রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ১২

0
490

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ১২
__________________________

[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনা পাঠককুলের জন্য উন্মুক্ত আমার লেখা]

শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ক্রমশ আদিম উত্তজনার দাপাদাপি কিলবিলিয়ে রগে রগে পৌঁছে গেছে দুটি মানুষের। তখনই
জানালার পাল্লাতে আচমকা কারও চপেটাঘাত পড়ল, নাছোড়বান্দা আশফিকের উদ্দাম ভেজা বুক থেকে ঝপাৎ করে উঠে বসল মাহি, ঘাড় ঘুড়িয়ে জানালার দিকে তারপর দরজাটার দিকেও দেখল আর শেষবারের মতো আর্দ্র রক্তিম চোখে আশফিককে। নিচ থেকে চাদরটা তুলে নিয়ে শরীর ঘিরেই দরজা একটানে খুলে যেন চিতাবাঘের গতিতে বেরিয়ে পড়তে চাইল। দো’তলার সোপানে পৌঁছতে বসার ঘরটাতে চোখে পড়ল পরাগকে। কানে ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মনেমনে তার প্রতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা জানাল অবিরাম।

আশফিককে কল করছিল পরাগ। বর্তমান এই আশফিককে সে ভরসা করতে পারে না। বৃটিশদের সাথে থেকে মস্ত একটা অসভ্য হয়ে এসেছে পাজিটা। মাহিকে বের হতে দেখে তখন পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল ও, নাজুক মেয়েটা যাতে করে আর না লজ্জা পায় তাকে দেখে।

এলোমেলো চুল আর পরনের কুঁচকে যাওয়া ফুলহাতা গেঞ্জিটা টেনেটুনে গুছিয়ে বাইরে আসতে দেখা গেল আশফিককে। পরাগ পারলে হা’ম’লে পড়ে কু’পি’য়ে ফা’লা’ফা’লা করে ফেলত ওকে। এসেই জিজ্ঞেস করল আশফিক, ‘ঘরে চলে গেছে?’
-‘তো কি তোর বাচ্চার মা হবে?’
-‘আমাকে ওর দুর্বলতার সুযোগ নিতেই হতো, দোস্ত।’
-‘মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিলে কি বীরপুরুষ হওয়া যায়?’
-‘যায় না, আমি আমার প্রতি ওর দুর্বলতা দেখতে চেয়েছিলাম, ওকে দেখাতে চেয়েছিলাম।’
-‘আগে পিছে কিছু না ভেবেই!’
-‘এত আগে পিছে ভাবতে গেলে কি হয়?’
-‘বলার নেই কিছু। ফলাফল কী আসে দেখি। ওই বাড়িতে যাবি না?’
-‘হুঁ, আব্বু আম্মু আছে। যেতে তো হবেই।
-‘চল।’

নিরালোক ঘরে জানালার কোণায় মাহি নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। আশফিক আর পরাগকে যেতে দেখছে সেখান থেকে। নিস্তরঙ্গ হৃদয়ে আবারও এলোমেলো ঝড় তুলে দিয়ে চলে যাচ্ছে ওই ঘৃণ্য মনুষ্যত্বহীন ব্যক্তিটা। এত কঠোরতার পাঁচিল ভেঙে গুড়িয়ে দিলো পাষাণটা আবারও! নিজেকে তবে গড়া হলো না নিজেতে একাগ্র, দৃঢ়নিষ্ঠ এক অগ্নিরূপী নারী। সেই রাতের অপমানের চেয়েও আজ এই রাতের অপমানের তীব্রতা বুক ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে ওর৷ ওকে কি কাদামাটির একটা দলা মাত্র মনে হয়? যখন যেমন ইচ্ছা তখন সেই দলাকে তেমন রূপ দিয়ে খেলা করবে!

