বাঁক ( ২৪ পর্ব )
____________
ইরফান বসলো মানহার সামনের চেয়ারে।
আহত হাতটা টেবিলে আলগোছে রেখে মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘ডাক্তারনি ম্যাডামের কী অবস্থা? কেমন আছো?’
মানহাও রসিকতা করে বললো,
– ‘ভালো আছি স্যার।’
– ‘স্যার?’
– ‘শিক্ষক মানুষ।’
তিনজন হেঁসে উঠলো।
– ‘তোমদের কী নাশতা করা শেষ?’
– ‘হ্যাঁ, তুমি তো করে আসোনি মনে হচ্ছে।’
– ‘না, এখানে চা খেয়ে নিব।’
ওয়েটারকে চা দিতে বললো ইরফান। মৃদুল ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘এখন কী অবস্থা হাতের?’
– ‘ভালোই।’
মানহা বললো,
– ‘শুধু কী হাতে লেগেছে?’
– ‘না পায়েও আছে। আচ্ছা এগুলো থাক। তোমাদের কীভাবে দেখা হলো সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না। আমি কত খোঁজাখুজি করেও পাইনি।’
মানহা ফিক করে হাসে। মৃদুল তাকে পুরো ঘটনা খুলে বললো। রূপগঞ্জ শুনে ইরফান অবাক হয়। কারণ কিছুদিন আগের খুনের ঘটনা রূপগঞ্জ হয়েছে সে জানে। তবুও এসব আলোচনায় না গিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে মৃদুলকে বললো,
– ‘তুমি এখন থেকে আর পালাবে না। পুলিশ ধরে নিলে নিক সমস্যা নেই।’
মৃদুল অবাক হয়ে বললো,
– ‘পুলিশে ধরা নিলে সমস্যা নেই মানে?’
– ‘পুলিশ ধরে নিলে আসল ঘটনা সামনে আসবে। তুমি যা গোপন করতে চাচ্ছ সেটা করার দরকার নেই। আমি পরিচিত এক আইনজীবীর সাথে কথা বলেছিলাম।’
মানহা পাশ থেকে বললো,
– ‘হ্যাঁ, পালানোর আর দরকার দেখছি না। এখন আইনি লড়াই করতে হবে। কারণ ইরফান ভাই আর আন্টি আছে৷ আমিও ছিলাম প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। তাছাড়া কম বয়সে পরিস্থিতির শিকার হয়ে খুন করলে শুনেছি শাস্তি হয় না।’
ইরফান চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
– ‘রাইট, তবে পরিস্থিতির শিকার ছিল সেটা প্রমাণ করতে হবে। তার জন্য আমি আর তুমিই তো আছি।’
– ‘আমরা তো অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিলাম।’
– ‘সমস্যা নেই মা আছেন।’
মৃদুল খানিক ভেবে বললো,
– ‘চাচি কেমন আছেন?’
– ‘ভালো, আমার সাথেই থাকেন।’
– ‘চাচি আমাদের পক্ষে সাক্ষী দেবেন?’
– ‘হ্যাঁ, আমিও দেবো, মা দেবেন নিজের ক্রোধ থেকে। বাবা আরও কয়েকটা বিয়ে করেছেন। মা’র সঙ্গে পৃথিবীর যতপ্রকার অবিচার অত্যাচার আছে সবই করেছেন। কিন্তু আমি ক্রোধ থেকে সাক্ষী দেবো না, আমি সাক্ষী দেবো বিবেক থেকে। চোখের সামনে একটা পরিবারের এমন দুর্দশা মেনে নেয়া যায় না।’
– ‘চাচিকে দেখতে যাব, পুলিশ যেহেতু ধরলে সমস্যা নেই তাহলে ভয় কিসের।’
– ‘এখনও ওরা সক্রিয়। তাদের বিজনেস আপডেট হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। রূপগঞ্জ যে খুন হয়েছে বুঝতে পারছো তো? এখন তোমার সঙ্গে মায়ের দেখা সাক্ষাৎ হলে ওরা জানতে পারলে পাগলা কুকুর হয়ে যাবে।’
– ‘ও বুঝেছি, কিন্তু এখন ইশিদের বের করার পর আমি কী নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দেবো?’
মানহা প্রতিবাদ করে বললো,
– ‘না, তুমি ধরা দেবে কেন? যে সত্যিকার অপরাধী সে ধরা দিবে।’
– ‘কী বলো এসব?’
