বাঁক ( ৫ম পর্ব )
________
৩
মোবাইল পুনরায় বেজে উঠলো। রাগে ইচ্ছা করছে মুঠোয় নিয়ে ছুড়ে মারে দেয়ালে। পাশের বিছানার ছেলেটি বালিশ থেকে মাথা তুলে লাল টকটকে চোখে তাকিয়ে বললো, ‘আরে ভাই কি শুরু করছেন কন তো? আপনের ফোনের যন্ত্রণায় তো ঘুমাইতেই পারতেছি না।’
মৃদুল বিছানা থেকে উঠে করিডরে এসে কল রিসিভ করে,
– ‘ম্যাডাম কি হয়েছে বলুন তো। এতো কল দিচ্ছেন কেন? বললাম তো আসছি।’
– ‘এতক্ষণ লাগে আসতে?’
– ‘এখন মাত্র সাতটা বাজে আমি আসবো কীভাবে?’
– ‘সাতটায় আসা যাবে না কেন?’
– ‘আপনি ভোর ছয়টায় কল দিয়ে বললেন গোসল করে ভালো জামা-কাপড় পরে চেম্বারে যেতে। তখন বলেন নাই সাতটার আগেই যাওয়া লাগবে। আমি তো আপনাকে প্রতিদিন নয়টায় যেতে দেখি।’
– ‘আচ্ছা ঠিকাছে এখন বলছি, আপনি বিশ মিনিটের ভেতরে আসুন।’
– ‘বললেই তো হবে না ম্যাডাম। আমার এখানে একটা মাত্র টয়লেট আর গোসলখানা৷ একদল এখন হাত-মুখ ধুয়ে আটটায় কাজে যাবে। আরেক দল যাবে নয়টায়৷ এখন আমি গোসলে গেলে সবাই মিলে দরজা ভেঙে মারবে। তাছাড়া বিশ মিনিট তো এখন সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থাকতেও চলে যাবে।’
– ‘ও আচ্ছা, তাহলে আপনি একটা কাজ করুন। পলিথিন বা কাগজের ব্যাগে লুঙ্গি গামছা ভরে এখানে চলে আসুন।’
– ‘কেন?’
– ‘এতো কথা বলেন কেন? আপনি আসুন তো, রাখছি।’
মৃদুল এখন নিজের উপরেই বিরক্ত। কোন উন্মাদিনীর পাল্লায় পড়েছে সে? প্রথমদিন নাম্বার না দিয়ে ভালোই করেছিল। কিন্তু গতকাল নিজ থেকেই তার কল দিতে হয়েছে। এক সপ্তাহ আগেই মালিককে বিস্তারিত সহ বলে দিয়েছিল নতুন লোক খুঁজতে, সে আর কাজ করবে না। গতকাল অন্য একজন কর্মচারী এসেছে। ডাক্তারনির সঙ্গে কথা বলে ঠিক হয়েছিল আজই সে চেম্বারে যাবে। তাই বলে ভোর ছ’টা থেকেই মালিকগিরি দেখিয়ে নির্যাতন শুরু করতে হবে? রাতে বরকত চাচাদের সঙ্গে তাস আর পাঞ্জা খেলে সে তিনটায় ঘুমিয়েছে। ভেবেছিল সাড়ে আটটায় উঠে গেঞ্জি একটা পরেই চেম্বারে চলে যাবে। কিন্তু না, ডাক্তারনি তাকে গুনে গুনে এ নিয়ে চারবার কল দিয়েছে। তার উপর আবার গোসল করে বাবু সেজেও যেতে হবে। মৃদুল একটা পলিথিনের ব্যাগে কাপড় ভরে ভাবলো এখানে দাঁত ব্রাশ করে যাবে না-কি ওখানে গিয়ে করবে? বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে দু’জন বাথরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একজন দাঁত ব্রাশ করছে আরেকজন লুঙ্গির ওপর দিয়ে উরু চুলকাচ্ছে। ব্রাশ আর পাউডার ব্যাগে ভরে রাস্তায় নেমে পড়ে৷ ফুটপাত ধরে পাঁচ মিনিট হেঁটে চলে এলো মামণি ফার্মেসির সামনে। উপরের তলায় দেখা যাচ্ছে ‘মানহা ডেন্টাল কেয়ার।’
ফার্মেসির ডান দিক দিয়ে সরু সিঁড়ি দেখে উঠে গেল উপরে। গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে ভেতরের কিছুই দেখা গেল না। কয়েকবার নক দিয়ে অপেক্ষা করেও কোনো সাড়া না পেয়ে কল দেয়৷ কিন্তু রিসিভ না হয়ে কেটে এলো। বিরক্ত হয়ে বাইরে পায়চারি করে খানিক্ষণ। পাক্কা বিশ মিনিট পর কেউ গ্লাস টেনে খুলছে দেখে সে এগিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে গ্লাসের আড়াল থেকে মেয়েলি গলায় বললো,
– ‘এই আসবেন না।’
তখনই ফাঁক দিয়ে ফর্সা ভেজা একটা হাত বের হয়ে এলো,
– ‘বোতলটা নিন।’
মৃদুল বিরক্ত ভঙ্গিতে বোতল নেয়। পুনরায় হাত ভেতরে গিয়ে বের হয়ে এলো একশো টাকা সমেত।
– ‘ইউনিয়ন অফিসের পাশে একটা দোকানে দুধ বিক্রি করে। আপনি তাড়াতাড়ি গিয়ে দুধ নিয়ে আসুন।’
মৃদুল টাকা আর বোতল নিয়ে চলে যাবে মেয়েটি আবার ডেকে বললো,
– ‘এই শুনুন।’
– ‘আর কী?’
