বাঁক ( ২৮ পর্ব )
_____________
মানহা ওর ক্রোধান্বিত চেহারা দেখে আঁজলা করা হাতটি ওর মুখ থেকে সরিয়ে নিয়ে বললো,
– ‘এতো অস্থির হচ্ছ কেন? আমি ইরফানকে বেশিকিছু জিজ্ঞেস করিনি, বললো ইশির নাম্বার থেকে সে কল পেয়েছে। তাদের কথাও হয়েছে।
মৃদুল বিস্মিত হয়ে বললো,
– ‘আমজাদ তো বলেছিল ইশির মোবাইল ছিনতাই হয়েছে।’
– ‘সেটা তো জিজ্ঞেস করিনি, দেখা হলে জানা যাবে।’
– ‘লায়লার না ইরফানের নাম্বারে কল দিয়েছে ইশি?’
– ‘ইরফানের।’
– ‘তাহলে তো ইশির নাম্বার থেকেই দিয়েছে কল, এতদিন দেয়নি কেন? যাইহোক, এখন কী করবো আমরা?’
– ‘ইরফান বললো দুপুরে দেখা করবে ইশি।’
– ‘কোথায় দেখা করবে?’
– ‘বন্দর এসে কল দিয়ে দেখা করবে, আমরা এখনই বের হয়ে যাব।’
মৃদুল অস্থির হয়ে বললো,
– ‘তাহলে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।’
মানহা বেডরুমে চলে যায়। ইচ্ছা ছিল বাসা দেখে এসে ঘুমোবে। ঘুম থেকে উঠে ভোরের অপ্রত্যাশিত দু’টো ঘটনা ভুলে যাবে। মামা আর মিরার ব্যাপারটা ভীষণ পোড়াচ্ছিল। এখন কাপড়-চোপড় নিয়ে বাথরুমে গেল শীতল জলের ধারায় সকল গ্লানি আর লাঞ্চনা দেহ থেকে ধুয়ে-মুছে ফেলতে। ইশিদের পেয়ে গেলে মৃদুল খুবই খুশি হবে। ওর আনন্দ দেখলে মানহারও মনে খুশির জোয়ার বয়ে যায়। খুব বেশি সময় নিল না গোসলে। বের হয়ে দেখে মৃদুল সোফায় বসে অপেক্ষা করছে।
– ‘তুমি কি গোসল করবে না?’
– ‘না, তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যাও।’
– ‘এতো অস্থির হচ্ছ কেন মৃদুল? ইশি বলছে ওরা দুপুরে এসে ইরফানকে কল দিয়ে দেখা করবে।’
– ‘সেটা বলুক, আমরা তাড়াতাড়ি গিয়ে ইরফানকে এনে ইশিকে কল দিব।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
তারা বের হতে হতে বেলা এগারোটা হয়ে গেল। পৌঁছে গেল জোহরের আগে। ইরফানও খানিক পর চলে এলো। মানহার কথামতো গিয়ে বসলো তারা সুরমা নদীর পাড়ে। এদিক দিয়ে সুন্দর নিরিবিলি পাকা রাস্তা গিয়েছে৷ নদীর পাড়ে রেলিঙ দেয়া। ফুটপাতে দোকান আছে। রঙিন ছাতা টাঙিয়ে মানুষের বসবার জায়গা করা। এখান থেকে বসে রাস্তার অপর পাশে দেখা যায় সিলেট সার্কিট হাউজ। সবুজ ঘাস আর ফুল গাছে ঢেলে সাজানো ঝলমলে একটি ভবন। পেছনে বয়ে গেছে সুরমা নদী। ইরফান চেয়ারে বসতে বসতে বললো,
– ‘জায়গাটা খুব নিরিবিলি।’
– ‘হ্যাঁ, কিন্তু এখান থেকে কিং ব্রিজের দিকে তাকিয়ে দেখো গাড়ি আর মানুষে গিজগিজ করছে।’
মৃদুল চেয়ারে বসে বললো,
– ‘কল দাও ওদের।’
– ‘দিয়েছি, ওরা আসার পথে।’
মানহা চা দিতে বললো দোকানিকে। মৃদুল পুনরায় ইরফানকে বললো,
– ‘ইশির না মোবাইল ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল।’
– ‘হ্যাঁ তাইতো, এখন মোবাইল কীভাবে পেয়েছে এটা জিজ্ঞেস করিনি।’
মানহা টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,
– ‘অস্থির হওয়ার কিছু নেই, ওরা এলেই সব জানা যাবে।’
ইরফান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। খানিক পর ওয়েটার চা এনে দিল। চা হাতে নিয়ে চুমুক দিতেই মৃদুলের ফোন বেজে উঠলো৷ ইরফান মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে বললো,
– ‘ইশি।’
– ‘রিসিভ করো।’
ইরফান রিসিভ করে বললো,
– ‘হ্যাঁ ইশি বলো।’
– ‘ভাইয়া আমরা তো বন্দর এসে গেছি।’
– ‘সার্কিট হাউজের সামনের দিকে আসো।’
– ‘আচ্ছা।’
ফোন রেখে দিল ইরফান। মানহা খানিক্ষণ কিছু একটা ভেবে বললো,
– ‘মৃদুল ওইযে রেলিঙের পাশে গাছ দেখা যাচ্ছে তুমি সেখানে চলে যাও।’
ইরফান অবাক হয়ে বললো,
– ‘কেন?’
