রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৩.১
____________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
অবিলম্বে আশফিক দু’হাতে মাহির ডিম্বাকৃতির কোমল মুখটা তুলে নিম্ন ঠোঁটটা ওর পাতলা দু’ঠোঁটের ফাঁকে ভেজাল। স্নেহার্দ্রতার বশে হোক বা কোনো অভিপ্রায়ে হোক। সমগ্র জগত ভুলে পরস্পরের ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করে থাকল ওরা কালহরণ করে। আশফিকের সংশায়পন্ন অন্তঃকরণ এখন আবেগে আধুত। মাহির উদ্দেশ্য প্রণোদিত মনটাও আর ঘটমান সময় তটে নেই। মনশ্চক্ষু ওর বদ্ধ চোখের দুয়ারে এনে খাঁড়া করিয়েছে স্মৃতি কালের সেই সন্ধ্যা আর সেই অচেনা, জনশূন্য ব্রিজে একাকী গাড়িতে বসে শুধু ওরা দু’জন…. স্থান, কাল ভুলে আশফিকের দুঃসাহিসক, প্রকাণ্ডকায় জাপটে ধরে ওকে প্রথম চুমু।
ভীতসন্ত্রস্ত, অসহায় ঐশী বিস্ময়ে জড়ীভূত। ওর মনে পড়ে না ত্রিশ বছরের জীবনে এমনো কোনো চমকিত অধ্যায় আছে কি না! কোনো ড্রামা সিরিজের অত্যন্ত রোমাঞ্চকর দৃশ্য নয়, তার দৃষ্টি সম্মুখের দৃশ্যটি ধ্রুব সত্য! কী করে, হঠাৎ কীভাবে, এসব প্রশ্ন জর্জরিত মনটা ওর ক্ষণিক পূর্বের অন্যায়ের কথা ভুলে বসেছে শুধু এই চোখ ছানাবড়া করা জীবন্ত চিত্রটি দেখতে দেখতে।
উদ্বেল আবেগ আর স্নেহের উন্মাদনায় আশফিক আজও স্থান, কাল, পাত্র ভুলতে বসেছিল। মাহি ওর বুকে মৃদু ধাক্কা দিতেই স্বপ্নবৎ পৃথিবী থেকে ফিরল ও। প্রবল উদ্বেগে নির্বাক চাউনিতে তাকাল মাহির চোখে। মাহি তখন এটুকুই বলল, ‘যাও, ঘুমিয়ে পোড়ো।’ ওর জন্য এতটুকুই বলার ছিল ব্যাস! দ্বিতীয় কোনো বাক্য বা প্রশ্ন নেই?
আশফিকের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি উপেক্ষা করে মাহি ঐশীর কাছে গেল। অপরাধী সেই যে বাকশূন্য! তার ণত্বষত্বজ্ঞানে এখনো উপলব্ধি হয়নি মাহি কিয়ৎ পল পূর্বের কাজটি কেন করল? নিঃশব্দে ঐশীর সেই হাতের কব্জি চেপে ধরল যে হাতখানা আশফিক ধরেছিল। এবং দু’জনের ধরবার ধরনই যাতনাদায়ক ছিল। টেনে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো মাহি। সশব্দে দরজা বন্ধ করে ঐশীকে ছুঁড়ে ফেলল বিছানাতে। ওকে ভাবি হিসেবে পছন্দ ছিল না সেই শুরু থেকেই৷ তবুও অসম্মান বা অবমূল্যায়নও করেনি কখনো৷ যতটা সম্ভব সৌজন্যপূর্ণ আচরণ রেখেছে আর কোনো কিছু অপছন্দনীয় হলে বিনা অভিযোগে কেবল এড়িয়ে গেছে। কিন্তু সব সময়ের মতো আজকের অপছন্দনীয়, অন্যায়ের সীমা অতিক্রম করা ওর কদর্যতা নিশ্চুপ এড়িয়ে যাওয়া কখনোই সম্ভব নয়।
এতক্ষণে কণ্ঠে তেজ ফিরল ঐশীর। তেতে উঠে দাঁড়াল, কৈফিয়ত চাইল মাহির কাছে, ‘তুমি আমার সাথে এত রুড কীভাবে হচ্ছ, মাহি? আমার জায়গাটা কোথায় ভুলে গেছ?’
