#ভালোবাসার প্রতিদান
#রোকসানা আক্তার
পর্ব-০৫
পরপর দু’দিন কেঁটে গেল!এখনো কাউকে সন্দেহ করার কোনো ক্লু পাই নি।বান্ধবী সবার সাথে যোগাযোগ করেছি!রসিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলেছি তারপরও লাভ বিশেষ হয়নি।সেই ছেলেটির কথায় ভরসা করে তাকেও যে সার্চ করিনি তা নয়,তারসাথেও এরফাঁকে বার কয়েক কথা বলেছি।দেখাও করেছি!আগের মতনই তার সেই নির্লিপ্ত কথা বলার বাচনভঙ্গি। এবারের জন্যেও মনে হয়নি সে ওরকম কিছু করেছে !তাহলে কে?কে?কে সেই ব্যক্তি?একই প্রশ্নে বারবার এসে ঠোক্কর খাই ।না এর কোনো উত্তর পাই।এবার সত্যি আমি হতাশ! আমি উদাস!মাথাটা আবার সেই আগের মতন চৌকাঠের সাথে লাগিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করি!চোখের পাতা বুঁজি!এভাবে কয়েক মিনিটস অতিবাহিত হয়!হঠাৎ ফোনের তীক্ষ্ণ আওয়াজে ক্লান্তি পাতা জোড়া আবার চ খুলে যায়।পাশ ফিরে ফোনটা হাতে নিই।স্ক্রিনে তাঁকিয়ে নদীর কল।রিসিভ করি।
“হ্যালো?”
“প্রিয়া তুই এখন কোথায় রে?”
“বাসায়।”
“একটু নোয়ারীপুর আসতে পারবি?”
“হঠাৎ নোয়ারীপুর?খুব প্রয়োজন?”
“অনেক।”
“এখুনি আসতে হবে?”
“হ্যাঁ,এখনই।”
“আচ্ছা আসতেছি।”
“আর শোন?ক্যাফের দিকটায় আসিস।”
“আচ্ছা।”
নদীর কল রেখে ত্রিশ মিনিটের মাথায় ক্যাফেতে পৌঁছে যাই।কিছুটা হাঁটতেই নদীকে সামনে পেয়ে যাই।আমি হালকা মৃদু হেসে নদীর কাছে ছুটে যাই।
“কী রে? এত আর্জেন্ট কেন ডেকেছিস?”
নদীর মুখটা মুহূর্তে কেনজানি খুব গম্ভীর করে ফেলে!কথা বলতে যেয়েও কথার ফসলা এড়িয়ে যাচ্ছে।তা দেখে,
“তোর কি মন খারাপ নাকি, নদী?কিছু হয়েছে?”
নদী এবার চট করে বলে উঠে,
“কেমন বান্ধবী তোর? আর কেমন বয়ফ্রেন্ড তোর? কেমন মানুষদের সাথে সম্পর্ক করেছিস?”
“মানে?কি কেমন বান্ধবী কী কেমন বয়ফ্রেন্ড? বুঝলাম না ঠিক?”
এবার দেখলাম নদীর গাম্ভীর্য মুখখানা ধীরে ধীরে লাল হয়ে যাচ্ছে।সে যে খুব বেশীই রেগে গেছে তা বেশ বুঝতে পারি।টকটকে মুখে বার কয়েক জোরে গাঢ় নিশ্বাস ছেড়ে আমাকে পেছনের দিকে কিছু একটা ইঙ্গিত করে বলে,
“ওই দ্যাখ!”
সাথে সাথে আমি পেছন ঘুরে তাকাই।পেছনে ক্যাফে!ক্যাফের গ্লাস ভেদ করে ক্যাফের ভেতরের একদম পশ্চিমের কর্ণারের দিকটায় রিয়াশ বসে আছে।আর তারই একদম গাঁয়ের সাথে গাঁ ঘেঁষে পাশে বসে আছে আমার প্রাণপ্রিয় বান্ধবী তিথি!দুজনে কি নিয়ে কথা বলছে আর কুঁটি কুঁটি হাসছে!দৃশ্যটা দেখার পর আমি মুহূর্তের আমার হাত-পা,পুরো শরীর কেঁপে উঠে।পুরো মাথাটা ঘুরতে থাকে।আর সাথে পৃথিবীটাও!টপ করে দু’চোখের কার্ণিশ বেয়ে দুই ফোঁটা জল গড়িয়ে যায়!নদী আমাকে শক্ত করে চাপড়ে ধরে!সান্ত্বনা স্বরে বলে,
“পৃথী শক্ত কর নিজেকে।পৃথিবীটার মানুষগুলোই এরকম একেকটা স্বার্থপর, নিষ্ঠুর,বেঈমান বাট নাথিং টু স্যা!”
