রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২০.১

0
399

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২০.১
____________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

এটা স্বপ্ন নয়, কল্পনাও নয়। ঐশ্বরিক ধরণীতলে বসে আশফিক প্রার্থিত বাস্তব সত্যের মুখোমুখিই।
-‘আমার বুকের মাঝে হাতটা রেখে বলো তো তুমি!’

আশফিকের বিস্ময়াভিভূত মুখের অভিব্যক্তি দেখে মাহির অসহ্য লাগল। উঠে বসে শক্ত গলায় বলল, ‘আমি কালই ঢাকা ফিরছি। আমার ছুটিও শেষ হতে চলেছে। এরপর কাজে ফিরলে তোমার সাথে দেখা হওয়ার সুযোগই নেই আমার। তাই প্রপোজালটা রাখা। তুমি বুদ্ধিমান। তাই ভেবে বোসো না আমরা সত্যিই পুরনো সম্পর্কে ফিরছি। তবে পুরোনে সম্পর্কের প্রতি গুপ্ত মায়া তো থাকেই। তা অস্বীকার্য নয়। আমি তোমাকে এড়িয়ে চললেও সেই মায়াকে এড়িয়ে যেতে পারি না। অনেকগুলো দিন পর যেহেতু চাইলেও না চাইলেও একই সঙ্গে আবার কিছু মুহূর্ত তৈরি করে ফেলছি তাই তিক্ততাটুকু নিশ্চিহ্ন করে দিয়েই এবার বিদায় নিতে চাই।’

তারপরই সংগোপনে বলে রাখল নিজের ভেতরের সত্তাকে, ‘যাতে শেষ সময়ে আফসোস না থেকে যায় যে, তোমার সঙ্গে কাটানো অন্তিম মুহূর্তের কোনো বিশেষ স্মৃতি নেই আমার।’

-‘আশ্চর্য! কে বলল দেখা হওয়ার সুযোগ নেই? আমি মাস চারেকের বিরতি নিয়ে এসেছি ঠিক৷ কিন্তু তোমাকে পাওয়া না হলে আমি অনির্দিষ্টকালের জন্য বিরতি নেবো।’
অনুযোগ করে বলল মাহি, ‘আচ্ছা তাই? তুমি আমাকে না পেয়ে ফিরছ না? আমাজন জয় করবে বাংলাদেশে বসে?’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আশফিক মাথা নুইয়ে ফেলল, ‘তিরস্কার করো আর যা-ই করো, সবটাই তোমার নির্ভর করছে।’
-‘উহুঁ, সবটাই পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে৷ অতীতের পরিস্থিতি, বর্তমানের পরিস্থিতি, সবটার ওপর নির্ভর করছে। এখন বুঝছ না কয়দিন পরই বুঝবে৷ চলো, এবার উঠি। সবাই এতক্ষণে চলে এসেছে নিশ্চয়ই।’

ওরা কটেজের দিকে এগিয়ে চলল। হাঁটতে হাঁটতে আশফিক জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যিই যেতে চাও?’
-‘হ্যাঁ, সেবারের মতো সবাই এক সঙ্গে৷’
-‘হৃদয় আর সাদিয়া ছাড়া সবাই ব্যস্ত। বাকিদের ছাড়া আমরাই না হয় চলি?’
-‘তুমি সুযোগ নিলে আমি কিন্তু যাব না।’
-‘নেবো না। আমি আর তুমিই চলি, চলো।’
-‘জীবনেও না। একবার তোমার প্ররোচনায় পড়ে ভুল করেছি। দ্বিতীয়বার করব না তার নিশ্চয়তা নেই। তোমাকেও বিশ্বাস করি না। একা পেলে শয়তান তোমাকে বেশি বেশি উষ্কাবে। দিলিশা আছে, হৃদয় ভাই, সাদিয়া আপু, বাকিদেরও ম্যানেজ করে ফেলো তিনদিনের জন্য। আমি পুরোনো সেই দিনের আনন্দটুকুই চাই শুধু। পুরোনো তোমাকে না।’
-‘একটু বেশিই হার্ট করে কথা বলছ তুমি!’
-‘আর হার্ট করব না। ক্যাম্পিং থেকে ফিরে ভালো সংসারী কোনো মেয়ে দেখে বিয়ে করে ফেলো। তোমার বিয়ে অ্যাটেন্ড করে যাব।’
বলতে বলতে মাহি কিছুটা এগিয়ে গেল। কিন্তু কথাগুলো আশফিককে আরও বেশি অধৈর্য করে তুলল৷ জীবনভর হাজারো সাফল্য অর্জন করলেও সেদিন বিয়েটা না করে চলে যাওয়ার মতো অত্যন্ত বোকামির জন্য আফসোসটা যাবে না। এখন ভীষণ আক্ষেপ হচ্ছে আর অশ্রাব্য গালি দিতে মন চাইছে নিজেকে। বারবার কানে বাজছে মাহির সেই কথাটা, “তুমি এই মুহূর্তে, আজই আমাকে বিয়ে না করলে আমি এক বিন্দুও বিশ্বাস করব না, তুমি দিলিশার প্রতি ফ্যাসিনেটেড নও।”

