রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩

0
664

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩
_________________________

[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

রুমকি এদের মাঝে ছিল না। কার থেকে খবর পেয়ে ছাদ থেকে দৌঁড়ে এলো, সবার পুনর্মিলনী দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ‘আপু’ বলে এক চিৎকার দিয়ে একরকম ঝাপিয়ে পড়ল সেও মাহিদের ওপর।

এইচএসসির পর রুমকি ঢাকাতে অনার্স করেছে। মাহির বাসাতেই থাকত। সেখান থেকেই ওর সঙ্গেও এই ছয়টি মানুষের খুব ভাব।

-‘আমাকেও এভাবে জাপটে ধর তোরা। আমার মুখটাও তো চার বছর পর দেখছিস।’
আশফিকের হাস্যোজ্জ্বল মুখের কথাটায় কার কতটুকু ভাবান্তর হলো জানা নেই, তবে মাহির মধ্যে একটু বিস্ময় খেলে গেল। ওকে আশফিক প্রত্যাখ্যন করে, বিয়ে ভেঙে চলে যাবার পর এই ছয়জন মানুষের সাথেও সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে স্নেহের বড়ো ভাইটা বাধ্য করেছিল ওকে। তবু একবার সাদিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিল ওরা লন্ডন যাচ্ছে আশফিকের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। তা শুনে মাহি সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিল ও জীবিত থাকতে আশফিক জাওয়াদকে কখনো স্বামী হিসেবে মানবে না। এরপর কী হয়েছিল, আদতে ওরা লন্ডন গিয়েছিল কিনা তা জানার সুযোগ পায়নি ও। তবে আশফিকের কথা থেকে ধারণা করা যায় লন্ডন যায়নি ওরা।

রক্তচক্ষু করে পরাগ হঠাৎ বলে বসল, ‘কেউ এই সেলেব্রিটিকে বলে দে, তার সঙ্গে জাপটাজাপটি করতে এতদূর আসিনি আমরা।’
বাক্য শেষ হতে দেরি কিন্তু ঘাড়ের ওপর মনে হলো ওর সত্তর মণের থাবা পড়তে দেরি হলো না। পরাগের অ্যাঁহ্, উঁহ্, আর্তনাদগুলোও শোনাচ্ছিল প্রচণ্ড হাস্যকর। আশফিক ওর ঘাড়টা ধরে নিজের দিকে ওকে ফিরিয়ে নির্দেশ দিলো, ‘আবার রিপিট কর তো। ঠিকমতো শুনিনি।’
অপি ক্ষেপে গেল, ‘ওই ক্যামেরাম্যান আমার বরের ঘাড় ছাড়িস বললাম! কই থেকে আসলা তুমি হ্যাঁ? তোমাকে কেউ ডাকছি আমরা?’

ক্যামেরাম্যান! ইশ ওর ফটোগ্রাফির ইজ্জত রাখল না পাঁজিগুলো৷ আড় নজরে দু’বার মাহিকে দেখে নিলো এই ফাঁকে। জারিন আর সাদিয়া তো ওর দিকে ফিরেও দেখছে না। হৃদয় আর সৌরভের সাথেই শুধু যোগাযোগটা অটুট ছিল এতদিনে। কিন্তু বাকি চারজনের সাথে জোর করেও কথা বলতে পারেনি ও। পরাগ চাইলেও অপি কথা বলতে দেয়নি ওকে। ওর চার বছর পূর্বের সিদ্ধান্তটা আজও কেউ মানতে পারল না!

পরাগের ঘাড়টা ছেড়ে দিয়ে নাদুসনুদুস অপির গালটা টেনে দিলো আশফিক। জারিন আর সাদিয়ার দিকে তাকাতেই ওরা ঝাড়ি মেরে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ওদের দু’জনের বাচ্চামোতে বাকিরা না হেসে পারল না। মাহির কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই কোথা থেকে যেন রিমনের অবতার হলো। ছেলেটার বয়স সবে ষোলো। তবে জ্ঞান বুদ্ধিতে যে বয়সের তুলনায় পরিপক্ক তা ওর হাবেভাবে বোঝার উপায় নেই।

-‘মা’পু মা’পু, অ মা’পু? তুমি নাকি চিৎ ক্যাল্লায় পড়ছো উঠোনে? মাজার হাড্ডিগুড্ডি জায়গা মতো আছেনি? নাকি হাসপাতালে যাবা? ভ্যান ডাইকে আনব?’

