শূণ্যতার_পূর্ণতা_তুমি #রোকসানা_আক্তার পর্ব-১০

0
326

#শূণ্যতার_পূর্ণতা_তুমি
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-১০

নিজেকে ইদানীং বড্ড একা লাগে।কাজকর্ম সেরে,সূবর্ণার সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা কাঁটিয়ে যখন নিজের রুমটায় ফিরে আসি তখন অশান্ত মনটা আরো বেশি অশান্ত হয়ে যায়।কোনোকিছু ই আর ভালো লাগে না তখন।দেড়টা মাস কেঁটে গেল রুমটা ফাঁকা।সোফায় বসে সময় পেলে ল্যাপটপ নিয়ে খুটখুট করা মানুষটি নেই।এসে ডাকারও নেই,
“সূপ্রভা?”
জানি না মানুষটিকে কতটা বেশি মিস করতেছি।কথাও তেমন বলতে পারি না।সপ্তাহ দুয়েক আগে একবার কথা হয়েছিল।সেই কথাটুকুও ছিল সংক্ষিপ্ত।কথার মাঝেই ম্যানেজার এসে বলে,
“আকাশ তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বাইরে আসো।গুলজা কোম্পানি থেকে কল করেছে।তাদের প্রজেক্টের একটা ডকুমেন্টস বানিয়ে তাদের আজকেই দিতে হবে।আমরা এখন হ্যামিলটনে যাবো।সবকিছু ওখানেই রেডি করবো।”

আকাশ ইতস্ততকর কন্ঠে বলে,
“সুপ্রভা?পরে এসে কল করবো তোমাকে!”
আর কল করা হলো না।মানুষটা বিজি হয়তো।চোখের কোণে এসে পানি জমা হলো কিছুটা।আলতো হাতে পানিটুকু মুছে জানলার কাছে যেয়ে গ্লাসটা খুলে দিলাম।দুপুরের ত্যাজত্যাজে রোদ রুমে ঢুকতেই চকচকা হয়ে উঠলো সারা রুম।সূবর্ণা ডেকে উঠে,

“ভাবী?ভাবী?”

সূবর্ণার দিকে তাকালাম।
“হু বলো সূবর্ণা?”
“পুডিং টা বানিয়েছো?”

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।সূবর্ণা বললো,
“মা জিজ্ঞেস করেছিলেন।”
আমি এবার হাসলাম।বললাম,
“ফুডিং,স্যান্ডউইচ,পাস্তা এবং খিঁচুড়ি সবই বানিয়েছি।টেনশন নিও না।”
সূবর্ণা হাসলো।আজকে আকাশের ছোট্ট খালামণি আসবেন।উনি বাইরে থাকেন।অস্ট্রেলিয়া।বাংলাদেশে বেড়াতে আসতেছেন। ছেলেমেয়েদের স্কুল-ভার্সিটি বন্ধ তাই।বিকেলের দিকে উনারা এসে পৌঁছান।শাশুড়ী মা ছোট্টবোনকে পেয়ে কেঁদেকুঁটে হয়রান।সূবর্ণা পাশ থেকে হেসে উঠে তার খালাতো ভাই-বোনদের সাথে কথা বলে।ছোট্ট খালা শাশুড়ীর তিনটা ছেলে-মেয়ে।মেয়ে সবার বড়।বয়স একুশ-বাইশ হবে।ভার্সিটিতে পড়ে হয়তো।দেখতে সিমসাম।চুলগুলো ছোট্ট ছোট্ট করে কাঁটা।গাঁয়ে শর্ট টপস এবং জিনস পড়েছে।পায়ে উঁচু হাই হিল।অস্ট্রেলিয়ায় যেহেতু থাকে চলাফেরা এরকমই হবে এটা আগেই ধারণা করেছি।মেজো টাও সেইম।তারও একই রকম ড্রেসাপ।আর ভাইটা ছোট্ট সবার।হয়তো ক্লাস সেভেনে পড়ে।সে আমাকে দেখে হেসে উঠে বলে,

“এই আমাদের ভাবী?সিস্টা?”

বোনকে ইঙ্গিত করে আমাকে দেখায়।তার কথায় বড় বোন তেমন পাত্তা দিলনা।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বিষয়টা খারাপ দেখাবে ভেবে আমি হেসে কথা বলে উঠি,
“কি অবস্থা তোমাদের সবার?”

