বাঁক ( ৩৪ পর্ব )

0
186

বাঁক ( ৩৪ পর্ব )
_____________

এডভোকেট মাহবুবুল আলমের কথাই ঠিক হলো। মামলা কোর্টে উঠার পর খুব সহজেই তিনি জিতে গেলেন। ইরফান এবং তার মায়ের সাক্ষী দেয়ার পর বাদী পক্ষের উকিলের কিছুই করার থাকলো না। উলটো প্রকাশ পেয়ে গেল সুন্দরপুরে চেয়ারম্যানের আধিপত্য। পত্র-পত্রিকায় উঠে এলো তার অবৈধ সকল ব্যবসা। মেম্বার, চেয়ারম্যান এবং ওঝা সহ সবাইকে আইনের আওতায় আনা হলো। মৃদুল সসম্মানে মুক্তি পায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক বালিকা আত্মরক্ষার জন্য খুন করায় ইশিরও কোনো শাস্তি পেতে হলো না।
এরপর ঘটে গেল কিছু সিনেমাটিক ঘটনা। অভিমানে টইটম্বুর মানহা কোর্ট থেকেই উধাও হয়ে গেল।
বাইরে এসে ইরফান তাকে কল দিলো,

– ‘মানহা তুমি কোথায়?’

– ‘ইরফান ভাই আমি বাসে। জলেস্বরী যাচ্ছি আমি। ওখানে আর থেকে কী হবে? জেলে যাওয়ার আগে তো ওরা আমাদের থেকে পালিয়েই গিয়েছিল। তাই মুক্তি পেয়ে গেছে দেখে নিজেই চলে যাচ্ছি। তুমিও চলে যাও বাসায়।’

ইরফানেরও অভিমান লোমশ বিড়ালের মতো নাড়া দিয়ে উঠলো।

– ‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। আমিও বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছি।’

সে ওদের কাছে গিয়ে ঘড়ি দেখে বললো,

‘তাহলে মা’কে নিয়ে আমি এখন যাচ্ছি, ভালো থাকো তোমরা’ কথাটি বলে তার মা আর স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা গাড়ি ডেকে চলে গেল। মৃদুল বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ইশি ইতিউতি করে বললো,

– ‘ইরফান ভাই এভাবে বিদায় নিয়ে চলে গেল কেন? আর মানহাও হুট করে কোথায় চলে গেল?’

– ‘বুঝতে পারছি না।’

– ‘আচ্ছা ইরফান ভাইয়ের হয়তো কোনো কাজ আছে। সে তো বিদায় নিয়েই গেল, আমি বরং মানহাকে কল দিয়ে দেখি।’

মৃদুল মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আফতাব গাড়ি নিয়ে এসে বললো,

– ‘গাড়িতে বসেই কল দেয়া যাবে। আন্টিকে নিয়ে উঠো।’

সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। ইশি মানহাকে দুইবার কল দিতেই রিসিভ হলো,

– ‘হ্যালো।’

– ‘মানহা তুমি কোথায়?’

– ‘ইশি আমার একটা জরুরি দরকার পড়ায় চলে এসেছি। তোমাদের যেকোনো প্রয়োজন হলে নির্দ্বিধায় সব সময় বলবে। এখন রাখছি।’

– ‘বলেই তো যাওনি, কোনো সমস্যা?’

– ‘আরে না, এতদিন চেম্বার রেখে তো মামলার জন্য ছোটাছুটিতে ছিলাম। আজ জরুরি দরকার পড়লো। ওদিকেও সবকিছু সমাধান তাই চলে এলাম। তোমাদের একটু পর কল দিয়ে ঠিকই বলতাম।’

– ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে।’

ইশি ফোন রেখে দিল। মৃদুল তাকিয়ে বললো,

– ‘কী হয়েছে?’

