বাঁক ( ১০ পর্ব )
____________
মৃদুল খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
– ‘আজ রাতটা গল্প করেই কাটিয়ে দেবো ভাবছি।’
– ‘তা করা যায়, তবে শর্ত হচ্ছে আমি তোমার বুকে পিঠ ঠেকিয়ে বসবো আর তুমি দুই হাতে আমাকে বেঁধে ধরে গল্প করবে।’
মৃদুল মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘আচ্ছা ঠিকাছে আসো।’
বাতির আলোয় সরাসরি কোলে গিয়ে বসতে মানহার কেমন যেন লজ্জা লাগছে।
চোখের দিকে না তাকিয়ে মুখে যতটা সহজে বলতে পেরেছে কাজটা যেন ঠিক ততটাই কঠিন।
– ‘কী হলো আসো?’
মানহা লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে বললো,
– ‘তোমার চোখ বন্ধ করো আগে।’
– ‘বাবা তোমার লজ্জাও আছে দেখছি।’
– ‘অন্ধকার হলে একটুও লজ্জা করবে না। তুমি সরাসরি তাকিয়ে আছো আমি কীভাবে গিয়ে হুট করে বসবো শুনি?’
– ‘মুখ থেকে হাত সরাও তো, চেহারাটা দেখি, ন্যাকামো করছো না-কি আসলেই লজ্জা পাচ্ছ বুঝা যাচ্ছে না।’
– ‘ভালো হচ্ছে না কিন্তু, এরকম বললে আরও বেশি লজ্জা লাগে।’
– ‘তুমিই না বললে কোলে বসে গল্প করতে, এখন আবার লজ্জা কেন পাচ্ছ?’
– ‘এতো কথা না বলে চোখ বন্ধ করো।’
– ‘আজব, আচ্ছা করলাম চোখ বন্ধ।’
মানহা চোরা চাহনিতে তাকিয়ে দেখে মৃূদুল সত্যিই চোখ বন্ধ করেছে। ঝট করে ওর কোল থেকে বালিশ সরিয়ে বসে মৃদুলের দু’হাত টেনে এনে নিজের পেটের ওপর আলগোছে রাখে।
ধৈর্যহারা হয়ে মৃদুল বললো,
– ‘চোখ কী খুলবো? শ্যাম্পুর ঘ্রাণে তো মাতাল হয়ে যাচ্ছি।’
মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘আচ্ছা এবার খুলো।’
চোখ মেলতেই তার সামনে দৃশ্যমান হলো মানহার সদ্য স্নান করে শুকানো উম্মুক্ত কৃষ্ণকেশ। এই চুলের নিচেই ঢেকে আছে ভোরেই সেই ফরসা নগ্ন ঘাড়। মৃদুলের দুই হাত মানহা নিজের উষ্ণ দু’টি হাত দিয়ে পেটে চেপে রেখেছে। তার শরীরে যেন আচমকা এক বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বয়ে গেল। মাথা তুলে দাঁড়াল শরীরের সমস্ত নিম্নমুখী লোম। পরক্ষণেই সে নিজেকে আপন মনে শাসাতে লাগে। নিজের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা হিংস্র দানবকে যেন স্মরণ করিয়ে দেয় তুই বিবাহিত। ফাতিহা ওর মতো রূপবতী না হলেও সে তোর বিয়ে করা স্ত্রী। নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য মানহাকে বললো,
– ‘আন্টি মারা গেলেন কয় বছর হলো?’
– ‘প্রায় বারো বছর।’
– ‘বলো কী?’
– ‘হু।’
– ‘তাহলে তো আমাদের দেখা হওয়ার কয়েক বছর পরেই মারা গেলেন।’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘কীভাবে মারা গেলেন? আর আঙ্কেল কোথায়? তোমরা না মৌলভীবাজার থাকতে? এটা তো তোমার নানাবাড়ি তাই না?’
মানহা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
– ‘সে অনেক কথা, এগুলো শুনে আজ সুন্দর রাতটা নষ্ট করে লাভ নেই।’
– ‘আরে বলো তো শুনি।’
– ‘মা আত্মহত্যা করেছিলেন।’
– ‘বলো কী! আত্মহত্যা করেছেন মানে?’
– ‘সে অনেক কাহিনি।’
– ‘কী কাহিনি? বলো আমি শুনবো।’
– ‘মা শেষদিকে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন।’
– ‘কেন?’
– ‘না শুনলে হয় না?’
– ‘তাও ঠিক, আমি তো তোমার ব্যক্তিগত বিষয় জানার মতো কেউ না।’
– ‘সামান্য ব্যাপারটার জন্য মহিলাদের মতো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করছো কেন?’
– ‘কোনো কিছুই করছি না, আমার শুনতে হবে না।’
– ‘তুমি তো দেখছি অভিমানও করছো মহিলাদের মতো।’
– ‘পুরুষ মানুষের কী অভিমান নাই?’