এরপরের ধৃষ্টতা আর মিথ্যা কী হতে পারে তা অনুমান করেই মাহি হাতের ফোনটাতে কল রেকর্ড চালু করে দিলো মুহূর্তেই। ‘তুমি আমার দিকে চাও, আশফিক।’ সেখানে কথার শুরুটা এখান থেকেই হলো। কিংকর্তব্যবিমূড় ঐশী। ধপ করে বসে পড়ল বিছানাতে।
নিচু কণ্ঠে মাহি বিবৃতি দিতে শুরু করল তখন, ‘সারা দুনিয়া মাড়িয়ে বেড়ানো তোমার চোখ ঝলসে দেওয়া ওই হটি, সে-ক্সি ছেলেটার পায়ের আঙুলের সমান বুদ্ধিও নেই তোমার। আর না আছে তোমার সঙ্গে বসবাস করা এই ফাইটার পাইলটরের ধূর্ততা বোঝার ক্ষমতা। যাকে বিশ্বাস করে সঙ্গে নিয়ে চুরি করতে নামলে সে আদতে তোমার বিশ্বাসযোগ্য কিনা তা পরোখ করে নেবে না রে বোকা! দেখেছ, তোমাকে ফাঁসিয়ে দিলো কীভাবে? এই কল রেকর্ডটা নাহিয়ান ইসলামকে শোনালে সে কি পঁচিশ বছরে ধরে ভালোবাসার বোনকে রেখে দুই বছর সংসার করা বউকে বিশ্বাস করবে? ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় শুধু ট্রান্সপারেন্ট একটা নাইট স্যুট পরে গেলে চরম উত্তেজনায়। আমি যত্নশীল ননদ পরে তা খেয়াল হতেই চাদরটা নিয়ে ছুটলাম বাইরে। তারপরই দেখলাম আশফির জন্য ছেড়ে যাওয়া ঘরটাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে তুমি। কী হলো ব্যাপারটা? ভাবনাতে পড়লাম তখন৷ এমনি এমনি তো যাওনি তুমি৷ যেখানে জানোই ওই ঘরটাতে দু’জন পরপুরুষ ঘুমাবে আজ৷ একটা পজিটিভ থট আনার চেষ্টাও করেছিলাম খুব, বিলিভ মি! কিন্তু আমার বিশ্বাসের পক্ষে কোনো যুক্তি পাচ্ছিলাম না যখন তোমাকে আর বের হতে দেখলাম না। আমি কিন্তু আশফি ঘরে ঢোকার আগ অবধি বাইরেই ছিলাম, একটু আড়ালে। পুরো ড্রামাটা বোঝার জন্য। সেটা যে শুনিয়েও দেবে তোমার শরীরে আ-গুন জ্বালানো ছেলেটা, এ ব্যাপারে ফিফটি পারসেন্ট আশাবাদী ছিলাম আমি। তোমার হাবভাব এখানে এসেই বুঝে ফেলেছিলাম আমি বা আমরা। আমরা বলতে আমি আর আশফি। আমাদের দূরদর্শিতার প্রশংসা করতেই পারো।’
বলার ফাঁকে মাহি একটু সময়ের জন্য থামতেই ঐশী ওর হাতদু’টো মুষ্ঠিবদ্ধ করল, ‘প্লিজ মাহি, মাফ করো আমায়৷ এমন ভুল আর জীবনেও করব না। নাহিয়ানকে কিছু জানিয়ো না ভাই। আমি মরেই যাব ও আমাকে ছেড়ে দিলে।’
এই কপটচারীর মিথ্যা কথার বিপরীতে কোনো উত্তর রাখল না মাহি। সম্মানের জায়গায় এই হীন নারী না থাকলে ও-ও গায়ে হাত তোলার স্পর্ধা না দেখিয়ে ছাড়ত না আজ। অপারগতা ওরও এখানেই।