শরীরের অবস্থাটা জানতে আশফিকও এগিয়ে আসছিল তখন মাহির কাছে৷ যে আচমকাভাবে পড়েছিল নিচে, তাতে এতক্ষণে সুস্থভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারার কথা না মেয়েটার। রিমনের কথা শুনে মাহি কোমর আর পিঠের ব্যথার যন্ত্রণা আর চেহারায় আড়াল করতে পারল না। সৌজন্যতার খাতিরে আর কতক্ষণই বা চুপচাপ থাকা যায়?

-‘ভ্যান ম্যান ডাকতে হবে না। ঘরে গিয়ে পেইনকিলার নিলে ব্যথা চলে যাবে হয়তো।’

অপিদেরও হুঁশ হলো, একটু আগে মেয়েটা সাংঘাতিক চোট পেয়েছে। বোকার মতো তা ভুলে গিয়ে কীভাবে এতক্ষণ ওকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারল ওরা? নিজেরাই নিজেদের দুষতে দুষতে মাহিকে বলল আগে ঘরে গিয়ে রেস্ট নিতে। রুমকির ওপর ওদের দায়িত্ব ছেড়ে সুযোগ পেতেই মাহি কোমর ধরে দো’তলার সিঁড়ি বেঁয়ে ওপরে চলে গেল। পিছু পিছু রিমনও গেল৷ এদিকে আশফিক প্রথমবারেই মাহির সাথে একটুখানি কথা বলার সুযোগটা পেয়েও পেল না।

***
আলাদা একটা ঘরে বসিয়ে আশফিককে আর ওর বন্ধুদের নাশতা পানি দিয়ে গেল মাহির বোনগুলো। মাহির মামাতো বোনের সংখ্যা দুই, খালাতো বোনের সংখ্যা তিন। পাঁচ জনের বয়সই প্রায় কাছাকাছি। আর বড়ো নানা, মেজো নানার গোষ্ঠীদের আত্মীয়স্বজন মিলে ভাই-বোনের হিসাব করতে গেলে সে সংখ্যা হয়ে দাঁড়াবে ত্রিশের মতো। অত বড়ো হিসাবের দিকে আপাতত আর নজর দিলাম না।

নাশতা রেখে মেয়েগুলো বিদায় নিতেই জারিন খপ করে আশফিকের চুল মুঠোয় ভরে টেনে ধরল, কিড়মিড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘দিলিশাকে কি বগলদাবা করে ঘুরিস সবখানে? হাগুমুতু করতে গেলেও ওকে লাগে তোর, তাই না? তো যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে যা, এইখানে নিয়ে এসেছিস কোন আক্কেলে?’

খুব শক্ত করেই চুলগুলো ধরেছে। চোখ মুখ ব্যথায় কুঁচকে অনুরোধ করল আশফিক, ‘আপা, চুলগুলো ছাড় আগে! কথা বলতে পারছি না।’ বলতে বলতে ওর হাতের মুঠো থেকে চুলগুলো ছাড়িয়ে নিলো, তারপর জবাব দিলো, ‘খারাপ ভালো সব সময়ই আমার পাশে থাকার চেষ্টা করত ও। দেশে ফেরার সময় ও-ও আসতে চাইল, এবার বাংলাদেশ নিয়ে ওর ব্লগে নাকি একটা পোট্রেইট রাখবে। না করা যায় কীভাবে বল তো? মাগুরা আসার কথা শুনে বলল ঝিনাইদহ যাবে ওর দাদার বাড়িতে। এ কারণেই এক সাথে আসা। তবে না আনলেই বোধ হয় ভালো হতো রে। বেচারি বাঙালি ভোজ করে বিছানাশয্যা এখন।’

সবাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই আশফিক সকালের ঘটনা বিস্তারিত জানাল৷ যা শুনে কয়েক দফা হাসি হয়ে গেল ওদের মাঝে৷ সাদিয়ার চোখে তো প্রায় জল এসে গেছে হাসির চোটে, ‘তোর তো সাহস মন্দ না রে! আবারও ভুঁড়ি ভোজ করতে চলে এলি? রাতের বেলা আবার কী করে সে চিন্তা করেছিস?’

আশফিকও হাসতে হাসতে বলল, ‘শিকদার বাড়ির জামাই হতে গেলে তাদের মতোই ভুঁড়ি ভোজ শিখতে হবে। শুনেছি ছোটো নানুরা নয় ভাই-বোন নাকি একটা আস্ত গরু খাওয়া লোক৷ তাদের নাতনির জামাই হতে হলে আমাকেও সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তার জন্য তো প্র্যাক্টিস দরকার না কি?’

এ কথায় সৌরভ ভর্ৎসনা করে উঠল, ‘তোমার পাছার ওপর লাত্থি মেরে নাতজামাই বানাবে শিকদার সাহেব।’
-‘মাহির নানা কী করবে জানি না৷ আমি হলে তা-ই করতাম।’
হৃদয়ের সমর্থন শুনে পরাগও চুপ থাকল না, ‘মাফ হয়তো পাবি তুই, কিন্তু ওদের মেয়েকে পাবি না। খাতা কলমে লিখে দিতে পারি।’
-‘ব্যাপারটা ক্রিটিক্যাল তা তো আব্বুর মুখোমুখি হয়েই বুঝতে পেরেছি। তবে জারিফ আঙ্কেলের আর আব্বুর যে ভেতরে ভেতরে এখনো আমাকে সুযোগ দেবার ইচ্ছা আছে তাও কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি। নানুভাইকে নিয়েই হলো বড়ো প্রবলেম।’
জারিন জানতে চাইল, ‘একটা ব্যাপার ক্লিয়ার কর তো। তুই মাহিকে বিয়ে করার জন্য ফিরে এসেছিস?’
-‘হুঁ।’
-‘কিন্তু চার বছর পরই কেন? বিয়েটা যদি করবিই আরও আগে আসা উচিত ছিল তোর।’
নিদ্রায় যাবার ভঙ্গিমায় সোফায় গা এলিয়ে দিলো আশফিক। তারপর সুস্পষ্ট উত্তর দিলো, ‘অপরাধবোধটা এই চার বছরে উপলব্ধি করিনি যে।’
-‘তাহলে বিয়ের কারণটা শুধুই অপরাধবোধ থেকে?’
-‘আরও কিছু কারণ আছে৷ সেই ব্যাপারগুলো একটু বিস্তৃত। আমাদের যখন দু’পরিবার থেকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয় আমি তখন সবে বিবিএ কমপ্লিট করা একটা বেকার ছেলে। তাদের ওই সিদ্ধান্ত তখন চরম অযৌক্তিক ছিল আমার কাছে। তবুও মাহিকে দেখে আর কোনো কিছু না ভেবে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। ওর সাথে যেদিন ফার্স্ট টাইম ডেট করলাম, সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম ও কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট কিন্তু সোশাবল, যদি আমার সঙ্গে মিশে যেতে পারে তো৷ যার জন্য ওকে সহজ করতে, আমার বিষয়ে খুটিনাটি জানতে তোদের সঙ্গেও মিলিয়ে দিলাম। আমাদের হাতে যেহেতু কম সময় ছিল বিয়ের, তাই চাইছিলাম একটু দ্রুতই যেন ও আমার সঙ্গে খোলাখুলিভাবে মিশে যেতে পারে। শুধু ভালো লাগার উর্ধ্বে গিয়ে আমি সিরিয়াসলি ওকে এক সময় ভালোবাসার ট্রাই করেছি ওই অল্প সময়েই। কিন্তু…’