– ‘কি জানি ওর দরকার তাই চলে গেছে।’

‘ও আচ্ছা’ বলে মৃদুল আনমনা হয়ে গেল। মানহার নিশ্চয় অনেক ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। তার জন্য মামা-মামীর সঙ্গে মনমালিন্য হয়েছিল। তবে এগুলো দীর্ঘস্থায়ী নয়। সুতরাং তার শক্ত থাকতে হবে।
ওদিকে ফাতিহার কি অবস্থা কে জানে।
পুলিশের মাধ্যমে তাকেও গ্রেফতারের খবর জানিয়েছিল। ইশিকেও নাম্বার দিয়েছে। জেলে থাকতে শুনেছে ফাতিহা অন্তঃসত্ত্বা। এই সময়ে সে একা।

– ‘ফাতিহার সাথে তোর কথা হয়?’

– ‘হ্যাঁ ডেইলি কল দিয়ে তোমার খোঁজখবর নিয়েছে। তারও শরীর খারাপ। নয় মাসে পড়লো মনে হয়।’

– ‘মানহাকে বলিসনি তো বিয়ের কথা।’

– ‘তুমিই তো না করলে।’

– ‘হ্যাঁ।’

মৃদুল হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু পুনরায় আনমনা হয়ে যায়। বিয়ের কথা মানহা জানলে তাকে প্রতারক স্বার্থপর ভাববে। তবুও তাকে জানানো উচিত। সহজে তার আশা ছাড়তে পারবে সে। এমনিতেই আবেগের বশে মানহকে অনেক প্রশ্রয় দিয়েছে। কিছুটা আবেগ আর কিছুটা স্বার্থ। সব মিলিয়ে মানহার জন্য জটিল হয়ে যাবে তাকে ভোলা। সেও যে মানহাকে পছন্দ করে না তাও না। তারও ভালো লাগে মানহাকে। সেটা হয়তো ভালোবাসাও। তবুও সে বিবাহিত। ওর থেকে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই মঙ্গল। সিএনজি চলে এলো খেয়াঘাট। তারা পৌঁছে গেল আফতাবের বাড়িতে।

প্রায় এক সপ্তাহ পর আফতাবের বাবা-মা এলেন। ইশিকে দেখে তাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সবচেয়ে বড়ো কথা আফতাব নিজ থেকে বিয়ে করতে চাচ্ছে। ছেলে সংসারী হবে তাতেই তারা খুশি। আফতাব সব সময়ই ছন্নছাড়া ছিল। নেহারা বেগম আর মৃদুলের সঙ্গে তারা বিয়ের ব্যাপারে কথা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করে নিলেন। বিয়ে হবে আগামী শুক্রবার। বিয়ে খুবই ঘরোয়া ভাবেই হবে।
এর ভেতরে ফাতিহাকে গিয়ে দেখে এলো মৃদুল। তাকে এই অবস্থায় বিয়েতে আনা গেল না। ইশি মোবাইলে নেহারা বেগমকে দিয়ে ইরফান এবং মানহাকে বিয়ের দাওয়াত দিয়েছে। দু’জনই আসবে মনে হলো।

কিন্তু বৃহস্পতিবার বিকেলেই মৃদুল খবর পায় ফাতিহার অবস্থা খুবই খারাপ। তাকে সদর হসপিটাল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। মৃদুল ছুটে যেতে হলো রূপগঞ্জ।
জুম্মার পরেই চলে এলো মানহা আর ইরফান। খেয়াঘাটে এসে ইশিকে তারা কল দেয়৷ ইশি আফতবাকে পাঠায়। আফতাব ভোরে উঠে সেলুনে গিয়ে মুখ সেভ করেছে। চুল কেটেছে। তার আজ এমনিতেই নিজেকে কেমন নতুন বর মনে হচ্ছে। সবার সামনে যেতেই বিব্রতবোধ করছে। মানহা আর ইরফানকে খেয়াঘাটে গিয়ে পেল। ইরফান কালো প্যান্টের সঙ্গে সাদা শার্ট ইন করে পরেছে। তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললো,

– ‘মানিক ভাই কোথায়? আজ আপনার বিয়ে আপনাকেই আসতে হলো।’

আফতাব এমনিতেই বিব্রতবোধ করছিল। তার উপর আবার সরাসরি বিয়ের কথা এসে গেল।

– ‘ভাবি গুরুতর অসুস্থ তাই চলে যেতে হলো।’

মানহা পাশ থেকে বললো,

– ‘ভাবি অসুস্থ মানে?’