ভাইটা জবাব দিল।মেঝো বোনটাও।কিন্তু বড়টা কেমন দেমাক দেখিয়ে মায়ের দিকপ তাকিয়ে,
“মাম্মি?অসহ্যকর গরম লাগতেছে!এসি আছে কোনো রুমে?”

এ বলে তরহর করে চলে গেলো।আমি খালা শাশুড়ী মাকে সালাম করলাম।খালা শাশুড়ী মা আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থির চোখে তাকিয়ে চাপা কন্ঠে সালামের জবাব নিলেন।তারপর বললাম,
“কেমন আছেন আন্টি?”
“হু,ভালো।তুমি?”

এতটুকু বলার সাথে সাথেই শাশুড়ী মা আন্টিকে টেনে নিয়ে যান ভেতরে।বিষয়টা যদিও উনার দৃষ্টিতে খারাপ দেখালো।হঠাৎ কথার মাঝে এভাবে টেনে নিয়ে যাওয়াটা আমার দৃষ্টিতে খারাপ দেখা গিয়েছে।যাইহোক কিছু বললাম না।দারোয়ান দাঁড়িয়ে রইলো।উনাদের ট্রলি-ব্যাগ কোথায় রাখবে?আমি গেস্ট রুমটা দেখিয়ে দিলাম।

———————————————————
আজকেও মাসিকের ডেটটা ওভার হলো!দুইমাস হলো আমি মাসিক হচ্ছি না!ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত না?সন্ধের পর হারিম চাচার ফার্মেসী তে যেয়ে প্রেগন্যান্সির একটা কিট নিয়ে আসি।ভেতরে ঢুকতে আমার শাশুড়ি মা কেমন রাগী স্বরে বলেন বোনকে ইঙ্গিত করে,
“কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ে সন্ধের পর বাসা থেকে বের হয়?কেমন অসামাজিক!আমি বললেই দোষ হয়ে যায়!দ্যাখ কেনো বলি?কেনো বলতে হয় আমাকে!”

আন্টিও শাশুড়ী মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কেমন কটু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।বিয়ের সময় বড় আন্টিকে দেখলাম।উনার কথাবার্তা,ভাবভঙ্গি খুবই সরল।চোখের দিকে তাকালে মমতার একটা ভাব ফুটে ওঠে।এই আন্টির মাঝে তেমনটা নেই।বড় আন্টির থেকে ইনি খুবই আলাদা।শাশুড়ী মায়ের সাথে উনার অনেকটা মিল পাওয়া যায়।আমি ইতস্ততকর হয়ে যাই।বলি,
“মা,মাথাব্যথা করেছিলো তো তাই আমি হারিম চাচার ফার্মেসী থেকে মেডিসিন নিয়ে এসেছি।”

ছোট্ট আন্টি বলেন সাথে সাথে,
“বুঝতে পেরেছি।কিন্তু মন যখন যা চাইবে তা নিজের স্বাধীনতায় করা আমার বোনের বংশে নিয়ম নাই।নিয়ম না জানলেও শিখে নিই।সব সোসাইটি তো আর এক না!”

আমি উনার কথার ধরণে বুঝলাম সোসাইটি বলতে আমার ফ্যামিলির কথা তুলেছেন!আর আমার ফ্যামিলিকে তাচ্ছিল্য করে দেখেছেন!মেহমান তাই কিছু বলতে পারলাম না।নিজেকে শক্ত করে একটু মেকি হাসি দিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।রুমে আসতে উনার বড় মেয়ে,সানহা আমার রুমে এসে ঢুকে।কি যেন খুঁজতে থাকে!আমি জিজ্ঞেস করি,

“কিছু খুঁজতেছো?”

সে জবাব দিলো না আমার কথার!আন্টির মতন আন্টির বড় মেয়েটাও!মেঝোটা একটু অমিল।খুব বেশি অমিল না।পথের্ গোচে দেখা হলেই আমি হেসে দিলে হেসে উঠবে কিছুটা। যেচে জিজ্ঞেস করলে কথার উত্তর দেবে।নিজ থেকে কিছু বলবে না।তাও তো কথা বলে সে।বড়টা তো একদমই না।দেমাক মুড নিয়ে থাকে সবসময়।আর ছোট্টটা,সানি.. সে আমার কাছে প্রায় এসে ভাবী ভাবী বলে ওটাসেটা জিজ্ঞেস করবে।তাকে দেখে ভাবী নিশ্চয়ই বাবার মতন হয়েছে।বাবা মিশুক হয়তো।আন্টি তো আর মিশুক না।সানহার বিরক্তি লেগে গেলো।বিড়বিড় করে বললো নিজেই,

“সূবর্ণা টা কোথায় রাখলো!রাগ লাগতেছে!”

