বাঁক ( ৩৫ পর্ব )
______________
কলমটা খাতার ওপর রেখে মানহা উঠে দাঁড়ায়। আলগোছে বারান্দার দরজাটা খুলে বাইরে আসে সে। আজ চাঁদের আলোয় যেন চারধার ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানহা গ্রিলে বাঁধা দড়ি খুলে দিল। দড়ি পিছলে পড়লো গিয়ে উঠোনে। মা কী এরকম আয়োজন করে একবুক অভিমান, অভিযোগ আর ক্ষোভ নিয়ে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছিলেন? এমন সুন্দর চাঁদনী রাত বুঝি সেদিনও ছিল? না-কি নিকষকালো রাত্রি? গ্রিল তালা দেখে মানহা পুনরায় নিজের কামরায় ফিরে আসে। দড়ি কাটতে হবে ভেবে ড্রয়ার থেকে কাঁচি নেয়। ঘরের দিকের দরজাটা আস্তে করে খুলে। করিডর পেরিয়ে রান্নাঘরে যায়। সেখানকার দরজা সতর্কভাবে খোলার চেষ্টা করলেও খানিক আর্তনাদ করে উঠলো। ভাগ্যিস কেউ জেগে উঠেনি। প্রকৃতি কী তাকে সমর্থন দিচ্ছে? বাড়ির পেছনে বেরিয়ে আসে। চাঁদের আলোয় সারি সারি সুপারি গাছের ছায়া লম্বা হয়ে মাটিতে পড়েছে। এসব সৌন্দর্য হচ্ছে মায়াজাল, এগুলো মোহ। কোনোকিছুর লোভই তাকে আজ আটকাতে পারবে না। মায়ের কাছে চলে যাবে একদম। মা কী খুব ভালো প্রেমিকা ছিলেন? বাবাকে ভীষণ ভালোবাসতেন বুঝি? সে কী মেয়ের মতো ভালো প্রেমিকা হয়েছে? যারা সমস্ত কিছু উজাড় করে ভালোবাসতে জানে। যাদের কানে কোনো যুক্তি আর বাস্তবতার বুলি পৌঁছায় না? যাদের পবিত্র চোখে প্রতারককেও প্রেমিক মনে হয়। মানহা সুপারি গাছের ছায়াগুলো ডিঙিয়ে বাড়ির পাশ দিয়ে উঠোনে এলো। মাথা নুইয়ে কাঁচি দিয়ে দড়ি কেটে হাতে নিল সে। বাড়ির দক্ষিণ পাশেই অনেকগুলো জাম্মুরা গাছ। একেবারে প্রথমটাতেই তো মা ফাঁস দিয়েছিলেন? মানহা খানিক্ষণ গাছটির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর দড়ি হাতে গেল পুকুর পাড়ে। এখান থেকে মায়ের কবর দেখা যাচ্ছে। বসলো সে পুকুরের সিঁড়িতে। পানিতে পা দিয়ে খানিক নাড়া দিল। জলের ভেতর চাঁদ নড়ছে। নারিকেল গাছের চিরল চিরল পাতাগুলো কাঁপছে। মানহার মনে পড়ে গেল মৃদুলের সঙ্গে স্টেশনে যাওয়ার সেই রাত্রির কথা৷ কুঁড়েঘরের সামনের সেই পুকুর। মৃদুল তাকে জলের ভেতর ডুবতে থাকা চাঁদ দেখাতে গিয়ে অল্পের জন্য তো ধরাই পড়ে গিয়েছিল। স্টেশনের সেই দু’টো মাতাল, হাওরে কাঁধে করে যাওয়া, রাস্তায় বমি। সব, সবকিছুই মানহার ভীষণ মনে পড়ছে। মনে পড়ছে টিলার ওপরের বাড়িতে রাত্রিযাপন। ট্রেন থেকে দেখা সেই অচেনা ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। হাওয়াই মিঠাই, হাওয়াই মিঠাই। মানহা মুখ ঢেকে দুমড়ে-মুচড়ে উঠলো কান্নায়। কার