কথাগুলো মুখে থাকতেই ঘরে রুমকির আগমন ঘটল।তাই আর শেষ করার সুযোগ পেল না আশফিক। সবাই মাহির অবস্থা জানতে চাইলে রুমকি বলল, ‘বিছানাতে শোবার পর আর উঠতে পারছে না। জারিন আপু শোনো, আপু তোমাদের নিয়ে যেতে বলল আমাকে। আর ভাইয়াদের সঙ্গে রাতের খাবারের সময় এসে দেখা করতে চাইল। ভাইয়ারা রেস্ট করো ততক্ষণ।’

সাদিয়া ওরা তিনজন ঝটপট রুমকিকে নিয়ে মাহির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ল। আশফিকও একবার যেতে চাইছিল, কিন্তু ও এসেছে অবধি রুমকি পিচ্চিটাও ওকে এড়িয়ে চলছে। এরূপ আচরণে তাই আর বলবার সাহস পেল না। অথচ বছর চার আগে গল্পটা অন্যরকমই ছিল। রুমকি ছিল আশফিক ভাই ভক্ত। এই পরিবারের সকলের কাছে কতটা সম্মানের আর কতটা আদরেরই না ছিল সে তখন! নিজের কাছে নিজেকেই এখন কেমন যেন আত্মসম্মানহীন লাগছে।

***
বিয়ে বাড়িতে এত এত আত্মীয়স্বজনের ভীড়ের মধ্যে আলাদা করে কাউকে অতিরিক্ত আদর যত্ন করা বেজায় কষ্টকর। কিন্তু কিছু সংকীর্ণ মানসিকতার ব্যক্তি থাকে যারা সেসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তুমুল ঝামেলা বাঁধিয়ে বসে। আর মফস্বলের মানুষের মধ্যে এ ব্যাপারগুলো তো অহরহ ঘটে থাকে। রুমকির নানা বাড়ির ক’জন আত্মীয় ইতোমধ্যে এমন পরিস্থিতি ঘটিয়ে ফেলেছে৷ যার জন্য আজ অসুস্থ শরীর নিয়ে সালাম শিকদারকেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে হলো৷ উঠানের ওপর দাঁড়িয়ে এক ধমক দিয়ে বসলেন তাদের, ‘এই এত চিল্লেপাল্লা কীসির? আমার বাড়িতি দাঁড়ায়ে কোনো মহিলা মানুষির উঁচো গলা যেন না শুনি আমি।’

ব্যাস এটুকুতেই সবাই সুড়সুড় করে যার যার কাজে চলে গেল। তারপর ছেলে বউ দু’জনকে আদেশ করলেন রাতের খাবারের আয়োজন করতে দ্রুত৷ আজ সবার সাথে তিনি বহুদিন পর খাবার ঘরে বসে খাবেন বলে জানালেন। ছেলে, ছেলেবউ, মেয়েরা তাতে খুব খুশি হলো। কতদিন পর বাড়ির আসল মানুষটা আজ সবার পাশে বসে খাবেন! কিন্তু হঠাৎ করে তাদের আব্বাজানের মনটা পরিবর্তন হলো কী করে?

তড়িঘড়ি করে মেয়ে লোকগুলো হাত লাগাল রান্না জলদি জলদি শেষ করবার কাজে। এর মাঝে হাবিব সাহেবের কাছে মাহির বাবার কল এলো, তিনি বললেন আশফিকের আদরযত্নের দিকে একটু খেয়াল রাখতে। সে নাকি লন্ডন থেকে ফিরে বাড়িতে একটা রাতও কাটায়নি। বাবা আর মায়ের সাথে দেখা করেই দিলিশাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল চট্টগ্রাম৷ পুরো চট্টগ্রামের আকর্ষণীয় ছোটো-বড়ো সকল দর্শনগুলো ক্যামেরাতে কভারেজ করে বেড়িয়েছে দু’জন এক সাথে। তারপরই ওখান থেকে সোজা মাগুরা চলে এসেছে। আশফিকের মা ছেলের জন্য ছটফট করছেন। অথচ তার হৃদয়হীন ছেলে মায়ের কাছে না ফিরে বান্ধবী নিয়ে সফর করছে! বিয়ের তিনদিন আগেই আশফিকের বাবা-মা’কে নিয়ে চলে আসবেন জারিফ সাহেব।

