ভালোবাসার প্রতিদান #রোকসানা আক্তার পর্ব-০৪

0
635

#ভালোবাসার প্রতিদান
#রোকসানা আক্তার
পর্ব-০৪

কিছুক্ষণ আগের স্বচ্ছ নীল আকাশটা এখন ঘন কালো মেঘে তে ভরপুর।বারবার বিজলি চমকে উঠছে।সবকিছু শুনশান আর নিরব।পরিস্থিতিই বলছে যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।আমি গ্লাসের মধ্য দিয়ে সেদিকে খানিক্ষন তাকিয়ে থেকে সামনে বসে থাকা আকাশ ভূঁইয়া অনিলের দিকে এবার তাকাই।সে এখন আমার সামনে বসে আছে।অবশ্যি গতকাল তার ফোন অন করার পর আমার নাম্বারটি তার কল এলার্টে দেখতে পায়।দেখার পর মনে মনে ভেবেছিলো আমিই হতে পারি।কারণ নাম্বারটি একদম অপরিচিত ।তাকে অপরিচিত কল করার মতন তেমন কেউ ই নেই।অপরিচিত হিসেবে আমিই ছিলাম, যাকে সে দুপুরে তার কার্ডের নাম্বারটি দিয়েছিল।আর তার ফোন অফ থাকার কারণ ছিল সে ঢাকায় যাওয়ার সময় ফোনে ফুল চার্জ করে যায়নি। ঢাকায় অনেকটা তাড়াহুড়োর উপরই রওনা করে।ঢাকায় যাওয়ার পরপরই যেটুকু চার্জ ছিল সেটুকুও ফুরিয়ে যায়।এতে ফোনটা অফ থাকে কিছুক্ষণ সময়।তবে আমি ছেলেটিকে যতটা খারাপ ভাবলাম সে ততটা খারাপ নয়।আমার ভুল ভাবনাকে গুড়িয়ে দিয়ে সে তার পরদিনই আমার সাথে দেখা করতে চলে আসে।আর তার দেখা করার উদ্দেশ্য একটাই ওই ছবিটি দেখার জন্যে!

“ঢাকা থেকে ভেবেছিলাম আরো দুইদিন পর ফিরবো।কিন্তু আপনার অবস্থার কথা ভেবে দেরী করলাম না।তাই রাতই চলে এলাম।”

আমি একটু হাসার চেষ্টা করে বলি,

“ওহ আচ্ছা।”
“জ্বী।তা এবার ছবিটি কি আমি দেখতে পারি?”
“জ্বী, দেখতে পারেন।”
বলে আমি ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকি। সেখান থেকে ছবিটা স্ক্রিনে এনে তার দিকে এগিয়ে দিই।সে তার হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকায়।তাকাতেই তার ভ্রু যুগল কুঁচকে আসে।চোখমুখে এক আকাশসম বিস্ময় ছুঁয়ে যায়।সাথে সাথে স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে বলে,

“হোয়াট ইজ দিস?!”
“সেইম প্রশ্ন আমারও!”

মুহূ্র্তে যেন সে তার সৎবিত হারিয়ে ফেলে।খানিক্ষন চুপ থেকে দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে তারপর বলে,

“আমি জানি না আমাকে আপনার বিশ্বাস হবে কি না!তবে এটা সত্যি আমি এরকম কিছুই করি নি!আর তারপরও যদি আপনার উপর আমার সন্দেহ থেকে থাকে তাহলে কাইন্ডলি রিকুয়েষ্ট- আমার উপর তদারকি করতে থাকুন।আমি আমার পরিবার,আত্মীয়-স্বজন সবার ডিটেইলস আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি।”

“নাহ, তার প্রয়োজন নেই!আপনি না হারালেই হবে!”
“সন্দেহ হয়?”
“হতেও পারে!”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।সন্দেহ করুন।আমার নো প্রবলেম।টাঙ্গাইলই আছি।কোথাও যাচ্ছি না!তবে মাঝে ফাঁকরে যদি আমার ইন্টারভিউতে ডাক আসে তাহলে আবার কিছুদিনের জন্যে আমাকে হারাতে হবে।তখন আবার ভাববেন না আমি ভয়ে পলাতক হয়ে গেছি।আর হ্যাঁ ঢাকায় যাওয়ার পর অবশ্যই আপনার সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখবো।”

বলে সে হাসার ভঙ্গিমা করে।হাসিতে তার কোনো ধূর্ততা নেই,নেই চাটুকারিতা।খুব সহজ আর নির্মল সেই হাসি!মুহূর্তে মনে হয় ওই কাজটি আসলেই এই ছেলেটি করে নি।অন্যকেউ করেছে।তাহলে কে করেছে ওমন নোংরা কাজটি?আর কেনই বা করলো?কী এমন উদ্দেশ্য ছিল তার?মনের ভাবনার মাঝেই,

“আচ্ছা,অনেক্ষণ ধরেই ত বসে আছেন।চা খাবেন না কফি?”

