বাঁক ( ২৩ পর্ব )
_____________
ইরফান ফোনের অপর পাশ থেকে আমজাদের কথা শুনে মানহাকে বললো,
– ‘বুঝতে পারছি, মাঝিকে জিজ্ঞেস করে বের করা যাবে। তোমরা সিলেট আসার পর একসাথে সেখানে যাব।’
– ‘আচ্ছা ইরফান ভাই তাহলে এখন রাখছি।’
মানহা মোবাইল ভ্যানিটিব্যাগে রেখে বললো,
– ‘আমজাদ সাহেব, আমরা দু’জন রাতে এখানে কোথায় থাকতে পারব?’
মৃদুল সঙ্গে সঙ্গে বললো,
– ‘ট্রেন এখন না পাওয়া গেলেও বাস তো মিলবে, তাই না আমজাদ সাহেব?’
– ‘হ্যাঁ তা মিলবে।’
– ‘স্টেশন কতদূর এখান থেকে কীভাবে যেতে হবে?’
আমজাদ খানিক চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,
– ‘আসলে এখন রাত অনেক হয়ে গেছে। আপনারা গিয়ে বাসের টিকিট কাটতে ঝামেলা হবে।’
মানহা কুণ্ঠিত গলায় বললো,
– ‘আপনি যদি একটু ব্যবস্থা করে দিতেন ভালো হতো, রাত নয়টা হয়ে যাচ্ছে।’
আমজাদ ইতিউতি করে বললো,
– ‘আচ্ছা আমি দেখছি।’
আমজাদ চেয়ার থেকে উঠে বারান্দা থেকে ভেতর ঘরে গিয়ে মুহূর্তেই আবার একটা ফতোয়া গায়ে জড়িয়ে কার সঙ্গে যেন কলে কথা বলতে বলতে বের হলো।
– ‘আসুন আমার সাথে, আপনারা বিদেশি মানুষ আমার বাড়িতে আসছেন। সাহায্য সহযোগিতা না করলে কেমন জানি দেখায়।’
মৃদুল আর মানহা তার পেছনে বারান্দা থেকে নেমে উঠোনে এলো। আমজাদ ফতোয়া একটু টেনে-টুনে ঠিক করতে করতে বললো,
– ‘আপনাদের সিলেট আমার বড়ো ভালো লাগে, আলী আমজাদের ঘড়ি জানেন তো? আহা আমার নামে নাম।’
মানহা পিছু থেকে মুখে হাত দিয়ে ফিক করে হেঁসে দিল। মৃদুল চিমটি কেটে দাঁত কটমট করে ইশারায় শাসায়। আমজাদ এসবে খেয়াল না করে কথা বলে যাচ্ছে৷ তারা উঠোন পেরিয়ে পাকা রাস্তায় এলো।
– ‘একটা সিএনজি আসতেছে অপেক্ষা করি এখানে।’
মৃদুল ‘আচ্ছা’ বলে সম্মতি জানায়। মিনিট পাঁচেক পরেই একটি সিএনজি তাদের সামনে এসে থামে। ‘উঠেন’ বলে আমজাদ সামনের সিটে বসে। মানহা আর মৃদুল পিছনে৷
– ‘বাস স্টেশন চল।’
সিএনজি চলতে থাকে। মিনিট তিরিশেক সময় লাগে তাদের বাস স্টেশন আসতে।
আমজাদ তাদেরকে একটা হোটেলে বসিয়ে বললো,
– ‘আপনারা বসে নাশতা করেন, আমি টিকিট নিয়ে আসি।’
‘আচ্ছা’ বলে মৃদুল সম্মতি জানায়।
আমজাদ ইতস্তত করে বললো,
– ‘টিকিট আর সিএনজি ভাড়ার টাকাটা।’
– ‘কত?’
– ‘সিএনজি এক হাজার দিতে হবে আর টিকিট দুই হাজার।’
মৃদুল রূঢ় গলায় বললো,
– ‘কী বলেন এগুলো? এইটুকু জায়গা এক হাজার টাকা কীভাবে? তাছাড়া বাসের টিকিট এতো টাকা না-কি?’
