আধারে_তুমি,১৯,২০

0
306

#আধারে_তুমি,১৯,২০
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ১৯

বাবা, ছেলে তিনজনই সন্দেহী দৃষ্টিতে তাকায়। শাহানাজ বেগম ঢোক গিলে নাইসাকে কোলে তুলে নিজের রুমে চলে গেলো।
কয়েকদিন দেখতে দেখতেই কেটে গেলো।
আজ সোহা আর ইতি এডমিশন টেস্ট দিতে যাচ্ছে। ইতি তার দরকারি জিনিসপত্র আনতে নিজের বাড়িতে গিয়েছে। ইতি সেখানে গিয়েই দেখা করবে বলেছে।
সোহা কিছুটা সুস্থ। সুস্থ বলতে গেলে একা একা মোটামুটি হাটাচলা করতে পারে। আগে ব্যাথায় সেটা করাও কিছুটা অসম্ভব ছিলো। শান যখন তখন চলে আসবে তাই ধীরেধীরে তৈরি হয়ে নিচ্ছে সোহা। সিমি হেল্প করছে তাকে।
এদিকে শান ঘুম থেকে উঠে হন্তদন্ত করে কোনোরকমে খেয়ে তৈরি হয়ে নিয়েছে। আজ ছুটির দিন তার তাই কাল রাতে থানা থেকে দেড়ি করেই ফিরেছে। প্রত্যেক সপ্তাহেই এমন হয় কিন্তু আজ ঘুম থেকে উঠতে দেড়ি হয়ে গিয়েছে। তারও কারণ রয়েছে। কারণটা হলো সোহার সাথে থাকতে পারবে তাই খুব খুশি ছিলো। খুশির জন্য রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ভোরের দিকেই চোখ লেগে এসেছিলো তাই দেড়ি হয়ে গিয়েছে।
শান পরিপাটি ভাবে তৈরি হয়ে নিচে নামলো। শাহানাজ বেগম ছেলের জন্যই বসে বসে অপেক্ষা করছিলো। শানকে নামতে দেখে কাছে এগিয়ে গেলো। বাহুতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে
” কেয়ারফুল ভাবে ড্রাইভ করে সোহাকে ভালো করে নিয়ে যাবি। আর হ্যা ! মেয়েটার উপর শুধু শুধু রাগ দেখাবি না একদম। বুঝিয়ে কথা বলবি আর না শুনলে একটু বকা দিস।” শান আলতো হেসে বলে
” আমি কি বাচ্চা মা ! আমি জানি কখন কি করতে হয়। আমি ঠিক ভাবেই নিয়ে যাবো আর নিয়ে আসবো তুমি চিন্তা করো না।”
শাহানাজ বেগম হেসে বলে
” আমার ছেলেদের উপর আমার ভরসা আছে। মেয়েটা এখনও অসুস্থ চিন্তা তো হবেই। ঠিকাছে বেরিয়ে পর এখনই নাহলে দেড়ি হয়ে যাবে।”
শান মাথা নেড়ে মাকে জড়িয়ে ধরে শাহানাজ বেগম শানের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। শান মুচকি হেসে চোখে সানগ্লাস লাগিয়ে বেরিয়ে গেলো। শাহানাজ বেগম প্রশান্তির হাসি দিলো। রোজকার দিন থেকে শানকে অনেক খুশি খুশি লাগছে আজকে। ছেলেকে খুশি দেখে মনটা শান্তি লাগছে। সোহাকে পেলে হয়তো আরো বেশি খুশি হবে। গম্ভীর রূপটা বদলে যাবে শানের। শাহানাজ বেগমের ভাবনার মাঝে সালমা এসে হাজির হলো। সালমা বললো
” খালাম্মা ভাই আর সোহা আপার বিয়ের কথা বলে কইবেন ?” শাহানাজ বেগম চোখ বড়বড় করে সালমার দিকে তাকালো। চোখ রাঙিয়ে বলে
” তোকে বলেছি না এসব কথা আমি না বলা পর্যন্ত তুলবি না ?”