এতটুকুন বলে বেরিয়ে যায় রুম থেকে তরহর।আমি তার দিকে তাকিয়ে থেকে ছোট্ট একটা শ্বাস ছাড়লাম।তারপর প্রেগন্যান্সির কিটটা বের করে বাথরুমে গেলাম।তিন মিনিটসের ব্যবধানে আমার মুখের আকৃতি অন্যরকম হয়ে যায়!আমি লজ্জায় নুইয়ে যাওয়া অবস্থা। সাথে এতটা আনন্দ। পুরো মুখটা যেন ঝলমল করতেছে!বিশ্বাস হচ্ছে না,নাহ কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না আমি মা হতে চলেছি!আমার পেঁটে আমার আকাশের..!মুখ দিয়ে আর কথা বেরুলো না!ভাবতে থাকি এত খুশির সংবাদটা কাকে দেওয়া যায়?আকাশকে..!কিন্তু তাকে তো কল করা যাবে না!তাহলে আর কাকে?সূবর্ণা কে!এমন সময় সূবর্ণা ডেকে উঠে,

“ভাবী?ভাবী?”

সূবর্ণার আওয়াজে আরো হেসে দিলাম।হেসে উঠে কিটটা রেখে তরহর বেরিয়ে এলাম।।সূবর্ণা হয়তো কিছু খুঁজতেছে,
“ভাবী?একটা প্লাগ রেখেছিলাম এখানে।দেখেছো?ওইটা না সানহা আপুর।আপু রাগ হয়ে গেছেন।আমার একটুও খেয়াল নেই কোথায় যেনো রেখেছি!উফস!”

“দেখি নি।”

সূবর্ণা চলে গেলো।মনটা খারাপ হয়ে গেলো মূহুর্তে!সূবর্ণাকে বলতে পারলাম না এত খুশির সংবাদটা।বিছানায় যেয়ে সোঁজা হয়ে বসলাম।আর পেঁটের দিকে তাকিয়ে মিটমট করে হাসতে থাকলাম নিজেই।ভাবতে থাকলাম,

“আজ যদি আকাশ থাকতো এই মুহূর্তে। সে যদি সংবাদটা শুনতো তখন কি রকম অনুভূতি হত তার?আমাকে কোলে তুলে নিয়ে কপালে চুমু ছুঁয়ে দিত?নাকি আঁচলটা সরিয়ে পেঁটে অনবরত…!দাৎ কিসব ভাবতেছি আমি!আমিও না নির্লজ্জ!”

———————————————————
এখানে বিয়ে হওয়ার পর আমার মা একবার এসেছেন।আর আজকে এসেছেন।তাও বাবার সাথে।সাথে করে মিষ্টি,সন্দেশ,দই আরো কয়েক পদের মিষ্টি জাতীয় খাবার নিয়ে এসেছেন।তাদের নাত/নাতনী হবে!ব্যাপার টা কতই খুশির না?কিন্তু আমার এই সংবাদে আমার শাশুড়ি মা তেমন খুশি হতে মনে হয় পারলেন না।চুপচাপ রইলেন।মা-বাবার সাথে তেমন আমোদ করে কথা বললেন না।আন্টি আত্মীয়তার খাতিরে দুই-চারটে কথা বললেন।আমি যতটুকু পেরেছি মা-বাবাকে যথেষ্ট আপ্যায়ন করার চেষ্টা করেছি।দুপুরের পর খাওয়াদাওয়া শেষ করে মা-বাবা বিদেয় নেয়।খুব কেদেছি যাওয়ার সময়।বুঝিও নি কেনো এতটা কেদেছি।তবে খুব কেদেছি।বাবা পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়েছেন!মা-বাবা চলে যাওয়ার পর মনটা আরো খারাপ হয়ে যায়!বসে থামি রুমে একা!একটু পর সূবর্ণা এসে,

“আমি যে ফুপী হতে যাচ্ছি ভাবী?”
তার পেছনে থেকে সানিও বলে,
“আমি কি হতে যাচ্ছি ভাবী?ভাইয়া?”

হাসি চলে আসে ওদের কথায়।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here