রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৪

0
613

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৪
_________________________

[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

চলে গেল মাহি। মাত্র হাত দুই দূরত্বে থাকা আশফিকের আদুরে ডাক সে শুনতেই পায়নি। আর আশফিকও দেখতে পায়নি মাহির কান গহ্বরে গুজে রাখা ইয়ারফোন। তাই নিজের মতো ভেবে নিলো, অন্তরে অসীমসিন্ধু রাগ, ঘৃণা পুষে রেখেছে মাহি তার জন্য, হৃদয়দ্বার বুঝি চিরতরের জন্য খিল দিয়েছে।

মাত্র একদিনেই সকলের অবহেলা যেন ক্রমশ আশাহত করে তুলছে ওকে। ও মানুষটা যে খুব ধৈর্যহীন, তা নয়৷ মানুষের অঙ্গভঙ্গি আর চোখের চাহনি দেখে তার অন্তর পড়ে ফেলার এক অনন্য ক্ষমতা আছে ওর। চারটা বছরে তো সে শুধু লন্ডনকেই ওর ছবি গ্রহণ করার প্রিয় আলোকযন্ত্রটাতে ধারণ করেনি। কত বিচিত্র পরিবেশে ঘুরে, নানান মানুষের সঙ্গে মিশে নিজের জ্ঞানভাণ্ডারকে দিনেদিনে করেছে বিশাল। তাই গত বাইশ ঘণ্টায় মাহির অচপল, স্থির চাউনি দেখে বুঝতে বেগ পেতে হয়নি, ওর প্রতি তার না আছে কোনো ক্ষোভ, অভিমান, রাগ আর না আছে কোনো আগ্রহ। আগ্রহ না থাকাটাকে স্বাভাবিক লাগলেও রাগ কিংবা অভিমান থাকাটা অবশ্যম্ভাবী ছিল। কেননা সেই চার বছর আগে তাদের সম্পর্কের সময়টা তিন মাস ব্যাপ্তিকাল হলেও ভালোবাসাটুকু মাহির বক্ষঃস্থলে জন্ম নিয়েছিল খুব জলদিই, তা বুঝতে পারত যখন সে কাছে এসে গাঢ়ভাবে তাকে ছুঁতো। আর ভালোবাসা থাকলে সেখানে অভিমান, রাগ, সব থাকাটা সাধারণ ব্যাপার না? কিন্তু তা মাহির মধ্যে নেই কেন?

ঘরে ফিরে এলো আশফিক৷ বিছানাতে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করেও পারল না। ভালো লাগছে না তার কিছুই। মাহির মনোযোগ পেতে চায়, সেই আগের মতো তার প্রতি মাহির উদ্বেগ দেখতে চায়। সে জন্য কী করতে হবে, কী প্রয়োজন, এসব ভাবনায় মস্তিষ্ককে জাগিয়ে রাখছে। দূরে দূরে থেকে এমনটা সম্ভব নয়। খুব কাছাকাছি থাকতে হবে, যতটা কাছে থাকলে তাগে উপেক্ষা করতে পারবে না।

***

কর্মজীবন থেকে কিছুদিনের জন্য নিষ্কৃতি পেতে সৌরভরা রুমকির বিয়ের নিমন্ত্রণটাকেই কাজে লাগিয়েছে। তাছাড়া একত্রে ছুটি কাটানোর সুযোগ তারা খুব একটা পেত না। তার ওপর আশফিক দেশে ফিরেছে, কখন আবার এই চরকিবাজি ছেলে ফুড়ুৎ করে উড়াল দেয় তার নিশ্চয়তা নেই। তাই এই সময়টাতে সকলের নিজ নিজ কর্মস্থল থেকে ছুটি নেওয়াটা অত্যাবশ্যক মনে হলো।