– ‘ওদের তো অনেকদিন পর দেখা হবে, যদি সিনক্রিয়েট হয়। আন্টি ধরো কান্না শুরু করলেন তখন আশপাশের দোকান থেকে মানুষ জড়ো হয়ে যাবে।’
– ‘হ্যাঁ, তা ঠিক বলছ, প্রথমে তারা ওখানে দেখা করুক।’
– ‘হ্যাঁ তাইতো বলছি। যাও মৃদুল, গাছের নিচে যাও। ওইদিকে গাড়ি যায় আসে শুধু। ফুটপাতে দোকান বা মানুষ নেই।’
মৃদুল হেঁটে হেঁটে চলে যায়। খানিক পরেই পুনরায় ইরফানের মোবাইল বেজে উঠে।
সে রিসিভ করলো,
– ‘হ্যাঁ কোথায় আছো তোমরা।’
– ‘সার্কিট হাউজের গেইটের সামনে দেখো একটা সিএনজি।’
মৃদুল তাকিয়ে দেখে সার্কিট হাউজের সামনে একটা সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে আর ফোন কানে লাগিয়ে এক তরুণী এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। ক্লান্ত বিধ্বস্ত চেহারা।
‘ইশি থাকো আসছি’ বলে ইরফান মানহাকে ইশারা করলো। দু’জন ছুটে গেল রাস্তার অপর পাশে। মানহার বুক অকারণ ধুকপুক করছে। ইরফান সিএনজির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীকে বললো,
– ‘ইশি না-কি?’
ইশি বিস্মিয় ভরা চোখে তাকিয়ে বললো,
– ‘তুমি কে?’
– ‘আমি ইরফান।’
উত্তেজনায় ইশির চোখে পানি এসে গেল। তাড়াতাড়ি সিএনজিতে মাথা ঢুকিয়ে নেহারা বেগমকে ধরে নামিয়ে বললো,
– ‘দেখো মা ইরফান ভাই এসেছে।’
তিনি ইরফানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। সিএনজি থেকে আরেকজন যুবক বের হয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পা ফাঁক করে মানহার পাশে দাঁড়াল। তার গলায় মোটা চেইন। গেঞ্জিতে চশমা ঝুলছে। ইশি চারদিকে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছে। মানহা গলা খাঁকারি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ইশি মানহার পা থেকে মাথা অবধি তাকিয়ে বললো,
– ‘আপনি কে?’
মানহা জবাব না দিয়ে আঙুল তাক করলো দূরের গাছের নিচে। ইশি সেদিকে তাকিয়ে বললো,
– ‘কি?’
– ‘মৃদুল গাছের নিচে অপেক্ষা করছে।’
– ‘মৃদুল কে?’
মানহা নিজের ভুল বুঝতে পেরে মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘মানিক।’
‘ইরফান ভাই তোমরা মা’কে নিয়ে আসো আমি যাচ্ছে’ বলেই ইশি সেদিকে ছুটে গেল।
মুচকি হাসলো মানহা৷ ইরফান রেহানা বেগমকে গাড়িতে আবার বসিয়ে দিয়ে বললো, ‘ওই গাছের নিচে মানিক ভাই’ তারপর ড্রাইভারকে বললো, ‘উনাকে গাছের নিচে দিয়ে আপনি ওই চা’র দোকানের সামনে চলে আসবেন আমরা এক সঙ্গে চা খাব।’
ড্রাইভার সম্মতি জানিয়ে স্টার্ট দিল।
মৃদুল দূর থেকে তাকিয়ে দেখছিল সিএনজি থেকে একটা মেয়ে নেমেছে৷ মানহা আর ইরফান গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলছে। খানিক পর দেখলো একজন মহিলা নেমে ইরফানকে জড়িয়ে ধরেছে। মহিলাকে চিনতে তার ভুল হলো না। তারই মা জননী, সতেরো বছরে একদম বুড়ো হয়ে গেছেন। ইচ্ছা করছিল ছুটে যায়। তবুও নিজেকে দমিয়ে রাখে। তাদের একান্তে পাওয়া দরকার তার। একটু পরেই এদিকে ছুটে আসতে দেখে তরুণীকে। ও কি ইশি? ভাবতে ভাবতে কাছে চলে এলো মেয়েটি। সামনে এসে খানিক্ষণ থমকে দাঁড়ায়। তারপর আচমকা জড়িয়ে ধরে তাকে। নির্বাক মৃদুল৷ তার যেন সমস্ত কথা ফুরিয়ে গেছে৷ পৃথিবী যেন দুলছে। ঝাপসা হয়ে এলো চোখ। হাত রাখলো বোনের মাথায়। ইশি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
