বাঁক ( ৯ম পর্ব )

0
196

বাঁক ( ৯ম পর্ব )
_______________

মানহা ঈষৎ সময় নিয়ে কিছু একটা ভেবে স্মিথ হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা সবকিছুই বলবো, এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই।’

– ‘হ্যাঁ, তাহলে বলো।’

– ‘আমরা বেলকনিতে কফি নিয়ে বসে কথা বলি? যেহেতু দু’জনই ক্লান্ত, কফি খেলে ভালো লাগবে।’

– ‘তুমি এতো রহস্য করছো কেন বুঝতে পারছি না মানহা।’

– ‘হু, আমারও তাই মনে হচ্ছে৷ এখনই সবকিছু খুলে বলা দরকার।’

– ‘তাহলে বলছো না কেন?’

– ‘তুমি বেলকনিতে গিয়ে চেয়ার নিয়ে বসো, আমি কফি বানিয়ে নিয়ে আসছি।’

মৃদুল খানিক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে তাড়াতাড়ি আসো।’

সে বেলকনিতে চেয়ার নিয়ে বসে। মস্তিষ্কে চিন্তার ঝড় বইছে। মেয়েটি আসলে কে? নিশ্চয় পরিচিত, শুধু পরিচিতই না। যতদূর বুঝা যাচ্ছে এই মেয়েটি তার জন্য রাহু নয়। বিন্দুমাত্র ক্ষতি করবে না। এমন একজনের বড্ড দরকার ছিল। যে তার সবকিছু জেনেও কোনো ক্ষতি করবে না। যার সঙ্গে লুকোচুরি করা অনাবশ্যক। যে চাইলেই তাকে সহযোগিতা করতে পারবে। সুতরাং মানহা যেইই হোক ওর সঙ্গে ভালো রকম মিশতে হবে। যা চায় তাই করতে হবে। অবশ্য আগেই বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখায় একদিক থেকে ভালোই হয়েছে৷ অযুক্তিক হলেও যতটুকু মনে হয়ে কোনো এক কারণে মেয়েটি তাকে পছন্দ করে। সুতরাং এটাই প্রধান হাতিয়ার। শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, বিশ্বস্ত একজন মানুষ পাশে পেলে অনেক কিছুই সহজ হবে। অতি অল্প সময়ে সে মনস্থির করে নেয় মানহা যা চায় সে তাই করবে। অন্তত অভিনয় করে যাবে। কারণ সতেরো বছরের ভ্রাম্যমাণ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সে যতটুকু বুঝতে পেরেছে বিনিময় ব্যতীত কেউ সহযোগিতা করে না। ‘কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়’ প্রচলিত এই কথা বড়ই বাস্তবিক।

– ‘কফি নাও।’ মানহার কথায় মৃদুল ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে আসে।

– ‘হ্যাঁ, দাও।’

মানহা ওর দিকে কাপ বাড়িয়ে দিয়ে নিজেও চেয়ারে বসে কফিতে চুমুক দেয়। মৃদুল কাপ হাতে নিয়ে মানহা মুখের থেকে কিছু শোনার জন্য চতক পাখির মতো অপেক্ষা করে।

– ‘আমি তোমার রক্তের সম্পর্কের কেউ না। তুমি আমাকে আশাও করছো না৷ বরং আমার পরিচয় দিলে এতদিন ভণিতা করেছি বলে রাগও করতে পারো।’

– ‘মানহা তুমি যেইই হও আমার কাছে তুমি গুরুত্বপূর্ণ, সবকিছু আমাকে খুলে বলো প্লিজ।’

– ‘এতদিন অতিরিক্ত দুষ্টামি করার কারণে আমি দুঃখিত। বারবার মনে হচ্ছিল দুষ্টামি করা ঠিক হচ্ছে না৷ তবুও তুমি চিনতে পারছো না দেখে মজা করার লোভ সমলাতে পারিনি।’

– ‘আচ্ছা সমস্যা নেই বলো।’