” কেনো মা ভুল কি বললো ? কতোদিন আর চেপে থাকবেন কথাটা ? এবার তো বলা উচিত।”
শাহানাজ বেগম আর সালমা চোর ধরা পড়ার মতো পেছনে ঘুরে তাকালো। উক্ত কথাটি নিলারই বলা কথা। নিলা এগিয়ে এসে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে
” আমি তো কয়েকদিন ধরেই লক্ষ করছি আপনাদের। এখন বুঝতে পারলাম আসল কাহিনী।” শাহানাজ বেগম কোণা চোখে সালমার দিকে তাকালো। নিলা অভিমানী কন্ঠে বললো
” মা আমাকেও কি বলা যায়নি? আমি এতোটা পর হয়ে গেলাম ? আমি তো সোহাকে নিজের বোনের চোখে দেখি। আমাকে বললে কি ক্ষতি হতো ?” শাহানাজ বেগম মুখ ছোট করে বললো
” আসলে আমি চেয়েছিলাম সোহার পরীক্ষার পরই সবাইকে জানাবো তারপর সব ঠিক করবো।” নিলা হেসে বলে
” আরে মা মন খারাপ করছেন কেনো ? আমি তো এমনই বললাম। যাই হোক যা হচ্ছে ভালোই হচ্ছে। সোহা আসলে আরো ভালো হবে।” শাহানাজ বেগম মুচকি হাসলো।

শান গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছুক্ষণ হবে। বাড়ির ভেতর যেতে বলছিলো শান কিছুক্ষণ বসে এসে পরেছে। শানের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সোহা আসলো। সিমি নিয়ে আসছে তাকে। শান এগিয়ে গিয়ে সিমির হাত থেকে সোহার ফাইল নিলো। সিমি সোহাকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। সিমি শানের সাথে কথা বলতে থাকে। সোহা শানকে পা থেকে পা পর্যন্ত পরখ করে নিলো। কালো জিন্স, হোয়াইট-ব্ল্যাক কালার মিক্সড সু, সাদা শার্ট, অগোছালো চুল, শার্টের সামনের বোতাম দুটো খোলা আর সানগ্লাস ঝোলানো। বরাবরের মতোই অসাধারণ লাগছে তবে আজকে পুলিশ পুলিশ ভাবটা নেই। সোহা মিটমিট করে হাসলো। শান তার কথা শেষ করে এসে গাড়িতে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে সোহার মিটমিটিয়ে হাসি শানের চোখে পড়লো। কিছু দূড় যেতেই জিজ্ঞেস করলো
” কি হয়েছে ম্যাম ? হাসছেন কেনো এতো ?” সোহা এবার জোড়েই খিলখিল করে হেসে দিলো। শান ভ্রু কুঁচকে নিলো। আজ এতো হাসছে কেনো মেয়েটা ? উক্ত কথাটির ভাবনার মাঝেই সোহা বলে উঠলো
” আজকে আপনাকে দেখতে পুলিশ পুলিশ লাগছে না তাই মজা লাগছে আমার।” শান নিঃশব্দে হেসে বলে
” কেনো আজকে আমাকে কেমন লাগছে ?” প্রশ্ন শুনে সোহার হাসি ধীরে ধীরে কমে আসলো। উপরের ওষ্ঠ ধারা নিজের ঠোঁট চেপে ধরে বললো
” বলবো কেনো ?” শান বাকা হেসে বলে
” তারমানে তো খুব সুন্দর লাগছে আমাকে।” সোহা চোখ ছোট ছোট করে বললো
” এটা কে বললো আপনাকে ?” শান ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে বলে
” যার বলার তার চাহনিই বলে দিয়েছে সব। আলাদা করে বলার কি আছে ?” সোহা অবুঝ গলায় বললো
” কার বলার কথা ?” শান ড্রাইভ করতে করতে বললো
” সেটা আপনাকে জানতে হবে না মিস। তবে আমাকে এটা বলো ! এক্সাম দিতে যাচ্ছো অথচ চোখে মুখে টেনশনের ছাপও নেই কেনো বলো তো ?” সোহা দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে হেসে বলে
” আমি কখনই এক্সাম দিতে যাওয়ার সময় টেনশন করি না। টেনশন করলে সব ভুলে যায় তাই চিল মুডে থাকতে হয় এক্সাম টাইমে। পরে তো এসেছিই টেনশন করলে তো আর কাজ হবে না, উল্টো প্রবলেম হবে। টেনশনে ঠিক কাজও উলটপালট হয়ে যায়।” শান অবাক হয়ে বলে
” বাহহ ! এই ব্যাপারে দেখছি ভালোই বোঝ সব কিছু !”