মাহির বাবার কথামতো হাবিব তার স্ত্রীকে আদেশ জানালেন৷ মঞ্জুয়ারা বুঝতে পারলেন, চার বছর পূর্বের না হওয়া সম্পর্কটাই পুনরায় তৈরি করতেই আশফিক ছুটে এসেছে। মনটার ভেতরে কেমন যেন একইসাথে রাগ আর খুশির মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে তার।

ঝটপট খাবারের ঘর পরিপাটি করে বিশাল আয়তকার খাবার টেবিলটায় অসংখ্য পদের খাবার-দাবার সাজিয়ে ফেলল সবাই। তারপর বাড়ির ছোটো সদস্যদেরকে পাঠানো হলো প্রথম বৈঠকে বিশেষ মেহমানদের খেতে ডাকতে। আর সেই বিশেষ মেহমান বলতে আশফিক আর তার বন্ধুগুলো। এবং বাড়ির মুরুব্বি মানুষগুলো।

দো’তলা থেকে সৌরভ সাদিয়ারা নামতে নামতে আশফিককে নিয়ে আরেক দফা হাসাহাসি করল, ভয় দেখাল ওকে, ‘সকালের ঘটনা নিশ্চিত আবারও পুনরাবৃত্তি করবে রে না হওয়া জামাই। আল্লাহ হেফাজত করুন তোকে।’
ওদের হাসি ঠাট্টায় আশফিক সামিল হলেও ভেতরে ভেতরে আশঙ্কায় ঠিকই ঘামতে থাকল। আল্লাহকে স্মরণ করতে করতে খাবার ঘরে এসে পৌঁছতেই সকালের থেকে খাবারের আধিক্য দ্বিগুণ দেখে অকস্মাৎ নিজ পেটে হাত চলে গেল ওর। চারটা বছর ধরে পৃথিবীর কত দুর্গম জায়গা নির্ভীকভাবে পায়ে মাড়িয়ে এলো, অথচ কোনো একদিন সুস্বাদু খাবার দেখেও যে তাকে ডরালু হতে হবে তা কে জানত! তবে ভয়-ভীতি ভুলে গিয়ে আশফিকের হৃদ মাঝে খুশির ডঙ্কা বেজে উঠল হঠাৎ, টেবিলের অপরপ্রান্তে মাহিকে খেতে বসতে দেখে। মনে মনে এখন তার উদ্দেশ্য হলো মাহির ঠিক পাশের চেয়ারটায় গিয়ে জায়গা দখল করবে৷ সেদিকে এগিয়ে যেতে না যেতেই পাশের সব চেয়ারগুলো ময়মুরুব্বি মানুষ একে একে দখল করে নিলেন। তার মাঝেই ঘরে প্রবেশ করলেন নানাজান। তিনি আশফিকের দিকে একবার অচঞ্চল দৃষ্টি মেলে দেখে সময় বিলম্ব না করে খেতে বসে গেলেন। বন্ধু ছ’জনও ওকে রেখেই হার হাভাতের মতো বসে পড়ল খেতে। মসবিত তৈরি হলো শুধু ওর বেলায়। একে তো সামনের খাবার দেখে স্নায়বিক দুর্বলাবস্থা প্রায়, অধিকন্তু এত মুরুব্বিদের মাঝে তার বসার জায়গা হারিয়ে গিয়ে বিমূঢ় হয়ে রইল৷ কী একটা অবস্থা! ওর মতো সকল পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়া অতি বুদ্ধিমান ছেলেটির এমন নাকাল হওয়া কি ওর ব্যক্তিত্বের সাথে যায়?