জারিনকে সিঙ্গেল মাদারই বলা যায়। স্বামীর সঙ্গে সংসার জীবনে মিলমিশ না হওয়াই দু’জন আলাদা থাকে। ওদের তিন বছরের একমাত্র ছেলেটা বছরের অধিকাংশ সময় ওর সঙ্গে থাকলেও স্বামী জয় যখন চাইত তখন ছেলেকে দু একদিনের জন্য নিজের কাছে রাখত। এখন ছেলে কিছুটা বড়ো হওয়াই এই প্রথম সপ্তাহখানেকের বেশি থাকবে সে বাবার সঙ্গে। এই সুযোগেই জারিনও এক সপ্তাহের একটা ছুটিদিবস কাটাবে মাগুরাতে। সে একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার।

সৌরভ, সাদিয়ার জুটিটা ঠিক সু্বিধার না। আবার অসুবিধারও না। বছরে চার বার এই প্রেমিকযুগলের মধ্যে তথাকথিত ব্রেকআপ শব্দটি প্রয়োগ করে মাসখানেক দু’জন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রাখে। এই অপরিপুষ্ট সম্পর্কের জন্য এদের দু’জনের পরিবার এখন অবধি এদেরকে বিয়ে অবধি টানতে পারছে না। সৌরভ একটা প্রাইভেট ফার্মে ভালো বেতনেই চাকরি করে। কিন্তু সাদিয়া না বিয়েতে আগ্রহী, না চাকরি-বাকরিতে ইচ্ছুক। সে ঘরে বসে খাটনিবিহীন কাজ করতে আগ্রহী কেবল৷ অনলাইনে লাইভ ভিডিয়োর মাধ্যমে জামাকাপড়, বিভিন্নরকম ইমিটেশনের গহনা বিক্রি করে টুকটাক উপার্জন করে নিজের মতো চলে ফেরে।

সেদিক থেকে পরাগ, অপির সম্পর্কটাতে আল্লাহ পাকের রহমত বোধ হয় খুব বেশি। সমাজের কাছে অপি বেঢপ মোটা, পাত্রী হিসেবে চলনসই নয় ঠিকই, কিন্তু পরাগের মতো সুপুরুষের কাছে ওর মূল্য হীরার চেয়েও দামি। পরাগ যতটা সম্ভব চেষ্টা করে আল্লাহর পথে চলে তাঁকে সন্তুষ্ট রাখবার। এ কারণে মুখভর্তি লম্বা লম্বা দাঁড়ি রাখা থেকেও বিরত থাকেনি সে। ন্যাশনাল ভার্সিটির সাধারণ একজন লেকচারার। আর অপিকে গৃহিণী হিসেবে দেখতেই সে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

এদের সকলের একটা গতি হলেও হৃদয় উচ্চবিত্ত পরিবারের পড়ালেখা শেষ করা এখন অবধি ঘুরি, ফিরি, খাই বৈশিষ্ট্যের একজন বেকার ছেলে। যাকে তার পরিবার এই বয়সেও মেরেধরেও চাকরিতে আগ্রহী করতে পারছে না। সে নাকি সরকারের চাকর হতে পারবে না। অথচ দেশের ব্যয়বহুল প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে সেখানকার লেকচারার হবার সুযোগ পেয়েও অবজ্ঞা করে চলে এসেছে। ওই কাজটি নাকি তার জন্য মনঃপুত নয়। এসবের বাইরে গিয়ে সে ব্যবসা করবে এমনটিও বলেনি। তাকে নিয়ে তার পরিবার বেশ দুশ্চিন্তায় আছে। বর্তমান তারা পরিকল্পনা করছে ছেলেকে অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে দেবেন। বউ এসে যদি তাকে ভালো করতে পারে!