-‘আরে শোনো শোনো, কথা শেষ হয়নি আমার৷ পাওয়ারলেস, আনঅ্যাবল যাকে বলে এলে তার বিছানার কর্মদক্ষতা সম্পর্কে ধারণা দিতে না পারলেও প্রাথমিক পর্যায়ের পারদর্শিতা কেমন তা বলতে পারি আমি৷ সে বেস্ট কিসার এ নিয়ে তো কোনো সন্দেহ এখন আর থাকার কথা না তোমার। অন্যদের মতো স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে হাতাহাতি না করেও ওর ক্ষমতা ছিল সামান্য আমার গালে গাল ছুঁইয়ে ক্ষণিকে দুর্বল করে দেবার। ইয়েস, উই ওয়্যার ইন আ রিলেশনশিপ। আমি সেই পুরোনো সময়ের কথাই বলছি। পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে তোমায় বলতে ইচ্ছা করছে আমাদের সেই সময়কার রগরগে রোমান্সের গল্প। কিন্তু হাতে সময় কম। আসল কথাগুলোই বলি, সে-ক্সুয়াল অ্যাট্রাকশন ওর মধ্যে আছে কি নেই এসব উস্কানিমূলক কথাগুলো শুনলেই বুঝি ও রেগে গিয়ে তোমাকে নিয়ে বিছানাতে ঝাপিয়ে পড়ত? ওর দৃঢ় ব্যক্তিরূপটা তোমার বুঝতে বিরাট ভুল হয়েছে৷ সেই ভুলের খেসারত আদায় না করে ও ছেড়ে দিলেও আমি তো ছাড়ব না। এখান থেকে আগামীকালই ফিরবে তুমি আমার সঙ্গে। আমার আব্বুর সুপ্ত বাসনা দাদু ডাক শুনবার৷ মুখ ফুটে না বললেও তোমার বুঝে নেওয়া উচিত ছিল। আশা করছি এ বছরেই আব্বুকে এই সংবাদটা শোনাতে পারবে। আমার ভাইও যে এর পক্ষে তাও আমি জানি৷ কিন্তু সবাই ভীষণ স্বাধীনচেতা মানুষ বলে তোমার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। তোমার ইচ্ছা আর মতামতের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। বিয়ের সম্পর্কগুলো তো চাইলেই ভেঙে দেওয়া যায় না। এ জন্যই ভাইয়াকে ততক্ষণ কিচ্ছু জানাব না আমি যতক্ষণ তুমি নিজেকে শুধরে রাখবে।’
কথা শেষ হওয়ার মুহূর্তেই মাহির ফোন বেজে উঠল। নাহিয়ান কল করেছে। ঐশীকে ফোনে পাচ্ছে না বিধায় যে ওকে ফোন করেছে তা বুঝতে অসু্বিধা হলো না ওদের। মাহি জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার ফোন কই?’
মিনেমিনে গলায় জবাব দিলো ঐশী, ‘আশফিক ডেসট্রয়েড।’
অবাক হলো না মোটেও মাহি, ‘তোমার ব্লু সিন ফোনক্যামেরাতে ধারণ করেছিলে?’
লজ্জা, ভয়ে নিশ্চুপ ঐশী নত হয়ে রইল৷ রোষাগ্নি চোখে চেয়ে আছে মাহি৷ এই নিকৃষ্ট মহিলার সামনে উগ্র মেজাজ আর বেশিক্ষণ সামাল দিতে পারবে না সে। এর মাঝে নাহিয়ানের কলটাও কেটে গিয়েছে।
-‘কী করে?’
