বাঁক ( ২৬ পর্ব )

0
167

বাঁক ( ২৬ পর্ব )
_____________

বাজার এনে রান্না-বান্না শেষ করতে করতেই সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে মানহার। দু’দিন হলো খাওয়া ঘুম কিছুই ঠিকঠাক হয়নি। বিকেলে একাই বাজার সদাই করে এনে রেঁধেছে। খাবারের খুব বেশি আয়োজন নেই। মাছ এনে কাটাকুটির ঝামেলায় যায়নি সে। কেবল ফার্মের মুরগি এনে ভুনা করে রেঁধেছে। বাথরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নিল। আয়নায় তাকিয়ে নিজের প্রতিই যেন বড়ো মায়া হচ্ছে। চেহারায় প্রচণ্ড ক্লান্তির ছাপ। চোখের নিচে খানিকটা কালশিটে দাগ পড়ে গেছে। মুখ শুকিয়ে মলিন হয়েছে অনেকটা। বিকেল থেকে কিছু দুশ্চিন্তা মাথার চারপাশে মাছির মতো উড়াউড়ি করছে। কিন্তু এসব চিন্তাকে মানহা প্রশ্রয় দিতে চায় না। ক’দিন পরেই মৃদুলকে বিয়ে করে নেবে৷ ইশি, আন্টি আর মৃদুলকে নিয়ে তারও একটা হাসি-খুশির সংসার হবে। লোকে কয়দিন মুখ টিপে হাসুক, ফিসফিস করুক। বিয়ে হয়ে গেলে সবকিছুই বন্ধ। টাওয়েলে মুখ মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বের হয় মানহা। কী করবে এখন? আজ কী মৃদুলের সঙ্গে থাকবে সে? তা তো হয় না। নানাবাড়িও যেতে পারবে না। গেলে প্যানপ্যানানি শুনতে হবে, অযথাই ঝগড়াঝাটি হবে। তা আর ভালো লাগে না। এমনিতেই ক্লান্ত ভীষণ। মিরাদের বাসায় গিয়ে আজ থাকা যায়। মানহার বান্ধবী মিরা৷ ওর মা তাকে ভীষণ ভালোবাসেন। একরাত সেখানে থাকা ব্যাপার না। কাল একটা বাসা দেখবে৷ ইশি আর আন্টিকে খুঁজে পাবার আগপর্যন্ত সেখানে একাই থাকবে সে। ওদেরকে পেয়ে গেলে তো বাসা একটা এমনিতেই দরকার। কিন্তু আজ অসুস্থ অবস্থায় মৃদুলকে একা রেখে যাওয়া কি ঠিক হবে?
মানহা সিদ্ধান্ত নিল না। মৃদুলকে নিয়ে খাওয়া-দাওয়া করে দেখা যাবে। এখন কি খেতে ডাকবে? একদিন সন্ধ্যায় রাতের খাবার খেয়ে নিলে কি এমন সমস্যা? তাছাড়া বিকেল থেকেই তো মৃদুল ঘুমোচ্ছে। মানহা ধীরে ধীরে ওর ওপর থেকে কম্বল সরিয়ে গায়ে হাত দেয়। প্রচণ্ড গরম শরীর। জ্বর আরও বেড়েছে। কাঁধে ধাক্কা দিয়ে ডাকলো সে৷ মৃদুল গোঙানির মতো শব্দ করলো কেবল। নাক দিয়ে গরম শ্বাস বেরুচ্ছে। খানিক ভেবে উঠে গেল মানহা৷ মৃদুলের লুঙ্গি এনে বিছানায় মেলে দিল। টি-টেবিল টেনে আনে পালঙ্কের কাছে।
পানির জগ আর ভাত তরকারির বাটি এনে টি-টেবিলে রাখে। প্লেটে তরকারি নিয়ে লুঙ্গিতে রেখে মৃদুলকে ডেকে মাথার নিচে হাত দিয়ে ঠেলে তুলে বললো,

– ‘তুমি দেয়ালে হেলান দিয়ে বসো, ভাত আর ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে।’

মৃদুল গোঙানির মতো শব্দ করে সম্মতি জানায়। মানহা প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখিয়ে ওর দিকে এক লোকমা বাড়িয়ে দিল।
মৃদুল ফ্যাকাসে মুখে মুচকি হেঁসে হা করে।
খানিক পর আরেক লোকমা দেয়ার আগে মৃদুল খেয়াল করে বললো,

– ‘তুমিও খেয়ে নাও।’

– ‘কীভাবে? তুমি নিজে নিজে খাবে?’