যত্নে গড়া আশফিকের আকর্ষিত ব্যক্তিত্বকে মাহির অবিশ্বাস আর ক্রোধাগ্নির প্রখর তাপে ধ্বংস করে দিয়েছিল, নিজের সুচরিত্রের শুদ্ধতার প্রমাণ দেবার কথাটাই ওর কঠিন অহংবোধে আঘাত করেছিল।
তাই সেই অহং আদর্শ প্রচণ্ড জিদ তৈরি করে ওকে বলতে বাধ্য করেছিল, “ইয়েস, আ’ম ফ্যাসিনেটেড, অ্যাট্রাকটেড টু দিলিশা৷ কী করবে তুমি? বিয়ে করবে না? ওকে ফাইন….”

নিজের দাম্ভিকতা, অহংকে যদি প্রশ্রয় না দিতো সেদিন! এখন বুঝ শক্তি যতটা সহজ আর সুন্দর হয়েছে এই পূর্ণপরিণত বুঝটাই তো তখন ছিল না। একইভাবে মাহিরও না।

আশফিকের অস্তিত্ব পাশে না পেয়ে মাহি দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছু ফিরে দেখল সর্বক্ষণের হাসিখুশি মানুষটি বিষণ্ন, ঔদাসীন্য নত মস্তকে শ্লথ পায়ে আসছে। কী করুণ লাগছে দেখতে! আবারও কান্না পেয়ে গেল মাহির। অপলক চোখে দেখতে থাকল আশফিককে। গায়ের রংটা আগের মতো আর চকচকে নেই। কেমন তামাটে বর্ণে চলে এসেছে। আগেও খুব বেশি ফর্সা ছিল না, আর না উজ্জ্বল শ্যামলা ছিল। মাঝামাঝি পর্যায়ের গোলাপি রঙা বর্ণটা ছিল। সাথে সুঠাম শরীরেও পরিবর্তন হয়েছে খুব। লম্বা মুখটা ভরাট হয়েছে, শরীরও অনেক ভারী হয়েছে বোঝা যায়। আগাগোড়াই খাবারের দিকে সচেতন সে। এখন নিশ্চয়ই আরও বেশি৷ যশস্বী ব্যক্তি বলে কথা! তবে আগের মতোই দুষ্টু স্বভাবটা থেকে গেছে। এই সুন্দর মানুষটা সেদিন কী করে পেরেছিল ওকে জখমে জখমে জর্জরিত করে ফেলতে? মুখের ওপর প্রচণ্ড হুঙ্কারে বলে দিয়েছিল, “বেরিয়ে যাও।” শুধু মানুষটির ঘর থেকে নয়, গোটা জীবন থেকেই বেরিয়ে যেতে বলেছিল।

দোষ ছিল মাহির। দোষের ভাগিদারটা না হয় ও-ই বেশি ছিল৷ কিন্তু তার শাস্তিটা কি এত নিষ্ঠুর হওয়া উচিত ছিল? ক্ষমা চাইবার সুযোগটাও ওকে দেয়নি আশফিক।

