রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩৫ সমাপ্তি পর্ব

0
845

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৩৫
সমাপ্তি পর্ব
__________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও কঠোর মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত। এবং কপি নিষেধ। ফেসবুক মেইন অ্যাপ আর ব্রাউজার ব্যবহার করবেন। যদি ফেসবুক লাইট থেকে পড়তে অসুবিধা হয়।]

তিনটি ঘাঁটি ছিল পুরো গ্রামে। এনএসআই সংগঠন আর সেনাবাহিনী দু’ভাগে জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে লড়ে ঘাঁটি তিনটাই ধ্বংস করেছে৷ পঞ্চাশজন সেনা নিহত এতে। তবে জয় লাভ হয়নি। জঙ্গি লিডারসহ ওদের আরও কিছু সদস্য খুব সতকর্তার সঙ্গে পালিয়ে গেছে। বিমানবাহিনীর দুই অফিসার, দুই অস্ত্র ব্যবসায়ী আর নিখোঁজ বিমান উদ্ধার করা গেলেও তিনশত যাত্রীদের উদ্ধার করা যায়নি৷ কোথায়, কীভাবে তাদের রাখা হয়েছে তা কেউ ধারণাও করতে পারছে না৷ এর মাঝে দু’জন ফাইটার পাইলট মাহি ইসলাম এবং আসিফ খন্দকার যুদ্ধ বিমানসহ নিহত। তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমান পাহাড়ের খাদে পড়ে গেছে। সেনাবাহিনী তাদের সমাধির জন্য উদ্ধার কার্যে নামলে কেবল একজন পাইলটের চিহ্ন পাওয়া যায়। তার শরীর পুড়ে ছারখার, চেনার মতো উপায় নেই সেই পাইলটকে। শরীরের অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। তার দেহাবশেষ কুড়িয়ে পাওয়া গেলেও বাকি একজন নিশ্চিহ্ন। তার ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমানটাই শুধু পাওয়া গেছে।

সারা বাংলাদেশসহ, ভারত, পাকিস্তান এ খবর ইতোমধ্যে প্রচার করা হচ্ছে প্রত্যেকে নিউজ চ্যানেলে। আন্তর্জাতিক খবর হিসেবেও দ্রুতই প্রচার হয়ে যাবে। মাহির আপনজনেরা প্রত্যেকেই বুক ফাটা আর্তনাদে লিপ্ত। আশফিকের প্রেসক্রিপশনে ঘুমের ওষুধ ছিল বলে সে ওষুধ খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে৷ তাকে ডেকে এ খবর জানানোর সাহস ওর বাবা-মা, বন্ধু কারওরই হলো না।

জিহাদ সাহেব আগাগোড়াই ভীষণ কঠিন হৃদয়ের মানুষ। বিয়ে করেছিলেন চল্লিশ বছর বয়সে এক আমেরিকান প্রবাসী নারীকে। কিন্তু তার বউয়ের ভাগ্যে সংসার সুখ জোটেনি। তিনি আজীবন একা একাই বিদেশের মাটিতে কাটিয়ে দিয়েছেন। কারণ, জিহাদ সাহেব নিজের দায়িত্ব আর কাজকেই প্রশ্রয় দিয়ে গেছেন সারা জীবন৷ সেখানে আবেগের কোনো ঠাঁই নেই৷ এমনকি নিজের দু’টো ছেলে সন্তানের জন্যও না৷ আজ আদরের ভাতিজির মৃত্যু সংবাদ শুনেও চোয়াল কাঠিন্য রেখে, বুকেও যেন পাথর চেপে ‘কংথং অপারেশন সেকেন্ড টাইম’ নিয়ে সকল অফিসারের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেছেন৷ তবে সেনাবাহিনীর প্রধানকে তিনি জিদ্দি গলায় বলেছেন, ‘ইনটেলিজেন্স এজেন্ট নয়। আমি আমার ভাতিজি মাহি ইসলামের শরীরের এক টুকরো অংশ হলেও চোখের সামনে দেখতে চাই৷ নয়তো আপনার জন্য আমার পদক্ষেপ অন্য কিছুই হবে।’

মাহির দেহাবশেষ খোঁজার দায়িত্বসহ, গুম করে রাখা তিনশো যাত্রী খোঁজার কাজে এবার আরও সেনাবাহিনী আর এনআসআই অফিসার যুদ্ধে নেমেছে।
.
.
একটু আহত হয়েছে মাহির শরীরের কিছু কিছু জায়গা। যখন ওর বিমানের দিকে বোমাবর্ষণ করা হয় তখনই ও বিমান বেশ সতর্কতার সঙ্গে উড়িয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। তবুও বিমানের পেছনভাগে কীভাবে যেন আগুন ধরে যায়। কোনোভাবেই বিমানকে নিজের নিয়ন্ত্রণে না আনতে পেরে বহুকষ্টে নিচের দিকে নেমে ও বিমান থেকে বেরিয়ে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে বিমানটা ঝর্নাতে পড়ে তার পতন ঘটে। মাহি পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে খুব সাবধানে পা ফেলে যখন চূড়ায় ওঠে তখনই ও সামনে পড়ে যায় কয়েকজন জঙ্গির। তারা ওকে দেখেই টেনে তুলে নিজেদের সব থেকে নিরাপদ আশ্রয় অর্থাৎ গোপন ঘাঁটিতে নিয়ে আসে৷ যে জায়গাটা অনেকটা গুহার মতো। সেখানেই সন্ধান মেলে সেই তিনশো যাত্রীর। আহাজারি চলছে তাদের মাঝে।

কালো পোশাকধারী,এগারোজন জঙ্গি সদস্য ওর সামনে এই মুহূর্তে। মুখও কালো কাপড়ে বাঁধা তাদের। ওর হাত পিছমোড়া করে বেঁধে, হাঁটু গেড়ে বন্দুকের সামনে বসিয়ে রাখা হয়েছে ওকে৷ লিডার যে সে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এক বাঙালি যুবক। নাম ইমরান। কতক্ষণ ওকে পর্যবেক্ষণ করে সে মুখ খুলল, ‘তোকে খু’ন করার কোনো ইচ্ছা নাই। আমাদের তোর মতোই ইন্টেলিজেন্ট, স্মার্ট, অ্যাক্টিভ লোক প্রয়োজন। তোর কাজ হবে এই তিনশো যাত্রীর উদ্ধারের বাহানা দিয়ে আরও কয়েকজন চতুর অফিসারকে বিনা আর্মসে এখানে আনা। তোদেরকে নিয়ে আমরা এখান থেকে বিদায় নেবো আর ওদের মুক্তি দেবো।’

মাহির মাথা জোরপূর্বক নুইয়ে রাখা হয়েছে। কথা বলতে চাইলে ওকে নত হয়েই বলতে হবে। তাই ও বিদ্রুপস্বরে বলে উঠল, ‘ইসলাম কি এক আল্লাহ ছাড়া মানুষের সামনে মাথা নুয়াতে শেখায়? না কি ইসলাম জোরপূর্বক বা যুদ্ধ করে সব কিছু আদায় করতে শেখায়?’

কথা শেষ হওয়া মাত্রই ওর ঘাড়ের ওপর বন্দুকের পেছন দিয়ে খুব জোরে আঘাত করা হলো। মুখ থুবড়ে পড়ল তখন ও মাটিতে। ইমরান এসে ওর চুলের খোঁপাটা ধরে মুখটা তুলল, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমি দু’বার রিপিট করব না আমার কথা। তুই যদি ভেবে থাকিস তুই একা ওদের উদ্ধার করে নিয়ে এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি তাহলে বুঝব মস্ত বড়ো নির্বোধ তুই।’

মাহি একবার চোখের কোণ দিয়ে অসহায় যাত্রীগুলোকে দেখে নিলো৷ ওর যা-ই হয়ে যাক, এই নিরীহ মানুষগুলোকে যেমন করেই হোক ওকে বাঁচাতে হবে। ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল, ‘এরা এমনিতেই ভয় মরমর অবস্থা৷ তোরা শুধু শুধু ওদের সামনে বন্দুক নিয়ে পায়চারি করে নিজেদের এনার্জি লস করছিস। আর আমি নির্বোধ না। খুব ভালো করেই জানি, আমার পক্ষে তোদের সাথে একা লড়ে টিকে থাকা সম্ভব না। কিন্তু তোরা প্রচণ্ড ভীতু। এই যে গুহাতে লুকিয়ে থেকে যুদ্ধ করছিস, এটা কি বীরপুরুষদের কাজ? যোদ্ধারা কোনোদিন ভয়ে লুকিয়ে থাকে? হাঃ হাঃ! এই অন্ধকার গুহা ছেড়ে আমাকে নিয়ে প্রত্যেকে দিনের আলোয় বের হ। লুকিয়ে লুকিয়ে আর কী ডিল করবি আমার সঙ্গে?’