নদীর কথা আমার মাথায় ঢুকলো কি ঢুকলো না তা আমি জানি না!তবে আমার ভেতরের ক্ষিপ্রতা যে চরম মাত্রায় বেড়ে গিয়েছে তা বেশ বুঝতে পেরেছি।আমি নদীকে এক হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ক্যাফের ভেতরে এগুতে থাকি!ওদের সামনে এসে দাঁড়াই।কঠিন গলায় রিয়াশের দিকে সোঁজা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই,
“এসব কি,রিয়াশ?”
আমার কথা রিয়াশের কুর্ণককুহরে যেন প্রবেশদ্বার করলো না।আগের মতনই স্বাভাবিকভাবে বসে রইলো সে।
“কী হলো?আমার কথার জবাব দিচ্ছ না কেন?!”
“কী জবাব দিব?”
” তিথির সাথে এসব কি চলছে?”
“দেখতেই ত পাচ্ছো কী চলছে!আবার জিজ্ঞেস করতেছো কেন!?”
এবার আমি খানিকটা দমে যাই!রাগ এবং চোখের পানি দুটোতেই যেন আমার ভেতরটা বিষে পরিণত হচ্ছে!নিজেকে বহু কষ্টে সামলাই!
“সেদিন ওই ছবিটা দেখে আমাকে চরিত্রাহীনা বলেছ!এখন তুমি কোথাকার চরিত্রবান পুরুষ শুনি? যে একটা প্রেম শেষ করতে না করতেই অন্য আরেকটা মেয়ের সাথে ফষ্টিনষ্টি করা শুরু করে দিয়েছে!”
“তুমি যদি অন্য আরেকটা ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করতে পারো তাহলে আমি কেন পারবো না?আর তুমিতো বয়ফ্রেন্ড থাকা অবস্থা ওরকম অসভ্যতামী করেছো।আমি করি নি!তোমার মতন মেয়েকে ছুঁড়ে ফেলে তারপর করতে এসেছি!”
“তাই বলে একে?!”
“সো হোয়াট?”
এবার তিথির দিকে তাকাই!তাকানোর দৃষ্টি শান্ত!
“তিথি?তুই না আমার বেস্ট ফ্রেন্ড?ভার্সিটির সবার থেকে বেস্ট বান্ধবী যাকে বলে।সে তুইও শেষ পর্যন্ত আমাকে এই প্রতিদান দিলি?”
তিথি আমার কথায় কোনো উত্তর করেনি।কেমন “ডোন্ট কেয়ার” ভাব নিয়ে অন্যদিক তাকিয়ে আছে!এমন সময়
নদী পেছন থেকে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়।আমার কথার ফোঁড়ন কেঁটে বলে,
“প্রতিদান দেবে কি আর!ও তো পুরাই একটা স্বার্থপর আর বেঈমান আজ যা দিল পরিচয়!”
“মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ,নদী!”
“এখন গাঁয়ে লাগতেছে খুব?দোষ করতে পেরেছিস এখন তা বললেই দোষ?!আরেহ,নিজেই ত দেখলি প্রিয়ার বিয়েটা কীভাবে ভেঙ্গে গেল!আর তুই নিজেই সেই বান্ধবীর হাবির সাথে সাথে সম্পর্ক করতে গেছিস?এতটা নীচক মানসিকতা তোর!ছিঃ!আমার ভাবতেও ঘেন্না লাগে!তুই বান্ধবী নামের কলঙ্ক!”
“সাট আপ,নদী!অনেক বলেছিস!এবার আমার কথা শোন,আমি নীচক মানসিকতা কাজ করেছি রিয়াশকে ভালোবেসে!আর ও যে এরচেয়েও জঘন্য কাজ করেছে তাও রিয়াশের সাথে সম্পর্ক থাকাবস্থায়?তা কী খুব উঁচু মানসিকতার কাজ?তাছাড়া রিয়াশকে ত আমি জোর করে ভালোবাসি নি।রিয়াশ নিজেই আমাকে আগে প্রপোজ করেছে!জিজ্ঞেস করে দেখ রিয়াশকে?”
“প্রয়োজন নেই।ভালোবাসলে আগলে রাখ!তবে দেখিস না আবার তোর ভালোবাসার মাঝে যেন আবার অন্যকেউ এসে রিয়াশকে না নিয়ে যায়!কারণ রিয়াশের প্রেম রোগ!নাহলে কেউ আগের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক খুব সহজে ভুলে যেয়ে অন্য আরেকটা মেয়ের খুব সহজে হাত ধরতে পারতো না!”