চার বছর আগে তাকে বাগদত্তার স্থান থেকে লা’থি মেরে এক বহিরাগত নারীতে পরিণত করেছিল আশফিক আরেক নারীর সম্মুখে। সেই নারীই সেদিন তাদের সম্পর্ক ভাঙনের প্রথম কারণ ছিল। এরপর চলে এলো আরও কত কত না জানা কারণ! তারপরই হলো সম্পর্কের বিচ্ছেদ।

আশফিকের করা সেদিনের অভিযোগ, সেদিনের করা লাঞ্ছিত অপমান, আর সেই অপমানের সীমা অতিক্রম করা আশফিকের চড়। এসব কি কোনোদিন ভোলা যায়? রক্তে মিশে গেছে মাহির, ওই দিনের প্রতিটা তীব্র অপমানসূচক বাক্য। নিজের বিবেকের কাছে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। পাই টু পাই সে শোধ তুলবে সব কিছুর জন্য।

***
সহস্রাধিক পল পেরিয়ে রায়ান আর রুমকির দীর্ঘ অপেক্ষাময় দিনটি চলে এলো, বাড়ির আনাচে-কানাচেতে গমগম মানুষের ভীড়ে। রায়ানের গায়ে হলুদ হলো সকালে আর বিকালেই গিয়ে পৌঁছল তাদের বরযাত্রী কনে বাড়িতে। রুমকির আগমন আগামী দিনে নব বধূরূপে হবে বলে সে থেকে গেল বাড়িতে। সঙ্গে রয়ে গেল মাহি। সারাদিনে বহুবার আশফিকের মুখোমুখি হয়েও চোখে চোখ রাখেনি, কাছ ঘেঁষে আশফিকও দাঁড়ায়নি অবশ্য। একটু সময় দিতে চায় ওকে, সেদিনের পূর্ব পরিকল্পিত ঘনিষ্ঠতা ওর কাছে সহজ হলেও মাহির কাছে খুবই অপ্রত্যাশিত।

রায়ানের বরযাত্রীতে আশফিকের বাবা-মা’ও থেকে গেছেন বাড়িতে। আসমান আরা বাড়ির গৃহিণীদের সঙ্গে খোশগল্পে মগ্ন। মাহির সঙ্গে একান্তে কথা বলার সুযোগ খুঁজছেন অনেকক্ষণ ধরে৷ মেয়েটাকে হাতের নাগালে পাওয়াই যায় না।