ইমরান ওর বাকি দশজন লোক নিয়ে অনায়াসেই এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাকআপ রেখেছে। আর বর্তমান যে জায়গাতে ওরা আছে তা কংথং গ্রাম থেকে দূরে কোথাও। ঝর্নার কাছাকাছিতেই। তবে গুহাটা খুঁজে পেতে খুব পরিশ্রম গেছে ওদের। এটা পাহাড়ের বেশ নিচে। এখান থেকে কেউ চাইলেও বেরিয়ে পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। যাত্রীদের যোগাযোগ করার মতোও কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। তবু দু’জনকে পাহারাতে রেখে মাহিকে উঠিয়ে ওরা চলল সামনের পাহাড়ের চূড়াতে। কিন্তু পথিমধ্যে কী যেন ভেবে ইমরান দাঁড়িয়ে গেল। এমনিতেই ওরা সদস্য সংখ্যা কম। যেভাবে হেলিকপ্টার আকাশ জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাতে যদি ধরা পড়ে যায়? আবার ভাবল সঙ্গে মাহি আছে৷ ওদের ক্ষতি করতে চাইলেও মাহিকে নিশ্চয়ই বাঁচাতে চাইবে! এই গুহার অনুসন্ধানও খুব সহজে করতে পারবে না। প্রবল এই আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাকি দু’জনকে গুহার মুখে বড়ো বড়ো কিছু পাথর চাপা দিয়ে ওদের সঙ্গেই আসতে বলল। ওদের প্রস্তাবে যদি মাহি রাজি হয় তো ভালো। নয়তো আজ মাহিকে সব থেকে ভয়ানক মৃত্যৃ দেবে আর তার ভিডিয়োটাও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে পৌঁছে দেবে। বাকি তিনশো মানুষগুলোকেও আর জীবিত রাখবে না।

চলে এলো গিরিপ্রপাতের খুব কাছাকাছি পাহাড়ের চূড়ায়। পর্যটন রাজ্য হলেও সবাই জানে এখন এই রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে আছে জঙ্গি। তাই কোনো পর্যটকদের আনাগোনা নেই। মাহিকে আবারও বন্দুকের সামনে আগের মতোই বসিয়ে বলল, ‘তোর হাতে ওই তিনশো মানের জান। তুই যদি…’

-‘ওদের জান আমার হাতে থাকলে তোদের জানও আমার হাতেই থাকত। কথা তো ভেবেচিন্তে বল!’

প্রচণ্ড রাগে ইমরান এসে সজোরে লাথি দিয়ে বসল মাহির মুখে৷ অধৈর্য আর অত্যধিক রাগের জন্যই ইমরান বোকা বনে গেছে। মাহির আবার চুলের খোঁপাটা শক্ত করে হাতের মুঠোয় ধরে টেনে বসাল ওকে।

-‘এই জা-নোয়ার! আমি আর একবার জিজ্ঞেস করব। তুই আমাদের কথা মানবি কি মানবি না?’

-‘ছেড়ে দে ওই তিনশো মানুষকে। ওদের সিলেট বিমানবন্দরে পৌঁছে দে। তারপর তোদের সাথে বাকি কথা।’

ইমরানের পাশ থেকে হাকিম নামের চব্বিশ বছরের যুবকটা ক্রোধ নিয়ে বলে উঠল, ‘ও আমাদের কথা শুনবে না। ওর চোখ বলে দিচ্ছে, আমাদের সাথে ধূর্ততা করছে। ওর জানের মায়া নেই। তাই জান ওর জন্য নয়। আমরা অতিরিক্ত সময় নষ্ট করছি ওর পেছনে।’

এ কথায় বাকিরাও সম্মতি জানিয়ে দিলো। ইমরান এদের দলপতি হলো কী করে? মাহি ভেবে পাচ্ছে না। এই সামান্য বোধটুকু বাকিরা কী অনায়াসেই বুঝে গেল!

ইমরানও এবার সম্মতি জানাল, ‘ঠিক আছে। ফোনটা বের কর। ওকে আ-গুনে জ্বা-লিয়ে মা-রব। ভিডিয়োটা সেনাবাহিনী হেডের কাছে পাঠানো হবে।’

ওর হাতের ইশারায় মেয়ে জঙ্গি দু’জন এগিয়ে এলো। যাদের বয়স বাইশের মতো। মাহি আশ্চর্য হয় সামনের প্রতিটা বাঙালিদের দেখে, আর আফসোসও। এদের পূর্বপুরুষেরাই হয়তো আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করেছিল। হাহ! চোখদু’টো বুঁজে ফেলল নীরবে। সর্বপ্রথম ভেসে উঠল হৃদয়বিদারক সেই মুহূর্তটুকু৷ মা’কে খাটিয়াতে তুলে নিয়ে যাচ্ছে দুই মামা, বাবা আর ভাই। তারপরই আশফিকের সঙ্গে শেষ দেখাটা। দূর থেকে আকুল চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে আশফিক। ওর মুখের অভিব্যক্তি স্পষ্ট না দেখতে পেয়েও মাহি বুঝেছিল, চোখে পানি নেই ওর। তবু চোখদু’টো রক্তিম, মুখটা মলিন আর চোয়ালজোড়া কঠিন। বহু কষ্টে নিজের আবেগকে ধরে রেখেছে।

ঘাড়টা ঘুরিয়ে পাশে তাকাল মাহি। মেঘালয়ে অসংখ্য জলপ্রপাত, গিরিপ্রপাত৷ এত নাম মনেও রাখা যায় না। মাহি জানে না ও কোন গিরিপ্রপাতের কাছে আছে। চারপাশটা দেখে মনেমনে ধারণা করে নিলো অনেক কিছুই। হঠাৎ AK-47 রা-ইফেলের বাট দিয়ে ওর কপালের ডান পাশে আঘাত করে বসল। পেছন থেকে দু’জন ওর ঘাড়টা তখনও ধরে আছে, তবে হাতটা ছেড়ে দেওয়া। একে একে চোয়ালে, কপালে, বাহুতে, পিঠে, গলায়, এমনকি বুকে, পেটেও বাদ পড়ল না। কখনও রাইফেলের বাট, স্টক, স্লিং স্টাড অংশগুলো দিয়ে লাগাতার কিছুক্ষণ মে-রে গেল। মাটির সঙ্গে মিশে গেছে মাহি। কপাল ফেটে গেছে, ভ্রু কেটে গেছে, চোয়াল থেঁতলে গেছে, নাক দিয়ে অনর্গল রক্ত ঝরে যাচ্ছে। চোখ দু’টোই সাংঘাতিক ফুলে গেছে। তাকাতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বুকের আঘাতে দম ফেলতে পারছে না। শেষে ইমরান ওকে দাঁড় করাতে বলল৷ দু’বাহু টেনে ধরে ওকে দাঁড় করালে ও মাথাটা নুইয়ে নেতিয়ে রইল৷ ইমরান দূরে দাঁড়িয়ে এবার অট্টহাসি দিয়ে বলল, ‘নিজের দিকে তাকা। দ্যাখ, এখন তুই নিজেই ঝুঁকে আছিস আমার সামনে।’

