#বাঁক ( ৩য় পর্ব )
____________
অন্ধকারে লঞ্চের আলো নদীর জলে পিছলে পড়ে ঢেউয়ের সঙ্গে নৃত্য করছে। ঠিক তখনই মৃদুল দেখতে পায় লঞ্চ যতই কাছাকাছি আসছে ঢেউয়ের তোড়ে ছোট্ট নৌকাটি বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। লঞ্চ আসছে অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে।
নৌকাটির মাঝি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে। সঙ্গের ছেলে তিনটি সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে।
নৌকায় চাদরে ঢেকে নিজেকে আড়াল করা একমাত্র মেয়েটি আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে এদিক-ওদিক ছুটোছুটি শুরু করেছে। ঢেউয়ের সঙ্গে সংগ্রামে হেরে গিয়ে আচমকা মৃদুলের চোখের সামনেই নৌকাটি উলটে গেল। প্রথম চিল্লানি মৃদুল অনেকটা নিজের অজান্তেই দিয়ে সেদিকে ছুটে যায়। লঞ্চ থেকে একসঙ্গে অসংখ্য মানুষ ‘হায় হায় ডুবে গেল রে, ডুবে গেল রে’ বলে শোরগোল করছে।
পাশের দোকান থেকেও চাচারা জমে উঠা গল্প ইস্তফা দিয়ে নদীর পাড়ে এসে জড়ো হয়েছেন। কিন্তু আশংকাজনক কিছুই হয়নি। নাও অনেকটা কিনার ঘেঁষেই যাচ্ছিল। পাঁচজনই নদী সাঁতরে উঠে এসেছে।
কিন্তু তারা কাউকে হা-হুতাশ করার সুযোগ না দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়েটিকে নিয়ে অন্যদিকে হাঁটা শুরু করে। দোকানে বসা অতি উৎসুক চাচারা কেবল একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে ইতি টানলেন না।
এদেরকে ডেকে দাঁড় করাতে এগিয়ে গেলেন।
মৃদুল শেষটা দেখতে পারলো না৷ লঞ্চের ডাক শুনে দৌড়ে গিয়ে উঠতে হয়েছে।
তার পরনে হলুদ গেঞ্জির সঙ্গে কাদামাখা পুরাতন জিন্স প্যান্ট৷ সবার দৃষ্টিগোচর না হলেও সে মনে-প্রাণে জানে এই প্যান্টের চেইন নেই। কোমড়ের বাঁধা মন্ত্র পড়া শক্ত তাগার উপরে জোরপূর্বক বেল্টের কাজও চাপিয়ে দিয়েছে। লঞ্চের আলোয় নিজের করুণ অবস্থা নিয়ে বড়ই লজ্জায় পড়ে গেল সে। নোংরা পোশাক দেখে লোকজন দলবেঁধে তাকাচ্ছে। মানুষের দৃষ্টির অত্যাচার থেকে মুক্তির জন্য সে ধীরে ধীরে উপরে উঠে লঞ্চের পিছনের দিকে গিয়ে অন্ধকারে বসে পড়ে। অজগর সাপের মতো লঞ্চ একটা গা ঝাড়া দিয়ে বাচ্চাদের নাকি সুরে কান্নার মতোন আর্তনাদ করতে করতে ছুটতে শুরু করে। লঞ্চ নদীর বুক ছিঁড়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। সে তাকিয়ে আছে পেছনের দিকে। কেউ যেন তার কোমড়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মাথা তুলে উপরের দিকে তাকায়। রাতের আকাশের ঝলমলে বিন্দু বিন্দু তারা পেছনে ফেলে সে কোথায় ছুটে যাচ্ছে? গন্তব্য কোথায়? অচিন পুর? মানুষের কি আদৌও গন্তব্য নিয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা আছে? মৃদুল উঠে গিয়ে রেলিঙ ধরে নদীতে তাকায়। ঢেউয়ের ওপর লঞ্চের জানালা দিয়ে বাতির আলো লাফিয়ে পড়েছে।
একজন চা নিয়ে নাকি সুরে ‘এই চা লাগবে চাআয়া’ বলে এদিকে আসছে।
সে কি এই লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে কেকগুলো ছিনিয়ে নিতে পারবে? এটাই তো মানুষের আদি পেশা। কাড়াকাড়ি, মারামারি যে পারবে তারই জমি, ফসল। মানুষ এখন সভ্য হয়েছে। গায়ে পোশাক উঠেছে। সরাসরি কাড়াকাড়ি করে না। সে আবার অন্ধকারে গিয়ে বসে পড়লো। পেটের ক্ষুধা মাথাঝাড়া দিয়ে উঠেছে। শীত শীত লাগছে ভীষণ। অবশ্য পেছনের দিকে বসায় ঠান্ডা বাতাস লাগছে না৷ সে পা দু’টা ভাঁজ করে বুকের কাছে এনে কুণ্ডলি পাকিয়ে চোখ বুজে।