জন্য সে নিজের জীবনটা দেবে? মায়ের মৃত্যুর পর বাবার জীবনের নিয়মে কী কোন ব্যাঘাত ঘটেছিল? পরের স্ত্রীকে নিয়ে দিব্যি কেটে গেছে তার দিন। কালেভদ্রে কি লোকটির মায়ের কথা মনে পড়ে? এমন চাঁদনী রাতে কি মায়ের জন্য তার বুকটা ফাঁকাফাঁকা লাগে? না-কি যে যায় একেবারেই যায় নিষ্ঠুরদের জীবন থেকে? প্রথম প্রথম তাকে বাপ-দাদারা নিতে চাইতেন। তারপর যত দিন যেতে লাগলো। নতুন স্ত্রীর কোলেও বাচ্চা এলো। তারা পুরোপুরি ভুলে গেলেন তার কথা। আচ্ছা সেও যদি মায়ের মতো মারা যায়? মৃদুল কি একটু কাঁদবে? চোখ থেকে খানিকটা জল কী ফেলবে তারজন্য? কখনও কী মনে পড়বে একজন মানুষ আমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে ধোঁকা খেয়েছে? তারই দেয়া বুক ভার করা যন্ত্রণা সইতে না পেরে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে চুপচাপ বিদায় নিয়েছে। এমন চাঁদনী রাতে কি তার জন্য বুকটা হাহাকার করে উঠবে? আলসে দুপুরে কোনো এক পাখির ডাক কানে আসবে, হুট করে তখন মানহার কথা ভেবে তার মনটা কী একটু খারাপ হবে না? না-কি পাষাণদের কখনও এমন হয় না? প্রতারকরা কী একটা জীবন শুধু প্রতারণা, ছলনা আর নিজের স্বার্থের জন্য কাটিয়ে দেয়? তাহলে কেন মায়ের মতো এই সুন্দর ভূবন ছেড়ে সে চলে যাবে? যার জন্য যাবে সে তো দিব্যি কাটাবে জীবন। হয়তো আপদ বিদায় হয়েছে ভেবে খুশি হবে। মানহার আচমকা কী যে হলো। জলের ভেতর চাঁদের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিল মানুষের সকল অপমান, অপবাদ সে মুখবুজে সহ্য করে নিবে। বিয়ে-শাদি কিছুই করবে না। সুন্দর করে গুছিয়ে আবার নতুন করে জীবনটা শুরু করবে। চেম্বার থেকে যা টাকা আসবে তা অল্প অল্প করে জমিয়ে গ্রামে একটা পাঠাগার দেবে। সুন্দর একটা পাকা ঘর থাকবে চারপাশে বুক অবধি পাঁচিল তোলা৷ একপাশে ফুলের বাগান। পাঠাগারে নানানরকম বই থাকবে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এসে বিনামূল্যে বই পড়বে। বাগানে ঘুরে ছবি তুলবে। তারপর একদিন সে হুট করে প্রকৃতির নিয়মে মরে যাবে। দড়ি সিঁড়িতে রেখে উঠে গেল মানহা। পুনরায় বাড়ির পেছন দিকে দিয়ে ঢুকে নিজের রুমে চলে গেল।
*
ফাতিহার সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায়ই মারা গেছে। গর্ভকালীন সময়ে মৃদুলের জন্য দুশ্চিন্তা, অনিদ্রা, দিনের পর দিন খাবারের প্রতি অনিহা৷ সবকিছু মিলিয়ে সে পুষ্টিহীনতায় ভুগছিল। পেটে সন্তান যে মারা গেছে তাও বুঝতে পারেনি। হসপিটাল যাবার পর আল্ট্রাসনোগ্রাম করে জানা যায় সন্তান মারা গেছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে ফাতিহার শরীরেও নানান সমস্যা বাসা বেঁধেছে। প্রেসার একদম লো। ওর জরায়ু দূর্বল, পুষ্টিহীনতা। হিমোগ্লোবিন কম। এই অবস্থায় ডাক্তাররা অপারেশন না করে বললো পনেরোদিন হসপিটাল থাকতে।