-‘কমোডে ফ্লাশ করে।’ আগের মতো মন্থর গলাতেই বলল ঐশী।
-‘ওয়াও! গ্রেট ম্যান।’
ফোনটার দিকে একবার চেয়ে এবার ঐশীকে অবগত করল, ‘রেকর্ডটা আমার সিক্রেট ফোল্ডারে সেইভ আছে৷ তাই ভেবো না ডিলিট করে দিলে সব ভ্যানিশ। সিক্রেট ফোল্ডার খোঁজার বৃথা চেষ্টাটাও কোরো না।’
আবার বাজতে শুরু করেছে নাহিয়ানের ফোনকল। মাহি রিসিভ করতেই নাহিয়ান জিজ্ঞেস করল, ‘কী করছিস? তোর ভাবি কই? ওর ফোন বন্ধ পাচ্ছি।’
-‘আনফরচুনেটলি ফোনটা টয়লেটে পড়েছে৷ ভাবি আমার সামনেই। নাও কথা বলো।’
ঐশী ভীষণ আঁতকে উঠল। মাহি বলে দিলো ফোনের বর্তমান পরিণতি? ক্রুরোকর্মার ন্যায় হাসল মাহি, ‘মিথ্যা বলার দায় তোমার। আমার না।’
ল্যাপটপটা নিয়ে বাইরে চলে এলো ও। বারান্দাতে পিলারের গায়ে গা হেলিয়ে বসল। ফোনটার জন্য কাজে ব্যাঘাত ঘটবে বেশ৷ স্যারের থেকে বকাও খেতে হবে তার জন্য। তবে এখন কিছুক্ষণের জন্য ও নিজেই কাজ বিরত দেবে একটু। এইতো এক সপ্তাহের মধ্যে ফিরতে হবে ওকে কর্মস্থলে৷
আশফিক! আর অন্তর্দাহ করা আশফিকের প্রতি প্রণয় মায়া! কিছুই ত্যাগ করতে পারেনি ও। এত কাল চোখের আড়ালে ছিল তাই সব কিছুই মনে ছাইচাপা দিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু এবার এই আবেগতাড়িত হৃদয়টা নিয়ে বেশ ঝক্কি পোহাতে হবে ওর।
আজকের দুর্ঘটনাটা ছিল কি শুধুই আশফিকের মান অপমানের? নাহ, সরাসরি মাহির বুকেও আঘাত হেনেছিল। অকাট্য সত্য যা তা হলো, অতীতের সম্পর্কের জের মাহি না চাইতেও বর্তমান অবধি ধরে রেখেছে। বিয়েটা না হলেও স্বামী রূপেই তো ওর বোকা মনটা এক সময় আশফিককে গ্রহণ করে নিয়েছিল। সেই মনটা আজ দস্তুরমতো বুঝদার হলেও ওই মানুষটার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা আর তার সক্রিয় প্রভাব তো বিলীন হয়নি। যার প্রমাণ— আজ সে সহ্য করতে পারেনি যখন ঐশী আশফিককে নিয়ে বর্ণনাতীত নোংরা খেলা খেলতে নেমেছিল, আশফিকের পুরুষত্বকে তিরস্কাপূর্ণ করেছিল।
ঘাড় বেঁকিয়ে আশফিকের বর্তমান অবস্থানরত ঘরের দরজায় চোখ রাখল৷ ছেলেটার একটাবার খোঁজ নেওয়া জরুরি ছিল ওর। বর্তমান সমাজের মানুষগুলোর মস্তিষ্কের বিকৃতির পরিণাম এতই ভয়াবহ যে, আশফিক পুরুষ হয়েও দুই দু’বার যৌ-ন উৎপীড়নের শিকার হলো ওরই চোখের সামনে। তাহলে ওর আড়ালে এই পুরুষের সাথে কী হয়েছে? না কি হয়নি কে জানে! আগের মতো মনটা অধিকারপ্রবণ হয়ে উঠছে ওর, জ্বলে উঠছে ভেতরটাতে৷ যখন সে ক্লাস এইটে তখন নানিবু বেঁচে ছিলেন৷ তাঁর কাছে গল্প শুনেছিল, নানুভাইও না কি ব্যবসায়িক কাজে একবার ভারত গিয়ে কীভাবে যেন কোন মধ্যবয়স্ক মহিলার দ্বারা জোরজবরদস্তির শিকার হয়েছিলেন। বলে রাখা হলো, সালাম শিকদার যুবক বয়সে দেখতে ছিলেন বেশ সুঠামদেহী পাকিস্তানিদের মতো।
