বাঁক ( ৩৩ পর্ব )

0
209

বাঁক ( ৩৩ পর্ব )
_____________
( পড়লে প্রথম পর্ব থেকে পড়ুন, মাঝখান থেকে না পড়ার অনুরোধ )

মানহা আরেক ঢোক জল খেয়ে বলতে শুরু করলো,
‘আমি আর ইরফান ভাই আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইশি এমদাদ খানের রুমে যাবার কিছুক্ষণ পরেই দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি কৌতূহলে চুপিচুপি দরজায় এসে কান পেতে ধস্তাধস্তি টের পেয়ে ইরফান ভাইকে ইশারা করলাম। কিন্তু সে ভয়ে আর এদিকে না এসে উলটো দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল। খানিক পরেই দেখি মানিক হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসেছে।’

উকিল থামিয়ে দিয়ে বললেন,

– ‘মানিককে ইরফানই দড়ি খুলে দিয়েছে গিয়ে তাইতো?’

ইরফান পাশ থেকে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি মানিক ভাইয়ের সাথে দরজার কাছে যাইনি। সিঁড়ির ওদিকে ছিলাম।’

– ‘কেন?’

– ‘আব্বা আর চাচাদের প্রচণ্ড ভয় পেতাম। তাও আবার লুকিয়ে দড়ি খুলে দিয়েছি।’

– ‘আপনি ঝুঁকি নিয়ে দড়ি খুলে দিতে গিয়েছিলেন কেন? তখন কী বুঝতেন দরজা বন্ধ করা মানে খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে?’

– ‘না, তবে মানহা ইশারা করার সময় আমিও দূর থেকে ভেতরের ধস্তাধস্তি টের পাচ্ছিলাম। ভেবেছি হয়তো চাচা ইশিকে দরজা বন্ধ করে মারছেন। তাই দৌড়ে গিয়ে মানিক ভাইকে বললাম। সে তখন খুব করে দড়ি খুলে দিতে বলে। আমিও ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে খুলে দেই।’

– ‘আচ্ছা তারপর কী দেখলেন?’

মানহাই আবার বললো,

‘মানিক এসে দরজায় ধাক্কা দেয়ার আগেই খুলে গেল। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখলাম ইশির হাতে রক্তাক্ত ছুরি।’

উকিল তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

– ‘উনিই তো ইশি।’

সবাই তাকিয়ে দেখলো তাদের পেছনের সোফায় বসে ইশি দুই হাতে মুখ ঢেকে নীরবে কাঁদছে। আফতাব তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। উকিল উঠে গেলেন চেয়ার থেকে। চেয়ার টেনে ইশির সামনে বসে বললেন,

– ‘আপনি ভেতরে ছুরি পেলেন কী করে?’

ইশি চোখের জল মুছে নিয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে বললো,

– ‘দরজা বন্ধ করে এমদাদ খান আমাকে ধরতে এলে চিৎকার করে উঠি। সঙ্গে সঙ্গে সে আমার মুখ চেপে ধরে। দু’জনের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। তখন সে পালঙ্কের নিচ থেকে ছুরি বের করে।’

উকিল থামিয়ে দিয়ে বললেন,

– ‘পালঙ্কের নিচে ছুরি কেন রেখেছিল? আপনি ওখানে যাবেন কি-না সে তো আগে থেকে জানতো না। সুতরাং আগে থেকে প্রস্তুত থাকার কথা নয়।’

– ‘এর ক’দিন আগে কোরবানি হয়েছিল। মানহা বললো না সে ঈদের ছুটিতে সুন্দরপুর গিয়েছিল। তখন ঈদ গেছে সপ্তাহ খানেক হবে। কোরবানির ছুরি পালঙ্কের নিচ থেকে তুলে রাখা হয়নি।’

– ‘ও হ্যাঁ বুঝেছি, মানে তুলবো তুলবো করে দেরি হচ্ছিল। তারপর কি হলো?’

– ‘সে অশ্লীল ভাষায় গালি আর ধমক দিয়ে ছুরি দেখিয়ে বলছিল চিৎকার করলে গলা কেটে দেবো। চোখ রাঙিয়ে বারবার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলছিল একদম আওয়াজ করবি না বললাম। চুপচাপ কাপড় খুল। কোনো ভয় নেই৷ শুধু কাপড় খুল। না হলে গলা কেটে দেবো।’

ইশি পুনরায় মুখ ঢেকে কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠলো। আফতাব পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাতে ধরাতে বাইরে চলে গেল।

উকিল তাড়া দিয়ে বললেন,

– ‘তারপর কী হলো?’