ওর কাছে এগিয়ে এসে থেমে গেল আশফিক৷ নির্বাক চেয়ে থেকেই আশফিক অপরাধী, কাতর চোখে অনেক কথায় বলে দিলো। মাহি কেমন করে ওঠা মনটাকে অদৃশ্য হাতের মুষ্টিতে চেপে রেখে দুর্বল আবেগ সামলালো। গাঢ় হয়ে মিশে দাঁড়াল আশফিকের সাথে, কোমল গলায় বলল, ‘তুমি মুভ অন করো, আশফি।’
বলা শেষ না হতেই আশফি জলোচ্ছ্বাসের মতো আছড়ে পড়ল মাহির শরীরে। ওর দীর্ঘ উচ্চতার প্রশস্ত বুকের মধ্যে মাহির ছোট্ট শরীরটা দৃঢ় আলিঙ্গনবদ্ধ করল।
-‘আগে কতটুকু ভালোবেসেছি বলতে পারি না। এখন আমার তোমাকে ছেড়ে যাওয়া দায়, খুব মুশকিল। তার থেকেও বেশি অসম্ভব। আমি একেবারে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছি তোমাকে ভালোবেসে…. এতখানই নিংড়ে দেওয়া ভালোবাসা বেসেছি! তোমার ভালোবাসা পুরোনো দিন থেকে হলেও আমার ভালোবাসার সময়কাল নতুন। আমার তোমার মতো ধৈর্যশক্তি নেই, সহ্যক্ষমতা নেই ভালোবাসা পেয়েও হারানোর। তুমি কি কোনো সমস্যায় আছ, মাহি? তোমার আজকের কথাগুলোই কী যেন ছিল? কেমন রহস্য, অনেকটা ব্যথা৷ আমার মধ্যে অশান্ত ঝড় বয়ে যাচ্ছে কেন? আমি আজ এত কষ্ট পাচ্ছি কেন?’
এই কণ্ঠে আকুলতা ছাড়া কাতর কান্নাটুকুই বাদ ছিল।
নিশ্চল মাহির ইচ্ছে করছে ক্ষয়ে গিয়ে এই বুকেই মিশে থাকতে।

অতীতে ওদের প্রথম আলিঙ্গন ছিল আরও শ্বাসরুদ্ধকর আর ভয়ঙ্কর মিষ্টি।
_________________ _________________

স্কুটি নোরাকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেদের অট্টালিকা সাম্রাজ্যে প্রবেশ করতেই মাহি আশফিকের গাড়িটা পার্কিং প্লেসে দেখতে পায়। হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলো একবার। সন্ধ্যা হতে আরও আধা ঘণ্টা বাকি। এখনো না হওয়া হবু জামাইয়ের আজ এত তাড়া কীসের? প্রথম দিন তো আত্মশ্লাঘায় উড়ে যাচ্ছিল। যেন তার মতো ছেলেকে সে ভাগ্যগুণে পেতে যাচ্ছে৷ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে খোলাখুলি রোমান্সে অভ্যস্ত হতে পারেনি বলে চুকচুক শব্দে কী ভীষণ আফসোসই না করছিল মনের মতো বউ না পেয়ে! পায়ের তালু জ্বলে মাথার তালু অবধি গরম হয়ে গিয়েছিল ওর। ও ভালোভাবেই টের পেয়েছিল, ওকে আচ্ছামতো জব্দ করেছে আশফিক। তবুও অশালীন কথাগুলো তো ওকে শুনতেই হয়েছে। আজ বেকার, বজ্জাত মিনসেটাকে হাড়েহাড়ে জ্বালিয়ে খাক করে দেবে ও।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২০.২
____________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

আয়তকার অবসর কক্ষের ম্যাগনোলিয়া রঙা দেওয়ালের সঙ্গে ওয়াল সেট লাইটিং। এর পাশাপাশি চমকপ্রদ রকমারি পেনডেন্ট লাইট। স্টিল, পিতল আরও কী কী যেন ব্যবহার করে তৈরি আলোর সেটগুলোও আকর্ষণীয় খুব। তিনটি কালো রঙা বড়ো সোফার সঙ্গে দু’টো হাই ব্যাক সোফা চেয়ার আর বড়ো একটি সোফার দু’পাশে ফ্লোর ল্যাম্প দু’টোও একটু অন্যরকম সুন্দর। অনেকটা হাতে তৈরি সৌখিন ধাচের। আর উত্তর দক্ষিণ দেওয়ালের একটিতে ভারতের মানচিত্রের মতো কিছু একটা নকশা, যেটা দেখে মনে হয় দেওয়ালেই খোদাই করা হয়েছে। অন্যটিতে বিখ্যাত কয়েকটি রঙিন চিত্রাঙ্কন। যেগুলো দেশের বাইরে থেকে সংগ্রহ।

আশফিকের নজর কেড়েছে ছোটো থেকে বড়ো সব জিনিসই। এ ধরনের সাজসজ্জার পরিকল্পনা ওর জানাতে মেয়েদের মাথা থেকে আসে। কেন যেন ওর মনে হচ্ছে এই সুন্দর পরিকল্পনা মাহির।