– ‘না, আমাকে এক লোকমা দিবে নিজেও খাবে।’

– ‘আচ্ছা।’

মুচকি হেঁসে নিজের মুখেও খাবার দেয় সে। দু’জনের খাওয়া শেষে মানহা ওষুধ আর গ্লাস বাড়িয়ে দিল মৃদুলকে। সবকিছু গুছিয়ে এসে দেখে ওষুধ খেয়ে মৃদুল শিশুদের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। কী করবে এখন? বাইরে থেকে তালা মেরে চলে যাবে সে? সোফায় রাখা ভ্যানিটিব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখে সাতটা ত্রিশ বেজেছে। ক্লান্ত শরীরে মানহার বের হতে ইচ্ছা করছে না। ভাত খেয়ে শরীর যেন আরও ভারি হয়ে পড়েছে। খানিক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে মিরাদের বাড়িতে চলে যাবে। বালিশ নিয়ে মৃদুলের পাশে যায়। জ্বরে উত্তপ্ত গালে ডান হাত রাখে। মৃদুলের উষ্ণ শ্বাস বিছানায় আছড়ে পড়ে শরীরে এসে লাগছে। ভীষণ আরামদায়ক মনে হলো মানহার। বালিশ নিয়ে আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে নিজেও কম্বলের ভেতরে চলে গেল। ওর উষ্ণ হাত নিজের গালে এনে চেপে ধরে ঠোঁট দিয়ে আলতো করে চুমু খায়। আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বাঁ হাতের আঙুল ডুবিয়ে দেয় মৃদুলের চুলে। গরম শ্বাস এখন বুকে এসে পড়ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর খুব কাছ থেকে দেখছে ওর মুখটা। আচমকা উপুড় হয় মৃদুল। তার পায়ের নিচে চাপা পড়ে মানহার কোমর। হাত বুকের ওপর দিয়ে পিছলে গিয়ে বেঁধে নেয় তাকে। নাক আর ঠোঁটের নিচে চাপা পড়ে গলা। মানহা মুচকি হাসে। জেগে উঠে নারীত্ব। মমতায় বুকটা শিরশির করে। পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ভাবে একটু পরেই চলে যাবে মিরাদের বাড়িতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত যাওয়া হলো না। ক’দিন এমনিতেই অনিদ্রায় কেটেছে। তাই যাব যাব করে ঘুমে চোখের পাতা বন্ধ হয়ে এলো। বিকল হয়ে এলো মস্তিষ্ক। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মৃদুলের সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লো।

ফজরের আজান শুনে মানহার ঘুম ভেঙে গেল। কেঁপে উঠলো বুক। মৃদুল তাকে জড়িয়ে ধরে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। রাতে সে ওর সঙ্গেই থেকেছে তাহলে? কেউ কী ব্যাপারটা খেয়াল করবে? মানহা আস্তে আস্তে নিজেকে মৃদুলের হাত-পায়ের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নেয়। সোফা থেকে ভ্যানিটিব্যাগ হাতে নিয়ে মোবাইল বের করে দেখে ইরফানের অনেকগুলো কল। কল কী এখন ব্যাক করবে? এতো ভোরে দেয়া ঠিক হবে না। কাল ক্লান্ত হয়ে গিয়ে ঘুমিয়েছে নিশ্চয়। হোয়াটসঅ্যাপ নোটিফিকেশন চ্যাক করে দেখে ইরফান রাত নয়টায় ভয়েজ মেসেজ পাঠিয়েছে। প্লে করে মানহা। রেকর্ডে মানুষের গিজগিজ শব্দ আর গাড়ির ডাক। এসবের মাঝখানে ইরফানের ক্লান্ত গলা শোনা যাচ্ছে, ‘মানহা কল দিয়ে তোমাকে পাচ্ছি না। আচ্ছা শোনো, লায়লাকে আমি পেয়েছি। ওর কোলের ছেলেটা মোবাইল পানির জগে ফেলে দিয়েছিল। সে পুরোদিন খুঁজে খুঁজে হয়রান। যখন পেয়েছে তখন মোবাইল নষ্ট। নতুন মোবাইলও কেনেনি এখনও। আমি সবকিছু বুঝিয়ে বলার পর বাজারে যেতে রাজি হয়েছে। সিম তুলে আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছি। মোবাইলে অন করে রাখবো সেটা। দেখা যাক কি হয়, আল্লাহ ভরসা। পরে কলে কথা হবে। এখন আর কিছু বলার নেই রাখছি।’