মানহা মাছি তাড়ানোর মতো হাত নেড়ে বললো,
– ‘উনাকে কি বলছো এগুলো? চুপ থাকো তো তুমি।’
কথাটি বলে মানহা টাকা বের করে দিয়ে বললো,
– ‘এই নিন আমজাদ সাহেব। আমরা অপেক্ষা করছি, আপনি এলে একসঙ্গে নাস্তা করবো।’
‘আচ্ছা’ বলে আমজাদ বের হয়ে গেল। মৃদুল হোটেলের জানালা দিয়ে ‘থুথু’ ফেলে বললো,
– ‘এই শালা তো দেখি মানুষের কাতারেই পড়ে না। সামান্য তথ্য দেয়ার জন্য কত টাকা নিল। এখন আবার সিএনজি ভাড়া আর বাসের টিকিটেও টাকা বাড়িয়ে নিয়েছে।’
– ‘তুমি এতো রাগ করছো কেন বাদ দাও তো।’
– ‘তাকে ছাড়াও আমরা আসতে পারতাম, টিকিটও কাটতে পারতাম।’
– ‘তা ঠিক, তবুও ভেবেছিলাম রাত হয়ে গেছে দেরি হলে বাস মিস হবে।’
– ‘কিন্তু এখন যে টিকিটের টাকা দিয়ে দিলা যদি পালিয়ে যায়?’
মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো তো এসে। মানুষকে তোমার এতো অবিশ্বাস কেন?’
– ‘তোমার এতো বিশ্বাস কেন?’
– ‘বলছি বসো এসে।’
মৃদুল পাশে বসার পর মানহা বললো,
– ‘আমরা আমজাদের বাড়ি চিনি তাই পালিয়ে যাবে না।’
– ‘বাড়ি চিনে কী হবে সে অস্বীকার করতে পারে।’
– ‘হ্যাঁ তোমাকে বলছে, মানুষ চোরা পথে ইউরোপও চলে যায় আগে দালালকে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে।’
– ‘কিন্তু আমজাদ চোরাকে দিয়ে দুই টাকার বিশ্বাস নেই আমার।’
মানহা আবার হেঁসে ফেললো।
– ‘নিন টিকিট, দশটায় বাস ছাড়বে। আর বেশি বাকী নেই।’
আমজাদ এসে চেয়ারে বসতে বসতে কথাটি বললো।
মানহা টিকিট হাতে নিয়ে বললো,
– ‘এখানে কী খাওয়া যাবে বলুন তো।’
– ‘ভালো কিছু পাবেন না, সময়ও কম। শিঙারা আর ডিম দিয়ে বিরিয়ানি খেয়ে নিন।’
মানহা সম্মতি জানায়। আমজাদ অর্ডার দেয়। টেবিলে তিন প্লেট বিরিয়ানি এলো।
কথা বলার মাঝখানে মানহা আমজাদের নাম্বার নিয়ে সেভ করে রাখলো মোবাইলে। খাবার শেষে আমজাদ তাদের বাসে তুলে দিয়ে বিদায় নিল। মানহা বসেছে জানালার পাশে। তাকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা যাচ্ছে। নির্ঘুম, বাইরের অখাদ্য খাবার, গোসল না করা কোনো কিছুই তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ ফেলতে পারছে না। বারবার মনে হচ্ছে দিনটা কত সুন্দর। এক সঙ্গে থাকা হয়েছে, ওর পাশটায় বসে অপরূপ সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে করতে ট্রেনে এসেছে। এখন আবার বাসে করে যাবে৷ মানুষটা পাশেই বসা।
– ‘যাক আমজাদ ভালোই ভালোই বলে দিছে ইশিদের কথা। এবার মনে হয় ওদের পেয়ে যাব, কী বলো মানহা?’