– ‘রেগে যাচ্ছ কেন? আচ্ছা বলছি সব।
আমার বাবা ঢাকা বায়িং হাউজে কাজ করতেন। আমি আর মা প্রথমে দাদা-দাদিদের সাথেই থাকতাম। আমার আগেই না-কি দু’টা ভাই হয়ে মারা যায়, তারপর আমি শুধু বাঁচলাম। কিন্তু কোনো এক কারণে আমার জন্মের প্রায় পাঁচ বছর হয়ে যায় মা’র আর কোনো সন্তান হচ্ছিল না৷ এমনিতেই প্রথম দু’টা ছেলে সন্তান হয়েই মারা গেছে এটার জন্য দাদি মা’কে দু’চোখে দেখতে পারতেন না৷ বাবা তাদের একমাত্র ছেলে। ওর ঘরে আরেকটা ছেলে না হলে বংশের বাতি কই? এসব নিয়ে প্রথম দুই বছরে প্রচুর স্নায়ুযুদ্ধ হচ্ছিল, তারপর সম্মুখ যুদ্ধ৷ মাও ছিলেন প্রচণ্ড বদ মেজাজি তাই দাদি কিছু বললেই দু’দিন পর পর ঝগড়া লেগে যেতো। বাবা কখনও ফোনে আবার কখনও বাড়িতে এসে ঝগড়া মিটমাট করতে হতো। চার বছরের মাথায় আত্মীয়-স্বজন সবাই বাবাকে আরেকটা বিয়ে করানোর জন্য বলাবলি শুরু করলো। এসব শুনে মা রেগে আগুন হয়ে তুলকালাম বাঁধান। ততদিনে বাবা বাড়িতে আসা কমিয়ে দিলেন। একদিন দাদির সাথে ঝগড়ার পর মা বাবাকে বললেন ঢাকায় তার কাছে আমাদের নিয়ে যেতে, সে আর এক মুহূর্ত এ বাড়িতে থাকতে পারবে না৷
বাবা রাজি হলেন না, তবে মা’র জোরাজোরির কারণে একপর্যায়ে বললেন তাহলে মৌলভীবাজারে আলাদা বাসা ভাড়া করে থাকতে। মা প্রথমে এর কারণ কিছুই বুঝলেন না। তিনি শুধু দাদা-দাদির থেকে আলাদা থাকতে পারবেন ভেবেই রাজি হয়ে গেলেন। আমরা আলাদা বাসায় গেলাম। সেখানে শুধু মা আর আমি। সুন্দর পুর থেকে আসার কিছুদিন পরই মা লোকমুখে শুনছিলেন বাবা ঢাকায় আরেকটা বিয়ে করেছেন। কিন্তু উড়ো কথা গায়ে মাখলেন না। দিন চলতে থাকে এভাবে। এক সময় বাবা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে আনতে শুরু করলেন। টাকাও ঠিকঠাক পাঠান না। মা এক সময় আমাকে নিয়ে নানাবাড়ি চলে আসেন। এর কিছুদিন পর জানতে পারেন একটা ছেলে সন্তান সহ বাবা বউ নিয়ে বাড়িতে উঠেছেন। মা’র পাগল হওয়ার অবস্থা। মামা তারাও সবাই রেগে গেলেন। করলেন গিয়ে মামলা। কিন্তু মা’র যে কী হলো, বাবার সামান্য দ্বিতীয় বিয়ে তিনি বিন্দুমাত্র মেনে নিতে পারছিলেন না। খুব দ্রুত পাগল হয়ে গেলেন। এক সময় বেঁধে রাখতে হয়েছে চেইন দিয়ে৷ মাঝে মাঝে খুব চিল্লাচিল্লি করতেন। আমাকে দেখলে ধেয়ে আসতেন মারতে। আমিও ধারে-কাছে যেতাম না৷ কিন্তু মাঝে মাঝে হুট করে পুরোপুরি আবার ভালো হয়ে যেতেন। আমাকে ডেকে নিয়ে হু হু করে কাঁদতেন৷ এভাবে বছর খানেক কাটার পর একদিন ভোরে নানা পুকুরে অযু করতে যাবেন হঠাৎ দেখেন জাম্বুরা গাছে মা ওড়না প্যাঁচিয়ে ঝুলে আছেন। একটা সময় বাপ-দাদারা আমাকে নিতে চাইলেও আমি যাইনি। মামা আর খালারা আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। তাদের ভালোবাসায় আমি বেড়ে উঠতে লাগলাম, পড়ালেখা শুরু করলাম। মনে মনে পরপুরুষের প্রতি একবুক ঘৃণা আর অবিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠছিলাম। তবে তোমার কথা মনে পড়লেই একটু নিভে যেতাম। মনে হতো মানিক অন্য সকলের মতো নয়, সে একটু আলাদা।