ঘুম যখন ভাঙলো তখন রাত কয়টা সে জানে না। বাঁ হাতে ‘ঝি ঝি’ করছে। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে টের পেল পায়েও ‘ঝি ঝি’ ধরে অবশ হয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে রেলিঙ ধরে পাড়ের দিকে তাকায়। সৌর বিদ্যুতের বাতি জ্বলছে চারদিকে। মস্ত বড়ো বাজার মনে হচ্ছে। সে ঘোরের মধ্যে নেমে গেল সেখানে। একটা সাইনবোর্ডে লেখা রূপগঞ্জ লঞ্চঘাট। লঞ্চ থেকে নেমে মানুষ পাশের একটা চা স্টলে ভিড় জমিয়েছে।
সে ধীরে ধীরে দোকানে ঢুকে প্রথমে গিয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে এক চুমুকে সবটুকু খেয়ে নেয়।
তারপর অধিক চিন্তা-ভাবনা না করে দোকানিকে গিয়ে বললো,
– ‘দুইটা কলা আর কেক দিন চাচা।’
দোকানি তাকে কেক আর কলা বাড়িয়ে দেয়। পেছনের একটা বেঞ্চে গিয়ে বসে। প্রথমে একটা কলা আর দু’টা কেক খেয়ে নেয় দ্রুত। তারপর ভাবতে লাগলো কীভাবে বের হবে। দরজার দিকে সতর্ক চোখ রেখে শেষের কলাটি ধীরে ধীরে খায়।
আচমকা লঞ্চের ডাক দিল। বসে বসে আয়েশ করে বিড়ি-সিগারেট টানতে থাকা লোকজন বিল দিতে দোকানিকে ঘিরে নিল। সে শ্লথ গতিতে উঠে দাঁড়ায়। বুকের ভেতর হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙার মতো শব্দ হচ্ছে। আলগোছে সে বেরিয়ে পড়ে দোকান থেকে। বাজারটা তার পছন্দ হয়েছে। লঞ্চে না গিয়ে হাঁটতে থাকে। এগলি-ওগলি হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ কয়েকটা নেড়ি কুকুরের সামনে পড়ে যায়। প্রথমে কুকুরগুলো কেবল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে তার চারপাশে ঘুরতে শুরু করে। সে আলগোছে তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে গেল।
তখনই ‘ঘেউ ঘেউ’ করে পেছন থেকে তাড়া করলো কুকুর। সে ত্রাসে দৌড়াতে শুরু করে। খানিক পর একটা ইটের রাস্তা পেল সামনে। ভাঙা ইটের টুকরো হাতে নেয়ার জন্য নুইয়ে বসতেই কুকুরগুলো উলটো দিকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে মাথা তুলে চারদিকে তাকায় মৃদুল, বুঝতে পারে সে বাজারের বাইরে চলে এসেছে। রাস্তার পাশে একটা স্কুল দেখতে পেল। বড়ো করে লেখা ‘রূপগঞ্জ হাই স্কুল’। তার নিচে ছোট্ট করে লেখা ‘সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুর, রূপগঞ্জ বাজার’।
সে ইটের রাস্তা ধরে গন্তব্যহীন পথ চলতে শুরু করে। খানিক পথ যেতেই সামনে পেল একটা মসজিদ। পাকা ইদগার পরে একটা পুকুর। গেইট খুলে ইদগা পেরিয়ে পুকুর ঘাটে যায় সে। মুখ-হাত ধুয়ে জামা-কাপড় পানি দিয়ে মুছে নেয়।
ঘাটের দু’পাশে সোফার মতো পাকা করে বসার জায়গা। একটায় উঠে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ে সে। কারও ডাকে ঘুম ভাঙার পর নাকে তখন ভুরভুরে আতরের ঘ্রাণ পায়। চোখ মেলতেই বুঝতে পারে তার গায়ে চাদর। শরীর প্রচণ্ড গরম। কেউ একজন তাকে আবার ধাক্কা দেয়। কিন্তু মাথা বের করতে ইচ্ছা করছে না তার৷ শুনতে পেল একজন বলছে, ‘ইমাম সাব ছেলেটার তো জ্বর আইছে মনে অয়।’
– ‘জ্বি জ্বরই মনে হচ্ছে।’
– ‘কি করবো এখন?’