রাত আটটা ছুঁই, কনেকে নিয়ে বরযাত্রীর ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে। মেজো শিকদার বাড়ির পেছনে পুকুরপাড়ে সাদা বাল্ব লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে মেহমানদের সুবিধার্থে। সেখানে চেয়ার পেতে নিশ্চিন্তে মাহি আর রুমকি গল্প করছে। রুমকির কাছে কিছুটা বলেছে মাহি আশফিকের ব্যাপারে। সে বিষয়েই দু’বোনের মধ্যে নিবিড় আলোচনা চলছে। তাতে মাহি যোগ করল ওর একমাত্র ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শান্তাকে। শৈশবের বন্ধু ওরা। এইচএসসি এর পর শান্তার বিয়ে হয়ে যায় ঢাকা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির এক মালিকের সঙ্গে। কিন্তু ইন্টার পাসের পর তিনি ওকে পড়াশোনা করাতে আর আগ্রহী হননি। তিন বছরের একটা মেয়ে আছে ওদের। এই বন্ধুটির সঙ্গেই এখন অবধি বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট রেখেছে মাহি। কিন্তু নিজের অসহায়তা, দুর্বলতা, দুঃখের গল্প, মাহি কারও কাছেই বলতে পারে না, খুব ভালো বন্ধু শান্তার সাথেও ভাগাভাগি করতে পারে না। এই নিয়ে প্রতিবারই শান্তার অভিযোগের শেষ নেই। তবে আজ হাঁসফাঁস লাগছে মাহির, মনস্তাপ একটু হলেও কমানোর জন্য দিব্য আর আশফিককে নিয়ে অনেক কথাই বলল শান্তাকে। শান্তা ধীরস্থির জবাব দিলো, ‘তোর মনের শান্তিরে তুই আগে প্রায়োরিটি দিবি। এটাই হলো মূল এবং শেষ কথা। দিব্যর সঙ্গে কথা কইলে তুই হালকা থাকিস, মজায় থাকিস। আর জীবনে ভালো থাকার জন্য তো এমন কাউরেই দরকার যার সঙ্গে থাকলে তুই নিজেরে হ্যাপি ফিল করিস। এখন তোর কাজ দিব্যকে সরাসরি প্রপোজ করা। দ্যাখ দোস্ত, সব সময় ইগোরে স্যাটিসফাইড রাখতে গেলে আনন্দরে দূরে থাকতে হয়। তোদের এতগুলোর দিনের পরিচয়ে এখনো যে ক্যামনে প্রেম নিবেদন আসলো না কারও পক্ষ থেকে সেটাই ভাববার বিষয়। দিব্যর থেকে আসে নাই না আসলো, তুই করবি। এরপর দেখবি আশফিক জা’নো’য়া’ররে নিয়ে যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে সব থেকে মুক্তি পাবি। কারণ, তোর তখন মাথায় থাকবে তুই অন্য কারও সাথে কমিটেড৷ তার বদলে প্রাক্তনরে নিয়ে ভাবনাতে মশগুল থাকলে দিব্যরে ঠকানো হবে। আর আমার দোস্ত এই কাজ কখনোই করতে পারবে না। কারণ, সে সব সময় লয়্যাল আর অনেস্ট।’
পাশ থেকে কথাগুলো রুমকি কান পেতে স্পষ্ট শুনে চকিতেই সহমত জানাল, ‘আমিও এটাই চাচ্ছি শান্তা আপু, মাহিপু দিব্য ভাইকে প্রপোজ করে ফেলুক। মেয়ে মানুষ আগে প্রপোজ করতে পারবে না এটা কি কোথাও লেখা আছে? তোমার দোস্তরে ভালো করে বোঝাও সেটা।’
শান্তা রুমকির কথাগুলো শুনে মাহিকে উষ্কে দিলো আরও, ‘দ্যাখ, তোর থেকে পিচ্চি হয়েও ও যথেষ্ট ম্যাচিওরড। কোনটা বেটার সেটা রুমকিও বুঝছে। আর আশফিককে চরমভাবে অপমান করার শুরু হবে এটাই। তুই আজকে রাতেই দিব্যরে বলবি যা বলার।’

প্রলম্বিত শ্বাস ছেড়ে মাহি ভাবল, রুমকি আর শান্তা খু্ব ভুল কিছু বলছে না। দিব্যর প্রতি এই মুহূর্তে মাত্র ভালো লাগা থাকলেও একটা সম্পর্কে জড়ালে কোনো না কোনো সময় নিশ্চয়ই ভালোবাসাও হয়ে যাবে। না হয় এই প্রথমবার নিজের অহংবোধকে এক পাশে সরিয়ে রাখল।

শান্তার সঙ্গে ঘন্টাখানেক সময় ধরে আরও নানান বিষয়ে গল্পগুজব করে সময়টা কাটাল পরবর্তীতে রুমকির সাথে। ওদিকে রায়ান বউ নিয়ে চলে এসেছে বলে রুমকি আর বসল না। কিন্তু মাহি যেতে গিয়ে বাধা পেল দিব্যর ভিডিয়ো কলে।