– ‘আমি ভয়ে চুপচাপ কাপড় খুলে ফেললাম। সে আমাকে কোলে তুলে বিছানায় নিল। ছুরি রাখলো বালিশের পাশে। আমি তখনই ছুরি হাতে নিয়ে নিলাম।’

উকিল তাকে থামিয়ে বললেন,

– ‘সে ছুরি এরকম বালিশের পাশে রাখবে কেন?’

– ‘ছোট দেখে হয়তো বুঝতে পারেনি আমি পালটা আক্রমণ করবো, অথবা বেখেয়ালে রেখেছিল।’

– ‘আচ্ছা তারপর?’

– ‘ছুরি হাতে নিয়েই তার বুকে ঘা মারি, খুব বেশি কিছু হয়নি। চাকুটা বুকের বাঁ পাশে একটু ঢুকেছে আর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুলো। তবুও যেন অদ্ভুত এক কারণে সে দূর্বল হয়ে গেল অনেকটা। এমদাদ এক হাতে নিজের বুক চেপে আরেক হাতে আমার গলা টিপে ধরলো। আমি পলকে ছুরি চালিয়ে দিলাম তার পেটে৷ একহাত দিয়ে আমার গলা ধরে তাকায় আমার অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার বগলে লাগলো ছুরি। তখনই সে ছেড়ে দিল আমাকে। আমি বাইরে বের হয়ে এলাম। এসে দেখি মানিক ভাই আর মানহা। ওরা আমাকে দেখে বললো চাকু হাতে কেন? কোথায় পেলি? আমি খুলে বললাম সবকিছু। ভাইয়া দৌড়ে ভেতরে গিয়ে দেখলো এমদাদ খান মারা গেছে৷’

উকিল থামিয়ে বললেন,

– ‘মানিকের তখন বয়স কত হবে?’

– ‘আমাদের সবার বড়ো ছিল। আনুমানিক চৌদ্দ হবে।’

– ‘আচ্ছা তারপর?’

– ‘তারপর মানিক ভাই আমার হাত থেকে ছুরি নিয়ে বললো তোর হাত আমার গেঞ্জিতে মুছে নে তাড়াতাড়ি। আমি তখন একটা ঘোরের ভেতর ছিলাম। কথামতো তাই করলাম। মানিক ভাই তখন মানহাকে মানে ওকে সবাই তখন তাসফিয়া ডাকতো আরকি। তাকে বললো তাসফিয়া কাউকে তুমি বলবে না ইশি খুন করেছে। তাসফিয়া তখন বললো তাহলে কী বলবো? ভাইয়া বললো বলবে মানিক কীভাবে দড়ি খুলে এসে চাকু দিয়ে খুন করেছে আমি জানি না। শুধু দেখেছি ওই ঘরে ঢুকে ছুরি হাতে বের হতে।’
ততক্ষণে বাড়ির মানুষ এদিকে আসতে থাকে। ভাইয়া চাকু তাক করে সবাইকে ভয় দেখিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। এরপরের সবকিছু ইরফান ভাই বললেই ভালো হবে।’

উকিল উঠে গেলেন নিজের চেয়ারে।

– ‘ইরফান সাহেব এবার আপনি বলুন। যেহেতু আপনি ওই বাড়িরই ছেলে।’

ইরফান বলতে শুরু করলো,

‘আমি তখন ভয়ে কাঁপছিলাম। কারণ কেউ যদি জানে আমি মানিক ভাইকে দড়ি খুলে দিয়েছি তাহলে আব্বার মাইর খাব। বাড়িতে তখন হট্টগোল শুরু হলো। বাবাকে ফোন দিয়ে জানানো হলো এমদাদ চাচা খুন হয়েছেন।’

উকিল থামিয়ে বললেন,

– ‘আপনার বাবা মানে চেয়ারম্যান তাইতো?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘তারপর বলুন।’

– ‘বাবা তাড়াতাড়ি বাড়িতে আসার পর সবাইকে জিজ্ঞেস করলেন কী হয়েছে? মা বললেন সবকিছু তো জানি না। তবে ইরফান ছিল ওকে ভালো করে জিজ্ঞেস করতে হবে। বাবা আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে বল। আমি ভয়ে সব সত্য কথা বলে দিলাম। বললাম ইশি গিয়েছিল চাচার ঘরে। তিনি দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারপর ইশি দেখেছি ছুরি হাতে বের হয়েছে।’

উকিল তাকে থামিয়ে বললেন,

– ‘কিন্তু মানিক তো তোমাদের অন্যকিছু শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।’