আশফিক নাহিয়ান দু’জন পাশাপাশি ধূসর রঙা সোফাতে বসে খোশগল্পের একটা দু’টো কথা শুরু করেছে মাত্র৷ সবে হাতে নেওয়া তাদের কফি মগ থেকে ধোঁয়া উড়ছে বেশ। নাহিয়ানের সাথে আশফিকের পরিচয় অনেক আগে থেকেই৷ ব্যবসায়িক কাজকর্মে ওদের বাসায় নাহিয়ানের যাওয়া পড়ে ভালোই৷ সম্পর্কটাও তার সঙ্গে আশফিকের ভালোই৷ যতটা ভালো হলে নাহিয়ান তুই সম্বোধন করে তাকে। কিন্তু আশফিকের এই প্রথমবারই আসা এ বাড়িতে। লজ্জা করছে এই ভেবে, বাবা-মায়ের সাথে করে মাহিকে দেখতে আসার আগেই সে একাই এসে পড়েছে৷ এমন উদ্দেশ্য ওর একদমই ছিল না। ইচ্ছা ছিল মাহি বাসার সামনে পৌঁছতেই ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে৷ সেই অপেক্ষাতেই গাড়ি নিয়ে বাসার রাস্তার বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু কে জানত নাহিয়ানের চোখে পড়ে যাবে! অসম্ভব লজ্জা কাকে বলে তা হবু সম্বন্ধীর সামনে পড়ে বুঝেছে আজ।

এসে থেকে বাসায় কাজ করার মতো মানুষকে চোখে পড়ল না আশফিকের৷ মাহির মতো বাচ্চা একটা মেয়ে গোটা এই বাড়িটা একা সামলিয়ে রাখে ভাবতেই বিস্ময় আর বিমুগ্ধতায় বাকহীন হয়ে যাচ্ছে। ঘরোয়া কাজে মেয়েটি খুব পারদর্শী বলে শুনেছে সে মায়ের কাছে। সে কারণেই মায়ের খুব মনে ধরেছে মাহিকে। তিনি নিজের মতো সংসারী, ঘরোয়া স্বভাবের ছেলে বউ চান। নিজস্ব কোনো পছন্দ নেই বলে আশফিকও আর অমত করার সুযোগ পায়নি। তারপর তো নিজেই গতকাল যাচাই বাছাই করে এখন মায়ের মতো তারও মনে ধরে গেছে মাহিকে। আজকের সবটা দেখার পর, বোঝার পর ওর কাছে মাহিকে ‘অল রাউন্ডার’ বলে মনে হচ্ছে। বাদ বাকি যেটুকু অজানা তা জানতে হলে নিজের ‘ওভার স্মার্টনেস’ ঠাটঠমকটা ত্যাগ করে মাহির সঙ্গে সহজ হতে হবে। শুরুতে বন্ধু, দ্বিতীয়তে প্রেমিক আর শেষে অর্ধাঙ্গ।

ব্লুটুথটা কান থেকে খুলে দ্রুত প্যান্টের পকেটে গুঁজে নাহিয়ান আর আশফিকের দিকে এগিয়ে এলো মাহি। ওরা কথাতে ব্যস্ত ছিল বলে ওর ভেতরে আসা খেয়াল করেনি৷

-‘কে কখন এলে তোমরা?’
তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টিকারী রিনরিনে কণ্ঠস্বর কানে পৌঁছতেই আশফিক কফিতে চুমুক দিতে ভুলে গেল, অবিলম্বে ঘাড় ফেরাল ওর পানে। নাহিয়ান ওকে দেখে সরস অভিব্যক্তিতে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ল, ‘কই ছিলি এই সন্ধ্যায়?’
-‘এই তো সামনেই।’
-‘নোরাকে কল করেছিলাম, বলল ওর স্কুটি নিয়ে কোথায় নাকি গিয়েছিস। এদিকে আমি সিলেট থেকে বাসায় ফিরে দেখি রাস্তার ওপাশে আশফিক বাম্পারে উঠে বসে আছে তোর অপেক্ষাতে।’ শেষ কথাতে হেসেও দিলো নাহিয়ান।
মাহিও হাসছে মিটিমিটি, ‘তাই নাকি? আমাদের সন্ধ্যায় মিট করার কথা ছিল আসলে। এক্সাক্ট টাইমটা বলিনি। ও তাই হয়তো আন্দাজ মতো এসেই অপেক্ষা করছিল।’

অতি বিনম্র, সুশীল পুরুষ হিসেবে আশফিক বিব্রত, অস্থির চাউনি এদিক ওদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে বদ অভ্যাসবশত বৃদ্ধা আঙুলে নাকের ডগা চুলকাচ্ছে ঘনঘন। এদের দু’ভাইবোনের সামনে কী একটা বেকায়দা অবস্থায় পড়ছে সে বারবার!