মানহা মোবাইল ভ্যানিটিব্যাগে রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এবার ইশির যদি নাম্বার মুখস্থ থাকে আর কল দেয় তাহলেই হলো।
মানহা বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে মৃদুল ঘুমোচ্ছে। এখন কী করবে মানহা? এখানে থাকা আর ঠিক হবে না। ভোরে সবাই খেয়াল করবে। মানহা বাইরে থেকে চেম্বারের সময় এখানে এলে লোকে ভাববে রাতে থাকেনি। তবুও কেউ কেউ নজরদারি করতে পারে। এসব চিন্তা করে এই মুহূর্তে লাভ নেই। আপাতত কোথাও গিয়ে নয়টায় চেম্বারে আসলে ভালো হতো। কিন্তু যাবে কোথায়? মিরাদের বাড়িতে এতো ভোরে গেলে কী ভাববে ওরা। তবুও মানহা বাথরুমে গিয়ে মুখ-হাত ধুয়ে মাথায় ওড়না দিয়ে বের হয়। সোফার ওপর থেকে ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে এক পলক বিছানায় তাকিয়ে চললো দরজার দিকে। চাবি বের করে আলগোছে দরজা খুলে বের হয়। এখনও আবছা অন্ধকার। সতর্ক চোখে চারদিকে উঁকি মেরে দেখে নেয় কেউ আছে কি-না। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিচে। ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ইউনিয়ন অফিসের গলির দিকে ঢুকে। একটা দোকানের সিঁড়িতে কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। জেগে না উঠলেই হলো। পদশব্দ যেন না হয় তাই আস্তে আস্তে হাঁটছে সে। কাজ হলো না। পাশ কেটে যাওয়ার সময় কুকুর মাথা তুলে তাকিয়ে ‘ভেউ-ভেউ’ করে পুনরায় বন্ধ হয়ে গেল।
ভাগ্যিস দোকানপাট বন্ধ, মানুষের নামগন্ধ নেই। মানহা কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটছে। খানিক পথ হেঁটে ইউনিয়ন পরিষদের সামনে দিয়ে ডান দিকে কাঁচা রাস্তা গিয়েছে। মানহা সেদিকে যায়। একটু পরেই শরৎ সুন্দরী প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কল পেরিয়ে রাস্তা আবার বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে। খানিক হেঁটে যেতেই রাস্তার পাশে মিরাদের দু’টা বিস্তৃত দিঘি। মাঝখান দিয়ে সবুজ সতেজ ঘাসে ঢাকা সরু রাস্তা গিয়েছে। মানহা রাস্তা দিয়ে গিয়ে লাউ বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে মিরাকে কল দেয়। দুইবার কল গিয়ে কেটে আসে। মিরা এমনিতেই ভীতু স্বভাবের। একটুও ঝুঁকি নেয়ার মেয়ে সে না। বাপ-চাচাকে প্রচণ্ড ভয় পায়। গায়ের রঙ গাঢ় কালো। কিন্তু দাঁতগুলো দুধের মতো সাদা। বিয়ের আলাপ আসে ঘন ঘন। কয়েক বছর থেকে বিয়ে হবে হবে করছে। ভোরবেলা বিনাবাক্য ব্যয়ে তাকে ঘরে নিবে কি-না কে জানে। আবার কল দিল মানহা। এবার রিসিভ হলো। ঘুম ঘুম গলায় মিরা ওপাশ থেকে বললো,

– ‘কিরে মানহা, তুই এতো ভোরে কল দিচ্ছিস কেন?’

– ‘স্বপ্নে দেখলাম তুই বিয়ে করে জামাইকে পেয়ে আমাদের ভুলে গেছিস। শরৎ পুর বারো মাসে একবারও আসিস না।’

– ‘ফাজলামি না করে বলতো কি হয়েছে এই ভোরবেলা।’

মানহা ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘তোদের লাউ গাছের নিচে আমি দাঁড়িয়ে আছি তুই একটু আয়।’

– ‘কি বলিস এগুলো? এখন তুই এখানে আসছিস কেন? ফাজলামো করছিস নাকি?’

– ‘আমি কি তোকে ভোরবেলা কল দিয়ে ঘুম থেকে তুলে ফাজলামো করবো? এসে দেখনা।’

– ‘বুঝলাম না তুই এখন এসেছিস কেন?’

– ‘আরে খানকি, আগে তো আয়।’

– ‘আচ্ছা দাঁড়া আসছি।’

খানিক্ষণ পর মিরা এলো লাউ গাছের নিচে। তার মুখ মলিন। ওড়না মাথায় আলগা করে দেয়া। মানহার সামনে এসে চারদিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘তুই এখন কোত্থেকে আসলি?’

– ‘এতো কথা বাইরে এখন দাঁড় করিয়ে শুনবি না-কি? তোর রুমে আগে চুপিচুপি আমাকে নিয়ে যা। তারপর নয়টায় ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলবি। কেউ আমাকে দেখলে বলবি একটু আগে এসেছে। তারা ভাববে খেয়াল করেনি হয়তো কখন ঢুকেছি।’

মিরা বিরক্ত হয়ে বললো,

– ‘দেখ মানহা, তোর এসব নাটকে আমি নাই। এলাকার মানুষ বলাবলি করে তুই বিয়ে-শাদি করিস না, অথচ রাস্তার একটা ছেলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। রাতেও না-কি লোকজন দেখেছে হাওরে যেতে। কিছুদিন থেকে ছেলে না-কি তোর ওখানে থাকে। তুই ভোরে চলে আসিস ওর কাছে। এখন কোথা থেকে এসে বলছিস লুকিয়ে আমার রুমে নিতে। দেখ বোন, আমি এসব লুকোচুরি করতে পারবো না। মাঝখান থেকে আমি কালার হব। তুই আয় আমি মা’কে ডেকে তুলছি।’

কথাগুলো বলে মিরা হাঁটতে শুরু করলো বাড়ির দিকে। মানহা ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। তার কান দিয়ে যেন গরম ভাপ বেরুচ্ছে৷ চোখ বেয়ে পড়লো উষ্ণ একফোঁটা জল।

____চলবে____

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here