্রকাশিত আর কিছু অপ্রকাশিত।তবে সেসবে আফসোস নেই। আমি খুব সুখী। কারণ
তুমি আমার অপ্রাপ্ত এক প্রিয় মানুষ। যার গল্পে,
আমি না থাকলেও সে আমার পুরো গল্পেই রয়ে যাবে।’

কথাগুলো বলে দিগন্ত থামল। হঠাৎ ওর বুকের কাছে ভেজা কিছু অনুভব করল। শিফা কাঁদছে।
দিগন্ত ব্যাতিব্যস্ত হয়ে কিছু বলার আগেই শিফা ওর শার্টের কলার চেপে ধরল। অশ্রুসিদ্ধ চোখে
কলার ঝাঁকিয়ে চিৎকার করে বলল,

-‘আজ এই পরিণতির জন্য কে দায়ী? কাকেই বা দোষ দিবো? কে শুনবে? এর সমাধানই বা কে করবে? আমিও তো এমন জীবন চাই নি! এমন হতেও চাই নি! আমারও স্বপ্ন, ইচ্ছে, ভাবনাপূর্ণ একটা ভুবন ছিলো। আমিও এক কল্পনারাজ্যের
রাণী ছিলাম। অমায়িক এক রাজকুমারের স্বপ্ন দেখতাম। সব নিঃশেষ! সব! আপনারা, হ্যাঁ আপনারাই সব শেষ করেছেন। আমাকে নিঃস্বও করেছেন। সব প্রিয় মানুষদেরও কেড়ে নিয়েছিল। আমার জীবনটাকে তিক্ত করে দিয়েছেন। ছোট্ট তনয়ের কাছে অপরাধী করেছেন। সে আমার প্রাণ। ওর মুখে মাম্মা ডাক শুনেছি। রাগ করলে মাম্মাম! মাম্মাম! বলে এই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ত। অসংখ্য আদর দিয়ে রাগ ভাঙাত। আমি ছাড়া কিছু বুঝতো না। সেই তনয়ের কাছে আমি পঁচা। আমার কাছে আসে না। মুখ ফিরিয়ে নেয়। এই কষ্ট অপনি বুঝবেন? বুঝবেন, এই ব্যথা কতটা যন্ত্রণাদায়ক! আর কত দগ্ধ করবেন? বলুন না আর কত? তারচেয়ে মেরেই ফেলুন না! আমিও মুক্তি পাই। সহ্যশক্তিও হারিয়েছি। পারছি না আর। এই হারানোর ব্যথা আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। ক্লান্ত আমি! বড্ড বেশি ক্লান্ত।
আমারও ভালোবাসা চাই। খুব করে চাই! আমি সুখী হতে চাই! কারো হৃদয়শ্বরী হতে চাই। কারো বুকে মাথা রেখে কষ্ট লাঘব করতে চাই। কোথায় পাবো সেই বুক? কে দিবে আশ্রয়? আজ আমি বিবাহিত। আমারও স্বামী আছে। তবুও জড়িয়ে ধরতে পারি না। দু’ একটা মনের কথাও বলতে পারি না। আদুরে আহ্লাদ করতে পারি না। তার
হাত ধরে পথচলার প্রতিজ্ঞা করতে পারি না।তার স্পর্শ হৃদয় ছোঁয়াতে পারে না। বরং পুরো শরীর ঘিনঘিন করে। মনে হয়, এই শরীর অন্যেকারো
দখলে ছিলো। ঠোঁটজোড়া, হাত, বুক, নগ্ননারীর শরীরে মত্ত ছিলো। শুধু খায়েশ মিটানোর জন্য।
আপনার প্রতি জোর, দাবি, অধিকার, আবদার কিচ্ছু নেই। তবুও অন্য নারীতে মত্ত থাকার কথা শুনলে, কষ্ট হয়। বুকে ভাঙন ধরে! হৃদয় জ্বলে!
প্রতিটা মেয়ের কাছে বাবা আর স্বামী ই অমূল্য।
মেয়েরা বাবার ভাগ দিলেও স্বামীরটা ভাগ দিতে নারাজ। বাবার ভাগ ভাই অথবা বোনকে দিতে হয়। এটা সহজ হিসাব। কিন্তু স্বামী! সেই স্বামী নামক মানুষটা শুধু তার, তার, তার’ই। অথচ সেই মানুষটাও আমার নেই। যে আছে সে পাপী, খুনী, বিবেকহীন, হিংস্র, পর-নারীতে আসক্ত।
বলুন, আমার এই না পাওয়াগুলোর হিসাব কে চুকাবে? কে দিবে, এই কষ্টের মূল্য! আপনি কেন ভালো হলেন না?কেন আমাদের গল্পটা সাধারণ হলো না? কেন সম্পর্কের পূর্নতা পাচ্ছি না? কেন
বলুন, কেন?