– ‘আমি সিঁড়ির ওখান থেকে শুনিনি। অবশ্য মানহা তখন প্রতিবাদ করে পাশ থেকে বাবাকে বললো না না মানিক এসে উনাকে খুন করছে। বাবা তখন ইশিকে ডাকলেন। নেহারা আন্টি আর ইশি এলো। ইশিকে জিজ্ঞেস করতেই সে কেঁদে কেঁদে বলে দিল তাকে চাচা ছুরি দেখিয়ে কাপড় খোলার ভয় দেখিয়েছিলেন। বাবা তখন মানহাকে ডেকে নিয়ে ধমক দিয়ে বললেন,
– ‘তুমি কেন বলেছিলে মানিক খুন করেছে?’
ধমক খেয়ে সে বলে দিল মানিক শিখিয়ে দিয়েছিল বলতে। তখনই আব্বার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। ইশিদের যেতে বললেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সবকিছু বাইরে প্রকাশ পেলে ইজ্জত যাবে। বাড়ির সবাইকে বললেন লোকজনকে বলতে এমদাদ চাচাকে মানিক খুন করে পালিয়েছে। কেন খুন করেছে তারা জানেন না।
মা তখন বললেন,
– ‘ওর মা-বোন তো সবাইকে বলে দেবে সত্য কথা।

‘সেটা পরে দেখা যাবে’ বলে বাবা কল দিলেন ওঝা দাদা আর মেম্বারকে। আমি চুপিচুপি গিয়ে নেহারা আন্টিকে সবকিছু বললাম। তারা কেন যেন ভয় পেয়ে গেলেন। যেহেতু ইশি খুনি তাই আন্টি পালিয়ে যাওয়াটাই বেছে নিয়েছিলেন। সকলেই হঠাৎ দেখলো ওরাও নেই। ওঝা দাদা সব সময়ই তাদেরকে বুদ্ধি দিতো। বাবা আর মেম্বার তার পরামর্শ কানে নিতেন বেশি। সে বললো এমদাদের কান কেটে সরিয়ে ফেলো।
বাবা আর মেম্বার অবাক হয়ে বললেন,
– ‘কেন?’
ওঝা তখন বললো এই খুন কেন হয়েছে পুলিশ ছেলেটিকে ধরার আগ পর্যন্ত জানতে পারবে না৷ কিন্তু পরিবার সহ পালিয়ে যাওয়ায় সে খুন করেছে এলাকার মানুষ সহ সবাই জানবে। এখন তার খুনের আলাদা একটা ধরন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাহলে এই ধরনের যত খুন হবে পুলিশ তাকে সন্দেহ করবে। আর আমাদের গাঁজার ব্যবসা, কবিরাজি, আপনি চেয়ারম্যান আর ইউনিয়নে আমাদের লোকদের মেম্বার বানানো সবকিছুর জন্য প্রায়ই খুন-খারাবীর সঙ্গে জড়াতে হয়। আমরা নিজেদের কাজে খুন করে কান কেটে ফেলবো। পুলিশ খুঁজবে ওই ছেলেকে৷ ওঝার কথামতোই সবকিছু করা হয়। আমাদের জঙ্গলের পরিত্যক্ত বাড়ি হলো অবৈধ সবকিছুর কারখানা। জঙ্গলের পেছনের দিকে নদী থাকায় তাদের আরও সুবিধা হয়েছে। চোরাই পথের সবকিছু এনে এখানে সহজে রাখা যায়। তাছাড়া পুরো ইউনিয়নে তখন কবিরাজির ব্যবসা ছিল। তারা একটা চক্র মিলে কবিরাজের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে দিতো। শত শত মানুষ নানান অসুখ-বিসুখ নিয়ে হাজির হয়। প্রতিদিন একেকটা এলাকায় হাজার হাজার টাকা ইনকাম। তাছাড়া বর্ষাকালে ট্রলার দিয়ে ডাকাতি। এরকম সবকিছুতে কেউ বাঁধা দিলে প্রায়ই তাদের খুন করতে হতো। তারা খুন করে দুই কান কেটে নিতো। পুলিশ তখন মানিক ভাইয়ের খুনের সাথে সাদৃশ্য পেয়ে তাকেই খুঁজে বেড়াতো।’

উকিল এক ঢোক পানি খেয়ে বললেন,

– ‘বুঝেছি, এখন আপনি বলুন এইসব কথা আদালতে কী বলতে পারবেন?’

– ‘হ্যাঁ অবশ্যই বলবো আমি।’

– ‘নিজের বাবার বিরুদ্ধে?’

– ‘শুধু আমি না, আমার মাও দেবেন সাক্ষী। তাছাড়া মানহাও আছে।’

– ‘তাহলে এতদিন দেরি হলো কেন?’

– ‘সত্যি কথা বলতে আমার বাবার সঙ্গে মায়ের তখন মিল ছিল। আমিও মানিক ভাইদের খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’

– ‘আচ্ছা বুঝেছি, আপনি আর আপনার মা যদি সাক্ষী দেন কেসটা আমার জন্য খুবই সহজ হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ইশি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। তার উপর আত্মরক্ষার জন্য খুন করেছে।’

– ‘আমরা সাক্ষী দিতে প্রস্তুত আছি।’

___চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here