সোহা রেগে বললো
” আপনি কি বলতে চান! আমি অন্য কিছু বুঝি না ?” শান ভ্রু উঁচিয়ে বললো
” সেটা কখন বললাম আমি ? বলতে চাইছি আমার ধারণা ছিলো এক্সাম টাইমে মিস. বাদর টেনশনেই হার্ট এট্যাক করে বসে থাকবে কিন্তু আমার ধারণার পুরোই উল্টো রেজাল্ট বের হলো !” সোহা ভেংচি কাটলো। শান গান চালিয়ে দিলো। পুরো রাস্তায় আর দুজনের মাঝে কথা হলো না। উক্ত জায়গায় পৌঁছোলে শান নিজেই সোহাকে সাবধানে তার সিট খুঁজে বের করে বসিয়ে দিয়ে আসলো। ইতিকেও খুঁজে পেয়ে গেলো। শান সোহার দায়িত্ব ইতির কাধে দিয়ে দুজনকে শুভকামনা জানিয়ে বেরিয়ে আসে।
ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেলো। সামনেই কফিশপ রয়েছে যেটাকে পেরিয়ে এসেছিলো তার সামনেই গাড়ি থামালো। ভেতরে ঢুকে কফি অর্ডার করে বসে থাকে।
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা কেটে যায়। সোহাদের পরীক্ষাও হয়তো শেষ হয়ে গিয়েছে ভেবে শান বেরিয়ে গেলো।
এদিকে সোহা আর ইতি পরীক্ষা দিয়ে বেড়িয়ে আসে। দুজনই বেরিয়ে এসে পরেছে। কিন্তু সেখানেই ঘটলো বিপত্তিকর ঘটনা। দুজনের হাটার মাঝেই একটা মেয়ে দৌঁড়ে পাশ কাটিয়ে গেলো আর যাওয়ার পথেই সোহার ধাক্কা লাগলো মেয়েটার সঙ্গে। সোহা টান সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায়। আর সাথে সাথে ব্যাথায় চিৎকার দিয়ে উঠে। ইতি সোহাকে উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পরে। আশপাশ থেকে দুই একটা ছেলেমেয়েও এগিয়ে আসে সোহাকে দেখে। শান দূড় থেকেই তা দেখে দৌঁড়ে সোহার কাছে আসলো। শান সোহার সামনে হাটু গেড়ে বসে অস্থির হয়ে বললো
” কি হয়েছে সোহা ? বেশি ব্যাথা পেয়েছো ?” সোহা চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে রেখেছে। শানের প্রশ্নে মাথা নেড়ে হ্যা বললো। শান কিছু না ভেবেই কোলে তুলে সোহাকে। সোহা শানের শার্টের কলার চেপে ধরে শক্ত করে আর ব্যাথায় ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। শান সোহাকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। শান সোহার গালে হাত রেখে অস্থির গলায় বলে
” সোহা ! বেশি ব্যাথা করছে ?” সোহা কাঁদতে কাঁদতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো
” আমার অনেক ব্যাথা করছে।” ইতি আঁতকে বলে উঠে
” ভাইয়া ? সোহার ব্যান্ডেজ রক্তে লাল হয়ে গিয়েছে।” শান ঢোক গিলে ঠোঁট কামড়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসে। গাড়ি ঘুরিয়ে ইশানের হসপিটালের দিকে ঘুরালো। স্প্রিডে গাড়ি চালিয়ে কিছুক্ষণের মাঝে সেখানে পৌঁছোল। শান সোজা emergency কেবিনে নিয়ে গেলো। নার্স তা দেখেই ছুটে বেরিয়ে গেলো। সোহা কাতরাতে থাকে ব্যাথায়। শানের মনে হচ্ছে এখনই কলিজাটা হাতে চলে আসবে। কিছুক্ষণের মধ্যে ইশান দৌঁড়ে আসলো। সোহার অবস্থা দেখে অবাক হয়ে বলে