সবার চিন্তাভাবনা সাদাসিধা জীবনযাত্রা নিয়ে হলেও এদের থেকে একমাত্র আশফিকই হলো ভিন্ন, অনন্যসুলভ চিন্তাধারার মানুষ। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ’র মোটামুটি পর্যায়ের ছাত্র ছিল সে। পড়ালেখা শেষ করে চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে, এ চিন্তা তার না থাকলেও ছিল পৃথিবীর বুকে নিজের মুখ আর নিজের নামটাকে সুপরিচিত বানানোর। পৃথিবীর সর্বাধিক সৌন্দর্যগুলোকে স্বচক্ষে দেখা এবং তা সযত্নে আলোকচিত্রে ধারণ করে রাখা। যার শুরুটা সে সেই এইচএসসির সময়কাল থেকেই শুরু করেছিল। ফটোগ্রাফি নিয়ে কতরকম ম্যাগাজিন সংগ্রহ করত, কালে কালে যখন যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটল, কম্পিউটারে ইন্টারনেট কানেকশন দিয়ে গুগলের সাহায্যেও ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করল, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে টাইমলাইনে নিজের তোলা ছবির অ্যালবাম বানালো। একটা সময় এই ফটোগ্রাফির জন্য ফেসবুক পেইজ খুলল, ডোমেইন কিনে ওয়েবসাইট তৈরি করল, ব্লগ বানিয়ে পোট্রেইট, ধীরে ধীরে তার সযত্নে তোলা ছবিগুলো সারা জায়গায় ছড়িয়ে দিলো। পরিকল্পনা ছিল অনার্সটা শেষ করেই সে ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করবে যে-কোনো ভালো দেশে গিয়ে। তারপর ফটোগ্রাফার বনে সেখানে থেকে যাবে তার স্বপ্ন পূরণ না হওয়া অবধি। লন্ডন যাবার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু জাওয়াদ রায়হানের এই একটি মাত্রই পুত্র। তার যাবতীয় যা কিছু সবই তো এই পুত্রের। অথচ তার খামখেয়ালি চিন্তাধারার ছেলেটা দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবে নাকি গলায় একটা ক্যামেরা ঝুলিয়ে? তাহলে এই বিশাল ব্যবসা বাণিজ্য দেখবে কে? তার অমন সৌষ্ঠবপূর্ণ ছেলে কিনা ওসব আজগুবি কাজ কারবার করবে! বন্ধু জারিফ ইসলামের সঙ্গে সমস্যার সমাধানের জন্য আলোচনা করে শেষে দু’জন মিলে পরিকল্পনা করলেন মাহির মতো অমায়িক সুন্দরীর সঙ্গে আশফিকের বিয়েটা হয়ে গেলে ছেলে অত মিষ্টি বউ রেখে ওসব হাবিজাবি ফটোগ্রাফি করে বেড়াতে চাইবে না নিশ্চয়ই।

বাবার হঠাৎ হঠকারি সিদ্ধান্তে আশফিক শুরুতে একেবারে অমত থাকলেও মাহিকে দেখে কিছুটা নিমরাজি হয়ে বিয়েতে মত দিলো। সম্পর্কটাতে না চাইতেও একটা সময় আশফিক যত্নশীল হয়ে পড়ল মাহির জন্যই। তা দেখে জারিফ আর জাওয়াদ নিশ্চিন্ত হলেন, নিজেদের পরিকল্পনা আর ইচ্ছাও পূরণ হতে যাচ্ছে তা নিয়ে অন্তহীন খুশিও হলেন। কিন্তু মাস তিন যাওয়ার পরই হঠাৎ করে তাদের সেই ইচ্ছাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, মাহির মনে সদ্য সৃষ্টি হওয়া ভালোবাসা আর স্বপ্নকে উপেক্ষা করে সম্পর্কটা ভেঙে একদিন লন্ডন চলে গেল কাউকে না জানিয়েই।

***

শিকদার বাড়িতে না হয় কাক ডাকা ভোর, না হয় মোরগ ডাকা ভোর, শিকদার বাড়িতে হয় মঞ্জুয়ারা ডাকা ভোর। তার কর্কশ গলার সর্ব প্রথম ডাকগুলো ‘এ মাকসুউউ…এ তামিনাআআ(তাহমিনা)…ও মদনের মাআআ!’ উঠানের শেষ থেকে শুরু দু’টো পাক দিতে দিতে ডাকগুলো দেন। দো’তলা থেকে এই ডাকগুলো শুনে কাজের মানুষগুলো বিছানা থেকে লাফ দিয়ে ওঠার সঙ্গে জারিনদের ঘুমও লাফ দিয়ে পালাল। এত ভোরে ডাকাডাকি শুনে ওদের বিরক্ত লাগলেও এগুলো যে স্বাভাবিক পরিবেশই তা মেনে নিলো খুব সহজেই। ওরা আরও কিছুক্ষণ বিছানাতে শুয়েই আলসে ছাড়ল, গল্প করল, সময় যখন সকাল সাতটা হলো তখন তিনজন উঠে পড়ল।