ইরফান মানহাকে সমর্থন করে বললো,
– ‘হ্যাঁ তাই করতে হবে। তবে এই আলোচনা পরে করা যাবে। আগে ইশিদের বের করি।’
মৃদুল নীরব হয়ে গেল। মানহাকে এখন তার সন্দেহ হচ্ছে। মানহা কী নিজের ভালোবাসার মানুষকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে ইশিদের খুঁজছে? খুঁজে পাওয়ার পর কী পুলিশকে ওরা আসল ঘটনা বলে দিবে? এতোদিন এই ব্যাপারটা তার মাথায় আসেনি। মানহা যদি তাকে ভালোবেসে থাকে তাহলে তো তাকে নিরাপদ রাখতে চাইবে। মৃদুল আর ভাবতে পারছে না। ইশিকে সে কোনোভাবেই এসবে জড়াতে দেবে না। প্রয়োজনে ওদের নিয়ে আবার দূরে কোথাও হারিয়ে যাবে। যেখানে মানহা আর ইরফান কেউ থাকবে না। নতুন করে জীবন শুরু হবে।
ইরফান চা শেষ করে ঘড়ি দেখে বললো,
– ‘সাতটা হয়ে গেছে৷ এবার যাওয়া যাক।’
মানহা সম্মতি জানিয়ে বললো,
– ‘হ্যাঁ যেতে যেতে দেরি হবে হয়তো।’
– ‘হ্যাঁ, উঠি।’
মানহা বিল দিতে চাইলে ইরফান বাঁধা দিয়ে সে নিজেই দিল। তিনজন বের হয়ে এলো রাস্তায়। ইরফান সিএনজি ডেকে জায়গার নাম বলে তাদের নিয়ে উঠে। বেশি সময় লাগলো না খেয়া ঘাটে আসতে। সিএনজি বিদায় করে তারা ঘাটে নামে। খেয়া অপর পাড়ে দেখা যাচ্ছে। ইরফান হাঁক ছেড়ে,
– ‘ও মাঝি ভাই আমাদের নিয়ে যান।’
অপার থেকে মাঝি জবাব দিল,
– ‘আইরাম তোরা দেরি অইব।’
– ‘দেরি কেন?’
– ‘আমার ফুয়ার লাগি বার চাইরাম।’
ইরফান ওদের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘পাথরে বসো, আসতে দেরি হবে মনে হয়।’
মৃদুল আর ইরফান দু’টা বড়ো পাথর দেখে বসে৷ কিন্তু মানহা নদীর চারদিকে তাকাচ্ছে। কিনারায় বড়ো বড়ো পাথর৷ একের পর এক সেল্ফি তুলছে সে।
ইরফান আর মৃদুলের সামনে এসে বললো,
– ‘তোমরা তাকাও এদিকে।’
ইরফান মুচকি হেঁসে তাকায়। কিন্তু মৃদুল আচমকা দাঁড়িয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
– ‘আরে কোথায় যাও? তিনজনের সেল্ফি তুলবো তো।’
– ‘আমি ছবি তুলি না।’
ইরফান আর মানহা বেশ অবাক হলো। মানহা পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য মুচকি হেঁসে ইরফানকে বললো,
– ‘ঠিক আছে ও না তুলুক আমরা তুলি।’
তারপর তারা দু’জন সেল্ফি তুলতে তুলতে দেখলো খেয়া ছেড়ে দিছে। মৃদুল দূরে একটা পাথরে ম্লান মুখে বসা। মানহা মোবাইল ব্যাগে রেখে ওর দিকে পা টিপে টিপে হেঁটে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে বললো,
– ‘তোমার আবার কী হয়েছে?’
– ‘কিছু না।’
– ‘আচ্ছা চলো খেয়া আসছে।’
মৃদুল উঠে দাঁড়ায়। ঘাটে গিয়ে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর খেয়া চলে আসে। ইরফান উঠে গেল সবার আগে। মৃদুল উঠতেই মানহা পেছন থেকে বললো,
– ‘আমার হাতটা একটু ধরো তো।’
মৃদুল না পারতে হাত ধরে তাকে খেয়ায় তুলে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ে। মানহা গিয়ে বসলো তারই পাশে। ইরফান অবাক চোখে কেবল সবকিছু দেখছে। খেয়া চলতে শুরু করার পর ইরফান মাঝিকে বললো,
– ‘চাচা আলেয়ার বাড়ি কোথায়?’
মাঝি তাদের দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
– ‘আফনারা খে?’