মানহা ওর দিকে তাকিয়ে হাতটা পেঁচিয়ে ধরে বললো,
– ‘ইনশাআল্লাহ এবার পেয়ে যাব, প্লিজ দুশ্চিন্তা করো না তো তুমি।’
– ‘তোমাকে ছাড়া এগুলো সম্ভব হতো না মানহা। তুমি কীভাবে যেন সবকিছু সহজ করে দেখো।’
মানহা মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘হুহ, তবুও তো মানুষ আমাকে একটুও আদর করে না।’
কৃত্রিম অভিমান হলেও মৃদুলের বুকটায় চিনচিনে এক ব্যথা অনুভব হয়। আসলেই তো মানহার সঙ্গে সে অবিচার করছে। মেয়েটা তার জন্য কি-না করে যাচ্ছে। তার জন্য নিজের পরিবার থেকেও বঞ্চিত হবার পথে। তবুও একটু ভালোবাসে না সে। বিয়ের ব্যাপারটা লুকিয়ে নিয়েও তো মানহাকে কাছে টানা যায়। এমন না যে মানহাকে তার ভরণ-পোষণ করতে হবে৷ ওটা সে নিজেই পারবে। কেবল তার নিখাদ ভালোবাসা চায় মানহা। সেও কী চায় না? অবশ্যই চায়, কেবল বিবাহিত বলে বারবার নিজের হাত গুটিয়ে নিতে হচ্ছে তার।
বাস চলতে শুরু করেছে, ভেতরে বাতির আবছা আলো। প্রায় সবাই মোবাইলে ব্যস্ত। কেউ মোবাইল টিপছে, কেউবা ইয়ারফোন কানে গুঁজে চোখবুজা। মানহাও ফেইসবুক নিউজফিডে ঘোরাঘুরি করতে যেয়ে একটা বেবির ছবি দেখে মৃদুলকে দেখিয়ে বললো,
– ‘অনেক কিউট তাই না?’
– ‘হ্যাঁ।’
মানহা তার কাঁধে মাথা রেখে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
– ‘আমারও এমন বেবি চাই।’
মৃদুল দাঁত কটমট করে তাকায়। ইশারায় বাসের মানুষ দেখায়৷ মানহা এসব পাত্তা না দিয়ে বললো,
– ‘ইশিদের পেয়ে গেলে কালই ওদের জলেস্বরী নিয়ে যাব।’
– ‘নিয়ে?’
– ‘আলাদা বাসা ভাড়া নিব। আমরা সবাই সেখানেই থাকবো। তাছাড়া শিগগিরই বিয়ে করবো।’
মৃদুল কোনো জবাব দেয় না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দেয়।
তারা সিলেট পৌঁছে গেল পরেরদিন ভোরে। মানহা বাস থেকে নেমে হাই তুলে মৃদুলের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো,
– ‘তোমার চোখ এতো লাল হলো কেন?’
– ‘লাল হবে না? তোমার মতো পুরো রাস্তা তো আমি ঘুমিয়ে আসিনি।’
– ‘আচ্ছা আমরা কোথাও গিয়ে নাশতা করি। তারপর ইরফান ভাইকে কল দিতে হবে।’
– ‘আগে কল দাও, তারপর আমরা ব্রিজের ওপারে গিয়ে নাশতা করতে করতে সে চলে আসবে।’
– ‘কিন্তু ও তো অসুস্থ, আসতে পারবে কি-না কে জানে।’
– ‘কল দিয়ে দেখো।’
– ‘সবেমাত্র ছয়টা বাজে এতো ভোরে কল দেবো?’
– ‘হ্যাঁ দাও, সে আসতে এমনিতেই দেরি হবে।’
মানহা মোবাইল বের করে কল দেয়। কয়েকবার কল হবার পর ইরফান রিসিভ করে ঘুম ঘুম গলায় বললো,
– ‘হ্যালো।’
– ‘ইরফান ভাই আমরা তো সিলেট এসে গেছি।’
– ‘আচ্ছা তোমরা বন্দর কোথাও বসে নাশতা করো আমি এসে কল দিচ্ছি।
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
মানহা মোবাইল ব্যাগে রেখে বললো,
– ‘আমাদের বন্দর বসতে বলছে।’
‘আচ্ছা’ বলে মৃদুল একটা রিকশা ডাকে। দু’জন রিকশায় উঠে বসে।
মানহা বললো,
– ‘এখন ভাত খেলেই ভালো হতো।’
– ‘এতো ভোরে ভাত পাবে না। এখন নাশতা করতে হবে।’
– ‘তুমি খুব এক্সাইটেড তাই না?’