বাড়ির মেয়ে মানুষগুলো ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেও পুরুষগুলো বেহুঁশ হয়ে ঘুমে কাতর, শুধু পরাগ আর বাচ্চাবাচ্চা ছেলেগুলো ছাড়া। একটু বেলা গড়াতেই আশফিকদের ডেকে ওঠাল পরাগ। তিন বন্ধুকেই নামাজের জন্য ডেকেও ওঠাতে পারেনি ভোরে। সে নিচে চলে গেল অপির খোঁজ করত।

মাহির মেজো নানার বাড়ির পেছন দিকে ছোটোখাটো একটা পুকুর আছে। সেখানে আগে এলাকার অনেকেই গোসল করতে নামত, কিন্তু পানি ঘোলা হয়ে যাবার পর সেখানে এখন কয়েক রকম মাছ চাষ করে মেজো শিকদারের ছেলে। তার একটিই ছেলে আর সাতটি মেয়ে। তিনি মারা যাবার পর এই ছেলেরই এখন সব। বোনেদের কোনোরকমে কিছু কিছু সম্পদ দিয়েছে কেবল।

সেই পুকুরপাড়ে ভোরের প্রথম রৌদ্ররশ্মি এসে পড়ে। জারিনদের নিয়ে রুমকি আর রুমকির ছোটোবোন রিমি এসে দাঁড়িয়েছে। রিমি রিমনের সম বয়সী। একটু পরই পরাগ এসে দাঁড়াল। ওদের গল্প আরম্ভের মাঝেই আশফিককে নিয়ে সৌরভ, হৃদয় হাতে চায়ের কাপ সমেত হাজির হলো। জারিন রুমকিকে জিজ্ঞেস করল, ‘মাহিয়ান ওঠেনি রুমকি?’
আশফিক উৎসুক দৃষ্টি মেলে আছে রুমকির দিকে। রুমকি অকপটে জানাল, ‘রাত জেগেছে তো, তাই বেলা করে ঘুমোচ্ছে। একটু পরেই গিয়ে ডেকে দেবো।’
-‘রাত জাগে কেন? বিসিএস এর প্রিপারেশন নিচ্ছে মাহি?’ সাদিয়া জানতে চাইল।

প্রশ্ন শুনে রুমকি হা হা করে হেসে উঠল, ‘হ্যাঁ, কানাডা থেকে বিসিএস এর প্রিপারেশন নেওয়াই।’

সকলের কৌতুহলী চোখ পড়ল এবার ওর ওপর। কথাখানা বাকিরা যথেষ্ট স্বাভাবিকভাবে নিতে চাইলেও কে জানে আশফিকের বুকের মধ্যে ছলাৎ করে উঠল! এর নির্দিষ্ট কারণ সে যা ভাবছে তা যেন এই মুহূর্তেই মিথ্যা হয়, প্রার্থনা করতে থাকল একরকম।

অপি জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাব্রোড যেতে চাইছে?’
রুমকি ঘাড় উপর-নিচে দুলিয়ে হাঁ জানাল। আশফিক যেন জোর বাঁচা বাঁচল এতে। কিন্তু রুমকি পুনরায় হেসে বলল, ‘কানাডায় রাত জেগে কথা বলে।’

সবার মধ্যে অশনিপাত ঘটল যেন, একে একে আশফিকের মুখটার দিকে দৃষ্টি দিলো। চেহারায় ওর অতিশয় বিস্ময়, কাতরতা, কিছুই টের পাওয়ার উপায় নেই। কারণ আশফিক বিশ্বাসই করছে না। আর সব মেয়েদের মতো প্রেমে পড়া ধরনের মন মানসিকতা মাহির এক কালে ছিল না। এমনকি এটা ওর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায়ও না। স্কুল জীবনের ছ’সাতজন বন্ধুদের মধ্যে ওর নাকি মাত্র একজনের সঙ্গেই যোগাযোগ অটুট৷ বাকিদের সঙ্গে ও নিজে থেকে বিচ্ছিন্ন থাকত। কলেজ আর ভার্সিটি সময়কার কথা বলতে গেলে খুব প্রয়োজন ছাড়া ও ক্লাসমেটদের সঙ্গে কথা বা ঘুরত ফিরত না।