বলে সে চারপাশ চোখ বুলাতে থাকে ওয়েটারের খোঁজে।

“নাহ এখন কিছু খাবো না।”
“আসছেন গেস্ট মানুষ।হালকা পাতলা কিছু মুখে না নিলে কেমন দেখায়, বলুন?”
“আমি গেস্ট হলাম আবার কবে?আমিতো জাস্ট একজন অপরিচিত মানুষ!”
“প্রথম দিন অপরিচিত ছিলেন।সেদিন আপনি আমার নাম জানতেন না,আমিও জানতাম না।আজ আমি আপনার নাম জানি এবং আপনিও জানেন।তাই এখন আর আমরা অপরিচিত না।”
“শুধু নামেই বুঝি পরিচিত হয়ে যায়?”
“জ্বী।আমার হিসেবে যাদের মানুষ একদম নামই জানে না তারা অপরিচিত। কারণ নামের মাধ্যমেই মানুষের প্রথমে পরিচিয় শুরু হয়।”
“ভেরী ইন্টারেস্টিং ত।”

ছেলেটি আবারো হেসে দেয়।

“যাইহোক আপনার এই ইন্টারেস্টিং কথার জন্যে এক কাপ চা অবশ্যি খেতে পারি।”
“শুনে খুশি হলাম।”

তারপর দুজনে চা খেলাম।চা খাওয়া শেষ হলে সে আবার বলে,

“একটা কথা বলবো যদি কিছু মনে না করেন?”
“জ্বী,বলুন?”
“আমাকে ছাড়াও আপনার এমন কারো উপর সন্দেহ যায় যে আপনার ছবিটি এরকম করতে পারে?”
“নাহ।তেমন কারো উপর যাচ্ছে না আপাতত।”
“ভেবে দেখুন একটু!এমন তো নয় কেউ গোপনে আপনার বয়ফ্রেন্ডকে খুব পছন্দ করতো।তাকে পেতে আপনাকে পথ থেকে সরাতে চেয়েছে।বা আবার কোনো ছেলে যে আপনাকে খুব পছন্দ করে।সে আপনার বয়ফ্রেন্ড সরে আপনাকে সরাতে এরকম কান্ড করেছে।দেখুন আমি বলতে চাচ্ছি কি ছবিটি যেহেতু আপনার বিয়ের দিন পাঠানো হয়েছে তাই মূলত উদ্দেশ্য ছিল বিয়েটা ভেঙ্গে ফেলার!আর তা সাকসেসও হয়েছে।বিয়েটা ভেঙ্গেপ গেল আপনার!”

চুপ করে থাকি!আর মনে মনে কথাগুলো আঁচ করতে থাকি।আসলে ছেলেটি ত মন্দ বলে নি!হতে ও পারে!

“আমাকে আরেকটা কথা বলুনতো?আপনার ছবি কার কার কাছে আছে?আই মিন আপনার কোনো মেয়ে ফ্রেন্ড অথবা ছেলে ফ্রেন্ড, বা বাইরের কেউ?”
“ছেলে ফ্রেন্ড আমার তেমন নেই। দুই একজন আছে।তবে আমার কোনো ছবি তাদের কাছে নেই।আমি দিই নি কখনো।ছেলেদের মাঝে বলতে রিয়াশের কাছেই আছে শুধু ।তাও কচিৎ।আর মেয়েদের মাঝে অনেকের কাছেই আছে।যেমন তিথি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর কাছে আমার সবগুলো ছবিই বলা যায় সংরক্ষিত।কারণ,আমার বেশিরভাগ ছবি তোলা হয় ওর ফোন দিয়েই।ওর ফোনের ছবি খুব সুন্দর উঠে সেজন্যে। আরো আছে টোয়া,ছোঁয়া,নদী, পৃথী,রিতি আরো অনেকের কাছেই আছে।এছাড়া আমার ফ্যামিলি মেম্বার্সদের ছাড়া আর বাইরের কারো কাছে আমার ফটো নেই।”

“আপনার এই মেয়ে ফ্রেন্ডদের মধ্যে কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?”
“নাহ।সন্দেহ কেন হবে!ওরা ত আমার জানের জান।ওরা রিয়াশকে পছন্দ কেন করবে।কারণ যেখানে আমি সেখানে ওরা একদম নেপথ্যে।চোখ তুলেও তাকায় নি রিয়াশের দিকে।”
“খুব বিশ্বাস বান্ধবীদের উপর,না?”
“অনেকটা।”
“গুড!তারপরও চোখকান একটু খোলা রাখবেন।অনেক সময় দেখা যায় যেটা মানুষ কখনো কল্পনাও করতে পারে না পরে দেখা যায় সেরকম কিছুই ঘটে গেছে। দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ আ ভেরী স্ট্যান্জ প্লেস এন্ড হেয়ার’স পিপল অলসো।বিকজ,দ্য ওয়ার্ল্ড’স এক্টিভিটিজ ডিপেন্ডস অন
দ্যাট পিপল! বায় দ্য ওয়ে,আর বেশি চাপ নিবেন না।যে এরকম করেছে সে একদিন না একদিন ঠিকই ধরা পড়বে।তাকে ধরা পড়তেই হবে।সে যদি আমিও হয়ে থাকি।কারণ সত্য কখনো চাপা থাকে না!”