নাহিয়ান আশফিকের অবনত নাকাল চেহারাটা দেখে খানিক মায়াবোধ করল, মাহিকে বলল, ‘তাহলে তুই দেরি করিস না আর। ও বসুক আমার সঙ্গে। তুই ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে একেবারে তৈরি হয়ে আয়।’
নীরবে সম্মতি জানিয়ে মাহি সিঁড়ি অবধি চলে যেতেই নাহিয়ান বলে উঠল, ‘নাকি আমাদের বাসাটা ঘুরে দেখবি আশফিক? চল, বসে থেকে কী করবি?’
-‘তুমি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হইয়ো না৷ তুমিও তো বাইরে থেকে এসেছ। ফ্রেশ হয়ে আসো, আমি এখানেই রিল্যাক্সে আছি।’
-‘আরে চল তো। আমি ফ্রেশই আছি। জার্নিতে অতটাও জার্ম অ্যাটাক হইনি।’
মাহি ওদের কথা শুনতে শুনতে ঘর অবধি চলে গেল৷ তা খেয়াল করেই নাহিয়ান হাস্যরসাত্মক গলায় বলল আশফিককে, ‘যতই ওয়েল-ব্রেড হ ব্যাটা, এখনই বোনের ঘরে যাবার পারমিশন দিচ্ছি না।’

এমন মজার পিঠে মজা তো করাই যায়৷ আশফিকের মতো দুষ্টু ছেলে এসব রসিকতায় দমে থাকতে পারে না কি? সকল লজ্জা, বিব্রত ছুঁড়ে ফেলে জবাব দিলো, ‘ওই দিন দূরে নেই ভাই। তাছাড়াও তোমার বোন বাড়ি একা থাকে৷ আমি সেটার সুযোগ নিতেই পারি যখন তখন। তবে তোমাদের সিকিউরিটি গার্ডকে সচেতন থাকতে বোলো। তোমার বোনকে আমার মনে লেগেছে বেশ। সুযোগ পেলে হাত ছাড়া করব না কিন্তু।’
কপট রাগে ধমকাল নাহিয়ান, ‘শা/লা হাড্ডি হড্ডিতে পে/টা/ব কিন্তু।’
হাসতে হাসতে বলল আশফিকও, ‘আমিও তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব কিন্তু।’
.
.
.
উত্তরা সেক্টর ৭, লেক ট্যারেস স্টিকহাউজের রুফটপে কার্নিশের পাশ ঘেঁষে মুখোমুখি বসে ওরা দু’জন। খোলা আকাশতলে গায়ে এসে ঝাপটে পড়া ঝিরঝিরে মাতোয়ারা বাতাসে কার্নিশ ছুঁয়ে থাকা টবের গাছগুলোর নৃত্য আন্দোলন আর ল্যাম্পের গোধূমাবর্ণ ঈষৎ আলোয় এক রোমাঞ্চকর ঐন্দ্রজালিক সাঁঝে মনটা ওদের মিষ্টি প্রেমের জোয়ারে ভাসছে। চনমনে অনুভূতিতে আশফিক কথা জমানোর চেষ্টায় আছে। গতকালকের জন্য ভীষণ অনুতপ্ত তা কয়েকবার বলে ফেলেছে সে। কিন্তু মাহি গাম্ভির্যের সাথে ভাবান্তরহীন সেই গাড়ি থেকেই। হওয়াটাই স্বাভাবিক। মেয়েদের অভিমানী সত্তাটা ব্যক্তিগত পুরুষদের কাছে একটু বাড়াবাড়িভাবেই প্রকাশ পায়। তা বুঝে নেওয়াটা যেন অলিখিতিভাবে সেই ব্যক্তিগত পুরুষদের দায়িত্ব।

আশফিক এখন ভাবছে রোমান্টিক প্রেমিক বা বরদের মতো ক্যান্ডেল লাইট ডিনারের আয়োজন করে স্যরি বললেই সমস্যা এক চুটকিতে মিটে যেত! মেয়েদের কাছে চমকে দেওয়া উপহারের দ্বারা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশই বেশি প্রাধান্য পায়।