এক সময় খালাদের বিয়ে হয়। নানা মারা যান। নানি আগেই মারা গিয়েছিলেন। মামা বিয়ে করলে। ঘরে এলো নতুন মানুষ। সে আমাকে ভালোভাবে মেনে নিতে পারলো না। উটকো ঝামেলা মনে করতো। আমি তখন একটা ঘরেই বন্দি হয়ে গেলাম। ওখানেই পড়ালেখা করি৷ খাওয়া-দাওয়ার সময় শুধু যাই। নিজেকে তখন ভীষণ অসহায় লাগতো। আমার এইসব দুঃখ, কষ্ট আর একাকিত্বের দিনে বন্ধু হিসেবে তোমার কথা ভাবতাম। এইযে এখন যতসব পাগলামি তোমার সঙ্গে করছি সবকিছু আমার তখনকার ভাবনা। যখন খুব ছোট ছিলাম তখন ভাবতাম হঠাৎ দেখা হবে আমরা এটা-ওটা খেলবো। তারপর যতই বড়ো হচ্ছিলাম ভাবনা পরিবর্তন হচ্ছিল। যখন আমি যুবতী হয়ে উঠলাম। তখন একা একা ভাবতাম আমি তোমার পিঠে হেলান দিয়ে বসে গল্প করবো। রাতে যেদিকে ইচ্ছা হয় ঘুরে বেড়াবো। আমার কোনো ভয় নেই চিন্তা নেই কারণ তুমি আছো। আমি তোমাকে নির্লজ্জের মতো ভালোবাসবো। যেরকম ইচ্ছা মজা করে কথা বলবো। মাঝে মাঝে এমন হতো, বই পড়তে পড়তে হঠাৎ বন্ধ করে কল্পনায় ডুবে যেতাম তোমাকে নিয়ে। আমার যেন ভাবনায় আরেকটা জগৎ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যেখানে শুধু তুমি আর মা। তুমি আসবে জানতাম আর মা কখনও আর আসবেন না, এটাই তফাৎ। অবশ্য আমার কখনও টাকার সমস্যা হয়নি। কারণ খালা তিন জনেরই স্বামী প্রচণ্ড ভালো এবং বিত্তবান। আমার পড়ালেখার খরচ আর এইযে চেম্বার সবকিছু তারা মিলেই দিয়েছেন।’
মৃদুল অবাক হয়ে বললো,
– ‘তোমার সঙ্গে এতকিছু হয়ে গেল? কিন্তু বিশ্বাস করো দেখে একটুও বুঝা যায় না।’
– ‘এবার এই প্রসঙ্গ বাদ দেই।’
– ‘হু, দিলাম।’
– ‘আচ্ছা এটা বলো, আমরা কী লুকিয়ে বিয়ে করতে পারি না?’
– ‘বিয়ে করার এতো তাড়া কী?’
– ‘বিয়ে না করলে কী পুরোপুরি একজন আরেকজনকে পাব? আমি এখন চাইলেই কী তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমোতে পারবো?’
মৃদুল কী বলবে ভেবে পেল না। সে গম্ভীর পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য ছল করে কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
– ‘তাহলে এখনই বিয়ে করো, কারণ আমার এখনই তোমাকে খুব আদর করতে মন চাচ্ছে।’
মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘বাবা তাই? তাহলে আদর করার অনুমতি দিলাম।’
– ‘জ্বি না ম্যাডাম, আমার ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে ছাড়া আদর করতে চাই না।’
– ‘তাহলে তাড়াতাড়ি বিয়ে করো।’
– ‘না আমি ধৈর্য ধরবো, আগে মা আর ইশিকে বের করি, তখন ওদের নিয়েই বিয়ে করবো।’
– ‘আচ্ছা আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তুমি হুট করে ভালোবাসো বললে যে, এটা কীভাবে সম্ভব? তুমি কী আসলেই আমাকে ভালোবাসো?’
মৃদুল দমে যায়। তারপর হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে বলে,
– ‘ম্যাডাম আমার কাছে তো তুমি মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। আমার অবস্থান আমি জানি। তুমি রূপবতী তাও শিক্ষিত স্বাবলম্বী মেয়ে। আমার ভালো না বাসার কারণ কী থাকতে পারে?’
– ‘এটাকে ভালোবাসা বলে না-কি?’
– ‘সিনেমা আর গল্পে বলে না, বাস্তব বলে।’
– ‘বাস্তব বলে মানে?’
– ‘এরেঞ্জ ম্যারেজ কীভাবে হয়? মেয়ের পড়ালেখা, রূপ আর ছেলের কেরিয়ার এগুলোই তো দেখা হয়। এগুলো দুপক্ষের মনমতো হয়ে গেলেই শেষ। তখন কী প্রেম-ভালোবাসার জন্য বাসর রাতে কিছু আঁটকে থাকে? এরপর সারাজীবন কী প্রেম-ভালোবাসা ছাড়াই সংসার টিকে? তাছাড়া আমি তো বেশ কিছুদিন থেকেই তোমাকে দেখি।’
– ‘বাবা কী যুক্তি, আচ্ছা যাক, আমাকে ভালোবাসো মানলাম। এখন বাতি বন্ধ করে এসে বুকে মাথা রেখে ঘুমাবো আর তুমি আদর করবে। দ্বিতীয় কোনো কথার বা দ্বিধাদ্বন্দের স্থান নেই।’
মৃদুল কী বলবে ভেবে পেল না। সে নিজের উপর থেকেও কখন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে বুঝতে পারছে না। মানহা বাতি বন্ধ করতে বিছানা থেকে উঠে গেল।
____ চলবে___