#শূণ্যতার_পূর্ণতা_তুমি
#রোকসানা_আক্তার
#পর্ব_১৬
সারাটা সন্ধা থেকে মেয়েটা চুপচাপ ছাদে একা বসে আছে।বাসার হলরুম জুড়ে প্যান্ডেলের কাজ চলতেছে।সূবর্ণাকে সেদিন দেখার পরই তাদের সবার পছন্দ হয়ে গেছে।আর সেদিনই বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে ফেলে।আকাশের অবশ্যি যদিও এখন রাজি ছিল না,কিন্তু শাশুড়ী মায়ের কারণে পারেনি!সূবর্ণা সন্ধা থেকেই কিছু খায়নি।আমি পাশে বসলাম মেয়েটার।চারপাশে তাকিয়ে দেখি অনেক বঁধার নেমেছে।সূবর্ণা আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরেও কোনো রিয়াকশন করলো না।বললাম,
“সূবর্ণা?মন খারাপ?”
তাকালো আমার দিকে।চোখের কোণে পানি জমে আছে।তারপর আবার দৃষ্টি আগের স্থানে রাখলো।
“সূবর্ণা?বিয়ে-মৃত্যু জন্ম সব আল্লাহর মর্জি।কিছুই করার নেই আসলে।রাজি না থাকলেও কীভাবে যেন হয়ে যায়।জানিস?আমিও যে তোর ভাইকে বিয়ে করতে চাইনি তখন, কিন্তু মা-বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছে।অথচ এখন সংসার করতে হচ্ছে।”
সূবর্ণা চুপ করে রইলো।বললাম,
“সূবর্ণা?”
সূবর্ণা ফুঁপড়ে উঠলো।আর আমাকে আলতো জড়িয়ে ধরে বলতে থাকলো,
“ভাবী?নিহাল ভাইয়া যদি ওরকম বখাটে না হয়ে যদি ভালে হত তোমরা সবাই তাকে মেনে নিতে,না?”
আমি চুপ করে রইলাম।সূবর্ণা আবার বলে,
“ও যদি একটু ভালো হত!কেনো ও এরকম হয়েছে ভাবী।কেনো!?”
সূবর্ণার কথা শুনে বুকেট ভেতরটা ধক করে উঠলো।মেয়েটা এখনো নিহালকে ভুলতে পারছে না!
“ভাবী?আমার ইচ্ছে ছিলো, নিহাল ভাইয়া একদিন বর সেঁজে আমাকে বউ করে নিয়ে যাবে।খুব আদর করবে।কিন্তু উনি কেনো ওরকম হলেন?আচ্ছা ভাবী?মানুষ খারাপ হলে কি মানুষকে ভালো করা যায় না?খারাপ মানুষ কি সবসময়ই খারাপ থাকে!?”
আমার ভেতরটা টনকে উঠলো!শক্ত করে ধরলাম সূবর্ণার হাতজোড়া।আলতো স্বরে বললাম,
“সূবর্ণা?মানুষ খারাপ থেকে ভালো হয়,আবার ভালো থেকে খারাপ হয়।আবার প্রতিটি খারাপ মানুষের মাঝেও ভালো কিছু গুণ থাকে,আবার ভালো মানুষেরও অনেক কুৎসিত গুণ থাকে।এসব বলা আসলে মুশকিল।তবে বলা যায় আল্লাহর সৃষ্টি কোনো মানুষই খারাপ না।আর সবথেকে বড় কথা পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষকেইনপরিস্থিতি তাদের খারাপ করে।”
সূবর্ণা চুপ করে রইলো।আর কিছু বললো না।আমি বললা,
“সূবর্ণা? খেতে চল!”
সূবর্ণাকে নিয়ে নিচে এসে বাসায় মেহমান।আগামী পরসু বিয়ে দূরের-কাছের সব আত্মীয়রা আসা শুরু করে দিয়েছে।সূবর্ণাকে আমার রুমে বসালাম।আর আকাশ এমন সময় রুমে ঢুকলো।আমান তার কোলে।আমানকে আমার কোলে দিয়ে বললো,
“রাখো আমানকে।আমি আসতেছি।”
———————————————————শেষবার সূবর্ণা আলতো হাসির মাঝে চাপা কান্না মুখে ঝুলিয়ে আমাদের রেখে চলে গেলো।আমার কেনজানি খুব খারাপ লাগতেছে!খুব!আমি রুমে এসে চুপচাপ বসে আছি।আমান পাশে খেলতেছে।আকাশ তখন রুমে ঢুকে।কেনজানি আকাশকে দেখে কান্না করে দিলাম।জড়িয়ে ধরলা৷ আকাশকে।আকাশ বুঝলো সূবর্ণার জন্য কাঁদতেছি!আকাশ শুধাতে থাকলো।
“কিছুই করার নেই সুপ্রভা!”