মাহি মাথা উঁচিয়ে তাকাতেই ওর পায়ে আঘাত করে বসল। হাঁটুর নিচে বেশ ক’বার মে-রে উঠলে চিৎকার করলেও তার আওয়াজ খুব বেশি হলো না। সেই শক্তিটুকু নিঃশেষ ওর মধ্যে থেকে। ওকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে ইমরান আদেশ করল দল সদস্যের একজনকে, ভিডিয়োটা পাঠিয়ে দিতে আর চূড়া থেকে নেমে ডি-জেল নিয়ে আসতে। ডি-জেল নিয়ে আসার আগে মাহিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোর শেষ কোনো ইচ্ছা আছে না কি? বলে ফ্যাল।’

মাহি গিরিপ্রপাতের প্রায় কাছাকাছিই। ও বেশ খানিকক্ষণ ধরেই চেষ্টা করছে উঠে দাঁড়ানোর। পায়ে বলই নেই৷ কিন্তু তবুও দাঁড়াতেই হবে, এই জিদে সত্যিই কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়াল অবশেষে। তারপর শ্বাস আটকে আসা কণ্ঠেই বলল, ‘তোদের মৃ-ত্যু।’

কথাটা শুনতেই প্রত্যেকে হেসে ফেলল। মাহিও হাসল, ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকাল আকাশপানে। দৈত্যের মতো ঝড়গতিতে তেড়ে আসছে mig-29 জঙ্গি বিমান/বো-মারু বিমান। উল্লাসে, উত্তেজনায় মাহির সর্ব শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। তখনই ইমরানদের চিৎকার করে বলে উঠল, ‘আমি সত্যিই জানোয়ারের মতোই নি-র্দয়। তাই তোদের কোনো শেষ ইচ্ছে তো পূরণ করবই না। বরং তোদেরকে নিয়েই আমি মরব।’

ও চিৎকার করে বলার মুহূর্তেই বিমান এগিয়ে আসার সময় বায়ুর সাথে ঘর্ষণ হয়ে উৎপন্ন শব্দে আর জেট ইঞ্জিনের শব্দে ওরা এগারোজন ঘাবড়ে গিয়ে মাহির দিকে রা-ইফেল তাক করতেই ওই স্থান লক্ষ করে ওএফএবি ১০০-১২০ বো-মা নিক্ষেপ করল পাইলট উপর থেকে। এই সময়টুকুতে উভয় বৈমানিক চিন্তা রাখল, ”Live or d-ie.” চূড়ান্ত মাত্রার ঝুঁকি। আকাশ সীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং তাদের দায়িত্বে থাকা শত শত যাত্রীদের নিরাপত্তায় ওদের মূল উদ্দেশ্য। এর আগে পিছে নিজের জন্য কোনো চিন্তা বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব রাখা যাবে না৷

বিশ্বাস করা যায় পাহাড়ের চূড়ায় একটা পিঁপড়াও জীবিত নেই। অ-গ্নিশিখায় আকাশটা ছেয়ে যাচ্ছে, মেঘের বদলে সেখানে জুড়ে কালো ধোঁয়া আর কালো ধোঁয়া। ঝাঁকে ঝাঁকে পক্ষীকুল বাঁচার তাগিদে উড়ে চলেছে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে। তখন পশ্চিমাকাশে সূর্যটাও ম্রিয়মাণ।
————————————

তিনশো যাত্রী মুক্ত করতে পঞ্চাচজন সেনা শহীদ। সকাল ন’টায় বনানীতে সামরিক কবরস্থানে শহীদদের দাফন কার্য শেষে তাঁদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান, রাষ্ট্রপতির পক্ষে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল, ভারপ্রাপ্ত নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার এডমিরাল, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল সেরনিয়াবাত, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ও সিনিয়র সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

পুস্পস্তবক অর্পণ শেষে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা শহীদ সেনাসদস্যদের সম্মানে স্যালুট প্রদান করেন। পরে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।

বনানী সামরিক কবরস্থানে শহীদ সেনা সদস্যদের পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। অতিথিদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদ সেনা পরিবারের সদস্যরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

মাহির দেহাবশেষ মেলেনি। তার ছবিতেই সকলে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। ওকে নৃশংসভাবে আহত করার ভিডিয়োটা শুধু সেনাবাহিনী প্রধানের কাছে পৌঁছানো হয়নি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পৌঁছে দিয়েছিল ওরা। যাতে এ দেশের সরকারের ব্যর্থতা প্রকাশ পায় আর তার ওপর, সশস্ত্র বাহিনীর ওপর জনগণের আক্রোশ বাড়ে। এবং ওদের সংগঠনকে যেন ভয় পায় প্রত্যেকে। ওই ভিডিয়োটা সামাজিক মাধ্যমে এত বেশি তোলপাড় সৃষ্টি করেছে যে, মাহিকে প্রতিটা মানুষ স্যালুট জানাচ্ছে।

জিহাদ সাহেব বড়ো ভাই জারিফ সাহেবের মুখটাই ঘনঘন দেখে চলেছেন। খুব একটা সুবিধার লাগছে না তার ভাইকে৷ নাহিয়ানকে যে বলবে বাবাকে সামলাতে। কিন্তু তার অবস্থাও শোচনীয়। পুরুষ মানুষের আর্তনাদ কেমন হতে পারে তা নাহিয়ানের কাতর কান্না দেখলেই জানা যাবে। বোনটা তার থেকে বা বাবার থেকেও শেষ বিদায় নেয়নি। ওরা জানতেই পারেনি মাহি কখন, কবে অপারেশনে যাচ্ছে!

জিহাদের আশঙ্কাকে সত্যি করে জারিফ সাহেব স্ট্রোক করলেন। শূন্য কফিনের সামনে বৈমানিক পোশাকে মেয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখখানি দেখে নিজেকে আর স্বাভাবিক রাখতে পারেননি তিনি। বোনের শোক ভুলে নাহিয়ান হাসপাতাল ছুটল বাবাকে নিয়ে। সঙ্গে জিহাদ আর জাওয়াদ সাহেবও গেলেন। আশফিকের পরিবারটাও নির্জীবের মতোই৷ কারণটা আশফিক। ও বিশ্বাসই করছে না মাহির মৃত্যুটা। ওর বিশ্বাস শুধু, খুব শীঘ্রই মিরাক্কেল কিছু ঘটবে। মাহির পরিবারের সদস্য আর কেউ নেই এখানে। মাহির মামারা, মামাতো ভাইয়েরাও ছুটেছে হাসপাতালে। কেবল আশফিক মাহির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে। ওর অভিব্যক্তি বা মুখভঙ্গি দেখতে স্বাভাবিক মনে হলেও এক মাত্র ওর আপন কেউ বুঝতে পারবে ওর অস্বাভাবিক আচরণ। লালচে মুখটা গম্ভীর করে রাখলেও ওর চোখদু’টোর অসম্ভব চঞ্চল দৃষ্টি চারপাশে ঘুরছে। পাশ থেকে কেউ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘কাউকে খুঁজছেন?’

আশফিক আলগোছে ঘাড় ফিরিয়ে তার দিকে তাকাল। সে চেয়ে আছে মাহির ছবিটার দিকেই। ও উত্তর দিলো তাকে, ‘মাহিকে খুঁজছি৷ ওকে দেখেছেন কোথাও? এত মানুষ! আমি খুঁজে পাচ্ছি না।’

মাহির ছবি থেকে নজর ফিরিয়ে ওকে দেখল কিছুক্ষণ লোকটা। চিন্তিত গলায় শুধাল, ‘ও কী হয় আপনার?’