– ‘মানিক ভাইয়ের বউ।’

– ‘হোয়াট! সে আবার কবে বিয়ে করলো।’

আফতাব আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আপনারা জানেন না?’

ইরফান মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘না জানতাম না, আচ্ছা হাঁটুন।’

তারা আফতাবের পিছু পিছু এলো বিয়ে বাড়িতে। মানহার বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুই। আফতাব হয়তো ভুল বলেছে। বাড়িতে আসার পর সামনের রুমে তাদেরকে বসতে দেয়া হলো। মানহার অশান্তি লাগছিল। সে চুপিচুপি রুম থেকে বাইরে এসে বারান্দার এক মাথায় গিয়ে মৃদুলকে কল দেয়। দুইবার রিং হয়ে কেটে এলো। মানহা দাঁত কটমট করে আবার দেয়। ওপাশ থেকে রিসিভ হলো।

– ‘হ্যালো মানহা।’

– ‘বিয়ে বাড়িতে এসে তুমি নেই দেখে কল দিলাম।’

– ‘ও আচ্ছা, একটু সমস্যার কারণে থাকতে পারিনি।’

‘সমস্যাটা কী’ মানহার জিজ্ঞেস করতে ভয় করছে। যদি ঘটনা সত্য হয় তাহলে সে মেনে নিতে পারবে না। তবুও অনেক সাহস সঞ্চয় করে বললো,

– ‘তোমার স্ত্রীর এখন কি অবস্থা?’

মৃদুল খানিক নীরব রইল। তারপর স্বাভাবিক হয়ে বললো,

– ‘আসলে ওর বাচ্চা ডেলিভারির সময় এখনও আসেনি। তবুও হঠাৎ ব্যথা করায় হসপিটাল নিয়ে এসেছি।’

মানহার হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেল। সে গ্রিলে শক্ত করে ধরে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সবকিছু ঘোলাটে দেখছে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল দ্রুত। মোবাইল আস্তে আস্তে হাতে নিয়ে সাবার সামনে চলে গেল। বিয়ে পড়ানো শেষ হয়েছে তিনটার আগে। ভোজন পর্ব শেষে ইরফান আর সে বিদায় নিয়ে বের হতে হতে আছরের আজান হয়ে গেল। খেয়া পার হয়ে ইরফান বন্দর এসে তাকে বাস স্টেশনের সিএনজিতে তুলে দিয়ে বললো,

– ‘মা’কে নিয়ে কয়দিন পর নানাবাড়িতে যাব, তখন দেখা হবে।’