চুপ করে থাকি।ছেলেটি এবার ব্যস্ত ভঙ্গিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,

“তাহলে এবার আমরা উঠি।আপনার যদি আবার আমাকে প্রয়োজন পড়ে ডাকতে পারেন।আমি ঠিক সময়ে এসে হাজির হওয়ার চেষ্টা করবো।”
“আচ্ছা।থ্যাংকস!”
“থ্যাংকস দেওয়ার প্রয়োজন নেই।বায় এ্যানি চান্স ওই কাজটি করা নিয়ে যদি আমাকে নিয়ে সন্দেহ হয়ে পড়ে তাহলে তখন ত আর থ্যাংকস দিবেন না।সোঁজা কথা জুতা পট্টি খেতে হবে!”
বলে ছেলেটি আবারো হেসে উঠে।আমি ছেলেটির হাসির দিকে তাকিয়ে থাকি।মনে মনে ভাবি,ছেলেটি কী একটু বেশিই হাসে?কথা কথায় হাসে?অনেকে কথায় কথায় হাসলে দাঁত বেঁকে যায়।চোখ হাতির চোখের মতন হয়ে যায়।গাল চিমসে যায়।কিন্তু এই ছেলেটির ক্ষেত্রে তা একদমই হয়নি।ছেলেটি যতবারই হাসছে ততবারই তার হাসিতে মুখের সৌন্দর্য আরো দ্বিগুণ ফুঁটে উঠছে।

—————————————————————————

রুমে ঢোকার পর ভাবীও খুব সন্তপর্ণে পায়ে ভেতরে আসেন।দরজা চাপিয়ে দিয়ে আমার পাশে এসে বসেন।শীতল গলায় বলেন,
“ছেলেটি ওই ছবিটার ব্যাপারে কিছু বলেছে, প্রিয়া?”
“বলেছে ভাবী।”
“কি বলেছে?”

আমি কয়েক সেকেন্ডস যাবৎ চুপ করে থাকি।তারপর কথার ফোঁড়ন কেঁটে বলি,
“ভাবী আমার কি মনে হয়,জানো?”
“কি?”
“ছেলেটি এই কাজটি করে নি!”
“কীভাবে সিউর হলি,তুই?”
“কথার ধরণেই বুঝেছি।’

ভাবী আমার কথায় একটা তাচ্ছিল্যকর হাসি দেন।
“জানিস?যেই মানুষগুলোর কথাতে মনে হয় সে এই কাজটা করতে পারে না। সেই মানুষগুলোর মাঝেই গিয়ে দেখ ভেঁজাল আছে!কারণ,তার দিকে সন্দেহ না যেতে সে খুব সুন্দর করে কথা সাঁজায়। এমনভাবে সাঁজায় মুহূর্তের জন্যে মনে হয়, না সে ওই কাজটি করতেই পারে না!মোটেই পারে না।”
“কিন্তু না ভাবী ছেলেটিকে আমার ওরকম মনে হচ্ছে না একদম।সে কথা সাঁজায় নি।গুছিয়ে বলতে জানে।আর তার কথার এই গোছানোতেই বারবার সত্য সব প্রতীয়মানিত হচ্ছে।ভাবী আমি সত্য-অসত্য বুঝি।সত্য কথায় কখনো গরজিয়াস কিছু থাকে না।একদম সাধারণ সব বস্তু থাকে।যেমন তার কথা।তার হাসি দেওয়ার ভঙ্গিমা।আর মিথ্যাতে অতিরঞ্জিত নামক কিছু বস্তু থাকে।দেখলেই চট করে ধরে ফেলা যায় যে সে মিথ্যে বলছে!”
“তারপরও একেবারে হাত-পা ছেড়ে ছেলেটিকে বিশ্বাস করে বসিস না।এলার্ট থাকবি তার উপর।”
“তা অবশ্যই।”
“আচ্ছা এছাড়া তোর অন্য কাউকে আর সন্দেহ হয়?”
“হয়না।তবে সন্দেহ করতে হবে।ভাবী তোমার মনে হয়?আমার বান্ধবীদের মাঝে কেউ এরকম করতে পারে?!”

ভাবী এ’কথা শুনামাত্রই কিছুটা হকচকিয়ে যান।চোখমুখ তীব্র সংকুচিত করে খানিক্ষন কিছু ভাবতে থাকপন।তারপর দ্বিধা ভরা গলায় বলেন,

“অসম্ভব নয়!করতে পারে তারা প্রিয়া!এমন তো নয় তোর ফ্রেন্ডদের মধ্যে কেউ রিয়াশকে খুব পছন্দ করতে?”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here