মূর্তিমানের মতো টেবিলের সামনে হতবুদ্ধি চেহারা নিয়ে আশফিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মাহি কৌতুহলী চোখে চেয়ে রইল। তখনই দু’জনের দৃষ্টিমিলন ঘটল। আজ আর চার বছর পূর্বের মতো লাজুক চোখে মাহিকে দৃষ্টি নত করতে দেখল না আশফিক। বরং ওর চেয়ে থাকা দেখে তার নিজেরই কেমন একটা অপ্রস্তুত অনুভূতি হলো যেন চোখে চোখ রাখতে। শশার গোলগোল ফালিতে ছোটো-ছোটো কামড় দিতে দিতে কেমন ড্যাবড্যাবিয়ে চেয়ে আছে মেয়েটা! যেন কোনো উদ্ভট প্রাণী দেখছে সে। বনেবাদাড়ে ঘুরঘুর করে বলে কি তাকে সত্যিই উদ্ভট কিছু লাগছে না কি? ঘরে গিয়ে নিজেকে ভালোভাবে একবার আয়নায় দেখতে হবে তো।

অর্থহীন ভাবনা ভাবতে ভাবতে নানাজানের পাশে খালি চেয়ারটা দেখে আনন্দে আটখানা হয়ে গেল আশফিক। খেয়াল হলো সে বসতেই নানাজান খাবার বেড়ে নিলেন পাতে। তবে কি তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন নানাজান? কে জানে!

এ বেলায় আর আশফিককে ভোগ যুদ্ধ করতে হলো না। মামিদের হাস্যমুখর চেহারায় আপ্যায়ন কার্য দেখে মনে হলো যেন সেই চার বছর আগের ভালোবাসা পাচ্ছে। বিষয়টা তবে কি হাঁধর্মী নেবে সে? কালো চোখের তারায় আনন্দ, উত্তেজনা নিয়ে অপরপ্রান্তের ওই ধূসর চোখের দুষ্প্রবেশ্য শর্বরীর দিকে চেয়ে হঠাৎ পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই ডেকে উঠল, ‘মাহি?’

নীরব ঘরটিতে আশফিকের ছটফটে কণ্ঠস্বর সকলের কানে বাড়ি খেতে লাগল যেন। উপস্থিত ব্যক্তি সকলের সরু দৃষ্টি যখন ওর মুখপানে, অতি সত্বর তখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক নজরে রাখতে মাহিকে বলে বসল, ‘সালাতের বাটিটা এগিয়ে দাও প্লিজ।’

সে মুহূর্তে আবার মাহির সেই পূর্বেকার মতো অনুজ্জ্বল, ভাসাভাসা দৃষ্টিতে পড়ে আশফিকের কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে করল। এই মেয়ের ড্যাবডেবে চাহনি তো ওর হজম হচ্ছে না! এত এতবার কঠিন বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে আটাশ বছরের জীবনে কখনো পড়তে হয়নি ওকে। মেয়ে পটানো, মেয়ের পরিবার পটানো আরেকটু সহজ হতে পারত না?

***
নিশি রাত, বাঁকা চাঁদ আকাশে
চুপিচুপি বাঁশি বাজে বাতাসে, বাতাসে
নিশি রাত, বাঁকা চাঁদ আকাশে

-‘বাবা! আজকে আকাশে বাঁকা চাঁদ নাকি?’
-‘তাই তো দেখতেছি। বাইরে বের হন নাই আজকে?’
বিছানাতে শুয়েই আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে দেয়াল ঘড়িতে একবার সময়ের দিকে তাকাল দিব্য। দেড়টা বাজতে চলেছে। মাহির প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ফিরতি প্রশ্ন করল, ‘এতক্ষণ কী করলা? আরও দুই ঘণ্টা আগে কল করছিলাম।’
-‘ডিনার শেষে মেহমানদের সাথে গল্পগুজব করতেছিলাম। বড়ো নানুর বাসায় আর যাইনি৷ বিয়ে বাড়িতেই আছি।’
-‘বিয়ে বাড়ির খানাপিনা, খায়ে-দায়ে ফুলতেছ নাকি?’
-‘নাহ্, মেইনটেইন করতে হচ্ছে।’
-‘হুঁ, খেয়াল রাইখো হেলথের দিক। যে পেশায় ঢুকতেছ তাতে মোটাসোটা হয়ে গেলে ট্রেনিং থেকেই ছাটাই মারবে।’