” এসব কিভাবে হলো ?” শান অস্থির গলায় বলে
” ভাইয়া সেসব পরে জানবে আগে সোহাকে দেখো।” ইশান কথা না বাড়িয়ে সোহার ট্রিটমেন্ট করতে থাকে। স্প্রিডে গাড়ি চালিয়ে আসলেও কম সময় লাগেনি এখানে আসতে। ইশান তার কাজ শেষ করে গম্ভীর গলায় বললো
” এবার বলো এসব কিভাবে হয়েছে। তোমরা দুটো মানুষ থাকতেও এমন কি করে হয় ?” ইশানের ধমক শুনে দুজন মাথা নিচু করে নিয়েছে। ইতি মাথা নিচু করে সব বললো। সব শুনে ইশান শান্ত হলো। শান চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
” ভাইয়া বেশি কিছু হয়নি তো ?” ইশান সোহার দিকে একবার তাকিয়ে বলে
” ব্লিডিং হয়েছে তাহলে কিভাবে ভাবছো বেশি কিছু হয়নি ? যাই হয়েছে এখন ঠিকাছে। ব্যাথা করবে এখন তাই ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছি এখন আর ঘুম থেকে উঠবে না।” শান ইতিকে উদ্দেশ্য করে বলে
” ইতি চলো তো আমার সাথে !” ইশান ভ্রু কুঁচকে বলে
” কোথায় যাবি এখন ?” শান দাঁতে দাঁত চেপে বলে
” যার জন্য সোহা আবার ব্যাথা পেয়েছে তার সাথে একটু বোঝাপড়া করে আসবো।” ইশান শানকে আটকাতে চাইলেও শান কিছু না শুনেই বেরিয়ে গেলো। ইতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশান নিশ্বাস ফেলে বলে
” তুমিও যাও নাহলে শান পুরো ক্যাম্পাস মাথায় উঠিয়ে তারপর তাকে খুঁজে বের করে মারবে।”
ইতি ঢোক গিলে ছুটে গেলো।

চলবে……….

#আধারে_তুমি
#লেখিকাঃ মার্জিয়া রহমান হিমা
#পর্বঃ ২০

ইতিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশান নিশ্বাস ফেলে বলে
” তুমিও যাও নাহলে শান পুরো ক্যাম্পাস মাথায় উঠিয়ে তারপর তাকে খুঁজে বের করে মারবে।”
ইতি ঢোক গিলে ছুটে গেলো। ইশান নার্সকে সোহার খেয়াল রাখতে বলে অন্য পেশেন্ট দেখতে চলে গেলো।
শান আবারও গাড়ি নিয়ে আগের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই ইতি ছুটে এসে বসে পরলো। শান কোনোদিকে না তাকিয়ে গাড়ি চালাতে থাকে।
উক্ত জায়গায় এসে পৌঁছোতেই হনহন করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। ইতিকে বললো
” কোন মেয়েটা ধাক্কা দিয়েছে খুঁজে বের করে দেখাও আমাকে।” ইতি মাথা নেড়ে সায় দিলো। দুজন এদিক ওদিক খুঁজতে থাকে তাকে। কিছুক্ষণ পর ইতি সেই মেয়েটাকে দেখতে পেলো পাশে আরেকটা মেয়ে বসে রয়েছে। দুজন আইসক্রিম খাচ্ছে আর হাসাহাসি করে কথা বলছে। সম্ভবত দুই বোন তারা। ইতি শানকে সেই মেয়েটাকে দেখালো। শান রাগে লাল হয়ে যাওয়া চেহারায় সেই মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দুজনই দাঁড়িয়ে গেলো শানকে দেখে। শান শক্ত গলায় বললো