– ‘মৃদুল আমি খুব বেশি ধার্মিক না হলেও বিশ্বাসী মানুষ। আমি বিশ্বাস করি এই জগতের সবকিছু কারও ইশারায় চলে। আমাদের সম্পর্কটা তেমনই কারও সাজানো। যেকেউ শুনলে বলতে পারে এগুলো কাকতালীয়৷ কিন্তু না, আমার মনে হয় এটা অদৃশ্যের ইচ্ছায় হচ্ছে। তুমি হারিয়ে গেলে। বিচ্ছিন্ন একজন মানুষ, পরিবারকে খুঁজে পাচ্ছ না। অথচ দেখো এতো বড়ো পৃথিবীতে, অসংখ্য মানুষের মধ্যে আমার সঙ্গে তোমার সাক্ষাৎ হয়ে গেল। তারপর দেখো, আমি তোমার সঙ্গে আজ স্টেশনে গেলাম। আসার পথে ঠিকই অজ্ঞান হয়ে ফিরতে হয়েছে, এটা কী কাকতালীয় বলো? ছোটবেলার কথা মনে আছে তোমার? আমার বয়স সাত থেকে আট হবে তখন। তোমার হবে তেরো বা চৌদ্দ। ঠিক এভাবেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম আমি। তুমি আমাকে পাঁজাকোলা করে ভূতের বাড়ি থেকে ঢালু রাস্তা দিয়ে ফিরেছিলে। মৃদুল তুমি বিশ্বাস করবে না। কত যুক্তি দাঁড় করাবে তুমি কিংবা লোকজন। কেউ কেউ পাগলামি বলবে। কিন্তু সত্য হচ্ছে, আমি এই সতেরোটা বছর তোমার জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করেছি। ওই ছোট্ট মেয়েটির মাথায় মানিক নামটি গেঁথে রয়েছিল। আমার অবেচতন মন বলতো তোমাকে একদিন পাবো। কীভাবে পাব আমি জানতাম না। আমি কেবল বিশ্বাস করতাম পাব। আমি প্রতিটি ক্ষণে তোমার এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দায়ী করে আসছি। আমার জন্যই কেবল তোমার এই যন্ত্রণার জীবনকে যাপন করতে হয়েছে। আর হ্যাঁ, শুধু আমিই তো আসল ঘটনাটা জানি। পেপার পত্রিকা আর লোকমুখে পিচ্চি মানিক নামে কত আজগুবি মিথ্যে গল্প শুনি। তবুও আমি মুখ খুলে বলতে পারি না এগুলো মিথ্যে। কারণ তুমিই যে আমাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছিলে সেদিন।
আমার সব সময় মনে হয় এই ঘটনাটা তো আমাকে কেন্দ্র করেই হয়েছিল।
তাই এখন তোমার সকল পরিস্থিতির, বিপদের, দুঃখের ভাগীদার আমি হতে চাই মৃদুল। আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি বিয়ে করবো তোমাকে৷ লুকিয়ে রাখবো নিজের বুকের ভেতর৷ মানিক নামে কেউ নেই এই পৃথিবীতে। তুমি আমার স্বামী হয়ে বাঁচবে, আমার মৃদুল হয়ে। আমি শুনেছি তুমি সবাইকে বলো এক ফকির তোমায় রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিল। তোমার জন্ম পরিচয় জানো না। ব্যস, এটাই তোমার পরিচয় থাকুক। এভাবেই তুমি নতুন করে বাঁচবে আমার সঙ্গে।’

মৃদুল বিস্মিত হয়ে চেয়ার থেকে উঠে ওর সামনে গিয়ে বললো,

– ‘তুমি ইরফানদের বাড়ির সেই মেহমান মেয়েটি তাই না? কিন্তু তোমার নাম তো মানহা না, আরও কী যেন।’

– ‘স্কুলের সার্টিফিকেটে আমার নাম মানহা, ছোটবেলায় সবাই ডাকতো তাসফিয়া।’

– ‘হ্যাঁ তাইতো, কিন্তু কী আশ্চর্য আমি তো একটুও চিনতে পারিনি, তুমি চিনলে কী করে?’