কিন্তু গর্ভে সন্তান মারা গেছে শুনে সবারই মন খারাপ হয়ে গেছে। হসপিটালে থাকতে বললেও তারা চলে এলো বাড়িতে। প্রসব ব্যথা উঠলে না হয় আবার আসা যাবে।
বাড়িতে আসার পর ফাতিহার মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেল। পেটের ভেতর মৃত বাচ্চা নিয়ে চলাফেরা করতে কেমন যেন অস্বস্তি হয় তার। বারবার মৃদুলকে বলতো চলো অপারেশন করে বাচ্চা ডেলিভারি করিয়ে নিই। মৃদুল তাকে বুঝিয়ে রাখে। দাদাভাই বড়ো মসজিদের হুজুর এনে দোয়া দরুদ পড়ান। এভাবেই দিন কাটছিল।
হসপিটাল থেকে আসার প্রায় পনেরো দিন পর এক বৃষ্টির রাতে ফাতিহার প্রসব ব্যথা উঠে। ফাতিহা গোঙানি শুনে মৃদুলের ঘুম ভেঙে যায়। তাড়াতাড়ি ছাতা নিয়ে উঠোন পেরিয়ে সামনের ঘরের দরজায় গিয়ে ডাকে,
– ‘দাদাভাই, দাদাভাই উঠেন তাড়াতাড়ি।’
দাদি এবং দাদা দু’জনই দরজা খুলে বারান্দায় আসেন। দাদা অবাক হয়ে বলেন,
– ‘কি হইছে এতো রাইত ডাকতাছো কেন?’
– ‘দাদাভাই ফাতিহার ব্যথা উঠছে।’
– ‘কও কি তুমি তাড়াতাড়ি পশ্চিম পাড়া গিয়ে দাই বেটিরে নিয়ে আও, যাও ছাতা নিয়ে যাও।’
মৃদুল গ্রামের দাইমাকে আনতে যায়। দাদি আপাতত ফাতিহার কাছে গিয়েছেন। ফাতিহা কৈ মাছের মতো ছটফট করছে। বৃষ্টিতে ভিজে দাই মা’কে নিয়ে আসতে মৃদুলের প্রায় ঘণ্টা খানেক লেগে যায়। দাই মা ভেতরে গেলেন। দাদা ভাই আর মৃদুল বারান্দায় পায়চারি করছে। বৃষ্টির ছাট এসে তাদের ওপরে পড়ে অর্ধেক ভিজিয়ে দিয়েছে। অনেক চেষ্টা-তদবির চালিয়ে দাই মা ব্যর্থ হয়ে বাইরে এসে জানালেন অনেক রক্তক্ষরণ হচ্ছে। হসপিটাল নিয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু হসপিটাল নিয়ে যাওয়ার আগেই ফাতিহা মারা গেল। ডাক্তাররা দেখে মৃত ঘোষণা করলেন তাকে।
দুপুর নাগাদ আফতাব, ইশি, নেহারা বেগম এলেন জলেস্বরী। খবর পেয়ে এলো ইরফান আর মানহাও। উঠোনের মাথায় খাটিয়াতে তখন সাদা কাফনে মোড়ানো ফাতিহার দেহখানি। তার ছেলেটি সিঁড়িতে বসে অবিরাম কাঁদছে। মৃদুলের মাথার মাঝখানে টুপি। শার্টের এক হাত গুটানো, আরেক হাত ছাড়া। দাঁড়ি লম্বা হয়েছে বেশ। ইশিদের সঙ্গে মানহাও ফাতিহার চেহারা দেখলো। তারপর কেউ একজন দেখিয়ে দিল ফাতিহার ছেলেটিকে। ইশিরা তার কাছে গেল দু’একটা সান্ত্বনার বাণী শুনাতে।