– ‘টেনে তুলে জিজ্ঞেস করি বাড়ি কোথায়, এখানে কি করছে।’
– ‘পরে জিজ্ঞেস করা যাইব। ওরে আগে বাড়ি নিয়া ওষুধ খাওয়াই।’
– ‘হ্যা তাহলে তাকে টেনে দাঁড় করাই ধরুন।’
মৃদুল তাদের কথোপকথন শুনে ভেবে পাচ্ছে না তার ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে কী জবাব দেবে৷ এখানে কীভাবে এলো, কেন এলো এগুলো জিজ্ঞেস করলেই বা সে কি জবাবা দেবে। তবে আপাতত সিদ্ধান্ত নিল অসুস্থতার বাহানা করে সকল প্রশ্ন এড়িয়ে যাবে। দু’জন তাকে ধরে দাঁড় করালো।
– ‘আস্তে আস্তে হাঁটো আমাদের লগে। বাড়ি কোনে তোমার?’
সে কোনো জবাব না দিয়ে তাদের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করে। অনেক্ষণ হাঁটার পর চোরা চাহনিতে দেখতে পায় সামনে একটা চওড়া বাঁশের সেতু। তাকে নিয়ে তারা সেতু পেরিয়ে সরু মাটির রাস্তায় গেল। রাস্তার দু’পাশে নানান ধরনের গাছ-গাছালি। আরও খানিকটা এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল ডালিম, পেপে, পিয়ারা আর লেবুর গাছে ভরপুর। আরেকটু যেতেই দৃশ্যমান হলো একটা হাফ ওয়াল টিনের ঘর। এর দুপাশে আরও দু’টা ঘর। মাঝখানে বিস্তৃত উঠোনের সামনে সামনে বিশাল একটা পুকুর। পুকুর পাড়ে সারি সারি নারিকেল আর সুপারি গাছ। তাকে বাড়ির বাঁ পাশের টিনের ঘরের দিকে নিয়ে গেল তারা। দরজার খিল তুলে ধাক্কা দিতেই আর্তনাদ করে উঠলো। ছোট্ট ঘরের একটা দড়িতে কিছু কাপড় আর টিনের লোহায় ক্যালেন্ডার ঝুলানো। খাটের পাশে কাঠের চেয়ার। তাকে ফুল তোলা বিছানায় শুইয়ে কাঁথা উপরে দিয়ে দেয়া হলো। সে চোখবুজে ভান ধরে পড়ে রইল। তার জ্বর এসেছে, কিন্তু চেতনা পুরোপুরি আছে।
– ‘ইমাম সাব আপনে বইন চেয়ারে। আমি চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতেছি।’
– ‘না আমি যাচ্ছি এখন খাঁন সাব।’
– ‘আরে না বইন আপনে।’
তিনি বাইরে গেলেন। ঘরে নীরবতা নেমে এলো। খানিক পরেই আবার ফিরে এলেন।
– ‘ছেলেটা মসজিদে কই থাইকা আইল বুঝতেছিনা হুজুর।’
– ‘জাগলে জিজ্ঞেস করতে হবে।’
– ‘গরু মাঠে দিয়া ফার্মেসি থাইকা জ্বরের ওষুধ আনতে হইব। ছেলেটা আশেপাশের কোনো গ্রামেরই হইব কি কন? মা-বাপ মনে অয় মারছে আর রাগ কইরা মসজিদের ঘাটে আইসা ঘুমিয়ে পড়েছে।’
– ‘তা হতে পারে।’
খানিক পর আবার দরজায় শব্দ হলো। একটা মেয়েলি কণ্ঠে সালাম দিলো। হুজুর জবাব দিয়ে বললেন,
– ‘ফাতিহা, ভালো আছো।’
– ‘জ্বি হুজুর।’
– ‘কাল মক্তবে যাওনি কেন?’
– ‘মাথা বেদনা আছিল।’
তারপর বিছানায় কিছু একটা রাখা হয়েছে টের পেল মৃদুল। কাঁথার ফাঁক দিয়ে তাকায় সে। একটা ট্রে-তে দু’টা প্লেট। প্রথমেই দেখতে পেল পিস পিস করা লাল টকটকে পাকা পেঁপে। জিভে জল চলে এলো তার। পেটের ক্ষুধা মাথা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। তার পাশে বসেই তারা দুই প্লেট পেঁপে খেল। খানিক পর মেয়েটি আবার এলো চা-বিস্কিট নিয়ে। সে কাঁথার ফাঁক দিয়ে এই প্রথম পিচ্চি ফাতিহাকে দেখলো।
—চলবে—