আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন . ২২ পর্ব

0
217

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
২২ পর্ব
.
হাওরের আঁকাবাকা পিচ্ছিল আইল ধরে হাঁটছে তারা৷ খানিক আগেই অন্তরা একটুর জন্য পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে মোবাইল বক্কর আলীর পাঞ্জাবীর পকেটে দিয়েছে।
বাম হাতের তর্জনী দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল, ‘বক্কর ভাই আর কত দূর?’

— ‘একটু কষ্ট করো বইন। হাওর থাইকা চইলা গেলেই ভালা রাস্তা।’

— ‘জিসানকে কল দেবো কখন? সিক্তা আপুও অপেক্ষা করছে কি-না কে জানে।’

— ‘রাস্তায় গিয়া কল দিবা শান্তিমতো।’

অন্তরার বিরক্ত লাগছে। পায়ের স্যান্ডেলও ভিজে গেছে। হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে।
— ‘বক্কর ভাই জুতো কি হাতে নিব?’

— ‘নেও ইচ্ছা অইলে৷ কিন্তু ভাঙা শামুকে পাও পড়লে কিন্তু কাইটা যাইব।’

অন্তরা জুতো হাতে নিল। ধৈর্য ধরে মিনিট বিশেক হেঁটে তারা একটা কাঁচা রাস্তায় পৌঁছাল। বক্কর আলী একটা ডোবা দেখিয়ে বলল, ‘এইখানে পা ধুইয়া নাও।’

অন্তরা ধীরে ধীরে ডোবার কাছে গিয়ে মনে হলো পড়ে যাবে। বক্কর আলীকে ডেকে বলল তার হাত ধরে টেনে রাখতে। হাত-পা ধুয়ে রাস্তার আসার পর বক্কর আলী দেখলো সামনেই একটা পানির মেশিন চলছে। জামিতে পানি দিচ্ছে৷ অন্তরাকে দেখিয়ে বললে, ‘এই পাইপের পানি দিয়া মুখও ধুইয়া নাও চাইলে।’

পাইপ থেকে পানি উড়ে পড়ার দৃশ্য দেখে অন্তরারা মুগ্ধ হয়ে গেল সেদিকে। পাইপের সামনে হাত রাখতেই ছিটকে আসা পানি পুরো কামিজ ভিজিয়ে দিল। বিরক্ত হয়ে চলে এলো অন্তরা।

বক্কর আলী মোবাইল হাতে দিয়ে বলল, ‘এখন কল দাও। আমি কথা বলবো মাস্টার সাবের লগে।’

অন্তরা কল দিল। ওপাশ থেকে অস্থির গলায় বলল,
— ‘অন্তরা কোথায় তুমি? কখন থেকে অপেক্ষা করছি। এতো দেরি কেন?’

— ‘মাস্টার সাব আমি বক্কর আলী।’

— ‘মা..মানে, তোমার কাছে মোবাইল গেল কীভাবে?’

— ‘অন্তরা আমার লগেই আছে। চিন্তার কারণ নাই। হাওর দিয়া নিয়া আসছি। ওইদিকে গেলে চেয়ারম্যান ধইরা ফেলতো।’

— ‘আর সিক্তা? ও তো অপেক্ষা করবে বাড়ির সামনে।’

— ‘কোনো সমস্যা হইব না৷ অপেক্ষা কইরা চইলা যাইব। এখন শুনেন মাস্টার সাব। লঞ্চে যাইবার লাগছেন এইটা কিন্তু বোকামি। চেয়ারম্যান চাইলে লঞ্চ থাইকা নামার সাথে সাথে লোক দিয়া আপনাদের ধরিয়ে ফেলবে।’

— ‘তাহলে কীভাবে যাব?’

— ‘আপনে এখন করিমগঞ্জ বাজার চাইলা যান। আমি অন্তরাকে নিয়া আসতেছি। করমগঞ্জ থাকি নয়া রিকশা চালু অইছে। বৃষ্টি না অইলে কাঁচা রাস্তায় রিকশা চলে।’

— ‘রিকশা কোথায় যাবে সেখান থেকে?’

— ‘বেগম পুর যাইব। অইখান থাকি সিএনজি লইয়া চাইলা যাবেন শেরপুর।’

— ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।’

বক্কর আলী ফোন রেখে বলল, ‘এই রাস্তা দিয়া দুই ঘন্টার মতো হাটন লাগবো বইন। পারবে না?’