রিয়াশ চোখ গরম করে এবার নদীর দিকে তাকায়।ভাবলো নদীকে দুই একটা কথা বলবে।বলতে যেয়েও পরে আবার দমে যায়।তিথি বলে উঠে,
“সম্পর্ক ধরে রাখবে?হা হা হা হা।অন্ধের মতন কথা বলতেছিস নদী তুই!কারণ ও যেই কাজ করেছে তা শুধু রিয়াশ নয় যেকোনো ছেলের পক্ষেই মেনে নেওয়া অসম্ভব!”
“তোর বিশ্বাস হয় প্রিয়া এরকম করেছে?”
“অবিশ্বাসের কী আছে?”
“তবে আমার যে বিশ্বাস হয় না!”
“সেটা তোর মস্তিষ্কে সমস্যা!”
“তাহলে তোর মস্তিষ্কেরও সমস্যা আছে নাহলে অন্য আরেকজনের বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কাড়াকাড়ি করতিস না!”
“চুপ করবি তুই?আরেকজনের চামচাগিরী তোকে কেউ করতে বলে নি!”
“চামচাগিরী নয়!যা সত্য তাই ই বলছি!তবে একটা কথা শুনে রাখ বান্ধবীর পরিচয় কখনো এভাবে দিতে নেই!ধরে নিলি বান্ধবী দোষ করেছে তাই বলে তার মনে এভাবে দাগ দেওয়াটা এটা পৃথিবীর সবথেকে বড় চশমখোরের মধ্যে পড়ে!”
“আমার ভালো-মন্দ আমি বুঝবো!সেটা তোকে বলতে রাখি নি।এবার প্লিজ সর!এমনিতে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে তোদের সাথে কথা বলে!রিয়াশ আসো!”
বলে তিথির রিয়াশের হাতের মধ্যে তার হাত ঢুকিয়ে নেয়।আমি এবার আর চুপ থাকতে পারি নি।ধপ করে বলে উঠি,
“রিয়াশ আর মাত্র কয়দিনের অপেক্ষা! সব প্রমাণ করিগন্ডায় পেয়ে যাবে।আর এটাও শুনে রাখো,পরে নিজের ভুল বুঝার পর সেই সুযোগ আর কখনো আসবে না!”
রিয়াশ কিছু বললো না!চলে গেল তিথির সাথে।এবার আমার অবাধ্য চোখের পানি টপটপ করে বৃষ্টির পানির মতন ঝরা শুরু করে দিলো।নদীর কাঁধে মাথাটা ঠেকিয়ে বলে উঠি,
“আমি ভুল একজন মানুষকে ভালোবেসেছি, নদী!খুবই ভুল একজন মানুষকে!সে আমার ভালোবাসার এভাবে প্রতিদান দেবে ভাবতেও পারি নি!”
“ভেঙ্গে পড়বি না!একদম ই ভেঙ্গে পড়বি না।যেই ওরকম করেছে তাকে খুঁজে একদিন না একদিন বের করতে পারবিই!আর রিয়াশকে সেদিন হাতেনাতে প্রমাণ দেখাবি!তবে কি জানিস? আমার কেনজানি মনে হচ্ছে তোর এই বিয়ে ভেঙ্গে ফেলার পেছনে এই তিথিরও হাত ছিল!”
আমি নদীর ঘাড় থেকে মাথাটা তুলি।চোখের পানি মুছে এবার বলি,
” শুধুই তিথি ছিল।অন্যকেউ না!”
“কীভাবে বুঝলি তুই?”
“কারণ যেই ছেলেটির সাথে আমার ছবিটি ফটোশপ হয়েছে,সেই ছেলেটিকে আমি পেয়ে গেছি!”
“কী পেয়ে গেছিস? কীভাবে!?” (হকচকিয়ে গিয়ে)
“এই বাসস্ট্যান্ডের ই সামনে। তবে ছেলেটি ওইরকম কিছুই করেনি।”
“সে যে করে নি তা কীভাবে সিউর হলি?”
“ভাবভঙ্গি দেখে!”
“ভাবভঙ্গি দেখে?”
“হু।”
“যেমন?….!”
নদীকে আকাশ ভূঁইয়া অনিলের সবকিছু বললাম।নদী সব শুনার পর বলে,
“আমারও ডাউট হচ্ছে না ছেলেটির উপর।তবে, ছেলেটির ভাষ্যমতে “বান্ধবীদের মাঝে কেউ একজন রিয়াশকে পছন্দ করে” এই কথাটার সাথে তিথি পারফেক্ট মিলে গেছে!তাহলে তিথিই সব করেছে!”
“আমিও তাই ভাবছি!সব তিথিই করেছে।”
“তাহলে প্রমাণ সহ সব জোগাড় করে রিয়াশের সামনে ওই ছেলেকে দাঁড় করা তাড়াতাড়ি!?”
“হ্যাঁ..!”
চলবে….