আশফিকের কাছে যাবার তাগিদ অনুভব হলো মাহির। না গেলেই নয়৷ আশফিকও হয়তো অপেক্ষায় আছে ওর জন্য। কাল্পনিক কোনো দৈবশক্তি এমন কিছুই জানান দিচ্ছে ওকে। উঠে পড়ে সম্মুখে অগ্রসর হতেই ঐশী বেরিয়ে এলো। দরজা খোলার শব্দ পেয়ে ও থেমে পড়তেই ঐশী এগিয়ে এসে ফোনটা দিয়ে বলল ওকে, ‘তোমার কল আসছে ঘনঘন। নাহিয়ানের সাথে কথা শেষ করে দিয়েছি আমি।’
মাহি ফোনটা হাত বাড়িয়ে নিলো শুধু। ওর নিশ্চুপ অকৃত্রিম গাম্ভীর্যের অভিব্যক্তির সামনে ঐশীর আজ দাঁড়িয়ে থাকবার সাহস হলো না। বিদায় নিতেই মাহি পা বাড়াল আবার আশফিকের ঘরের পানে৷ ফোনের স্ক্রিনে নজর দিলো না। নয়তো আর যাওয়া হবে না আবদ্ধ ঘরের মানুষটির কাছে।
ঘর অবধি পৌঁছে দরজাতে কড়া দেবার পরই ফোনটা হাতের মধ্যে কেঁপে উঠল। স্ক্রিনে চোখ পড়তে দেখল, দিব্য ফারহান। নামটি দেখে ভাবনাচিন্তা করারও জো পেলো না। দরজার ওপাশের অপেক্ষারত ব্যক্তি সামনে ততক্ষণে দরজা মেলে দাঁড়িয়ে।
ইসরাত জাহান দ্যুতি
রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ২৩.২
____________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
নির্দ্বিধায় ফোনটা সাইলেন্ট মোড করে দিলো। লেগিংস প্যান্টটার পেছন পকেটে পুরে রেখে আশফিকের দিকে আগ্রহ নিয়ে চাইল, ‘এত দ্রুত! দরজার ওপাশেই দাঁড়িয়ে ছিলে না কি?’
-‘বের হচ্ছিলাম। তখনই নক করেছ।’
বলতে বলতে দরজার মুখ থেকে সরে দাঁড়াল। মাহি ভেতরে এসে দরজাটা নিজেই আলগোছে চাপিয়ে দিলো৷
-‘ঘুমাতে বলে গেলাম৷ বাইরে বের হচ্ছিলে কেন?’
নীরবে সোফার এক কিনার ঘেঁষে বসল আশফিক। মাহি কাছে এসে বসার পর বলল, ‘শি ইজ সাফারিং ফ্রম হাইপারসে-ক্সুয়াল ডিজঅর্ডার। ডিড য়্যু আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট?’
-‘নাহ, আমি তো তার কাছে হ্যারাজমেন্টের শিকার হইনি। বুঝব কীভাবে?’
-‘নাহিয়ান ভাই?’
-‘ঘরের কথা কি ভাইয়া বাইরে বলবে?’
কথার মাঝে হাসল মাহি। প্রশ্নটা বোকা বোকা ছিল যে। সে হাসিটা একটু ব্যাঙ্গাত্মক লাগল আশফিকের কাছে৷
অবনত মস্তক ওর, মুখটা বিমর্ষ৷ মাহি চেয়ে থেকে হঠাৎ বিদ্রুপাত্মক সুরে বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম এসে দেখব তুমি মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদছ।’
আশফিক কেমন করে তাকাল তখন। কোনো বিশেষ অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারল না৷ মাহি ওর গাম্ভীর্যতার মজা লুটছে! চট করেই তো আর সব পরিস্থিতিকে ভোলা যায় না। ভার কণ্ঠে বলল, ‘রাবিশ টক! আমি কি তোমার চোখে অসহায় নারীর মতো দেখতে? সমস্যাতে পড়েছি৷ কিন্তু এইরকম ডাইয়ার সিচুয়েশনে ফাঁসিনি আগে। আর না কখনো এসবের ফায়দা নিয়েছি। খুবই ভয়ঙ্কর আর বিপজ্জনক ছিল আজকের ব্যাপারটা। কারণ, এতে আমাদের ফ্যামিলিক্যাল ইসু তৈরি হতো।’
প্রলম্বিত শ্বাস ফেলল মাহি, ‘হুঁ, তা হতো।’
বলতেই খেয়াল হলো আশফিকের বলা বিশেষ একটি কথা, ‘সমস্যাতে পড়েছ। কিন্তু তার ফায়দা নাওনি। কেন বললে? মনে হলো জবাবদিহিও করলে এখানে।’