” কে ফেলেছে ?” ইতি ছোট মেয়েটার দিকে ইশারা করলো। শান দাঁতে দাঁত চেপে তার দিকে তাকালো। শানকে এভাবে দেখে দুজনেরই কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। শান রেগে চেঁচিয়ে বললো
” মাথায় কি কমন সেন্স আছে তোমার ? কোথায় কিভাবে চলতে হয় জানো না ? না জানলে নিজের বাড়িতে বসে থাকতে পারো না ? বাইরে বের হও কেনো ? ক্যাম্পাসে কি দৌঁড়োদৌঁড়ি করার জায়গা ? কিছুক্ষণ আগে একটা মেয়েকে ফেলে দিয়েছো আর এখন বসে বসে আইসক্রিম খাচ্ছো ? জানো তোমার জন্য এখন হসপিটালে শুয়ে আছে ? কয়েকদিন আগেই একটা এক্সিডেন্ট করেছে বড়সড় আর তোমার জন্য আজ আবারও ব্যাথা পেয়েছে। এটা কি পার্ক মনে হয় তোমার ?” শান আরো কিছু কড়াকড়া কথা শুনিয়ে দিলো মেয়েটাকে। পাশের মেয়েটা ইতির থেকে সোহার অবস্থা জেনে শানদের কাছে বারবার ক্ষমা চাইলো। শানও বাচ্চা মেয়ে দেখে আর কিছু বললো না। যা বলার বলে ফেলেছে। ইতি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখে টলমল চোখে তাকিয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে একটা বালতির প্রয়োজন। কান্নার বন্যা শুরু হবে বলে কথা।
শান তার কাজ শেষ করে হনহনিয়ে চলে এলো সেখান থেকে। ইতি এসে বললো
” মেয়েটা ছোট ছিলো ভাইয়া এতো বকার দরকার ছিলো না।” শান গম্ভীর গলায় বলে
” যা বলার বলা শেষ। এরপর থেকে যেনো খেয়াল রাখে সেটার জন্যই এতো কথা বলেছি।” ইতি মাথা নেড়ে বলে
” ঠিকাছে তাহলে আমি বাড়ি চলে যাচ্ছি। আপনি সোহাকে বাড়িতে পৌঁছে দেবেন কষ্ট করে।”
শান জিজ্ঞেস করলো
” তুমি সোহার বাড়িতে যাবে না আজ ?” ইতি না করে বললো
” নাহ একটু কাজ আছে তাই যেতে পারবো না। পরে যাবো।” শান ইতিকে ড্রপ করে দিয়ে আসার কথা বললে ইতি আলতো হেসে বলে
” না ভাইয়া আপনি সোহার কাছে চলে যান আমি চলে যেতে পারবো।” শান ইতির জন্য গাড়ি ডেকে দিলো। গাড়ি ছাড়ার আগে শান জিজ্ঞেস করে বসলো
” ইমনের সাথে কথা হয় ?” ইতি লজ্জায় পরে গেলো। কি বলবে বুঝলো না মিথ্যাও বলা ঠিক না তাই মাথা নেড়ে হ্যা বোঝালো। শান আলতো হেসে বিদায় দিলো ইতিকে।
গাড়ি ঘুরিয়ে হসপিটালে চললো আবার। বারবার ছোটাছুটি করায় ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে শরীরটা। বাড়িতে গিয়ে রেস্ট করতে হবে। বাড়ি থেকে এখনও কোনো ফোন আসেনি তাই নিজ থেকে কিছু জানালো না। বাড়িতে গিয়েই নাহয় জানাবে সবাইকে নাহলে সবাই চিন্তা করতে বসে যাবে।

সোহার কেবিনে ঢুকে পানি খেয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসলো। এখনও মেয়েটার ঘুম ভাঙেনি। শান চোখ বন্ধ করে কপালে হাত রেখে বসে থাকে। ইশান নিঃশব্দে এসে শানের পাশে বসলো। কারো উপস্থিতি অনুভব করে শান চোখ খুলে তাকালো। ইশান বললো
” কিছু খেয়েছিস বলে তো মনে হচ্ছে না। ক্যান্টিনে চল ! লাঞ্জ করে নেই দুজন।” শান আলতো হেসে বলে
” বিকেল হতে চললো লাঞ্চ করোনি এখনও ?”