-‘কী কবা কও! আজকে প্রচ্চুর ব্যস্ত থাকব রাতে।’
শার্টের প্রথম দু’টো বোতাম খুলতে খুলতে বিছানাতে আধশোয়া হয়ে বসল দিব্য।
-‘হঠাৎ দেখতে মন চাইল যে?’
-‘নতুন প্রোফাইল আপলোড করছ, তাই ভাবলাম কতদিন দেখি না। একটু দেখি আজকে।’
-‘তা আজকে ব্যস্ত থাকবেন ক্যান?’
-‘কাজ আছে মেলা।’
-‘দেশে টেশে আসবেন না, না কি?’
-‘দেশে গেলেই দাদা বিয়ে করায় দেবে। তাই যাব না বছর চারের ভিতরে।’
-‘কী আজব না? বিয়ে করার ভয়ে দেশ ত্যাগ করে বসে থাকবেন?’
-‘তুমি তো বুঝবা না আমার জ্বালা। বাপ ছাড়া পরিবারে বড়ো ছেলে হলে সুখ যায় তল দিয়ে।’
-‘তল দিয়ে! আল্লাহ্!’
দিব্যর কথার শ্রী দেখে লজ্জায় মাহির কণ্ঠ শেষে গিয়ে মিইয়ে গেল। অডিয়ো কলে এমন বেফাঁস কথাবার্তা বলতে বা শুনতে পারলেও দুজন দুজনের মুখোমুখি হয়ে মাহি বেচারি আর যা-ই হোক দিব্যর মতো ঠোঁটকাটা হতে পারছে না। তাই জলদি মূল প্রসঙ্গে ফিরল সে, ‘তো বিয়ে-শাদি না হয় দেরিতেই করলেন। মেয়ে তো পছন্দ করে রাখাই যায়।’
-‘তা যায়, কিন্তু আগেভাগে কারও সাথে কমিটমেন্টে যাইতে চাই না।’
-‘কেন?’
-‘ভবিষ্যতে আমার মন মানসিকতা পালটে যেতেও পারে, হুট করে দেখা গেল মেয়েটাকে আর ভালো লাগতেছে না আমার, পারিবারিকভাবেও কোনো সমস্যার কারণে তাকে বিয়ে করতে পারলাম না। এত অনিশ্চয়তার মাঝে আমি কাউকে আশাবাদী করতে চাই না। কী দরকার কাউকে স্বপ্ন দেখায়ে সেই স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার! মাঝখান থেকে মেয়ের অভিশাপ কামায় করা লাগবে। দুইটা এক্স নিয়ে শিক্ষা হইছে না? ভাগ্যিস কারও সাথে গভীর প্রেমে যাই নাই।’
-‘দুনিয়াতে আর ছেলেরা কি করে না রিলেশন? তারা কি আপনার মতো এত অনিশ্চয়তায় ভোগে?’
-‘ভোগেই তো, খুঁজলে কত পাওয়া যাবে।’
-‘তাহলে আমার প্রাক্তনের মতো বিয়ে করার আগ পর্যন্ত মেয়েদের সাথে খালি ছোঁয়াছুঁয়ি, প্রেম ছাড়া সম্পর্কে কাটাবেন, তাই তো?
-‘তোমার প্রাক্তনের সাথে আমাকে তুলনা দিলা? আমি জিভ বের করা ললুপ নাপাক কুত্তা না যে রাইট ছাড়াই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলব। আর মেয়েদের সাথে বলতে তুমি কী বুঝায়লা? আমি তোমার সাথে যত কথা বলি আর তোমার সাথে আমার যতদিন যোগাযোগ চলে এর আগে আর কোনো মেয়ের সাথে আমার সময়ে অসময়ে এত কথা হয় নাই, আর তাদের সাথে আমার সর্বচ্চ দু কি তিন মাসের বেশি পটে নাই। তোমার সাথেই খালি বারবার ঝগড়াঝাঁটি লাগলেও আবার নিজেই যোগাযোগ করি। কারণ, তোমারে আমার নিজের মতো লাগে, ভালো লাগে তোমারে আমার।’
-‘তো এই জায়গা থেকে আর এই ভালো লাগা থেকে আমরা আরও সামনে এগোতে পারি না?’

কণ্ঠরোধ হয়ে এলো দিব্যর। ঝুপ করে দুজনের মাঝে নীরবতা এসে বাসা বাঁধল। মাহির এই অকপট স্বীকারোক্তি নির্দ্বিধায় অন্য পুরুষের জন্য হলে একটা ক্ষণ সময় নিতো না সগৌরবে এই প্রস্তাব লুফে নিতে। কিন্তু দিব্য হঠাৎ নিরুদ্যম হয়ে পড়ল কেন?