রুমকির ঘুমটা বোধ হয় ভেঙে গেল মাহির গান আর বকবকানিতে। রাতের বেলা ঘরে পিনপতন নীরবতায় টু শব্দও বিস্ফোরণের মতো শোনায়। বিছানা ছেড়ে বারান্দাতে চলে এল সে। ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করল অমনিই। শীতের রাতে ঘরের বাইরে পা রাখা যায়? দ্রুত ঘরে ফিরে কম্বলটা গায়ে মুড়িয়ে বেরিয়ে এলো আবার।

ওদিকে ফোনের মধ্যে খচমচ শব্দ শুনে দিব্য বলে উঠল, ‘চুরি করে খাচ্ছ নাকি কিছু? শব্দ হচ্ছে কত!’
-‘কম্বল গায়ে নিলাম। বলেন এখন।’
-‘কী বলব? ভালো লাগতেছে না।’
-‘হলিডে ছিল আজ। তো ফ্রেন্ডদের সাথে হ্যাঙআউটে যাইতেন।’
কথাটায় ঠোঁট উলটে ফেলল দিব্য, ‘দুই বছর আগেও প্রচুর চিল করছি, ধলা সুন্দরীদের সাথে ডেট করছি, ফ্লার্ট করছি। হ্যাঙআউট চলত প্রতি হলিডেতেই। এখন আর ভালো লাগে না।’
বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়াল মাহি, চারপাশে বসার মতো ছোটো টুল বা চেয়ার খুঁজতে খুঁজতে জিজ্ঞেস করল, ‘এত বিষণ্ন ক্যান গলা? কী হইছে? বাড়ি থেকে আবারও বিয়ের প্রেশার দিচ্ছে না কি?’
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কিছু পল মৌন থাকল দিব্য, মৌনতা শেষে বলল, ‘মনটা বাড়ি বাড়ি করে ইদানিং। এই ঝকমকে দেশ আর মুগ্ধ করে না। কবে যে যাব আম্মার কাছে!’
-‘তিন বছর তো হলো। কত বছর পর যাবার প্ল্যান?’
-‘অন্তত আরও দুই বছর৷’
-‘একা একা আছেন তো, তাই ভালো লাগতেছে না কিছু। তা আপনি বিয়ে করতে চাচ্ছেন না ক্যান?’
-‘না রে মনি, দীপ্তরে সেটল না করে বিয়েশাদি করব না। পরে বউ আইসে আমার মা ভাইরে নিয়ে যদি অশান্তি করে? অবশ্য খচ্চর মনের বউ হইলে মাইর-ধইর দিয়ে বাপের বাড়ি পাঠাই দিবো।’
-‘আশ্চর্য! সব মেয়েরা কি এরকম হয়? ভালো কাউরে দেখেশুনে আনলেই তো পারেন।’
-‘তোমাদের বলে বিশ্বাস নাই। প্রথমে কিরণমালা রূপ দেখায়ে পরে কটকটি রানি হয়ে কটকট করে বেড়াবা।’
মৃদু ধমক দিয়ে উঠল মাহি , ‘এই আপনি আমারে বললেন ক্যান? আমারে আপনি কতদিন চেনেন, হ্যাঁ?’
-‘কী আজব! তোমারে কই বললাম? আমি তো তোমাদে…র বললাম৷ নিজের গায়ে টাইনে নেও খালি। আমার বউ হওয়ার এত শখ ক্যা, হুঁ?’
-‘থামেন রে ভাই, আমার রুচিতে প্রবলেম নাই বুঝছেন? মনে হয় যেন আপনি ছাড়া আমার আর কোনো অপশন নাই!’
-‘হাজারটা অপশন থাক৷ সেগুলোর সিরিয়াল যে আমার নিচে তা তো অস্বীকার করতে পারবা না।’
-‘হুহ্! ওদের সিরিয়ালের ভেতর আপনি তো নাই-ই। তো ফার্স্ট অপশন কীভাবে হবেন?’
-‘তো তোমার ফার্স্ট অপশন কীরা শুনি?’
হঠাৎ তমসাচ্ছন্ন আকাশে উজ্জ্বল বাঁকা চাঁদটার দিকে চেয়ে মাহি মিটিমিটি হেসে বলল, ‘বলা যাবে না।’