আমি আকাশকে কিছু বলতে পারলাম না।আমার সত্যিই অনেক খারাপ লাগতেছিলো।মনকে কেনজানি মানাতে পারছি না কিছুতে!সেদিনই দেখলাম কত ছোট্ট ছিল যেন,আর আজকে সেই মেয়ে পরের বাড়ির বউ হয়ে চলে গেলো!আমাকে এসে সারাক্ষণ এসে বলবে না”ভাবী?ভাবী?”
বিয়ের আজ তিনদিন কেঁটে যায়।আমি রান্না ঘরে আমানের জন্যে খিঁচুড়ি বানাচ্ছি।মা হঠাৎ কলে চেঁচিয়ে উঠেন।
“কি বলতেছো আপা তুমি এসব?আমার মেয়েকে আমেরিকা নিবে না মানে?বিয়ে তখন তাহলে কি বলে করেছে?হ্যাঁ?”
শাশুড়ী মা আবার বলেন,
“ছেলে যদি সেটেল হয় অস্ট্রেলিয়া,তাহলে সমস্যার তো কথা না যেতে সূবর্ণার!”
শাশুড়ী মা আবার,
“এখন কিছুতেই আমেরিকা নিবে না?তো আমার মেয়ে থাকবেটা কই?বিয়ের আগে কি এমন কথা ছিল!এটা বলেন আমাকে!”
শাশুড়ী মা দেখি পুরো রাগ হয়ে আছেন।চোখ টকটকে লাল।ফোনটা ঠাস করে সোফার উপর ছুড়লেন!আর বসে পড়লেন।ঘামতেছেন খুব!আকাশকে ডাকতে থাকলেন।আকাশ এখনো অফিসে যায় নি।রেডি হচ্ছে যাওয়ার জন্যে।আকাশ টাই ঠিক করতে করতে বলে,
“হ্যাঁ,মা..বলো?”
“সূবর্ণার শ্বশুর বাড়িতে আজ যাস তো!”
শাশুড়ী মা প্রচন্ড জোর দিয়ে কথাটা বলতেছেন!মুখের ভাবে বুঝতে পারলো আকাশ শাশুড়ী মা খুব রেগে আছেন।তাই আকাশ বললো,
“কিছু হয়েছে মা?”
“এত কথা বলতে পারবো না।তুই গিয়ে সূবর্ণার জামাইকে বলবি আজকে সন্ধায়ই সূবর্ণাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতে!”
“সেটা তুমি তাহলে ফোনেই বলে দাও।”
“ফোনে বলা এবং সরাসরি বলা আলাদা।সরাসরি বললে আসবে।”
“আমার সময় হবে যাওয়ার যা চাপ অফিসে।”
“চুপ কর!ওরা মিথ্যে বলেছে!আমার মেয়েকে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যাবে বিয়ের পরপরই।এখন বাহানা শুরু করেছে!ওর জামাইর সাথে সরাসরি কথা বলবো!সমস্যা কি আসলে যে নিবে না!”
“মা এটা নিয়ে এখন কথা বলাটা উচিত না।নতুন আত্মীয় করেছি!এসব বললেও ছোটলোকী দেখাবে।তাছাড়া,অস্ট্রেলিয়ায় একদম যেতেই হবে তোমার মেয়েকে এমন কোনো কথা নয়।শ্বশুর-শাশুড়ী আছে তাদের সাথে থাকবে সমস্যা কোথায়!”
“তখন কি এই কথা বলে বিয়ে করিয়ে নিয়েছে আমার মেয়েকে?উল্টা কথাবার্তা বলতেছিস কেনো!”
“মা একটু বুঝার চেষ্টা করো..অস্ট্রেলিয়ায় এখন নিয়ে যাচ্ছে না হয়তো ঝামেলা থাকতে পারে। থাকতে পারে না?!”
“তুই কোনো কথা বলবি না।যেটা বলেছি সেটা কর তুই!”
“আমার পক্ষে সম্ভব না!এসব ছোট্ট বিষয় নিয়ে একটা ইস্যু হবে আমু এসবের মাঝে নেই!তোমার ইচ্ছে হলে তুমি নিজে যেয়ে বলো!”