ইশান শরীর মুচড়ে বলে
” কি আর করার এতো পরিমাণ রোগী দেখা লাগে যে।” শান সোহার দিকে তাকালো ইশান বুঝতে পেরে বলে
” এখন ঘুম ভাঙবে না চল !”
ক্যান্টিনে এসে দুই ভাই দুই চেয়ার টেনে বসলো। ইশান তার পড়নের এপ্রোন খুলে রাখলো পাশের খালি চেয়ারটাতে। ইশান খাবার অর্ডার দিয়ে গলা ঝেড়ে বললো
” মেরেছিস নাকি তাকে ?” শান অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে গম্ভীর গলায় বলে
” বাচ্চা মেয়ে ছিলো মারবো কেনো ? শুধু বকাই দিয়েছি। এমন ভাবে বলছো যেনো আমি একজন গুণ্ডা। যে কথায় কথায় মারে।”
ইশান আলতো হাসলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে শান ব্যথিত গলায় বলে উঠলো
” আচ্ছা ভাইয়া ! তুমিও কি মনে করো আমি পুলিশ হওয়ার পথ বেছে নিয়ে ভুল করেছি ?”
ইশান অবাক হয়ে গেলো। শানের কথাটা শুনে অবাক না হওয়ার মতো কিছুই না। ইশানের এখনও মনে আছে মুসফিক চৌধুরী যখন শানের পুলিশে জয়েন হওয়া নিয়ে প্রথম আর শেষ বারের মতো রাগারাগি করেছিলো তখনই শুধুমাত্র শানের মুখে এই কথাটা ছিলো। আজ আবারও এতোদিন পর বলায় অনেকটা অবাক হয়েছে ইশান। শান শান্ত গলায় বললো
” উত্তর দিচ্ছো না যে !” ইশান অবাক হয়ে বলে
” তুই হঠাৎ এসব কথা বলছিস কেনো ? অকারণে এসব কথা একজন সৎ আর দায়িত্ববান পুলিশ অফিসারে মুখে বেমানান লাগে শান !”
শান মাথা নিচু করে আবার অন্যদিকে তাকালো নিচু স্বরে বললো
” অকারণে কোথায় ? কারণ কি নেই ? আজও বাবাকে কখনো দেখিনি আমি পুলিশ বলে গর্ববোধ করেছে। গর্ববোধ তো দূড়ে থাক পুলিশে জয়েন হওয়ার পর আজও বাবা আমার সাথে এসব নিয়ে কথা বলেনি খুশি হয়ে। তোমাদের মতো আমি বাবার ভালো ছেলে হতে পারলাম না।”
ইশান বড় একটা নিশ্বাস ফেললো। হেসে বললো
” বাবার কথা বলছিস ? বাবা মাঝে মাঝে বলে আমার তিন ছেলের মতো ছেলে যেনো সোবার ঘরে ঘরে জন্মে। তিন ছেলের মধ্যে কিন্তু তুইও রয়েছিস ! তুই যখন অফিসার পোস্টে প্রমোশন পেয়েছিলি বাবা কিন্তু কম খুশি হয়নি ! বাবা পুরো অফিসে মিষ্টি খাইয়েছিলো তবে বাড়ির কেউ জানতো না। আমিও জানতে পেরেছি ম্যানেজার আংকেল এর কাছ থেকে। তিনি মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলো। বাবার বলার বারণ ছিলো তাই কাউকে বলেনি। টিভিতে যখন তোর কথা বলা হয় তখন বাবাই বেশি খুশি হয়। বাবার একটাই দোষ। বাবা কখনো এসব প্রকাশ করেনি। পুলিশ পেশাটা বাবার অপছন্দ ছিলো ! কিন্তু এখন আর নেই। বাবা কাউকে বুঝতে দেয়না। আমরা সবাই তোকে নিয়ে গর্ববোধ করি। তুই একজন সৎ পুলিশ অফিসার। সমাজের দায়িত্ব তো তোর কাধেই।” শানের মুখে প্রশান্তির হাসি। ইশান তা দেখে মুচকি হাসলো।