শীতের প্রখরতা দালান ঘরে নেই ঠিকই, কিন্তু মাগুরার মতো না গ্রাম না শহরের মতো জায়গাতে শীত ঢের বোঝা যায় ঘরের বাইরে পা রাখলেই। তাই শত প্রকৃতির ডাক পড়রেও লেপ, কম্বলের নিচ থেকে উঠতে মন চায় না।

দো’তলার ঘরগুলোতে আশফিকদের স্থান মিলেছে। দু’ঘর মিলিয়ে ওদের সাত বন্ধুকে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আশফিককে বলা হয়েছিল বড়ো শিকদারের বাড়িতে আরাম করে থাকতে৷ সে যেতও, কিন্তু মাহি যে গেল না! আর ওর জন্য বাকি বন্ধুগুলোও থেকে গেল।

ঘরের দোর হালকাভাবে ভিড়িয়ে দেওয়া বলে বারান্দা থেকে কারও অস্পষ্ট আলাপ কানে ভেসে আসছে মাঝেমধ্যে। টয়লেট চেপে রেখেছিল আশফিক অনেকক্ষণ। আর থাকতে না পেরে বাথরুমে গিয়ে পেট ফাঁকা করেই বারান্দাতে শীতবিলাস করা ব্যক্তিটিকে দেখার কৌতূহল দমাতে ছুটল। মাত্র কয়েক হাত দূরে কম্বলে মুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাহিকে দেখে অত্যাধিক আশ্চর্য হলো সে। রাত সাড়ে এগারোটার বেশিই বাজে। এই শীতে বাইরে এসে অমন প্যাকেট হয়ে দাঁড়িয়ে একা একা কথা বলছে? আকাশের দিকে চেয়ে আছে কেমন করে! মেয়েটা কি প্রচণ্ড হতাশা বা বিষণ্নতায় ভুগছে? সেটা কতদিন ধরে? ওকে ছেড়ে চলে যাবার পর থেকেই কি? এভাবেই বুঝি একেকটা রাত শূন্যশব্দে একাকী পার করে! আপনাআপনিই হৃদপিণ্ডের স্থানটিতে হাত চলে এলো ওর, বারবার ডলতে থাকল সেখানে। অদৃশ্য যন্ত্রণা হচ্ছে যে! চারটা বছর ধরেই এমন কতগুলো রাত একাকী কাটিয়েছে মাহি? চলে যাবার পর অন্তত একটাবারও খোঁজ নেয়নি সে। কীসের অত রাগ ছিল যে তখন আল্লাহ পাক জানেন। কোমল, স্নিগ্ধ মেয়েটাকে ওর অবজ্ঞা, প্রত্যাখ্যানে বিষণ্ন পুতুল করে দিয়েছে ও। ওর দিকে তাকালে এখন আর কোনো অনুভূতি খুঁজে পায় না সে চোখে।

পাদু’টো চালিয়ে মাহির কাছাকাছি যেতেই মাহিও ঘরের দিকে হাঁটতে থাকল তখন। ওর উপস্থিতি টের পায়নি৷ আশফিক দ্রুত ডেকে উঠল, ‘একটু দাঁড়াবে মাহি?’

ইসরাত জাহান দ্যুতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here