বক্র চোখে চেয়ে আশফিক মাহির গোয়েন্দা দৃষ্টিভঙ্গি দেখে হতাশায় মাথা দুলাল। প্রেমিক অথবা স্বামী প্রাক্তন হোক কিংবা বর্তমান। চিরকাল পুরুষদের সন্দেহ নামক বন্দুকের মুখে রাখা নারীদের জাতীয় অধিকার। তবে হ্যাঁ, মাহি যেহেতু কৈফিয়ত হিসেবে ধরে নিয়েছে কথাটা সেটা খুব একটা ভুল ভাবেনি। নিজেকে স্বচ্ছ, শুদ্ধরূপে মাহির সামনে উপস্থাপন রাখার অভিসন্ধি তো ওর থাকেই।
-‘মাথা নাচাও কেন? এক্সপ্ল্যানেশন তখন দেয় মানুষ যখন সেও অভিযুক্ত থাকে৷’
কঠিন বিরসতায় আশফিক স্তিমিত গলায় বলল তখন, ‘আমি এ ধরনের কোনো অশ্লীলতা আজ অবধি করিনি, মাহি। বিশ্বাস না হলে দিলিশাকেই জিজ্ঞেস কোরো। ও অন্তত মিথ্যা বলতে পারবে না।’
মাহির সন্দিগ্ধ মন উথাল-পাতাল করে উঠল দিলিশার নাম শুনতেই৷ যে অতীতে দিলিশাকে ঘিরেই অভিযোগ করেছিল সে, আজও সেই নামটাই। তাহলে এখনো যখন দিলিশাতে আশফিক মোহিত বিয়েতে কেন অস্বীকৃতি ওর? আর কোনো কথা বাড়ানোর ইচ্ছা হলো না মাহির। কিন্তু উদ্দেশ্যশূন্য কথাটা আশফিকের নিজের কানে এসে লাগতেই সতর্ক দৃষ্টিতে মাহির মুখটা দেখল। বোঝার উপায় নেই কথাটার ভিন্ন অর্থ ধরেছে কি না মাহি। কিন্তু একই ভুল সেই আবারও! আহা ভাগ্য! না না দুর্ভাগ্য। তড়িঘড়ি করে বলে উঠল, ‘থাক দিলিশাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না। আমিই কনফেস করছি৷ মাস পাঁচেক আগে তখন আমরা অনেকে মিলে ট্যুরে গিয়েছিলাম। সেখানে দিলিশা আমাকে প্রপোজ করে। তার আগে ও আমার সঙ্গে কাপল ডান্স করতে চেয়েছিল, মানে করেছিল। দেন শি সাডেনলি ট্রাইড টু কিস মি অ্যান্ড আই রিজেক্ট হার। কিন্তু ওর হাতের পিঠে সাধারণভাবে স্রেফ ঠোঁট ছুঁইয়েছিলাম। শুধু আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা রক্ষার্থে।’
পাশাপাশি বসে সবটা খুব মন দিয়েই শুনল মাহি দৃষ্টি নিচুতে সীমাবদ্ধ রেখে। আশফিক নিজের অনুভূতির অকপট স্বীকারোক্তি দিলেও ওর মনটা তবুও আগের মতো এখন আর চায় না আশফিককে গ্রহণ করতে। অথচ ভালোবাসায় ওর মনেরও ভরাডুবি অবস্থা৷
দিলিশাকে কেন্দ্র করে ওদের বিচ্ছেদের শুরু। সেই থেকে এই মুহূর্ত অবধি দিলিশাই মূল কেন্দ্রবিন্দু থেকে গেল। মাহির কাছে মনে হচ্ছে এখন, দিলিশার ব্যক্তিরুপটা ভীষণ ঠুনকো এবং আশফিক সু্বিধাভোগী। প্রেম নিবেদন করবার পরও আশফিকের সঙ্গে দেশে এসে পড়েছে দিলিশা কী কারণে? নিশ্চয়ই সে আশা রাখে যে, আশফিক তাকে গ্রহণ করে নেবেই একটা সময়। এই যে বিশ্বাসটুকু করবার সাসহ পেলো সে, এই বিশ্বাস জন্ম নেয়নি কি আশফিকের আশকারাতেই? বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে গিয়ে যদি দিলিশা আশাবাদী থেকেই যায় তাহলে সেই প্রত্যাখ্যানের কী মূল্য থাকল? তবে কি আশফিক দিলিশাকে দ্বিতীয় পছন্দে রেখেছে? যদি মাহিকে ফিরে আর না-ই পায় তবে দিলিশা তো রইলই!