চকিতেই এক শব্দে জানাল আশফিক, ‘বউ।’

লোকটা এবার আঁতকে ওঠা স্বরে প্রতিবাদ জানাল, ‘অসম্ভব। আইনত ও আমার বউ।’

আশফিক কথাটা গুরুত্বই দিলো না। ওর বদলে অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই এ কথার সত্যতা যাচাই বাছাই করতে নেমে যেত। তাতে বউ মৃত থাকুক আর জীবিত। ও আগের মতো আবারও আশেপাশে নজর বুলাতে থাকল শুধু৷ অপ্রকৃতিস্থের মতোই আচরণটুকু ওর। লোকটা তা পর্যবেক্ষণ করতে করতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আশেপাশে চোখ পড়তেই দেখল শহীদদের শোকাহত পরিবারের যুবতী মেয়েগুলো কান্না ভুলে ওকে বিমূঢ় অবস্থায় এক দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে। এ হচ্ছে জ্বালা ওর। গায়ের রংটা ফর্সা থেকে শ্যামলা করে রাখে কত কষ্টে ও! তারপরও বিশ বছরের তরুণী থেকে শুরু করে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু আধুনিক মনস্ক বৃদ্ধারাও চেয়ে চেয়ে দেখে ওকে। অবশ্যই তা উপভোগ্য। কিন্তু কষ্টটা এক জায়গাতেই। বউটা ফিরেও তাকায় না। এসব ভাবনাচিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে মনোযোগ দিলো আশফিকের দিকে৷ ছেলেটার জন্য ওর খারাপ লাগছে। নাহ, আর দেরি করা যাবে না। ছেলেটার পরিবারে না কি পাগল টাগল হয়ে যাওয়ার রোগ আছে! ইতোমধ্যে ছেলেটাও অর্ধেক পাগল তো বোধ হয় হয়েই গেছে মনে হচ্ছে। আশফিকের হাতে সাদা র‍্যাপিংয়ে মোড়ানো ছোটো একটা বাক্স ধরিয়ে দিলো। আশফিকও এবার ওই মেয়েদের মতোই ফ্যালফ্যাল করে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওকে। তবে তা মুগ্ধতাই না, বিস্ময়ে। মাহির ছবিটাতে নজর রেখে লোকটা জানাল আশফিককে, ‘এখানে আপনার কোনো কাজ নেই মিস্টার জাওয়াদ। আপনি গাড়িতে গিয়ে আমার এই বক্সটা খুলে দেখবেন। আমার মনে হয়েছে মাহির পরিবারে এটা শুধু আপনিই ডিজার্ভ করেন।’

কথাগুলো শেষ করেই অজ্ঞাত মানুষটা অন্য দিকে চলে গেল। আশফিক প্রবল আগ্রহ নিয়ে হাতে ধরে রাকা বাক্সটা দেখতে দেখতে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে। গাড়িতে বসে পুরো র‍্যাপিংটা খুলে বাক্সটার ভেতর স্থির চোখে চেয়ে রইল। রক্তে মাখা জঙ্গি বৈমানিকের একটা শার্ট। নেমপ্লেটে লেখা মাহি ইসলাম। শার্টটা থেকে একটা উটকো গন্ধও আসছে। হাতে নিতেই বোঝা গেল শার্টটা ভেজা। সে বিষয়ে কোনো খেয়াল নেই ওর। শুকনো গলাটায় ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছে ওর। দু’দিন যাবৎ পেটে কিছু পড়েনি যে!

বুকের মাঝে শার্টটা নিয়ে বসে থাকল কতক্ষণ, তারপর সারা মুখে সেটা ছোঁয়াল, রক্তের জায়গাগুলোতে ঠোঁট বুলাল, চুমু খেলো নেমপ্লেটটাতে।
———————————–

২০১৯ সাল

ব্রিটিশ ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ডটা এবারসহ পরপর দু’বছর এলো আশফিক জাওয়াদের ঝুলিতেই। ছবিটির শিরোনাম: ‘Soul love’ ; লন্ডনের একটি সমাধি ক্ষেত্র থেকে ছবিটা তোলা ওর। আইরিশ বংশোদ্ভূত চার বছর বয়সের ছোট্ট একটা মেয়ে অ্যাডার সমাধিতে মাইকেল নামের কালো কুকুরটা চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। এ ছবিটাই তুলেছে আশফিক। কুকুরটা সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দু’বছর আগে বাচ্চাটা গাড়ি চাপা পড়ে মারা যায়। বাচ্চাটার বয়স যখন একদিন তখন কুকুরটা বয়স এক বছর। বাবা-মায়ের পর খেয়াল রাখার দায়িত্ব মাইকেলের ওপরই ছিল। অ্যাডা মারা যাবার পর প্রথম বছর প্রায় রোজই আসত বাবা-মা৷ কিন্তু গত বছর তারা পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এরপর থেকে তাদের আর আসা পড়ে না অ্যাডার সমাধিতে প্রার্থনা করতে৷ কিন্তু মাইকেল তাদের মতো নতুন কাউকে পেয়ে অ্যাডাকে ভোলেনি৷ যে সময়টাতে অ্যাডাকে সমাধি দেওয়া হয়েছিল, রোজ সে সময়টাতেই মাইকেল এসে সময় কাটিয়ে যায় এখানে।

পুরুষ্কারটা নেবার সময় অতিথি ও দর্শক সারিতে আশফিক হঠাৎ যেন এক ঝলক দেখতে পায় মাহিকে বসে থাকতে। লাল রঙা একটা টপস আর কালো প্যান্ট ছিল পরনে। শেষ চার বছর ধরে এমনই দেখে ও হুটহাট। মানসিক সমস্যায় ভুগছে ও কঠিনভাবে। এর জন্য প্রতিনিয়ত সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে ওকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। কিন্তু সুস্থ হওয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অতীতের অনেক কিছুই ও ভুলে গেছে। যা ওর কাছে গুরুত্বহীন ছিল। আবার বর্তমানেও অনেক কিছুই ও ভুলেও যায়। যেগুলো ওর কাছে গুরুত্ব পায় না। যেমন- গতকাল ও বাসায় ফোন করে বাবা-মায়ের সাথে কথা বলেছে এক ঘণ্টা৷ তারা ওকে বিয়ে করে নেবার জন্য খুব অনুরোধ করেছেন, আসমান আরা খুব কান্নাকাটি করেছেন। তা দেখে আশফিক মতও দিয়ে দেয়। কিন্তু এই সত্যটাই পরদিন ওর স্মৃতিতে থাকে না। কারণ, পুরো ব্যাপারটা ওর কাছে একদমই গুরুত্বহীন ছিল। তা ও হয় ভুলে যায়, না হয় স্বপ্ন বা কল্পনা করে সেটাকে বিশ্বাস করে। তবে চিকিৎসা নেবার কারণে আগের তুলনায় কিছুটা সুস্থ হয়েছে ও। মাহিকে গত ছ’মাস ধরে যতবার নজর সম্মুখে দেখতে পায়, তা ও নিজের কল্পনা বলে ভেবে নেয়। কিন্তু ছ’মাস আগে ও বিশ্বাস করত, মাহি কেবল ওর কাছেই আসে। এখন কিছুটা সুস্থ বলেই বাস্তবটা ও বুঝতে পারে। মাহিকে যখন তখন দেখলেও ওটা ওর ভ্রম তা টের পায়৷ এজন্যই এখন ও মাহিকে দ্বিতীয়বার চেয়ে দেখার আগ্রহবোধ আর করল না। কিন্তু স্টেজ থেকে নেমে যাবার মুহূর্তে শূন্য আশায় তবুও তাকায় সেখানে। মাহির বদলে বসে আছে একজন ব্রিটিশ সুন্দরী মেয়ে একই পোশাকে৷ সব বারের মতো এবারও ওর দেখার ভুল ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

বাসায় ফিরে পুরুষ্কারটা বিছানার ওপর ফেলে ক্যালেন্ডারের দিকে এগোলো। চলে যাওয়া মাসটার পাতা উলটিয়ে নতুন মাসকে বিড়বিড় করে স্বাগতম জানাল, বিড়বিড় করেই বলতে থাকল, ‘তুমি তোমার কথা রেখেছ, মাহি। চার বছর! আবারও গেল চারটা বছর!’

হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে ক্যালেন্ডার থেকে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল ওর। ঘর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে গেল মূল ফটকের কাছে। দরজাটা খুলতেই অপরিচিত বাঙালি এক ভদ্রলোকের দেখা মিলল। তার পরনে কার্গো হাফপ্যান্ট আর ঢোলাঢালা কালো টি শার্ট৷ মাথায় আবার ক্যাজুয়াল স্ট্র হ্যাট, চোখে কালো রোদ-চশমা। একদমই মানায়নি পরনের পোশাকের সঙ্গে হ্যাটটা। দেখতে শুনতে অবশ্য বেশ। সিনেমার পর্দার নায়কের মতোই।

-‘আশফিক জাওয়াদ! চেনেননি নিশ্চয়ই আমাকে? কেমন আছেন?’

আশফিক দরজার মুখেই সটান দাঁড়িয়ে সামনের ভদ্রলোককে চেনার চেষ্টা করছে। ব্যর্থ হয়ে অপ্রস্তুত মুখ করে বলল, ‘স্যরি! সত্যিই চিনতে পারছি না।’

-‘আমি মানুষটা এত সুন্দর! যে দেখে সেই মনে রাখে। আর আপনি ভুলে গেলেন? যাবেনই তো, হিংসাতে ভুলে গেছেন৷ হিংসা তো হবেই। আমরা এক বধূর দু’স্বামী কি না!’

আশফিক ভ্রু কুঁচকে তাকে ভেতরে এসে বসার সৌজন্যটুকু দেখাল। লোকটা এই অপেক্ষাতেই ছিল। বসার ঘরটাতে বসে চারপাশে তাকিয়ে ঘরের সাজসজ্জা দেখতে ব্যস্ত হলো সে। আশফিক জিজ্ঞেস করল, ‘কফি না কি অন্য কোনো ড্রিঙ্কস? আসলে দেশের মানুষ বলেই না চিনলেও আতিথেয়তা করতে মন চাইল।’

সে মুচকি হাসল। হাসিটা খু্বই সুন্দর। আশফিক তা লক্ষ করে মিটিমিটি হেসে বিদ্রুপস্বরে বলল, ‘আপনাকে সুন্দরের বদলে সুন্দরী বললেও ভুল হবে না। হাসির স্টাইলটা অ্যাট্রাকটিভ। কিন্তু মেয়েদের মতো।’

তির্যক অপমানসূচক কথাটা শুনতে একটুও রাগ হলো না লোকটার। আবারও হাসল, জানাল, ‘কোল্ড কিছু।’

খুব বেশিক্ষণ লাগল না আশফিকের ফিরে আসতে। হাতে চারটা সফট্ ড্রিঙ্কের ক্যান এনে বসল সে। একটা বাড়িয়ে দিলো সামনের ভদ্রলোকের কাছে। সে প্যান্টের পকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে আশফিককে দিলো, তারপর বলল, ‘আমার হিংসা হচ্ছে বউয়ের প্রথম স্বামীকে বউয়েরই লেখা চিরকুট এনে দিতে৷ কিন্তু আমি খুব উদারমনা বলেই ঝুটঝামেলা ছাড়া মেনে নিয়েছি আপনাকে। আপনি নিজের ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যাচ্ছেন তো?’

ক্যানে চুমুক দিয়ে চিরকুটটা টি-টেবিলের ওপর থেকে তুলে নিলো আশফিক। নজরটা চিরকুটেই স্থির রেখে ভার গলায় দায়সারাভাবে উত্তর দিলো শুধু, ‘নিচ্ছি।’

একটা ঠিকানা লেখা কাগজটায়। এখানেরই একটা হোলেটের ঠিকানা। তবে হাতের লেখাটা খুব পরিচিত। এবার আশফিক সামনের মানুষটার দিকে একটু গুরত্বের সঙ্গে তাকাল। চেহারায় ওর উত্তেজনা নেই দেখে লোকটা হতাশ। সে বুঝল, আশফিক এখনও সুস্থ হয়নি পুরোপুরি।

-‘লেখাটা মনে হচ্ছে না খুব বেশিদিনের৷ আপনি তাহলে সত্যিই মাহির স্বামী? মাহি আপনার সঙ্গেই সংসার করেছে?’

-‘মাহি বেঁচে আছে কি না প্রথমে এটা জানতে চাওয়া উচিত ছিল না আপনার? আপনি চমকাননি ওর বর্তমান লেখাটা দেখে?’

আশফিক ঠোঁট কামড়ে চিন্তিত চেহারায় তাকিয়ে থাকে তার দিকে, ‘সত্যিই চমকানো উচিত, না? আমি নিজেও বুঝতে পারছি না এই লেখাটা দেখে আমার যতটা চমকানো উচিত ছিল ততটা চমকাতে কেন পারলাম না? আসলে চারটা বছর ধরে আমি এতবার মাহিকে চোখের সামনে দেখি তাতে আমার মনে হয় ও আমার চোখের আড়াল হয় না কখনও, আমার সঙ্গেই আছে। কিন্তু বাস্তবতা তো এটাই, ও আমার কাছে নেই। আমার আশেপাশে কোথাও নেই৷ এটা আমি এখন জানলেও, বুঝলেও ওর না থাকার যন্ত্রণাটা উপলব্ধি করতে পারি না নিজের অসুখটার জন্যই। আমি চেয়েছিলাম এই অসুখটা নিয়েই থাকতে। কিন্তু আব্বু-আম্মুর জন্য পারলাম না।’

সামনের মানুষটাকে বিষণ্ন মুখ করে নীরব থাকতে দেখে আশফিক জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি কি সত্যিই ওর হাজবেন্ড?’

সে হাসল, ‘এ কথাতেও তো আপনার উত্তেজিত হয়ে পড়ার কথা ছিল, আমার নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করার কথা ছিল।’

-‘ছিল হয়তো। হতে পারলাম না বলে দুঃখিত।’

কথাটা বলেই ওরা দু’জন দু’জনের দিকে চেয়ে থাকল। তারপর আচমকাই এক সঙ্গে হেসে উঠল। হাতের ক্যানটা শেষ করে টেবিল থেকে আরেকটা ক্যান তুলে নিয়ে চুমুক দিতে দিতে বলল লোকটা, ‘অপারেশনের মাস তিন পরই যোগাযোগ করতে চেয়েছিল মাহি আপনার সঙ্গে। কিন্তু নিজের চরম একটা বোকামির জন্য হসপিটাল লাইফ সাপোর্টে থেকেছে সাতদিন। সাতদিন লাইফ সাপোর্টে থাকলে কেউ কি আর বেঁচে থাকে?’
.
.
জীবনের ঝুঁকি এ পেশাতে মাহি বহুবারই নিয়েছে। কিন্তু যেখানে মৃত্যু আশঙ্কা আশি ভাগ নিশ্চিত সেখানে ঝুঁকি নেওয়া কথাটা মানায় না৷ বলা যায় জেনে-বুঝে জীবনকে এক রকম নিঃশেষ করেই দেওয়া। কেবল আল্লাহ পাকের ওপর ভরসাটুকু রাখা আর তার লেখা ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেওয়া। বুক বরারব রাইফেল তাক করা। মাত্র একটা গুলি আর আকাশ থেকে বৈমানিক বোমা নিক্ষেপ করবে চোখের পলকে। সেই মুহূর্তে ওই সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করা, ভরসা করা ছাড়া আর থাকে কী?