– ‘আমি তখন বেশি হলে আট বছরের ছিলাম। এখন পঁচিশ বছর। মেয়েদের চেহারার পরিবর্তনও হুট করে বেশি হয়। আর তুমি তখনও অনেকটা বড়ো ছিলে। তাছাড়া গঠন খুব একটা বদলায়নি। চোখের নিচের কালো তিলটাও আছে।’

মৃদুল ওর হাত দু’টা ধরে বললো,

– ‘মানহা সেদিন আমি পালিয়ে গেলাম৷ তারপর আমার মা বোন কোথায় গেল? তাছাড়া পত্রিকায় পিচ্চি মানিক এতো প্রতিষ্ঠিত হলো কীভাবে? আমি তো এতো বছর সাধারণ মানুষের জীবন যাপন করেছি। এসব ঘটনার সাথে আমার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই।’

– ‘তখনও কিন্তু পিচ্চি মানিক কিছুই করেনি।’

– ‘মানহা আমি তোমার পায়ে ধরি, তুমি ওই কথাগুলো কাউকে বলবে না৷’

– ‘এতো বছর কিন্তু বলিনি।’

– ‘হ্যাঁ, আমাকে কখনও পুলিশে ধরে নিয়ে গেলেও তুমি সত্য কথা কাউকে বলবে না।’

– ‘পা ছাড়ো, আমি এখনও কাউকে বলিনি।’

মৃদুল উঠে দাঁড়ায়, আঁজলা করে মানহার মুখ ধরে বলে,

– ‘মানহা তুমি পড়ালেখা করে অনেক বড়ো হয়েছো। দেশ, রাজনীতি, আইন কতকিছু জানো।
আমি সারাজীবন আজকের রাতের মতো তোমাকে নিয়ে ঘুরবো ফিরবো৷ ছোটবেলার মতো তোমার সকল আবদার পূরণ করবো, তুমি শুধু আমার মা বোনকে খুঁজে বের করে দেবে? আমার এখন আর পালাতে ইচ্ছা করে না মানহা। পুলিশ ধরলে ধরুক, শুধু নিজের মা বোনকে চাই।’

– ‘তা কীভাবে?’

– ‘আমিই বলবো কীভাবে খুঁজতে হবে, তুমি হেল্প করবে না বলো?’

মানহা আচমকা উঠে দাঁড়ায়। মৃদুলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। তার নগ্ন লোমশ বুক চোখের জলে ভিজিয়ে দিয়ে ধরা গলায় বলে,

– ‘কীভাবে ভাবো আমি তোমাকে হেল্প করবো না? আমি সুন্দর পুরের ওই সুন্দর দিনগুলোর কথা আজও ভুলতে পারি না। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিনগুলো এক এক বের করলে দেখা যাবে তোমার উপহার দেয়া সেদিনগুলোই শুধু আছে। আজ রাতের কথাই ধরো, তোমার সঙ্গ ছাড়া এমন উপভোগ্য হতো বলো? তুমি অন্যরকম মানুষ, এতটা বছর আমি মন খারাপ থাকলেই কল্পনায় তোমার মুখটা দেখতাম।
তুমি মানেই যেন অপার্থিব কিছু। স্কুল, কলেজ থেকে শুরু করে কত স্মার্ট সুদর্শন ছেলের সঙ্গে ওঠা-বসা হলো আমার। তবুও কেউ যেন তোমার মতো নয়।
আজও আমার সবকিছু কেমন স্পষ্ট চোখের সামনে ভাসে। তোমার পালিয়ে যাবার সিনেমাটিক দৃশ্যটা গেঁথে আছে মস্তিষ্কে।
আমি এতদিন বিয়েটা অবধি করিনি। আমার মাথায় যে ছোটবেলা থেকেই তুমি গেঁথে আছো। একজনের জায়গায় আরেকজন কীভাবে আসবে।
কেউ না জানুক, আমি যে সবকিছু জানি। তুমি যে বাস্তব জীবনের হিরো।’

– ‘মানহা শান্ত হও, আমি তো এখন তোমার কাছেই আছি, তুমি যা বলবে তাই হবে।’

– ‘মৃদুল, আমার এখানে কাজ করলে তুমি আপাতত সেইফ। কিছুদিন আগেও একটা গ্রামের ঘটনার সঙ্গে পুলিশ পিচ্চি মানিকের মিল খুঁজে পায়। ডিবি পুলিশ হন্যে হয়ে খুজে বেড়াচ্ছে তোমাকে।’

– ‘হ্যাঁ, আমি সবকিছু জানি মানহা। আমি শুধু আমার মা বোনকে খুঁজে বের করার আগপর্যন্ত পুলিশের কাছে কোনোভাবেই ধরা পড়তে চাই না।’

– ‘তুমি ধরা পড়বে না মৃদুল। তুমি এখানে থাকবে আর আমার সঙ্গে কাজ করবে।’