আশফিকের মনের ব্যাখ্যাগুলোই জারিন প্রশ্নরূপে উপস্থাপন করল, ‘মাহিয়ান রিলশনে আছে? তার সঙ্গে রাত জেগে কথাও বলে? এটা সত্যিই সম্ভব রুমকি?’
-‘আরে আপু সত্যিই। তাও আড়াই বছর চলছে। জিজ্ঞেস করলে খালি বলে এমনিই কথা বলি৷ এই এমনি কথায় তাদের মাঝেমাঝে রাতভর চলে আবার দিনভরও।’
-‘মানে কীভাবে কী? আমার সত্যিই বিশ্বাস হচ্ছে না এখনো।’
অপি থামিয়ে দিলো ওকে, ‘ধুর থাম তো। আগে শুনতে দে। এই রুমকি, মাহির সঙ্গে তার পরিচয় কী করে হলো?’
-‘ফেইসবুকে।’
সাদিয়া হেসে বলল, ‘তাহলে এবার সত্যিই বিশ্বাস করতে পারলাম না। ও তাহলে এমনিই কথা বলে। সোশাল জগতটাতে ও নাম মাত্র যুক্ত থাকলেও এগুলো তো ও ব্যবহারই করত না। আর সে নাকি ফেসবুকে রিলেশন করবে?’
এ পর্যায়ে রুমকিকে একটু নিরানন্দ দেখাল, আশফিকের দিকে আড়চোখে একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছুঁড়ে তারপর জবাব দিলো, ‘অসম্ভব কেন আপু? মানুষ কি সারাজীবন এক রকমই থাকে। আড়াই বছর আগে আপু সারা সময়টাই কাটাত পড়াশোনা, সোশাল মাধ্যমগুলোতে আর ফ্যামিলি ট্যুর দিয়ে। মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের মাধ্যমে দিব্য ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। দিব্য ভাই এত বেশি ওয়ার্ম হার্টেড আর নেইবারলি যে মাহি আপুর মতো বোরিং পার্সোন ওই ব্যক্তির হাতে পড়ে চটপটে হয়ে গেল ছয় সাত মাসে। রিমন, আমি, রিমি তো ভাইয়ার মারাত্মক ফ্যান।’

রিমি পিচ্চিটা এতক্ষণে গল্প বলার সুযোগ পেয়ে হড়বড় করে বলতে শুরু করল, ‘কথা কয় একেবারে আমাদের সাথে মিলায়ে আঞ্চলিক টানে। আপনারা শুনলি হাসতে হাসতে মইরে যাবেন। ভাইয়ার বাড়ি ঠাকুরগাঁও, কিন্তু কথা শুনলি মনে হয় মাগুরার।’

রুমকি, রিমির মুখে এত এত গল্প শুনে সবাই অনায়াসে বুঝে ফেলল, যে ফুলের গাছটাকে আশফিক যত্নের পরিবর্তে উপড়ে ফেলে গিয়েছিল, সেই গাছটাকেই দিব্য ছেলেটা নতুন করে সযত্নে তুলে পরিচর্যা করেছে।

ওদের সবার থমথমে মুখগুলো দেখে রুমকি আর কথা বাড়াল না৷ সে ওদের বাড়িতে আসতে বলে নাশতা গোছগাছ করতে চলে গেল।

হৃদয় আশফিকের গভীর চিন্তিত চেহারাটা দেখে গলা ঝেড়ে বলে উঠল, ‘কী কাকা! কী বুঝলা?’
-‘মাহি চুপচাপ স্বভাবের হলেও বাস্তববাদী ছিল। ইমোশনাল ধাঁচের ছিল না। তাই ওর মুভ অন করাটা অসম্ভব কিছু না। তারপরও অবাক লাগছে। তুই হচ্ছিস না?’
আশফিকের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ল সৌরভ।
-‘অবাক করার মতো বিষয়ে তোরা অবাক হলি, তো আমি হবো না কেন? আমি কি ভিন্ন প্রজাতির প্রাণী?’