মাহি বোমা নিক্ষেপ করার তিন সেকেন্ড সময়ের মাঝে গিরিপ্রপাতে ঝাঁপ দেয় সেদিন। ঝর্ণায় ভেসে ভেসে কখন, কোন পাথরের আঘাত লেগে জান বেরিয়ে যাবে তার আশঙ্কাটুকু মনে করারও সুযোগ ছিল না। আর ওকে উদ্ধার করার জন্য ওই গিরিপ্রপাতেই যে আরেক দল সেনা অপেক্ষারত থাকবে, এই জ্ঞানটুকুও না।

প্রথমবার বিমান থেকে পাহাড়ের খাদে যখন ঝাঁপ দিয়েছিল, তার পূ্র্বে ওর ব্যক্তিগতভাবে ব্যবস্থা রাখা স্পাই ক্যামেরাটা হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছিল৷ নিরাপদে পৌঁছলে কেবল তা চালু করার অপেক্ষা শুধু। ছোটো পাহাড়টা আরোহণ করার সময়ই সেটা চালু করার সুযোগ পায় ও। যেটার সাথে সংযুক্ত ছিল এক মাত্র জিহাদ সাহেবের ব্যক্তিগত ফোনটা। এই স্পাই ক্যামেরার সুবিধা ছিল অডিয়ো, ভিডিয়োর সঙ্গে অবস্থান নির্ণয়৷ ওকে জঙ্গিরা সারা শরীর সন্ধান করেও ওই ক্যামেরাটা ধরতে পারেনি। চুলের খোঁপার মাঝে কালো ক্যামেরাটা এমনভাবে মিশে ছিল যে তা বোঝা দুঃসাধ্য। জিহাদ সাহেব মাহির সাথে সংযোগ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার সিক্রেট এজেন্টদের পাঠিয়ে দেন। এবং বিমানবাহিনী প্রধানের সঙ্গে গোপন বৈঠক বসে জঙ্গি বৈমানিকদেরও প্রস্তুত করে পাঠানো হয়। আরেক তরফ থেকে সেনাবাহিনী তো আগেই মাহিকে তালাশে নিয়োজিত ছিল৷ তাদের কাছেও ওর অবস্থান জানিয়ে দেওয়া হয়৷ এবং মাহির স্পাই ক্যামের সাহায্যেই যাত্রীদের অবস্থান জেনে পরবর্তীতে তাদেরও উদ্ধার করে আনা হয়।

মাহিকে গিরিপ্রপাত থেকে উদ্ধার শেষে হাসপাতালে আনলে ডাক্তার চিকিৎসা দেওয়ার পর জানায়, ও মেরুদণ্ডে আর পায়ে তীব্র আঘাত পেয়েছে। মেরুদণ্ডের স্পাইনার কর্ডে গুরুতর আঘাতটা লাগার কারণে অসহনীয় কোমরব্যথা, কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত ব্যথা ছড়িয়ে পড়েছে ওর। যার ফলে পাদু’টো অবশ বোধ করে, একেবারেই নড়াচড়া করতে পারে না। ডাক্তার আরও জানায়, প্রস্রাব–পায়খানা বন্ধ হয়ে যাওয়া বা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার সমস্যাও হতে পারে এতে ওর। অতএব ককপিটে বসার মতো পরিস্থিতি ওর হয়তো আর হবে না আগামী কয়েক বছরে। গাড়িতে বসলে অবশ্যই সিট বেল্ট বেঁধে বসতে হবে ওকে। তাছাড়া এই সমস্যার কারণে পায়ে সম্পূর্ণ ভর দিয়ে কোনো কাজ করতে পারবে না। তার ওপর ওর বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে টুকরো টুকরো! রিং ফিক্সটরের মাধ্যমে মেশিনের সাহায্যে তা জোড়া লাগানো হয়। সেই সাথে সারা শরীরের আঘাত তো আছেই।

সামনের আরও একটা অপারেশনের জন্য ওকে মৃত বলে ঘোষণা করেই মাস তিন পুরোপুরিভাবে ওকে আড়ালে রেখে চিকিৎসা চালায় জিহাদ সাহেব৷ কিন্তু এত এত বিপদের মাঝেও মাহির ব্যক্তিগত চিকিৎসক এক দিন খুশির সংবাদ জানায়, মাহি অন্তঃসত্ত্বা। দেড় মাস চলছে তার। তখন তো অন্তত আশফিকের সঙ্গে যোগাযোগটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়ায়। এদিকে সামনে আরও একটা মিশন, মাফিয়া দু’টো সংগঠনকে ধ্বংস করার। জিহাদ সাহেব তখন মাহির সুস্থতা ছাড়া আর কিছু ভাবেননি৷ ওকে তখন বললেন, আর তিনটা মাস বাদে আশফিকের কাছে যেতে পারবে সে৷ এর মাঝে সুস্থও হয়ে যাবে পুরোপুরি৷ ওর শরীর এবং মন উভয়ের চিন্তা করেই ওকে দার্জিলিং রেখে আসা হয়। যেটা মন সতেজকারক হিসেবে কাজে দেবে। কিন্তু সেখানে গিয়েই মাহি চরম ভুলটা করে বসে।

অচেনা মানুষের ভীড়ে যদি হঠাৎ চেনা কোনো মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়, তার আনন্দটাই হয় ভিন্ন আর অবর্ণনীয়। টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখতে গিয়ে দিব্যর দেখা পাবে কে জানত? না দিব্য জানত আর না মাহি। দেশের খবর দিব্য অবশ্যই জানে। মাহিকে দেখে সে সাধারণভাবেই ভূত দর্শনের মতো চমকে গিয়েছিল৷ তারপরই দিব্যর সঙ্গে সারাদিন কাটানো। দিব্যর সঙ্গ অবশ্যই উপভোগ্য ছিল ওর জন্য। বিয়েটা শেষ অবধি করতে পারেনি দিব্য। সেটা জেনে মাহি অন্তত এই ভেবে খুশি হয়, বোকামিকে প্রশ্রয় দেয়নি ছেলেটা। আগামীকালকের জন্য দিব্য ওকে আমন্ত্রণ জানায় এক সঙ্গে সকালের বাঙালি নাশতাটা করার জন্য। পরদিন মাহি রেস্টুরেন্টে এসে রুফটপের বুকিং দেওয়া টেবিলটাতে বসলেই দিব্য পুষ্পস্তবক নিয়ে এসে ওর সামনে হাজির হয়, হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, ‘আমি তোমাকে প্রপোজ করলে তুমি আমাকে ফিরিয়ে দেবে মাহি?’

এমন প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে তা ভাবনায় ছিল না মাহির। ও দিব্যর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে দেয়, ‘আমি বিবাহিত আরও সাড়ে চার বছর আগে থেকে। আজ তোমার সামনে তোমার চেনা মাহি না, একজনের বউ আর তার অনাগত সন্তানের মা দাঁড়িয়ে আছে।’

বাধ্য হয়েই দিব্যর কাছে আশফিকের সঙ্গে চলা মান অভিমানের গল্পটা জানায় ও। শেষে দিব্য কপট হেসে আবদার জানায়, ‘তাহলে আমার বন্ধু হিসেবে একবার হাগ করি?’

রেস্টুরেন্টে লোক সমাগম নেই বললেই চলে। অন্তত রুফটপে একদম মানুষশূন্য, ওরা দু’জন ছাড়া। প্রস্তাবটা সাধারণভাবেই নেয় মাহি। সম্মতি দিলে দিব্য চট করে ওকে শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে কানেকানে বলে, ‘তোমাকে আগে আমার পরিচয় দিই। আমি দিব্য চৌধুরী৷ এল্ডার ব্রাদার অব অনিল চৌধুরী। ভালোবাসবার জন্য প্রস্তাব দিতে চাইনি তোমাকে। তোমাকে মৃত্যু সাদরে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব দিতে চেয়েছিলাম। তোমার অনাগত সন্তান অনাগতই থাক৷ তুমি বরং ওর সঙ্গে স্বর্গে গিয়ে খেলাধুলা কোরো। তাই আগেই জানিয়ে দিই, রেস্ট ইন পিচ মাহি।’

কথাটা বলেই ছেড়ে দেয় দিব্য ওকে। মাহির মুখের দিকেও একটা পলকের জন্য না তাকিয়ে সিঁড়ি বেঁয়ে নেমে যায় তড়তড় করে৷ নামতে গিয়ে ধাক্কা খায় এক লোকের সঙ্গে। কিন্তু ফিরে চেয়েও দেখে না তাকে।

পেটের ডানপাশ চেপে ধরে মাহি ধপ করে নিচে পড়ে যায়। সাইলেন্সার লাগানো পিস্তলের গুলিটা ওর পেটের ডান পাশটাই তখন। পেট আর গোপনাঙ্গের পথ থেকে রক্তের স্রোত নেমে যেতে থাকে। ওকে সর্বদা খেয়াল রাখার জন্য যে দু’জন দেহরক্ষীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন জিহাদ সাহেব, তাদের না জানিয়ে আসার ফলেই সেদিনের বিপদটার মুখোমুখি হয় ও। এবং তৃতীয়বারের মতো আবারও বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়।
.
.
মাহির বিপদের প্রত্যেকটা লোমহর্ষক ঘটনাগুলো জানার পরও আশফিককে অনুভূতিশূন্য দেখাল৷ এসবের বিপরীতে আশফিক শুধু জিজ্ঞেস করল, ‘দিব্য ফেসবুকের সেই কানাডিয়ান বন্ধুটা না মাহির?’