– ‘কেন?’
– ‘কতদিন পর মা বোনের সাথে দেখা হবে।’
– ‘হ্যাঁ সতেরো বছর পর।’
– ‘আমিও এক্সাইটেড।’
– ‘কেন?’
– ‘আমিও তো ইশি আর আন্টিকে চিনি জনাব।’
– ‘সেটা তো মাত্র কয়েক সপ্তাহের চেনা।’
– ‘থাকলেও শৈশবের কিছু কিছু স্মৃতি মৃত্যুর আগপর্যন্ত ভোলা যায় না। স্মৃতিগুলো যে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয় তাও না।’
– ‘কে বলছে এই কথা?’
– ‘কেউ বলতে হয় না আমি জানি। তবে একটা বইয়ে পড়েছিলাম। ধরো তুমি অসুস্থ অবস্থায় দুপুরে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় উদাস মনে বসে গাছের উপর দিয়ে আকাশে তাকিয়ে আছো। তখন একটা পাখি ডেকে গেল৷ কাকও ধরো ডেকেছে। এটা খুবই স্বাভাবিক দৃশ্য না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘এই দৃশ্য কোনো যুক্তি ছাড়াই আজীবন তোমার মনে থাকতে পারে।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, ওইদিন আমি জর্দা দিয়ে ঠোঁট লাল করে পান খেয়ে মাথা ঘুরিয়েছিল না?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘এরপর থেকে কাউকে পান খেতে দেখলে আমার শরীরে লোম দাঁড়িয়ে যায়।’
– ‘বলো কী এটা সামান্য ব্যাপার ছিল।’
– ‘সমান্য হলেও এটা হয়তো আমার কয়েকবছর স্থায়ী থাকবে অথবা সারাজীবন। ওইদিন চেম্বারে এক প্যাসেন্টের মা’কে পান চিবুচ্ছে দেখে আমার অসহ্য লাগছিল৷ কিন্তু কিছু বলতেও পারছিলাম না৷ বারবার চোখও চলে যায় মহিলার দিকে। তারপর মাথা ব্যথা চলে এলো।’
মৃদুল হেঁসে উঠলো কথা শুনে। মানহা হাতে চিমটি কেটে বললো,
– ‘হাসছো কেন?’
– ‘তুমি বাচ্চাদের মতো কথা বললে হাসবো না?’
– ‘আমি বাচ্চাদের মতো কিছুই বলিনি।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে বলোনি।’
বন্দর এসে রিকশা থামলো। ভাড়া চুকিয়ে দু’জন গেল নাশতা করতে। প্রায় মিনিট তিরিশেক পর কল এলো ইরফানের।
– ‘হ্যালো ইরফান ভাই।’
– ‘হ্যাঁ কোথায় তোমরা? আমি বন্দর এসেছি।’
মানহা রেস্টুরেন্টের নাম বলতেই খানিক পর ইরফান এলো৷ হালকা-পাতলা গড়নের লম্বা একটি ছেলে। শ্যামলা গায়ের রঙ। দাঁত অস্বাভাবিক পরিষ্কার। মুখ ক্লিন সেভ করা। হাফহাতা সাদা গেঞ্জি পরনে। এক হাত বেন্ডেজ করা। মানহা দেখেই হাত তুলে বললো,
– ‘এইতো ইরফান ভাই এসে গেছে।’
মৃদুল বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। ইরফানকে একদম চেনা যাচ্ছে না। কত ভীতু ছিল। এখন বড়ো হয়েছে, চেহারায় আভিজাত্য একটা ভাব। শিক্ষকতা করায়। উত্তেজনায় মৃদুল বসা থেকে উঠে এগিয়ে গেল। ইরফানও মিষ্টি সরল একটা হাসি মুখে ফুটিয়ে তুলে জড়িয়ে ধরে বললো,
– ‘তোমাকে দেখেই চেনা যাচ্ছে মৃদুল ভাই। ইশি তো দেখলেই চিনে ফেলবে।’
– ‘কিন্তু তোকে চিনবে না। একদম বদলে গেছিস।’
– ‘আচ্ছা চলো বসি। কত বছর পরে আবার দেখা হলো।’
___চলবে___