খাবার এসে পড়তেই দুজন অন্য কথা বলতে বলতে খেয়ে নিলো। ইশান সোহার জন্য খাবারও পার্সেল করে নিলো যেগুলো তার জানামতে সোহার পছন্দের। দুজন সোহার কেবিনে এসে পরে। এসেই দেখে সোহা বেডে হেলান দিয়ে বসে বসে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে মোবাইল দেখছে। ইশান আর শান বোকার একে অপরের দিকে তাকালো। সোহা মোবাইল দেখতে দেখতে দরজার দিকে চোখ পরতেই দুজনকে দেখে ইশানকে উদ্দেশ্য করে একটা মন ভোলানো হাসি দিয়ে বললো
” কেমন আছো ভাইয়া ?” ইশান হেসে এগিয়ে এসে বললো
” আমি তো ভালোই আছি কিন্তু তুমি এখন কেমন আছো ?” সোহা মিটমিট করে হেসে বলে
” আমিও ভালো। তোমরা আমাকে রেখেই খেয়ে এসেছো ?” শান সোহার খাবারটা টেবিলের উপর রেখে বললো
” তোমাকে কে বলেছে আমরা খেতে গিয়েছি ?”
সোহা ফোন রেখে বললো
” কে আবার ! নার্স বলেছে। আচ্ছা আমার খিধে পেয়েছে আমিও কিছু খাবো।” শান সোহার জন্য আনা পার্সেল ব্যাগটা সোহার পাশে রেখে বললো
” নাও তোমার জন্যও আনা হয়েছে। তুমি যে খাদক সেটা ভালো করেই জানি তাই খাবার নিয়ে এসেছি।” সোহা ভেংচি কেটে নিজের হাত এগিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে বলে
” এতো চিকন একটা মানুষকে আপনার কোন দিক থেকে খাদক মনে হলো, হ্যা ? নিজেই তো আস্ত খাদক।”
শান খাবার বের করতে করতে বলে
” আমি খাবো না তো আর কে খাবে ? সারাদিন ক্রিমিনাল দের পেছনে তো আমিই ছুটি তুমি তো সারাদিন বসেই থাকো বাড়িতে।” সোহা মুখ ফুলিয়ে ইশানের দিকে তাকাতেই ইশান হেসে বলে
” আচ্ছা শান এবার থাম। আমি নার্সকে বলছি এসে সোহার খাবার সার্ভ করে দিয়ে যাবে।”
ইশান চলে যেতেই শান সোহার পাশে বসলো। শান্ত গলায় বললো
” এখন কেমন লাগছে ? ব্যাথা করছে আর? ”
সোহা কোণাচোখে শানের দিকে তাকিয়ে বললো
” নাহ ব্যাথা নেই। ভালো আছি এখন আগের থেকে।” শান মুচকি হাসলো। সোহা পূর্ণ দৃষ্টিতে মুগ্ধ চোখে শানের মুচকি হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে। শানের এই অমায়িক হাসিটা মারাত্মক সুন্দর যা বলে বোঝানো মুশকিল। শান সোহাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বললো
” এভাবে কি দেখছেন মিস. বাদর ?” সোহা জোড়ে জোড়ে মাথা নেড়ে কিছু না বোঝালো।
নার্স এসে খাবার সার্ভ করে দিয়ে যেতেই সোহা মনের সুখে খেতে থাকে। শান তাকিয়ে তাকিয়ে সোহাকে দেখতে থাকে। সকালের পর আর খাওয়ার সুযোগ পায়নি মেয়েটা খিধে লাগারই কথা।
খাওয়া শেষ হতেই শান ইশানকে বলে সোহাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সোহার চোখে ঘুম না থাকলেও বাতাসের এতো গতিতে চোখে আবারও ঘুম এসে ধরা দেয়। সিটে মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। শান চোখ ভরে সোহাকে দেখতে থাকে।

বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে শান সোহার দিকে এগিয়ে গেলো। সোহার গালে হাত রেখে সোহার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো গভীর ভাবে। সোহার এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে সোহার থেকে দূড়ে সরে আসে। ঘুমের মাঝেই শানের ছোঁয়ায় বেশ কয়েকবার কেঁপে উঠেছে তা খেয়াল করে শান মুচকি হাসি দিলো। দুইবার সোহাকে ধীরে ধীরে ডাকতেই সোহার ঘুম আলগা হয়ে আসে। সোহা ঘুমঘুম চোখে শানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার বাড়ির দিকে তাকালো।
দুজন বাড়িতে ঢুকতেই রিয়ানা রহমান আর সিমি এগিয়ে আসে হন্তদন্ত হয়ে। সিমি চিন্তিত হয়ে বলে
” ঠিকাছিস তুই ? ইতি মাত্রই ফোন করে আমাদের জানালো সব। কতো চিন্তা হচ্ছিলো।”
সোহা হেসে বলে
” আমি ঠিকাছি চিন্তা করো না তো !” রিয়ানা রহমান শানের হাত ধরে বললো
” তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো বাবা বুঝতে পারছি না। মেয়েটা দুইবার বিপদে পড়লো প্রত্যেকবার তুমি পাশে ছিলে। সুন্দর করে সব সামলে নিয়েছো।” শান স্মিত হেসে বলে
” ধন্যবাদের কিছু নেই আন্টি। আজকে পুরোদিন সোহা আমার দায়িত্বেই ছিলো। আমি আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি। তাও তো আজকে অঘটন ঘটে গেলো কিছু করতে পারিনি।”
সিমি সোহাকে জড়িয়ে ধরে বলে
” তুমি তো এসব কিছু করোনি। তুমি কেনো গিল্টি ফিল করছো ? সেইদিন তুমি ছিলে বলেই সোহা এখনও সুস্থ আছে।” শান বললো
” ভাবি রাখো না সেদিনের কথা ! বারবার সেই কথা তুলে কি হবে ?”
” হুম তাও ঠিক। আচ্ছা তুমি বসো আমি আসছি।”
শান মাথা নেড়ে বলে
” নাহ আজ যাচ্ছি আমি। তুমি কবে যাবে বাড়িতে ?” সোহা সিমির কাধে মাথা রেখে বলে
” নিয়ে যান, নিয়ে যান। আমার বাড়িতে এসে আবার জায়গা বসাচ্ছে।” সিমি সোহার মাথায় গাট্টা মারলে সোহা মুখ ফুলিয়ে নেয়। শান হেসে দিলো সোহাকে দেখে।
ওয়াসরুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলো শাহজাহান বেগম কফি নিয়ে বসে আছে। শান টাওয়াল রেখে এগিয়ে আসলো। মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ঘন্টাখানিক আগেই এসেছে বাড়িতে। এসেও ফ্রেশ হতে ঢুকেছে।
শাহানাজ বেগম শানের ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো
” সোহা কেমন আছে এখন?” শান চোখ বন্ধ করে বলে
” হ্যা ভালো এখন।” শাহানাজ বেগম কফির মগটা হাতে নিয়ে বললো
” কফিটা খেয়ে নে নাহলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। পরে মাথা ব্যাথা কমবে না।” সময় লাগিয়ে শান আলসেমি ভেঙে আবারও উঠে বসলো। কফিটা নিয়ে তাতে চুমুক দিলো। শাহানাজ বেগম শানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। তার কথা গুলো এখনই বলবে কিনা সেটা ভাবছে। শাহানাজ বেগমের মনের কথা হয়তো না বলার পরও বুঝতে পেরেছে শান। তাই বললো
” কি বলবে ? বলো না !” শাহানাজ বেগম গলা ঝেড়ে নিলো।

.

.

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here