এমন প্রশ্ন মোটেও প্রত্যাশায় ছিল না। মাহির খবর জিজ্ঞেস না করে ক্রিমিনালকে নিয়ে আগ্রহী আশফিক? মাহিকে তবে সে কী পরিমাণ কল্পনা করলে ওকে জীবন্ত ভেবে মৃত্যু সংবাদটা কখনও গুরুত্বই দেয়নি সে? চরম হতাশা নিয়ে সামনের লোকটি তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। অনেকক্ষণ পর বলে, ‘মাহি বিপদের সম্মুখীন হয়ে অসুস্থ। কিন্তু আপনি সুস্থ হয়েও অসুস্থ, আশফিক। আপনার ট্রিটমেন্ট আর জোরদারভাবে করা আবশ্যক।’

কথাটা শুনে আশফিকও মলিন মুখ করে বলল, ‘হয়তো ঠিকই বলেছেন আপনি।’

সে উঠে পড়ে চলে যাবার জন্য, ওকে জানায়, ‘ দ্য জেট হোটেল ট্রফ্যালগার কাল আপনার জন্য সারপ্রাইজ থাকছে। মনে করে যাবেন কিন্তু।’

বলা শেষে দরজা অবধি চলে যেতেই আশফিক জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার পরিচয়টা তো বললেন না?’

ওর দিকে ফিরে প্রাণবন্ত একটা হাসি দিয়ে বলল সে, ‘মাহির বিশেষ কেউ নিশ্চয়ই।’

-‘মাহির বিশেষ সব কিছুই আমার জানা।’

-‘তাহলে আমার কথাও আপনি জানেন। একটু মনে করে দেখুন তো। আপনি ছাড়াও ও কখনও অন্য কোনো পুরুষের কথা বলেছে কি না নিজে থেকে?’

মনে করতে গিয়ে আশফিক চোখের পলক ঘনঘন ফেলছে আর মনে আসা কথাগুলো বিড়বিড় করছে৷ অবশেষে মনে পড়ে, ও ছাড়াও মাহি একান্ত সময় কাটিয়েছিল মিস্টার মাহতাব নামের এক লোকের সঙ্গে, মিশনের স্বার্থে সেই লোককে মাহি চুমুও খেয়েছিল। এ কথা কি আর আশফিক ভোলে? মাথা তুলে সামনের লোকটাকে দেখে শুধাল, ‘মিস্টার মাহতাব?’

-‘জায়িন, জায়িন মাহতাব। আপনান বউয়ের ফেইক হাজবেন্ড।’ উচ্ছল হেসে বলল সে।
———————————-

গতকালটা ছিল বিশেষ দিন৷ মাহির ব্যক্তিগত প্রতিশোধের দিন। আর ঢাকা মাফিয়া সংগঠনটারও ধ্বংসের দিন। যে মিশনের পিছে চারটা বছর ব্যয় হয়েছে এনএসআই সংগঠনের, তাতে সাফল্য মিলেছে গতকাল৷ দিব্য মাহিকে হ-ত্যার প্রচেষ্টা করার পর সাত দিন লাইফ সাপোর্টে থাকে মাহি। সেদিনও আল্লাহর ইচ্ছায় বেঁচে ফিরে আসে ও। তিন তিনটা গুলি খেয়ে বেঁচে ফেরার ফলে জিহাদ সাহেব আর মাহিকে নিজের চোখের আড়াল করেননি৷ ঢাকা মাফিয়া সংগঠনটা পরিচালনা করত দিব্য। সর্বসম্মুখে ভাইকে রেখে সে সকলের আড়ালে থাকত৷ অনিলের বিরুদ্ধে প্রমাণ যোগাড় করে ওকে বহু কষ্টে অবশেষে আটক করা হয় চার মাস আগে৷ কিন্তু গুম করে রাখা হয়৷ নাটক সাজানো হয়, কোর্টে নিয়ে যাবার দিন পুলিশদের আহত করে ওকে কারা যেন নিয়ে পালিয়ে যায়৷ এরপর দিব্যকে ফাঁদে ফেলতে সময় লাগে চার মাস। ছোটো ভাইয়ের জন্য অবশেষে নিজে আত্মসমর্পণ করে কিছুদিন আগেই। মাহি নিজের সন্তান হারানোর প্রতিশোধটা নেয় ওরই সামনে অনিলকে মর্মান্তিকভাবে অত্যাচার করে। হাতের নখ, পায়ের নখ তুলে নেয় একেকটা করে যখনই দিব্য চেঁচিয়ে ওঠে ভাইকে ছেড়ে দিতে বলে৷ ব্লেডের অত্যাচার বাড়িয়ে দেয় দু’জনের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত৷ বিচারকার্য বেশিদিন চালানোর সুযোগ না দিয়ে সরকারের হুকুমে অবশেষে কাল দু’জনের ফাঁসি হয়ে যায়।

সকাল হতেই ঘুম ভাঙার পর আশফিক বিছানার পাশে মাহিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পায়৷ মিষ্টি হেসে মাহিকে বলে, ‘আমি ওষুধ রোজ নিই না, মাহি৷ নিলে তোমাকে কম কম দেখি৷’

মাহি অনিমেষ চেয়েই থাকে শুধু৷ আশফিক উঠে বসে ওকে কাছে ডাকে৷ কিন্তু মাহি শুধু হাসে। ও তেমন জোর করে না আর৷ যদি চলে যায়? নিজেই একা একা গল্প বলতে থাকে। ওর ফটোগ্রাফির গল্প, মাহিকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কোথায় কোথায় সেই গল্প। আর খুব করে চায় মাহির কাছে একটা ছোট্ট বাবু। সারাটাদিন ও আজ বাইরে যায় না। সাইক্রিয়াটিস্টের সাথে আজ দেখার করার কথা ছিল৷ সেটা ও ইচ্ছা করেই ভুলে যায়৷ নিজে রান্নাবান্না করে খাওয়া-দাওয়া করলেও ওষুধ নেয় না। মাহিকে কল্পনায় দেখে একা একা গল্প করে পুরো দিন কাটিয়ে দেয়। আজ সকালে যে ওর হোটেল যাওয়ার কথা ছিল, সেটাও ভুলে গেছে মাহিকে নিয়ে কল্পনা করতে করতে।

সন্ধ্যা লেগেছে সবে।
মাহি না কি আশফিকের হাতে বানানো পিৎজা খেতে চাইছে খুব। কিন্তু ঘরে চিজ নেই৷ আশফিক পাশের গ্রোসারিতে ছুটল চিজ আনতে৷ যাবার আগে যে ঘরের দরজাটা লক করে যাবে সে খেয়াল নেই ওর। বিশ মিনিট পর ফিরে এলো হাতে টুকিটাকি আরও অনেক কিছুই কেনাকাটা করে। ডাইনিং টেবিলে সব কিছু রেখে এসে শোবার ঘরে গেল জিরোতে। এসি থেকে একটু বের হলেই এখন শরীরে সাংঘাতিক ঘাম ছুটে যায় ওর। গা থেকে গেঞ্জিটা খুলে না দেখে কোথায় যে ছুঁড়ে ফেলল সে হুঁশ নেই। ধপাস করে বিছানাতে গিয়ে পড়ল। তখন মনে হলো কেউ ওর পাশে আর ওর দিকেই চেয়ে আছে। পাশ ফিরে দেখল, ওর পরনের গেঞ্জিটা বুকে আগলে ধরে মাহি বসে আছে, অন্য সময়ের থেকে খুব কাছেই ওর। এতটা কাছে কখনও আসেনি মাহি ওর কল্পনাতে৷ হাতটা একটু বাড়ালেই ছুঁতে পারবে ও। মাহিকে দেখতে দেখতে বলল, ‘তুমি মোটা হয়ে গেছ একটু, মাহি৷ গালদু’টো ভরেছে বেশ। ভালোই লাগছে। কিন্তু বাসা থেকে বের হওয়ার সময় না দেখলাম তুমি সেলোয়ার-কামিজ পরে ছিলে? টপস, প্যান্ট পরলে কেন হঠাৎ?’