আশফিককে নিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট চিন্তাগুলো এখন আর আসেই না মাহির মন আর মগজে। পুরো দুনিয়ার যুক্তি বেঠিক শুধু ওর যুক্তিবাদী মনটা ঠিক বলে, “দিলিশার দুর্বলতা জানবার পরও কেন আশফিক তাকে লেজে লেজে নিয়ে ঘুরবে? এতে কি দিলিশা ওকে ভুলে এগিয়ে যেতে পারবে? সে তো আশাবাদী থাকবেই!” এই প্রসঙ্গে দ্বিতীয় কোনো কথা না বাড়ানোর ফলে ও জানল না, ইতোমধ্যে দিলিশা আশফিককে পাবার আশা ছেড়ে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে আর তার ব্যক্তিত্ব এতটাও ভঙ্গুর নয়।
এই বিরোধী যুক্তিগুলোই মনের মধ্যে তালাবদ্ধ করে মাহি উঠে পড়ল।
-‘বসবে না আরেকটু?’ কণ্ঠে অদৃশ্য অনুরোধ আশফিকের।
মাহির একটু আগের দীপ্ত মুখটাই এখন মেঘমেদুর। আশফিক তা লক্ষ করল আর বুঝতেও পারল কারণটা দিলিশা। হতাশভাবে সোফায় মাথাটা এলিয়ে দিলো। একটুখানি ভালোবাসাতে মাখামাখি হতে না হতেই বারবার মনোভঙ্গ হচ্ছে ওর। মাত্র দেড়টা মাসেই ও ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছে। যার জন্য দিলিশা নামটা ওর কাছেও এখন বিষাক্ত। কবে বিদায় নেবে মেয়েটা?
-‘আমি কাজ ফেলে এসেছি। যেতে হবে এখন। তুমি রেস্ট করো।’
-‘আর কত!’
অপরিবর্তনীয় ভঙ্গিতেই রইল আশফিক। মাহির মুখের পানে চেয়ে আছে মন কেমন করা চাউনিতে। সত্যিই সেই দৃষ্টি দেখে মাহির খুব মায়া হলো। তবে উত্তর মিলল না ওর থেকে।
-‘ভাবির ট্রিটমেন্ট জরুরি। বিষয়টা অবগত করার জন্য ধন্যবাদ।’
আশফিক উঠে ওর কাছে এলো। নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘আর আমাদের ক্যাম্পিং?’
-‘ওহো ওটা? ভুলেই গিয়েছিলাম। হবে না বোধ হয়। ছুটি কমে এসেছে আমার৷ কালই ফিরে যাব ঢাকা। সেখানে একটু কাজ আছে৷ তারপর মূল গন্তব্যে ফিরব আমার।’
-‘তুমি বলেছিলে হতেও পারে এটা আমাদের শেষ দেখা। এখন আমিও বলছি, যদি এভাবেই শেষ দেখাটা রাখতে চাও তবে আমিও আগামী সপ্তাহেই ফিরে যাব আর আজকের রাতটাই হবে তোমার সাথে আমার শেষ দেখা।’
ইসরাত জাহান দ্যুতি
(ইমোজি, স্টিকার আর wow, nice, next কমেন্ট দেখলে আমার নিজের লেখাকে কেন জানি খুব সস্তা লাগে। আমি খুব ভালো লিখি না। কিন্তু বস্তাপঁচা টাইপ কিছু লিখি কি?)