মাহির নিমেষহীন চোখে চোখ রাখতে পারল না দিব্য। সে কখনো ভাবেনি মাহির থেকে এমন কথা শুনতে পাবে। চোখের চাউনি কেমন লুকিয়ে মিয়মাণ সুরে বলল, ‘পরে কথা বলছি এ বিষয়ে।’

অদ্ভুত তো! ছেলেটা লজ্জা পেলো না কি? কলটা কেটে দিতেই মাহি হেসে ফেলল। দিব্য ফারহান তুখোড় ঠোঁটকাটা লোক নাকি লজ্জাও পায়।

-‘আমাদের সম্পর্কের প্রথম দিনটার কথা তোমার মনে পড়ে মাহি?’
চমকাল না মাহি। পিছু ফিরে দেখার প্রয়োজনবোধও করল না আশফিককে। কিন্তু জবাব দিতে বিলম্ব করল না, ‘উহুঁ! শেষ দিনটার কথা মনে পড়ে।’
-‘তাই?’ এগিয়ে এসে ওর পিছু দাঁড়াল আশফিক।
-‘তা-ই।’
-‘আমরা শুধু একে অপরকে দেওয়া তিক্ততাকেই পুঁজি করে রাখি মনে, তাই না মাহি? তিক্ততার ক্ষণ জীবনে আসে হঠাৎ একবার কি দু’বার। অথচ মধুরতার চেয়ে তিক্ততার প্রতাপই বেশি।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে মাহি ওর বিপরীত দিকে দাঁড়াল, চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ক্ষণিকের দুর্বলতায় আমি কি তোমার বশ্যতা স্বীকার করেছি আশফি? তাহলে কেন এমন করলে?’
বিষণ্ন মুখটাই ক্লেশিত হাসি টেনে আশফিক জবাব চাইল, ‘তুমি উত্তর পাওনি মাহি? আমার চোখে লালসা দেখেছ?’
-‘মেয়ে মানুষ পুরুষের কাছে আগেও দাবার গুটির মতো ছিল আর আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকতে হবে তাদের। এটাই প্রমাণ করেছ তুমি।’
-‘তাই কি?’
মৃদু চিৎকারে আশফিকের কলার চেপে ধরল মাহি, ‘গোল্লায় যাক তোমার প্রতি আমার নির্লজ্জ অনুভূতি, আবেগ, আকর্ষণ। তোমার মায়া আমি ত্যাগ করেছি। তুমি এভাবে তা ফিরিয়ে আনতে চাও? হাস্যকর! কিন্তু হ্যাঁ, তোমার ট্যাক্টিস কাজে দিয়েছে। তোমার প্রতি আমার মনোগত টান আছে বলেই শরীরগত টানকে এড়িয়ে যেতে পারিনি। তাতে কী? আমি সব ভুলে তোমার কাছে আবার ফিরব? বিয়ে করব তোমাকে? এত ওভার কনফিডেন্স কেন তোমার আশফি? আমাকে তুমি কেন সহজলভ্য ভাবো?’
উত্তেজনায় ধীরে ধীরে গলার স্বর বাড়তে থাকল মাহির।অদ্ভুতভাবে কপালের দু’পাশের রগ ওদের দুজনেরই দপদপ করছে।

কলার থেকে মাহির হাতদু’টো টেনে এনে বুকের মধ্যিখানে রাখল আশফিক। শক্ত করে চেপে ধরে রাখল সেখানে, তা ছুটিয়ে আনার চেষ্টায় মাহির ত্রুটি নেই।
-‘আমার সেদিনের হঠকারী সিদ্ধান্তের থেকেও তোমার হঠকারীতার মাত্রা বেশি মাহিয়ান। এভাবেই আমার দিকে তাকিয়ে সত্য বলো, আশি ভাগ জিদের বশে আজ তুমি ওই ছেলেটিকে জীবনে জড়াতে চাচ্ছ না?’
-‘বাকি বিশ ভাগ আকর্ষণকে দায়িত্বে, ভালোবাসায় পরিণত করব৷ প্রতিটা লক্ষ্যে, প্রতিটা সাফল্যে পৌঁছতে হলে ঝুঁকি তো নিতেই হয়। আর নাই বা হোক দিব্য, তবু তোমার মতো স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী, নীচ আর মস্ত বড়ো অপরাধীকে আমি চাইব না।’