অন্তরার আমতা-আমতা করে বলল, ‘পারবো।’

ঘন্টা খানেক হেঁটে অন্তরার মনে হচ্ছে রাস্তার ঘুমিয়ে যেতে। ঘামতে ঘামতে যেন গোসল হয়ে যাচ্ছে। চোখ নিজ থেকেই বুঁজে আসছে। এদিকে পানির পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ।
— ‘আর পারছি না বক্কর ভাই। পানির পিপাসা পাচ্ছে।’

— ‘আরেকটু সামনে যাই৷ অই বাড়ি থাইকা পানি খাওয়া যায় কি-না দেখি।’

খানিক হেঁটে বক্কর আলী অন্তরাকে রেখে বাড়িতে হাঁকে, ‘কেউ কি বাড়িতে আছোইন?’
একজন মহিলা বের হয়ে আসে, ‘চাচি এক গ্লাস পানি দিবেন, বইনটা পানি খাইব।’
— ‘আচ্ছা বাজান আনতেছি দাঁড়ান।’

মহিলা স্টিলের গ্লাসে করে পানি এনে দিল। অন্তরা এক চুমুকে পানি খেয়ে নেয়। তারা আবার হাঁটা শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে করিমগঞ্জ বাজারের মাঠে যখন এসেছে তখন চারদিক থেকে ভেসে আসছে আছরের আজান। ক্লান্ত অন্তরা মাঠের মাঝখানে ঘাসের উপর শুয়ে রীতিমতো হাঁপাচ্ছে।
বক্কর আলী মোবাইল বের করে বলল, ‘মাস্টার সাবকে কল ধরিয়ে দাও।’

অন্তরা কল ধরিয়ে দিল।
— ‘হ্যালো মাস্টার সাব।’

— ‘হ্যাঁ বক্কর ভাই বলো, কোথায় আছো এখন?’

— ‘বাজারের পেছনের মাঠে আছি আমরা। আপনে আইসা পড়েন।’

জিসান খানিক বাদেই চলে আসে। তার সঙ্গে সেই রাতের নাপিত ছেলেটা আছে।
অন্তরার পাশে এসে বসে গেল জিসান। অন্তরার ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আঁজলা করে মুখে ধরে বলল, ‘আর কোনো চিন্তা নেই তোমার। অনেক পথ হেঁটে এসেছো তাই না?’
কেমন লজ্জা লাগছে অন্তরার। মাথা নুইয়ে ফেলল।

— ‘মাস্টার সাব কি শুরু করছেন। এলাকার লোকজন দেখলে ঝামেলা করবো। ধরাধরি করতাছেন কেন?’

জিসান সরে দাঁড়াল। নাপিত সুমিত দাশ বলল,
— ‘আপনারা আমার সেলুনের উপরে গিয়া জিরান লন। নাস্তার ব্যবস্থা করতাছি। আর রিকশাও পাইবেন সমস্যা নাই।’

অন্তরা এখনও ঘাসে শুয়ে আছে। জিসান তাকিয়ে বলল, ‘উঠো।’
অন্তরার উঠতে ইচ্ছে করছে না। জিসান চারদিকে তাকিয়ে দেখলো কেউ নাই। সুমিত দাশ আর বক্কর আলী হাঁটছে৷ সে হাঁটু ভাজ করে বসে দুষ্টামি করে ঘাড়ের দিকে হাত নিয়ে ঠেলে তুলে দিল। অন্তরা পা টিপে টিপে হাঁটছে। খানিক্ষণ জিরিয়ে নেওয়ায় শরীর যেন আরও ভারী হয়ে গেছে। সুমিত দাশ তাদেরকে সেলুনের উপরের দরজা খুলে দিয়ে বলল, ‘আসতাছি আমি। আপনারা বসেন পাটিতে।’

জিসান বক্কর আলীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ বক্কর ভাই।’

বক্কর আলী আয়েশ করে পাটিতে বসে বলল, ‘ধন্যবাদ দেওন লাগবে না। কথা হইল আপনেরা আমারে নিজের মানুষ ভাবলে প্রথম থাইকাই কাছে পাইতেন। আর অন্তরার সাথে প্রতিদিন আমি আলাপ তুলতাম সে এড়িয়ে যেতো। আপনেও রাতে দেখা করতে আসেন আমার লগে যোগাযোগ করেন না। পিয়াস রে দিয়া আমারে একদিন ডাকলেই হইয়া যাইত। আমি তো আর নিজের কাপড়ে বিয়া বসতে পারি না।’

— ‘হ্যাঁ বক্কর ভাই। আপনি সাহায্য করবেন জানলে সবকিছু আরও সহজ হয়ে যেতো। এখন এই একশো টাকা নিয়ে যান বিড়ি-সিগারেট খান গিয়ে।’

— ‘না মাস্টার সাব। ভালো লাগছে না।’

— ‘আরে ভাই যান না প্লিজ।’

বক্কর আলী না পারতে বাইরে গেল। অন্তরা পাটিতেই শুয়ে গেছে। বক্কর আলী চলে যেতেই জিসান ধীরে ধীরে দরজা খানিকটা ভেজিয়ে নিল। তাকালো অন্তরার দিকে। কালো ওড়না দিয়ে নিজেকে পুরোপুরি ঢেকে ঘুমোচ্ছে। জিসান মাথার পাশে গিয়ে বসে। আস্তে করে ওড়না মুখ থেকে টেনে নামায়। অন্তরা সঙ্গে সঙ্গে চোখের পাতা খুলে তাকাল। জিসানের চোখে চোখ পড়ায় হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিল আবার।
— ‘ঘুম পাচ্ছে না-কি?’