– ‘হাত স্পর্শ না করেও বোতল আর টাকা নেয়া যেতো।’
– ‘আশ্চর্য, আমি আপনার হাত ছুঁলাম কই?’
গ্লাসের ওপাশে ফিক করে হাসার শব্দ শোনা গেল।
– ‘হাত দিয়েছেন তো দিয়েছেন আবার মিথ্যে বলেন। যান তাড়াতাড়ি গিয়ে দুধ নিয়ে আসুন।’
মৃদুল দাঁত কটমট করে খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে চলে যায়।
ইউনিয়ন অফিস কোথায় সে জানে না। তবে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ইউনিয়ন অফিসের পাশের দুধের দোকানটি বের করতে তার খুব একটা সমস্যা হলো না। দুধ নিয়ে চেম্বারে ফিরে আসতে আটটা বেজে গেল। গ্লাসে কয়েকবার নক দিয়ে অপেক্ষা করে। খানিক পর মানহা গুনগুন করে এসে টান দিয়ে খুলে দেয়। মৃদুলের চোখের সামনে দৃশ্যমান হয় এক অপরূপ রূপবতী নারী। পরনে অচেনা রঙের শাড়ি। রঙটা সে ঠিক ধরতে পারছে না। এটা কী জলপাই রঙ? এরকমই কিছু একটা হবে। সদ্য গোসল করায় ভেজা চুল থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। মুখে এখনও প্রসাধনী ব্যবহার করা হয়নি। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়নি তার মৌলিক সৌন্দর্য।
চুল ঝেড়ে-মুছে বাঁ পাশ দিয়ে সামনে রাখায় একধার ভিজে গেছে।
– ‘হা করে তাকিয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।’
ঈষৎ লজ্জা পেল মৃদুল। এবার সত্যিই সে অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিল।
সে ভেতরে গিয়ে দেখে ডেন্টাল চেয়ার। তারমানে এটাই চেম্বার।
– ‘আসুন আমার সঙ্গে।’
মানহা গ্লাস খুলে পাশের রুমে যায়। সে পিছু থেকে তাকিয়ে আছে ওর ফর্সা নগ্ন কাঁধের দিকে। ছাই রঙা ব্লাউজের খানিকটা ভিজে গেছে।
– ‘বসুন।’ সোফা দেখিয়ে বললো মানহা।
মৃদুল সোফায় বসে চারদিকে তাকায়। ছোট্ট সুন্দর কামরা। নাকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ আসছে। একপাশে পালঙ্কে বিছানা করা। কেউ কি থাকে এখানে? দেয়ালের একপাশে রবীন্দ্রনাথের ছবি আর পৃথিবীর মানচিত্র।
মানহা বিছানায় সুন্দর করে বসে মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘নিচের দিকে তাকান।’
– ‘হ্যাঁ তাকিয়েছি।’
– ‘এটা কী?’
– ‘কার্পেট।’
– ‘আপনার পায়ে কী?’
‘জুতা’ বলেই মৃদুল নিজের ভুলটা বুঝতে পেরে লজ্জিয় ভঙ্গিতে বললো, ‘সরি, আমি আসলে খেয়াল করিনি। এখনই বাইরে রেখে আসছি।’
– ‘থাক জনাব, এসেই যখন পড়েছেন আর রেখে আসতে হবে না। এবার এই যে দেখুন বাথরুম। গিয়ে গোসল করে নিন।’
– ‘জ্বি ম্যাডাম যাচ্ছি।’
– ‘সবকিছু নিয়ে বাথরুমে ঢুকবেন। ওখানেই সবকিছু শেষ করে কাপড় পরে বেরুবেন। আমাকে বডি দেখানোর জন্য গামছা দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে বের হওয়া দরকার নেই।’
– ‘আমি আপনাকে বডি দেখাতে যাব কেন?’