ঝটকা দিয়ে মাহিকে সরিয়ে দিলো আশফিক, বক্ষঃস্থলে জ্বলতে থাকা নিভু নিভু অনল তরঙ্গায়িত হলো এবার। বিপরীত দিকের মানুষটির করা একপাক্ষিক বিচারে আর কত দোষী হবে সে? তার অন্যায় শাস্তিযোগ্য বলেই এই একতরফা অভিযোগগুলোতে প্রতিবাদ করেনি, পালটা কৈফিয়ত চায়নি। তাই বলে বেঠিক অভিযোগগুলো মাথা পেতে নেবে? তবে মাথা পেতে এর থেকেও হাজারো অভিযোগ নিঃশব্দে হজম করে নিতো, যদি মাহি শেষ একটা সুযোগ দিতো ওকে৷ সে জন্য না হয় সারাজীবনই এমন অভিযোগগুলো শুনে যেত! কিন্তু তার বদলে মাহি আজ সহ্য, ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে ফেলেছে। নিজেকে নিচু করতে করতে এখন আর তার মাঝে আত্মসম্মানের বালাই নেই, কঠোর ব্যক্তিত্ব আজ নড়বড়ে, চরিত্রে লম্পটতাও আনতে বাদ রাখেনি৷ এর চেয়েও বড়ো প্রায়শ্চিত্ত কী আছে আর? শ্বাস্তিস্বরূপ নিজেকে অপমৃত্যু দেওয়া? না কি গুণে গুণে চারবছরই মাহির পায়ে পায়ে ঘোরা?

মাহির উচ্চস্বরের দাপট যতখানি ছিল তার চেয়েও নিম্ন অথচ শক্ত গলায় বলল আশফিক, ‘অন্য নারীর জন্য আমি তোমাকে গুরুত্ব দিইনি, তার জন্য সেদিন তোমার গায়ে হাত তুলেছিলাম, তারপর স্বার্থপরের মতো তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলাম। তোমার অভিযোগ এক্সাক্ট এগুলোই না?’