– ‘আমার জন্য এতকিছু হলো ভাই। এতকিছু একমাত্র আমার জন্য।’
মৃদুল ধরা গলায় বললো,
– ‘কিন্তু তুই তো আমার জন্যই গিয়েছিলি এমদাদ খানের কাছে৷’
সিএনজি এসে থামে তাদের কাছে।
‘মা এসেছেন’ বলে ইশি মৃদুলকে ছেড়ে সিএনজি থেকে নেহারা বেগমকে নামায়। পলকে সিএনজি চলে যায় আবার। মৃদুল মা’র দিকে এগিয়ে গেল। নেহারা বেগম আঁজলা করে ছেলের মুখ ধরলেন। কথা বলতে পারছেন না, ঝরঝর করে চোখের পানি ফেলছেন। মৃদুলও মা’কে জড়িয়ে ধরে অনবরত চোখের জল ফেলছে। ইশি রেলিঙ ধরে নদীর দিকে মুখ ফিরিয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠছে। চলন্ত গাড়ি থেকে মানুষ বিস্মিত নয়নে তাদেরকে দেখছে।
– ‘তুই এতদিন কোথায় ছিলি রে বাবা।’
– ‘রূপগঞ্জ মা, কিন্তু তোমার এ কী অবস্থা হয়েছে?’
– ‘বয়স কী কম হলো? শরীরেও রোগ বাসা বেঁধেছে।’
– ‘মা আমরা এখনও সেইফ না। ইশিকে বাঁচাতে হবে। ওকে ভালো জায়গা দেখে বিয়ে দিতে হবে।’
– ‘এখন কি করবি?’
মৃদুল ইশিকে ডেকে এনে বাঁ হাতে বুকে টেনে নিল। ডান পাশে মা। ফিসফিস করে বললো,
– ‘আমাদের আবার পালাতে হবে মা।’
– ‘আর এসব ভালো লাগে না বাবা।’
ইশি অবাক হয়ে বললো,
– ‘পালাব মানে কি? আমরা এক সাথে সতর্কভাবে থাকবো।’
– ‘তা ঠিক, কিন্তু ইরফান আর মানহা থেকে আমাদের পালাতে হবে।’
– ‘মানহা মানে? মানহা কে?’
– ‘তাসফিয়া, ইরফানের সাথে যাকে দেখলি।’
– ‘হ্যাঁ দেখেছি, কি মিষ্টি হয়েছে দেখতে। কিন্তু ওকে আবার পেলে কীভাবে?’
– ‘সে অনেক কথা, পরে বলা যাবে। এখন শোন, ওদের কাছে থেকে আজ কোনোভাবে তুই বিদায় নিয়ে চলে যেতে হবে। আর আমার নাম্বার নিয়ে যাবি। পরে কথা হবে আমাদের। তারপর কোথাও চলে যাব।’
– ‘কিন্তু ইরফান ভাই আমাদের জন্য এতো কিছু করলো তাকে আবার না বলে চলে যাব?’
– ‘ইশি তুই বুঝবি না৷ তাসফিয়া চাইবে আমাকে ঝামেলা মুক্ত করতে তাই তোকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে।’
– ‘কি বলো এসব? সে এরকম করবে কেন? এতোদিন তো কাউকে কিছু বলেনি।’
– ‘ইশি ওর মাথার তার ছিঁড়া, তুই বুঝবি না। তাছাড়া ইরফান আর ওর মা নিয়াম খানের বিরুদ্ধে আমাদের দিয়ে প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে হয়তো। মাঝখান দিয়ে তুই ফেঁসে যাবি।’
– ‘তোমার কথার আগামাথা বুঝতে পারছি না ভাই। একবার তাসফিয়া আর ইরফান ভাইকে বলে দেখো যে তুমি চাও না আমি পুলিশে ধরা দেই।’
– ‘ তাতে মানহা যদি লুকিয়ে তোকে ধরিয়ে দেয়?’
– ‘তুমি এতো অবিশ্বাস করছো কেন তাদের? একবার তো বলে দেখো।’
– ‘তুই এসব বুঝবি না ইশি, যা বলছি তাই কর। তাসফিয়া কোনোভাবেই চাইবে না আমি তোর অপরাধ কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়াই।’
– ‘আচ্ছা ঠিক আছে চলো।’
– ‘দাঁড়া আমার নাম্বার নিয়ে একটা মিসকল দে আগে।’
দু’জন নাম্বার আদান-প্রদান করে নেয়।
তারপর মৃদুল মা’কে ধরে বলে, ‘চলো ওদের কাছে যাই।’
____চলবে___