মানহা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বিদায় দেয়। বাসে এসে বসলো জানালার পাশে।
মৃদুলের ব্যাপারে সবকিছু সে ছোট খালাকে বলেছে। তারা রাগারাগি করলেও শেষপর্যন্ত বুঝেছেন মানহা বিষয়টির সঙ্গে খানিকটা জড়িত। তাকে কেন্দ্র করেই এসব হয়েছে৷ তাই আবেগ থেকে হয়তো বাড়াবাড়ি করেছে। সবকিছু বাদ দিয়ে এখন সুন্দর করে যেন চলে এটাই তাদের শেষ কথা। এই এক সপ্তাহ মানহাও মামা-মামীর সঙ্গে ঝামেলাহীম কাটিয়ে দিয়েছে। এলাকার লোকজন বাঁকা চোখে তাকায়। আড়ালে নানান গল্প করে সবকিছু সে এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু আজ আবার নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে। একটা প্রতারক স্বার্থপরকে সে ভালোবেসেছে? এই মানুষটিকে নিয়ে সে সংসার করার স্বপ্ন দেখতো? ওর জন্য সে এলাকার মানুষের কাছে দুশ্চরিত্রা হয়েছে। মানহা আর ভাবতে পারছে না। জানালার পাশে সে বসেছে। পাশে আরেকজন মহিলা। আর কান্না পাওয়ার বুঝি সময় পেল না? মানহা জানালার বাইরে চোখ রাখে। বুড়ো আঙুল দিয়ে আলগোছে চোখের জল মুছে নেয়। গোধূলি পেরিয়ে অন্ধকার রাত হয়ে গেল জলেস্বরী আসতে। সোজা রিকশা নিয়ে চলে গেল নানাবাড়ি৷ গ্রিল খুলে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। বালিশে মুখ চেপে বোবা কান্নায় বারবার কেঁপে কেঁপে উঠলো। সেই ছোটবেলা থেকে মানুষের অবহেলা, অনাদর পেয়ে বড়ো হয়েছে। বাবা থাকলেও দেখা হয়নি কতটা বছর হয়ে গেল। মামীর হাজার রকম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে মুখবুজে। সব সময় যেন একজন মানুষেরই অপেক্ষা করেছিল সে। সেই মানুষটাই ছিল মৃদুল। নিজের সকল আবেগ অনুভূতি এই মানুষটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছিল। তাকে পাওয়ার পর মনে হয়েছিল মায়ের পরে সবচেয়ে আপন মানুষটাকে পেয়ে গেছে সে। আর এই মানুষটাই তার সঙ্গে প্রতারণা করলো? বিবাহিত হয়ে তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করেছিল এতদিন? কেন এমনটা করলো সে? দুশ্চরিত্রার সঙ্গে চললে লোকে তাদেরও খারাপ বলবে ভেবে আজকাল বান্ধবীরা তাকে এখন এড়িয়ে চলে। এলাকার মানুষদের সাথে তো মিশতেই পারবে না। এসব ভেবেই একা কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিল রুমে। মামী এসে রাতের খাবারের সময় ডাকলেন৷

– ‘এই মানহা খাইতে আয়, আইসাই দরজা বন্ধ কইরা শুইয়া পড়লি কেন?’

– ‘মামী আমি খাব না মাথা ব্যথা করছে।’

– ‘আরও কতকি তোমার করবো। আর কত নাটক দেখাইবা আল্লা কে জানে।’

কথাগুলো বলতে বলতে তিনি চলে গেলেন। মানহার ভীষণ অসহায় লাগছে। খুবই একা মনে হচ্ছে নিজেকে। মৃদুল জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সে অভিমান করে চলে এলেও আশা ছিল এখন ঠিকই তাকে বিয়ে করবে। আর তো কোনো সমস্যা দেখছে না সে। আগে পালিয়েছিল ইশির নিরাপত্তার জন্য। সুতরাং সকল সমস্যা এক সপ্তাহ মুখবুজে সহ্য করেছে। এবার কী হবে তার? লোকে খারাপ কথা বললে কীভাবে মানিয়ে নেবে সে? এভাবে রাত তিনটা হয়ে গেল। মানহার চোখে ঘুম নেই। আচমকা মনে হলো এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে মায়ের মতো দুনিয়া থেকে চলে গেলে। উঠে টেবিলে গেল সে। খাতা আর কলম নিয়ে খানিক্ষণ আঁকিবুঁকি করলো। তারপর একটা খালি পাতায় লিখলো,
আমাকে তুমি অনেক কিছু দিয়েছো মৃদুল,
দিয়েছো অবহেলা, অনাদর আর প্রণয়ের নামে ছল,
আমার কাফনে মোড়ানো লাশ দেখে শেষ বিদায়ে দেবে কী?
তোমার চোখের চুইয়ে পড়া একটুখানি জল।

____চলবে___ ( যারা লিঙ্ক থেকে পড়ছেন, তারা আশাকরি পেইজ ফলো করে যাবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here