-‘তুমি আমাকে সাত বছর আগের সেলোয়ার-কামিজে ভাবো বেশি। কিন্তু আমি সেলোয়ার-কামিজ পরি না সাতটা বছর হলো।’

-‘ওহ, তাই? তোমার কণ্ঠই বা ভেঙে গেল কখন? ঠান্ডা লেগে এইটুকু সময়ের মধ্যে?’

মাহি ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ভালোবাসাটা দু’জনের কার কতটুকু ছিল তা বোঝা যায়নি৷ কিন্তু মাঝের অনাকাঙ্ক্ষিত বিচ্ছেদটা পরিষ্কার করে দিয়েছে, আশফিকের থেকে বেশি ভালো ও বাসতে পারেনি। কবে সুস্থ হবে এই মানুষটা?

মাহি এগিয়ে এসে ওর বুকের ওপর মাথা রেখে শুলো, ‘অতিরিক্ত আইসক্রিম খেয়ে গতকাল ঠান্ডা লেগে গেছে। বাজি ধরেছিলাম একজনের সঙ্গে কতগুলো আইসক্রিম খেতে পারব।’

বলেই আশফিকের খোলা বুকে চুমু খেলো কতগুলো৷ আশফিক সে স্পর্শে স্তম্ভিত হয়ে রইল কতক্ষণ। বলে উঠল, ‘এভাবে তো আগে কাছে আসোনি? ছুঁতে গেলেই পালাতে।’

-‘তখন যে আমি তোমার কল্পনায় আসতাম, বাস্তবে নয়৷ কল্পনার মানুষ ছুঁতে গেলেই উবে যায়৷ আমি সত্য, আমার অস্তিত্ব জীবিত। ভালোবেসে যাচাই করো? ছুঁয়ে দেখো তো?’

বিস্ময়শূন্য রয়েই আশফিক ওকে ছুঁতে চাইল। কিন্তু তখনই মাহির ফোনটা বেজে উঠল। জিহাদ সাহেব কল করেছেন। আশফিকের দিকে অপরাধ ভরা চোখে চাইতেই চমকে দিয়ে আশফিক বলল, ‘এই লোকটা সব সময় আমার তোমার মাঝে এসে বাগড়া দেবে। অসহ্য একটা মানুষ!’

-‘তোমার মনে আছে কাকুকে?’ অত্যধিক বিস্ময় গলায় শুধাল মাহি।

-‘হ্যাঁ, তাকে আমার বরাবরই অপছন্দ৷ সাদিয়াকে দেখতে যেতেই পারলাম না। তোমাকেও কাছে থাকতে দিলো না।’

উত্তেজিত গলায়, অতি উৎসাহের সাথে মাহি জানতে চাইল, ‘আর কী মনে আছে তোমার?’

-‘তোমার কাছে আমার একটা বাবু চেয়েছিলাম৷ তুমি তো দিলে না!’ ভীষণ মন খারাপের গলায় বলল আশফিক।

জিহাদ সাহেব অবশ্যই আশফিকের কাছে গুরুত্ব বহন করে, ঘৃণার পাত্র হিসেবে। ভেবেই মাহি প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে কলটা ধরল, ‘হ্যাঁ, কাকু বলুন।’

-‘তোমার বাবা তো রেশমা মির্জাকে পুলিশে ধরিয়ে দিলো একটু আগে৷ অনন্যা মেয়েটা ফাঁসিয়ে দিয়েছে তাকে সত্যি, মিথ্যা এক সাথে বলে। তোমার প্রাক্তন ভাবিকেও ছাড় দেয়নি।’

-‘ভাইয়ার জন্য এবার সংসারী, সাদামাটা মনের একটা মেয়ে খোঁজেন৷ সামনের মাসে দেশে ফিরছি জামাই নিয়ে। এক সাথে বিয়ে করব ভাই-বোন।’

জিহাদ সাহেব ফোনের ওপাশ থেকে হাসি আটকে কপট ধমকের স্বরে বললেন, ‘লজ্জা শরমকে ছুটি দিয়েছ? চাচার মুখের ওপর সরাসরি বিয়ের কথা বলা হচ্ছে, না? রাখো ফোন। আর নিজেদের খেয়াল রেখো।’

মাহিকে কব্জায় আনতে দিব্যর লোকগুলো যখন জারিফ সাহেব আর নাহিয়ানের পিছে পড়ে ওদের তুলে আনার জন্য, কিন্তু কোনোভাবেই জিহাদ সাহেব আর মাহির জন্য তা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে রেশমার ব্যাপারটা। অনন্যা আরও তথ্য জানার জন্য তার প্রতিবেশী সেজে খুব গাঢ় সম্পর্ক তৈরি করে ঐশীর সঙ্গে। ধীরে ধীরে জানতে পারে, মাহির মায়ের আর মাহির সম্পত্তির অংশটুকু মিলিয়ে নাহিয়ানের সমান সম্পত্তি মাহির হবে সেটা ঐশী বা রেশমা কেউ চায় না। মাহিকেই তারা সহ্য করতে পারে না। এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে অনন্যা নিজেদের উদ্দেশ্য কিঞ্চিৎ জানায়। সে মাফিয়া দলের অন্তর্ভুক্ত, অবশ্যই এ তথ্য গোপন রাখে। মাহিকে কৌশলে মে-রে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঐশীর থেকে মাহির ব্যাপারে সমম্ত খবরাখবর অনন্যাকে পৌঁছে দিতো।

দু’বছর আগেই নাহিয়ান ঐশীকে তার নিজেরই দু’জন বন্ধুর সাথে পরপর অনৈতিক সম্পর্ক হাতেনাতে ধরে ফেলে৷ যার ফলাফল গড়ায় ওদের তালাক অবধি। এতে রেশমা সংসারে খুব অশান্তি করতে থাকলে হুইলচেয়ারে সারাদিন বসে থাকা জারিফ সাহেব আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। আরও দু’বছর তা সহ্য করার পর আজ রেশমার গোপন সত্য সব অনন্যা ফাঁস করে দিলে জারিফ সাহেব নিজে হাতে তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেন৷ এখনও তিনি জানেন না, মাহি বেঁচে আছে। জিহাদ সাহেব ভাইয়ের জন্য এটা শ্বাস্তিস্বরূপ গোপন রেখেছেন এতদিন।

আশফিকের মুখটা এখনও রাগ আর বিরক্তিতে ভার হয়ে আছে৷ মাহি ওর ফুলিয়ে রাখা নাকের ডগাটা টেনে দিয়ে বলল, ‘আমরা আবার বেবি প্ল্যানিং করব, ঠিক আছে?’

আশফিক উত্তরে শুধু দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘তোমাকে বারবার ছুঁই? যতবার ছোঁবো ততবার বিশ্বাস হবে তুমি সত্য।’

ওর বাড়িয়ে রাখা বাহুডোরে মাহি নিজেই গিয়ে আবদ্ধ হলো, ‘আমি সত্য। তুমি আরও শক্ত করে আমায় জড়িয়ে ধরো।’

ইসরাত জাহান দ্যুতি
এত বড়ো পর্ব দ্বিতীয়বার পড়ে এডিট করার এনার্জি পাইনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here