এ বলে আকাশ বেরিয়ে যায়।
সন্ধের দিকে আকাশ অফিস থেকে ফিরলে আমান দৌড়ে যেয়ে বাবার কোলে উঠে।আর বাবাকে ওর ডান গালটা দেখায়!তারপর আমাকে হাত দিয়ে দেখায়!আকাশ বুঝে উঠতে পারে না আমান কি বুঝাচ্ছে!আকাশ আমাকে তখন বলে,
“কি করেছো ছেলেকে?তোমাকে দেখাচ্ছে কেনো?”
“মেরেছি!”
“কেনো?!”
“খিচুড়ি খাওয়াতে পারি নি!”
“তাই বলে মারবে?”
“তাহলে তুমি খাওয়ায় দিকি!”
আকাশ এবার হেসে দেয়!তারপর ছেলের দিকপ তাকিয়ে বলে,
“আমান তুমি দুঃখ পেয়ো না!আমি এখনই তোমার মাম্মামকে মাইর দিব।খুশি?”
আমান হেসে দেয়!
“তাহলে তুমি দাঁড়াও পাপ্পা এখানে!তোমার মাম্মামকে ডিসিমডিসুম দিয়ে আসি।”
আমান কে নামিয়ে এবার আকাশ আমার দিকে এগিয়ে বসে।আর আসার ভণিতা দেখে আমার ভ্রু যুগল কুঁচকে আসতে থাকে। ভাবতে থাকি সত্যিই আমাকে মারতে আসতেছে নাকি।যখন আমার একদম কাছে চলে আসে, তখন বলে উঠি,
“এহহহহহ…কি!”
বাকিটুকু বলতে পারি নি!ঠোঁটজোড়ায় আলতো একটা চুমু বসিয়ে দেয়!আমি হতবাক!তারপর আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আমানকে ডেকে উঠে,
“আমান?”
আমান তাকায়।আকাশ বলে,
“এখন ডিসিম দিই?”
আমান মাথা নাড়ে।আকাশ ওমনি আমার গালে খুব আস্তে কামড় বসিয়ে দেয়!তা দেখে আমান খিলখিল করে হেসে উঠে।আমি বলি,
“নির্লজ্জ!বাচ্চাদের সামনে এরকম করে কেউ!”
“এরকম না!মেরেছি তোমাকে!ভালোবাসার মাইর বুঝো?”
“হইছে!রাখেন আপনার ভালোবাসার মাইর!এবার ছেলেকে মানুষ করেন!ও খেতে চায়না!”
“একটু কষ্ট করো।আর ওকে মারবে না।আদর করে,ইনিয়ে বিনিয়ে খাওয়াবে সুপ্রভা।”
“মারি নি!গালে আস্তে একটা টোকা দিছি এতেই আপনার ছেলের যত নাটক ঠিক আপনার মতন!”
আকাশ খিলখিল করে হেসে দেয়।তাকিয়ে থাকি হাসির দিকে।খুব সুন্দর করে হাসে।মসৃণ দাঁতে,মুখে, গোলাপী ঠোঁটে,ভাসা চোখে এই ছেলেটার হাসিটুকু যেন আমার চোখজোড়া স্থির হয়ে যায়।তাকিয়ে থাকি!এমন সময় ফোন বেজে উঠে আকাশের।আকাশ বিছানা থেকে ফোনটা নিয়ে দেখে সূবর্ণা কল করেছে।
“সূবর্ণা কল করেছে।”
“আমাকে দেও।”
আমি ফোনটা হাতে নিয়ে,
“হ্যালো সূবর্ণা?”
সূবর্ণা কাঁদতেছে!
“কিরে কাঁদতেছিস কেন?কি হয়েছে?”
“মা কোথায় ভাবী?”
“কেনো কি হয়েচে বল আমাকে?”
“সিয়াম কিছুক্ষণ আগে আমেরিকা ব্যাক করেছে।যাওয়ার সময় আমাকে বলে গিয়েছে আর কখনো আমাকে বাপের বাড়িতে আসতে দিবে না।এখানেই থাকতে!আমি এখানে থাকতে পারবো না ভাবী।এই বাড়ির প্রতিটি মানুষগুলা কেমনজানি খুব কঠিন মনের।আমার ভাল্লাগে না ভাবী।আমি বাড়িতে যাবো।আমি তোমাদের ছাড়া কীভাবে থাকবো!”
বলে আবারো।কাঁদতে থাকে সূবর্ণা!আমি নিশ্চুপ হয়ে যাই সূবর্ণার কথা শুনে।আকাশ বলে,
“কি হয়েছে সূবর্ণা!”
আমি আকাশকে কিছু বলতে পারি নি!
চলবে…….
(দুইদিন পরপর ক’দিন গল্প দিব।ফাইনাল এক্সাম চলতেছে।)