– ‘আমি কী জানি কেন দেখাবেন, যান তো তাড়াতাড়ি গোসল করেন।’
মৃদুল বাথরুমে ঢুকে গেল। মানহা স্মিত হেঁসে উঠে দাঁড়ায়। তোয়ালে দিয়ে চুল আবার ভালোভাবে মুছে। তারপর দুধের বোতল নিয়ে বাথরুমের পাশের দরজাটি খুলে রান্নাঘরে যায়।
একটা প্লেট ধুয়ে ব্রেডের প্যাকেট থেকে এক পিস নিয়ে চাকু দিয়ে স্টিকসের মতো পাঁচ ভাগ করে কাটে। এভাবে সকল ব্রেড কাটার পর ফ্রাইপ্যান ভালোভাবে ধুয়ে চুলোয় বসিয়ে কয়েকটা ব্রেড স্টিক আলাদা আলাদা রেখে অল্প আগুন দেয়।
একটু পরেই একটা একটা করে উলটিয়ে দেখে নিচের দিকে লালচে আর মচমচে হয়ে গেছে।
নামিয়ে রাখে আলাদা প্লেটে। এভাবে সবগুলো স্টিক মচমচে করে ভেজে আলাদা প্লেটে রাখে। আবার ফ্রাইপ্যান ধুয়ে চুলোয় বসিয়ে অল্প চিনি আর পানি দিয়ে আগুনে কিছুক্ষণ নেড়ে অল্প একটু বাটার দেয়।
খানিক্ষণ এভাবে রেখে এক কাপ দুধ দিয়ে পুনরায় নাড়ে। অল্প সময় পর ভেজে রাখা ব্রেড স্টিকস একটা একটা করে ফ্রাইপ্যানে দেয়। দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখে মৃদুলের গোসল শেষ।
– ‘চেয়ার নিয়ে এখানে এসে বসুন।’
মৃদুল চেয়ার নিয়ে এসে বলে,
– ‘সবকিছুই এখানে আছে দেখছি৷ রান্নাঘর, বিছানা, বাথরুম। কেউ থাকে না-কি?’
– ‘না, তবে দাঁতের চেম্বারে রুগীর খুব বেশি ভিড় লেগে থাকে না। এখানেই শুয়ে-বসে কাটাই। নিজে এটা-সেটা বানিয়ে খাই। গান শুনি। বই পড়ি। রুগী এলে যাই।’
– ‘ও আচ্ছা। এগুলো কি করছেন?’
– ‘ব্রেড স্টিকস।’
– ‘এটা আবার কী?’
– ‘খেলেই বুঝবেন। এবার পারলে আপনি বঁটি দিয়ে নিচ থেকে পেয়াজ, আদা, কাঁচা মরিচ, টমেটো কাটেন। পারবেন?’
– ‘হ্যাঁ পারবো।’
– ‘ম্যাকারনির জন্য তাই কুচি কুচি করে কাটবেন।’
– ‘জ্বি আচ্ছা।’
– ‘আপনি কাটাকুটি পারায় ভালোই হলো। প্রতিদিন এভাবে ভোরে এসে এখানে গোসল করবেন। তারপর দু’জনে নাস্তা বানাবো।’
মৃদুল বঁটি নিয়ে বসতে বসতে বললো,
– ‘আপনার সহকারী একজন আছে বলছিলেন।’
– ‘সে তো এখনও স্টুডেন্ট। কলেজ শেষে আসে। তার চাকরির কারণ হচ্ছে শেখা।’
– ‘ও আচ্ছা।’
– ‘আপনি তো গোসল করলেন সবেমাত্র, তেল লাগবে?’
– ‘হ্যাঁ, থাকলে চুলে দিতাম একটু।’
মানহা মুচকি হেঁসে বললো,
– ‘নেই, কাল এনে রাখবো।’
– ‘আচ্ছা ঠিকাছে।’
– ‘কিন্তু আপনারা চুলে তেল দেন কেন বলুন তো। ছেলেদের কিন্তু তেল ছাড়া সিল্কি চুলে সুন্দর লাগে।’
– ‘তাই না-কি?’
– ‘হ্যাঁ, তেল দিলে কিরকম যেন হয়ে যায়। বাট তেল না দিলে আবার শেষে চুল লালচে হয়ে যাবে। চুল সজীবতা হারাবে।’
– ‘হ্যাঁ সেটাই, তেল না দিলে কেমন হয়ে যায়।’
দু’জন গল্প করতে করতে ব্রেড স্টিকস আর ম্যাকারনি বানিয়ে প্লেটে করে টি-টেবিলে এনে রাখে।
মৃদুল সোফায় বসলো। মানহা চেয়ার টেনে এনে সামনে চলে গেল। একটা স্টিক মুখে দিয়ে বললো,
– ‘এই রুমে থাকবেন আপনি?’
– ‘বুঝিনি।’
– ‘বলছি রাতে এখানে থাকতে পারবেন চাইলে।’
– ‘আমার তো থাকতে সমস্যা নেই।’
– ‘ঠিকাছে, আজ রাতে আমরা এখানেই ঘুমাবো।’
– ‘আমরা মানে?’
– ‘আপনি আর আমি।’
কথাটি শুনে মৃদুলের হাতের ব্রেড স্টিক ভেঙে পড়ে গেল টেবিলে।
—চলবে—