– ‘কিন্তু আমরা এক সাথে থাকলে তো লোকে সন্দেহ করবে।’

– ‘আমি এখানে থাকবো না, তুমি একা থাকবে। আর কিছুদিনের ভেতরেই আমরা বিয়ে করে নেব।’

মৃদুলের মাথায় সঙ্গে সঙ্গে একটা বুদ্ধি উদয় হলো। যতটুকু সম্ভব বিয়ে এবং শারীরিক সম্পর্ক থেকে দূরে থাকতে হবে তার।

– ‘মানহা আমরা এখনই বিয়ে করা ভুল হবে।’

– ‘কেন?’

– ‘একটা ডাক্তার মেয়ে রাস্তার কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেকে বিয়ে করেছে এটা লোকে সহজে হজম করতে পারবে না, ঘাটাঘাটি শুরু করবে। উল্টো আমার ঝামেলা হবে।’

– ‘তাহলে?’

– ‘আমরা পরে বিয়ে করবো। আপাতত এরকম গোপন সম্পর্ক থাকুক।’

– ‘ঠিকাছে।’

– ‘এখন রুমে চলো।’

মৃদুল চেয়ার দু’টা নিয়ে যাচ্ছে। মানহা কাপ নিয়ে পিছু পিছু আসে। মৃদুলের নগ্ন পিঠের দিকে পিটপিট করে তাকায়৷
চওড়া বুক, দুই হাতের বাহু শক্তপোক্ত, পেটানো শরীর। মানহার বুকটা শিরশির করে উঠে। লোকটা কতটা বছর আপনজন ছাড়া দেশে দেশে ঘুরছে। কোনো না কোনোভাবে তো সেও এর জন্য দায়ী। তাছাড়া আজ তাকে কত যত্নে কাঁধে করে রেলস্টেশন নিয়ে গেল। বমি করার পর একটুও ঘেন্না না করে কোলে তুলে নিল। এমনও বুঝি মানুষ পুরুষ হয়? আমার বাবা তো এমন না? মায়ের সঙ্গে কত অবিচার করেছেন। অবশ্য মৃদুল ছোটবেলায়ও এমন ছিল। কেমন যেন, মানুষটা অন্য রকম। একটুও বদলায়নি। মৃদুলের সকল দুঃখ, বিষাদ কী চুষে নিতে পারবে না সে? ওর জীবনটা কী একটু রাঙিয়ে দিতে পারবে ভালোবাসার রঙিন তুলি দিয়ে? পারবে সে, অবশ্যই পারবে।

– ‘দাঁড়িয়ে আছো কেন?’ মানহার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় মৃদুল।

– ‘কিছু না।’

– ‘কী দেখছিলে এমন করে?’

– ‘তুমি দেখতে মোটামুটি ভালোই। হয়তো এতো কষ্টে না থাকলে আরও সুদর্শন হতে।’

– ‘তুমি আসলেই উন্মাদিনী। কাপ দু’টা হাতে কেন? রেখে আসো।’

মানহা কাপ রেখে এসে শাড়ি গুটিয়ে নিয়ে বিছানায় আসন পেতে বসে। মৃদুলও বালিশ কোলে নিয়ে মুখোমুখি হয়ে বললো,

– ‘আন্টি কেমন আছেন?’

মানহার মুখটি ম্লান হয়ে গেল। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।

– ‘মারা গেছেন।’

– ‘ও আচ্ছা।’

– ‘এসব কথা বাদ দাও, এখন শুনো, তুমি মুখ সেভ দাও কেন? সুন্দর করে কাট দিয়ে দাড়ি রাখবে।’

– ‘পারবো না, আমার মুখ চুলকায়।’

– ‘রাখলে অভ্যাস হয়ে যাবে, আর চুল এমন পাখির বাসা না বানিয়ে সাইটের চুল খাটো করে ফেলে নিবে।’

– ‘আচ্ছা বাবা ঠিকাছে, এখন শুনো সুন্দর পুর যেতে…।’

মানহা ঠোঁটে হাত দিয়ে আঁটকে দিয়ে বললো,

– ‘সব সময় কাজের কথা না। এগুলো কাল প্ল্যান করা হবে।’

– ‘তাহলে আজ কী করবো?’

– ‘আমি জানি না।’

—-চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here