মানহা দূর থেকে তাকিয়ে রইল ছেলেটির দিকে। ফাতিহার দাফন সম্পন্ন হলো জোহরের পর। তিনটার দিকে ইশিরা সবাই মৃদুলের সঙ্গে কথা বলে বিদায় নিল। মানহা তখন দাঁড়িয়ে রইলো দূরে। তারা রূপগঞ্জ বাজারে আসতে আসতে আছরের আজান হয়ে গেল। রূপগঞ্জ এখন লঞ্চ ছাড়াও চলাফেরা করার মতো পাকা রাস্তা হয়ে গেছে। তারা এখান থেকে গাড়িতে উঠে চলে গেল।
মৃদুল প্রায় এক সপ্তাহ রূপগঞ্জ এভাবেই থেকে যায়। রোজকার মতো ছেলেকে নিয়ে সামনের ঘরে ঘুমিয়েছে সে। এই খাটেই আগে ফাতিহা তাদের সঙ্গে থাকতো। এখন সে নেই। আজ ফজরের আজান শুনে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল মৃদুলের। আজকাল প্রায়ই তার মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। নিজেকে তখন ভীষণ একা লাগে। নেহারা বেগম ইশির সঙ্গে থাকেন। মৃদুল এখানে আছে কেন সে নিজেই বুঝতে পারছে না। এই বাড়ির সঙ্গে তার আর কিসের বন্ধন? ফাতিহা মারা গেছে। যে কারণে পালিয়ে এসেছিল তাও সমাধান হয়ে গেছে।
এই ছেলেটাও তার নয়। এটা সে এবং এ বাড়ির সবাই জানে। ফাতিহার অবৈধ সন্তানের দায়িত্বও কী তার নিতে হবে?
এখনও কী মানহাকে সে ভালোবাসতে পারবে না? তার জীবনে কি আলাদা কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই? সব সময় কেন অন্যদের জন্য বাঁচতে হবে তার? ফাতিহার অবৈধ সন্তানকে রেখে যদি মানহার কাছে এখন ছুটে চলে যায়? বিবাহিত বলেই তো মানহাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। প্রকৃতির নিয়মে আজ ফাতিহাও নেই, সে একা। এখন আর কিসের বাঁধা? সেও তো মানহাকে ভালোবাসে। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দরজা খুলে বাইরে আসে। এখনও ভোরের আলো ফোটেনি। মানহার কাছে যাবে। সবকিছু খুলে বলবে মানহাকে। তাকে অবশ্যই মানহা গ্রহণ করবে মানহা। নতুন করে তারা সংসার শুরু করবে। মানহার ইচ্ছামতো জলেস্বরী বাজারে বাসা ভাড়া করা হবে। মা তাদের সঙ্গেই থাকবেন। মৃদুল হেঁটে হেঁটে মেইন রাস্তায় চলে এলো। এতো ভোরে গাড়ি-ঘোড়া কিচ্ছু নেই, না থাকুক। প্রয়োজনে সে হেঁটে হেঁটে চলে যাবে। ফজরের নামাজ পড়ে মানুষ মসজিদ থেকে বের হচ্ছে, মৃদুল হাঁটছে তো হাঁটছেই।
আচ্ছা মানহার সামনে গিয়ে সে দাঁড়ালে সবকিছু ভুলে কি পুনরায় গ্রহণ করবে? না-কি স্বার্থপর, প্রতারক বলে মানহা তাড়িয়ে দেবে?
_______সমাপ্ত_______
বি:দ্র: কমেন্টে আমার প্রথম বই ‘বিষাদিনীর বসুন্ধরা’ এর অর্ডার লিঙ্ক দেয়া থাকবে। কেউ চাইলে কিনতে পারেন। এছাড়া আমার লেখা ‘দেশলাই, আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন, ঘাসফড়িং উপন্যাস সহ সকল গল্পের ফেইসবুক লিঙ্ক দেয়া থাকবে।