উত্তর প্রদান করতে ইচ্ছা করল না মাহির, মুখ ফিরিয়ে রেখেছে সে।

-‘তোমার প্রথম দুই ভুল অভিযোগ আমি ইতোমধ্যে শুধরে দিয়েছি। তোমার কাছেই ফিরে আসা তার প্রমাণ। কিন্তু আমার চলে যাবার পিছে তোমার কি একটুও অবদান নেই, মাহিয়ান? পেছনের সময়টাতে গিয়ে একটু রিপিট করো তো প্রতিটা ঘটনাগুলো। রিপিট করে দেখো তো শুনতে পাও কিনা আমাকে ভেঙেচুরে দেওয়া তোমার বিষ বাক্যগুলো? আমার এক যুগের লালিত স্বপ্নকে হেয় করে দিলিশাকে বলা তোমার সেই কথাগুলো, যে কথাগুলো আমার বুকের ভেতরে তিরের মতো গিয়ে বিঁধেছিল, রক্তাক্ত করে দিয়েছিল৷ একবারও তোমার মনে হয়নি আমি আমার স্বার্থের টানে কম তোমার বিষবাণে আহত হয়ে অভিমান পুষে, রাগ পুষে, যন্ত্রণা পুষে বেশি দেশ ছেড়েছি? সত্যি করে বলবে।’
-‘না, এক বিন্দুও মনে হয়নি। যন্ত্রণা, অভিমান আসে ভালোবাসা থেকে। আর তুমি তো কখনো আমাকে ভালোইবাসোনি। বলো ভালোবেসেছিলে তখন আমাকে? বলো আশফি!’ ক্ষিপ্রগতিতে বলল মাহি।
শক্তপোক্ত জবাব দিতে পারল না আশফি, ‘হয়তোবা। নয়তো কেন আমি তোমার কথাতেই যন্ত্রণাদগ্ধ হবো, প্রভাবিত হবো?’
হেসে উঠল মাহি, ‘নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছ আশফি? উত্তর তুমিই আমাকে আর সাথে তোমাকেও দিয়েছ। ভালোবাসাতে কি হয়তোবা শব্দ থাকে? থাকতে পারে?’
-‘দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলে পারে। আমি সেদিন দ্বিধাতে ছিলাম। কিন্তু তোমার দেওয়া আঘাত বাক্যে আমি আমার মধ্যে কষ্ট খুঁজে পেয়েছিলাম। মনে ভালোবাসার উপস্থিতি ছিল বলেই আমি পারিনি অন্য কোনো নারীকে তোমার বিকল্প ভেবে নিতে। যদি সন্দেহ থাকে দিলিশাকে নিয়ে। তা নিশ্চয়ই অমূলক। তোমার প্রতিটা অভিযোগের কাউন্টার রিপ্লাই আমার কাছে আছে মাহিয়ান। কিন্তু এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে তোমাকে তা আর দেবো না। আমার অস্তিত্ব তুমি তোমার পিছে টের পেয়েছিলে বলেই আমাকে অবগত করলে, তোমাদের কাছে আমি এক বিকৃতমূর্তি, রাস্তার ললুপ জন্তু! তাই তো? চার বছরের হিসাব বরাবর করে দিয়েছ তুমি এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। বিয়ে ভেঙে যাবার কারণে তোমার অপদস্থ হওয়া। বিনিময়ে তোমার কাছের মানুষদের কাছে আমাকে জা’নো’য়া’রে পরিণত করা। সব কিছুর শোধ অসুল করে নিয়েছ তুমি৷ এরপরও শোধ হয়নি, তা হাজার জ্ঞানী গুণীরা বললেও তা আমি মানব না। চার বছরের যাতনার শোধ চারদিনে তুলে নেবার অসম্ভব ক্ষমতা আর বুদ্ধি তোমার কাছেই আশা করা যায়। শোধ হয়নি বলো?’
-‘না!’ জিদ্দি সুরে অটল জবাব মাহির।
উত্তরখানা শুনে এসবের মাঝেও হাসির লহরী খেলে গেল আশফিকের ঠোঁটে। সম্ভ্রমের মতো দামী ঐশ্বর্য হারিয়েও যখন হাসি পায় সে হাসিকে অনুভূতির কোন শ্রেণীতে ফেলা যায়, আশফিক জানে না। অনুরোধ গলায় শুধাল সে, ‘আমাকে নিয়ে তোমার অভিযোগের শেষ হবে না বুঝে গিয়েছি। তবু শুনতে চাই, তোমার অন্তিম অভিযোগ কী?’

মাহির শক্ত মুষ্টিবদ্ধ হাতের মতোই দুরধিগম্য ওর মনটাও। আশফিক চেয়ে রইল, কেমন নিষ্ঠুর করে রেখেছে মুখটা! তথাপি এই মুখটাই তো ওকে আবার ফিরিয়ে আনল যে স্বপ্নকে ছুঁতে ছুটে গিয়েছিল সব ছেড়ে। নিশ্চুপ মাহির জন্য আর অপেক্ষা করল না। শম্বুকগতিতে বাড়ির দিকে এগোলো ওকে ফেলেই। তখনই শুনতে পেলো ওর বিরুদ্ধে নির্দয় মাহির শেষ অভিযোগ।
-‘ভালোবাসোনি৷ ভালো না বেসেই প্রতিনিয়ত একটু একটু করে আমাকে দুর্বল করে দিলে কেন? আমার দুর্বলতাকে হাতিয়ার করে নিতে তোমার বিবেকে বাঁধল না?’
উত্তর না দিতে চেয়েও দাঁড়িয়ে পড়ল আশফিক, গম্ভীর জবাব দিলো, ‘বললাম না তোমার আর কোনো অভিযোগের বিপরীত জবাব আমি দেবো না? আজকের মতো এখানেই তোমার সাথে আমার শেষ দেখা। ঢাকাতে ফিরে দেখা হবে তোমার আমার। আজকের পর থেকে আপাতত আমার একটাই কাজ, তোমার জন্য ত্যাগ করা আমার আরাধনায় পাওয়া অনুপম ব্যক্তিত্বের দেহাবশেষ কুড়িয়ে গুছিয়ে তোলা। আসছি, দেখা হবে।’

ইসরাত জাহান দ্যুতি

এডিট ছাড়া পর্ব। আমার নিয়মিত পাঠকদের ইদি এটা। সবাইকে ইদ মুবারক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here