– ‘সাধারণ মানুষ, একটা দরকারে সেখানে যাব।’
– ‘পুলিশ না সাংবাদিক খও আগে।’
ইরফান মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘না চাচা আমরা দু’জন মানুষকে খুঁজে এসেছি।’
– ‘ইজাগার সন্ধান খে দিছে?’
– ‘চট্টগ্রামের একজন মানুষ।’
– ‘নাম কিতা তার?’
– ‘আমজাদ।’
– ‘ও আইচ্ছা চিনতাম ফারছি।’
– ‘আলেয়ার বাড়ি কোনদিকে জানেন?’
– ‘এখলা চিনতায় নায়, আমার ফুয়ায় দিয়া আইবোনে তারে চা ফানির টেখা দিবায় আরকি।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে চাচা তা দেয়া যাবে।’
খেয়া ঘাটে আসার পর মানহাকে বাঁধা দিয়ে ইরফান ভাড়া দেয়। পিচ্চি ছেলেটি খেয়া থেকে লাফ দিয়ে নেমে বলে,
– ‘আমার লগে আইন আফনারা।’
তারা পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। খানিক্ষণ পর ইরফান পিচ্চিকে বললো,
– ‘কতদূর আলেয়ার বাড়ি?’
– ‘বেশিদূর নায় ওউতো সামনে।’
অনেক্ষণ হেঁটে মানহা ক্লান্ত হয়ে মৃদুলের হাত ধরে বললো,
– ‘ক্ষুধা লেগে গেছে আর হাঁটতে পারছি না৷’
ইরফানও ক্লান্ত গলায় বললো,
– ‘আমারও পায়ে সমস্যা হচ্ছে।’
মৃদুল পিচ্চিকে ধমক দিয়ে বললো,
– ‘আর কতদূর সত্যি করে বল।’
সে পুনরায় বললো,
– ‘ওউতো সামনে আর বেশি নায়।’
মানহা মৃদুলের হাত ধরে হাঁটছে। তাদের এতো ঘনিষ্ঠতা দেখে ইরফান মনে মনে অবাক হচ্ছে। আরও খানিকটা পথ হেঁটে যাবার পর পিচ্চি উঁচু দেয়াল তোলা একটা বাড়ির গেইট দেখিয়ে বললো,
– ‘ওউটা আলেয়ার বাড়ি, আমারে টেখা দেইন আমি যাইগি।’
– ‘কত দেবো?’
– ‘পঞ্চাশ টেখা।’
ইরফান তাকে টাকা দিয়ে গেইটের সামনে গেল। বয়স্ক এক দারোয়ান তাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– ‘কী চান?’
– ‘আলেয়া বেগম আছেন?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘উনাকে দরকার।’
দারোয়ান তিনজনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘লগে মহিলা মানুষ দেখা যায়, কী দরকার বলুন আগে।’
– ‘আমাদেরকে আমজাদ সাহেব পাঠিয়েছেন।’
– ‘ও আচ্ছা তাহলে দাঁড়ান।’
দারোয়ান ভেতরে গিয়ে একজন মোটা মহিলাকে নিয়ে এলো।
মহিলা গেইটের ভেতর থেকে বললো,
– ‘কে আপনারা?’
মৃদুল সামনে গিয়ে বললো,
– ‘আমরা ইশি আর ওর মা’কে নিতে এসেছি।’
– ‘ইশি ফিশি তো এখানে নাই আপনাদের কে পাঠিয়েছে?’
– ‘আমজাদ সাহেব।’
– ‘আমজাদ বাটপার কোথায়? আপনাদের সঙ্গে এসেছে না-কি? এই গিয়ে দেখে আয় তো রাস্তা।’
দারোয়ান বাইরে গেল। মানহা শান্ত গলায় বললো,
– ‘আমজাদ সাহেব আসেননি। কিন্তু উনি বলেছেন এখানে ইশি আর এক বৃদ্ধ মহিলাকে কাজে দিয়েছেন।’
মহিলা বাজখাঁই গলায় বললো,
– ‘আমজাদ এদেরকে কাজে দিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। কিন্তু ওরা থাকেনি এখানে, মা-মেয়ে চলে গেছে। টাকা ফিরত দিতে আমজাদকে কল দিলে এখন আর কল ধরে না।’
তিনজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বললো,
– ‘মা মেয়ে চলে গেছে মানে?’
– ‘চলে গেছে মানে চলে গেছে এখানে নাই।’
মৃদুল অস্থির গলায় বললো,
– ‘কোথায় গেছে জানেন?’
– ‘না, জানি না।’
___চলবে___