-‘আমরা কিছু অর্ডার করি, মাহি?’
-‘করে ফেলো।’
-‘তুমি করো না! তোমার পছন্দও জানা হবে এতে আমার।’
-‘আপাতত সফ্ট ড্রিংক নিই৷ তারপর ডিনার করে বের হবো। আমি সেই প্ল্যান করেই এসেছি।’
আশফিক হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ওরও তেমন পরিকল্পনায় ছিল। তবে ও ভেবেই নিয়েছিল, সামান্য খাবার অর্ডার করতে চাওয়া নিয়েও হয়তো গাল ফুলিয়ে রেখে তালবাহানা করবে মাহি। ভাগ্যগুণে মাহি নয়, সে-ই কপাল করে ন্যাকামিবিহীন সোজাসাপটা, স্পষ্টভাষী বউ পেতে চলেছে৷ ও কখনো আলাদা করে ভাবেনি মূলত ওর কেমন মেয়ে পছন্দ৷ কিন্তু মাহিকে দেখার পর থেকে তার সামান্য থেকে বিশেষ সব ব্যাপারগুলোই ভালো লেগে যাচ্ছে।

পানীয় অর্ডার করে আনার পর থেকে স্ট্র মুখে পুরে মাহি নিশ্চুপ। এই নিশ্চুপতা দেখা আশফিকের ধৈর্যে নিচ্ছে না আর। চেয়ারে গা এলিয়ে শার্টের একটা টপ বোতাম খুলে একজন সার্ভিস বয়কে ইশারা করল স্ট্যান্ড ফ্যান আরও কিছুটা ওদের টেবিল বরাবর ঘুরিয়ে দিতে। হাওয়ার তোরে তখনই হঠাৎ মাহির নীল রঙা ওড়ানাটা এক কাঁধ থেকে খসে পড়ল। খুব একটা দৃষ্টিকটু বা বিব্রতকর নয় এই ঘটনা। কিন্তু আশফিক কেবল তার দিকে মনোযোগ আনতে বাধ্য করার জন্য বলে উঠল, ‘ওড়ানাটা সুন্দর করে নাও, মাহি।’
কথাটা বলা শেষ হলো কি হলো না, মাহি নত মস্তক তড়াক করে উঁচু করল, ‘কী!’

কণ্ঠের ঝাঁঝটা আশফিকের দারুণ লাগল। চোখে সেই গতকালকের মতো স্ফুলিঙ্গ ছুটছে৷ কিন্তু বিশাল একটা সৌন্দর্যের অধিকারী হতে পারেনি মাহি৷ রাগলে একদমই মুখটা লাল হয় না ওর।

আশফিক ভড়কাল না, ভীতও হলো না। বরং সহজ সাবলীলভাবে অবগত করল, ‘তুমি বোধ হয় খেয়াল করো না, বাইরে লোকভীড়ে তুমি অনায়াসেই অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করো। গতকালও সকলের কেন্দ্রবিন্দু ছিলে৷ আজ অন্তত এমনটা আমি চাই না।’

ওড়না বস্তুটাই যেখানে মেয়েদের জন্য ভীষণ সংবেদনশীল সেখানে তর্ক করার জায়গা থাকে না। নয়তো সেটা খুব উদ্ধত দেখায়। নিঃশব্দে ওড়নাটা কাঁধে তুলে আশফিকের দিকে আর চাইল না মাহি। একটু লজ্জাও লাগছে। কারণ, না চেয়েও ইন্দ্রিয়গম্য হচ্ছে ওর, আশফিকের অকপট নিষ্পলক চাউনি ওর মুখে নিবদ্ধ। এমনভাবে রইলও সে বেশ কিছুক্ষণ। মাহির কাছে চাউনির এই ঢঙটা কেমন দাম্ভিকতাপূর্ণ লাগছে। যেন ওকে তাচ্ছিল্য করছে। তাই মুখের ওপর এবার ও বলেই ফেলল, ‘তোমার দেখার ঢঙটা আমার ভীষণ লাগে, এটা পরিবর্তন করবে।’
ঠোঁট ছড়িয়ে একদমই সামান্য হাসল আশফিক৷ যেন হাসিতেও ও হামবড়া ভাবটা প্রকাশ করতে চাইল, ‘কোথায়? বুকে লাগে?’

ইসরাত জাহান দ্যুতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here