জারিন, সাদিয়া, অপি আপাতত আর কিছু বলল না। আশফিকের ওই ত্যারা ধাঁচের উত্তরেই বুঝে গেছে ছ্যাঁকা দেওয়া ছেলেটা এবার নিজে ছ্যাঁকা খেয়ে রাগে ফাটছে।
-‘ধুর শাল আবাল! এবার তুই দিলিশাকে নিয়ে নাচনকোঁদন কর। তুই যা করে গেছিলি, তা কি হজম করার মতো যার আত্মসম্মানবোধ আছে? বলেই পরাগ বাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। ওর মতে মাহি একদম ঠিক করেছে। ওর বন্ধু যে অন্যায়টা করে গিয়েছিল তা বিয়ের আসরে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার সমানই।

***

এজমালি পরিবারে সদস্যের ভীড়, ঝগড়াঝাঁটি, আরও নানারকম সমস্যা থাকলেও কোথাও যেন একটা সকলের মনের মধ্যে নিজেদের নিরাপদ বলে মনে হয়। কারণ, একা থাকাটা হয়তোবা ঝুটঝামেলাহীন তবে বিপদ আপদে খুব দ্রুত কাউকে পাশে পাওয়া বা কারও পরামর্শ পাওয়া বেজায় কঠিন। যৌথ পরিবারে কিন্তু এই চিন্তাটা থাকে না। এদিক থেকে সকলেই দিনের শুরু থেকে দিনের শেষ অবধি নিশ্চিন্তে রয়। শুধু তা সব সময় উপলব্ধি হয় না বলেই কেউ কেউ বোকার মতো একাকী থাকাটাকেই বেশি সু্বিধাজনক মনে করে।

রামিম সাহেব একটা সময় এমন বোকামি করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আজ মেয়ের বিয়ের অসিলায় প্রতি পদে পদে টের পাচ্ছেন ভাইয়ের সঙ্গে একত্রে ছিল বলেই বিয়ের মতো ঝামেলাটাকে ঝামেলায় মনে হচ্ছে না। নাশতার টেবিলে এক সঙ্গে খেতে বসে এসবই ভাবছিলেন আর বাপ ভাইকে দেখছিলেন। তাদের বাপটা আজ দু’দিন হলো কী সুন্দর তাদের সঙ্গে বসে খাবারটা খাচ্ছেন। এই অসাধ্য সাধন কী করে যে হলো কে জানে!
আশফিকের দিকে নজর পড়লে রাগ আর বিরক্তে মুখটা কুঁচকে আসছে তার। ছেলেটা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। অথচ ভাবখানা কী! জামাই আদরটা নিজে থেকেই আদায় করে নিচ্ছে কেমন বেহায়ার মতো। সবাই যখন খেতে বসল, মাহি আসল সকলের শেষে। আশফিক তখন রায়ানের পাশে বসেছিল। মাহি খেতে বসতেই আশফিক চট করে রায়ানের পাশ থেকে উঠে গিয়ে বসল মাহির পাশের চেয়ারে। তারপর থেকে শুরু করেছে আরেক নাটক। মাহিকে বলছে এটা ওটা এগিয়ে দিতে, খাবার-দাবার বেড়ে দিতে, টুকটাক কথা জমানোরও চেষ্টা করছে মনে হয় মাহির সঙ্গে। কিন্তু সু্বিধা করে উঠতে পারছে না। নেহাৎ তাদের বাড়ির মেয়েটা শিক্ষিত, মার্জিত বলেই অত কিছুর পরও ওই ছেলেকে আপ্যায়ন করে যাচ্ছে নিরবে। বাপের দিকে তাকালেন রামিম আবারও, বাপটাও দেখো কেমন না দেখার মতো করে চুপচাপ মেনে নিচ্ছেন! আশফিককে এত খাতিরযত্ন করার কারণটা এখনো যে রামিমের অজানা।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

আপনারা মন্তব্য করতে চান না কেন?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here