কথাগুলো বলে শিফা ডুকরে কেঁদে দিগন্তের বুকে মুখ লুকালো। আজ কাঁদছে। প্রচন্ড কাঁদছে। ওর কান্না দেখে দিগন্ত’ও ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সে নিরবে অশ্রু ঝরিয়ে শিফার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বুকে অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে। আফসোস হচ্ছে। সত্যিই তো! ওদের জীবনী অন্যরকম হতে পারত! শিফা দিগন্তের বুকের শার্ট আঁকড়ে ধরে কাঁদছে। উচ্চশব্দে। এতদিনের জমানো কথা সে বলতে পেরেছে। বোঝাতে পেরেছে অব্যক্ত মনের কথা। হোক, মানুষটা বৈধ শত্রু। শিফা হয়তো এটা জানবে না, শুধু ওর জন্য দিগন্ত চারিদিকে জাল বিছিয়েছে। অদৃশ্য জাল। যাতে কেউ ওর ক্ষতি করতে না পারে। শতবার আড়ালে থেকে ওকে বাঁচিয়েছে। নয়তো একা একটা মেয়ে বেঁচে থাকা দায় হয়ে পড়ত। সে যতই বুদ্ধিমতী হোক না কেন! সে প্রশান্তের করা কাজগুলোতে প্রথমে অবগত ছিলো না। সাফার মৃত্যু আর তনয়ের হাত কাটার পর অবগত হয়েছে। তখন থেকে’ই শিফাকে নিরাপত্তা দিয়েছে। নিজেকে আড়ালে রাখতেই, শিফাকে কষ্ট দিতো, অপমানও করত।
এই কাজে সফলও হয়েছে। প্রশান্ত ওর নিষেধাজ্ঞা
অমান্য করাতে মারতেও দ্বিধা করল না। বাবা নামক মানুষটাকেও শাস্তি দিয়েছে। নির্মম এক শাস্তি। দিগন্ত ইচ্ছে করে’ই শিফাকে এসব কথা জানাল না। কারণ শিফার সহানুভূতি সে সহ্য করতে পারত না। কর্মদোষে সে ঘৃণায় পাত্র। এ
কথা মানতেও বাধ্য। শিফা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। দিগন্ত কম্পিত হাতে ওর গাল ধরে মুখটা তুলল। অঝরে অশ্রু ঝরছে। চোখজোড়াও লালবর্ণ হয়ে গেছে। যেন এক্ষুণি রক্ত গড়িয়ে পড়বে। দিগন্ত দু’বার ঢোক গিলে মৃদু স্বরে বলল,

-‘পুনর্জন্ম বলে যদি কিছু থাকে। তাহলে আমি আবারও জন্ম নিতে চাই৷ এক জীবনে, তোমাকে ভালোবাসার স্বাদ আমার মিটলো না।’

শিফার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে গেল। দিগন্তের এক একটা কথায় কিছু একটা আছে। দিগন্তকেও কেমন জানি লাগছে! অস্বাভাবিক! হয়তো হৃদয়ে জ্বালাময়ী প্রণয়ের জ্বালা বেড়ে গেছে। কষ্ট হচ্ছে?
হয়তোবা! দিগন্ত স্বযত্নে শিফার চোখজোড়া মুছে দিলো। কপালে আদর দিতে গিয়ে থমকে গেল। ওর স্পর্শে শিফার শরীর ঘিনঘিন করে। বিরক্ত হয়। দিগন্ত নিজেকে সামলে কম্পিত কণ্ঠে চোখে চোখ রেখে বলল,
-‘সামান্য একটু ভালোবাসবে আমায়?’
-‘কখনোও না!’
-‘আচ্ছা।’
-‘আপনাকে আমি প্রচুর ঘৃণা করি, প্রচুর।’
-‘তবুও! যন্ত্রণার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলছি; এই শূণ্য হৃদয় শুধু তোর’ই নামে খোদাই করা।’

To be continue…………!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here