— ‘না, কিন্তু শরীর ব্যথা করছে। দূর্বল লাগছে।’

— ‘আচ্ছা নাস্তা আনতে গেছে সুমিত ভাই। কিছু খেলে ঠিক হয়ে যাবে। এরপর আর হাঁটার রাস্তা নাই।’

— ‘হুম।’

— ‘এতো লজ্জা পাচ্ছ কেন তুমি? পাটিতে মাথা রাখতে সমস্যা হলে আমার কোলে রেখে শুতে পারো।’

অন্তরা কোনো জবাব দিল না। জিসান আস্তে করে মাথা টেনে কোলে তুলে নিল। কিন্তু হচ্ছে না। জিসানের কাছে মনে হলো হাঁটু পড়ে গেছে অন্তরার পিঠের নিচে। এভাবে ব্যথা পাবে। আরেকটু টানাটানি করেও মনে হচ্ছে এরকম ঘুমাতে পারবে না। অন্তরা এসব দেখে মুখ ঢেকে হেঁসে ফেলল।
— ‘হাসছো কেন?’

— ‘কি শুরু করছেন আপনি?’

— ‘হচ্ছে না আমি কি করবো। তবে আরেকটা পদ্ধতি আছে। তুমি আমার কোলে হেলান দিয়ে বসতে পারো। আমি জড়িয়ে ধরে বসে থাকবো।’

— ‘লাগবে না। আমি শুতেও চাই না আর। কিন্তু আপনি অনেক বাচ্চামু করেন।’

— ‘বাচ্চামুটা আবার কি?’

— ‘অই আরকি আপনার বয়স থেকে কম বয়েসীদের মতো আচরণ।’

— ‘প্রেমে পড়েছি বলে হয়তো।’

— ‘ধ্যত্তেরি আপনি সুযোগ পেলেই শুধু পঁচা পঁচা কথা কন।’

— ‘আমি শুধু পঁচা কথা বলি? আচ্ছা ঠিকাছে আসছি।’
জিসান দরজা খুলে বাইরে একটু উঁকি দিয়ে এলো। কেউ নেই। আবার এসে দরজা ভেজিয়ে বলল, ‘একটু দাঁড়াও।’

অন্তরা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘কেন?’

— ‘আরে দাঁড়াও।’

অন্তরা দাঁড়াল। জিসান একেবারে কাছে গিয়ে বলল, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বাংলায় বলতে হবে।
— ‘কি?’

জিসান আরেকটু কাছে গিয়ে দু’হাতে মুখ ধরে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি অন্তরা। অনেএএএএএক বেশি ভালোবাসি।’

অন্তরার কেমন লজ্জা লাগছে৷ লোকটি কি শিশু হয়ে গেছে? লজ্জা-শরম বলতে কি কিছু নাই?
— ‘ভালো না বেসেই পালিয়ে এলে না-কি? উত্তর দাও।’

— ‘আমি পারবো না বলতে।’

— ‘পারতে হবে। আচ্ছা আরেকটা অপশন দিচ্ছি। হয়তো চোখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসি বলো। অথবা খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছো। জড়িয়ে ধরো আমাকে। দু’টার মাঝে একটা।’

অন্তরার এবার রীতিমতো শরীরে কাঁপন শুরু হয়েছে। শা শা আওয়াজ হচ্ছে কানে। বুক ধুকপুক করছে। পরপুরুষের এতোটা কাছাকাছি কোনোদিন আসেনি সে৷ এসব কথাও শুনেছি। অন্তরারও বোধহয় ইচ্ছে হলো লোকটিকে একবার জড়িয়ে ধরি। এমনিতেই সে চোখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার কথা বলতে লজ্জা পাবে। থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। আচমকা জড়িয়ে ধরলো জিসানকে। জিসানের পুরো শরীর কেঁপে উঠলো। শরীরের সমস্ত লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে৷ দু-হাত পিঠের দিকে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে নিল অন্তরাকে।
খ্যাক করে দরজা খোলার আওয়াজে তাকিয়ে চমকে উঠলো দু’জন।
—চলবে–
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here