রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ৫
_________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
মাগুরাটা একেবারে মফস্বল ধরনের না। এখানের কিছু কিছু শিক্ষিত পরিবারগুলো ছেলে-মেয়েকে ছোটো থেকেই অনেকটা আধুনিক মানসিকতার গড়তে চেষ্টা করে। এই যেমন মূল শহরের ভেতর ঢুকলেই দেখা যায়, কিশোর-কিশোরী বয়সের ছেলে-মেয়েগুলো ক্রিকেট খেলার জার্সি পরে ভর দুপুরে রাস্তার পাশ দিয়ে ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, অনেকেই সাঁতারু হওয়ার প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, কলেজ পড়ুয়া ছেলেগুলো প্রতিদিন জিমনেসিয়ামে যাচ্ছে। এ শহরের গর্ব সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানই আমাদের মাগুরার ছেলে-মেয়েদের অনুপ্রেরণা বলা যায়।
সেই উদ্দীপনা বুকে নিয়ে রিমন ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন দেখে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিমে খেলার তার খুব ইচ্ছা। প্রতিদিন ক্লাবে খেলতে যায় সে। রুমকি আর রায়ানের বিয়ের চক্করে পড়ে ভেবেছিল কয়েকটা দিন বিরতি দিয়ে শুধু মজা করে বেড়াবে সবার সঙ্গে। আজ হঠাৎ সকালের নাশতা শেষে ক্লাবে যাবার জন্য সেজেগুজে বেরিয়ে মাহির কাছে আসলো সে। মাহি বড়ো নানার বাড়িতে যাবে, আজ দুপুর থেকে ওখানেই থাকবে৷ তাই সালাম শিকদারের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে যেতে চাইছিল। আশফিক ছেলে বন্ধুদের নিয়ে একটু বাইরে বেরিয়েছিল তখন৷
রিমন নানাজানের ঘরে এসেই আচমকা মাহির হাত টানতে শুরু করল, ‘মা’পু চলো, ক্লাবে যাব।’
হঠাৎ টানাটানিতে একটু চমকে গিয়েছিল মাহি, নানাজান তখন চশমাটা চোখ থেকে খুলে বিছানাতে শুয়েছেন। মাহি কিছু বলবার আগে তিনিই শুধালেন, ‘ও যায়ে কী করবি?’
-‘বাড়িতে মেলা ভেজাইল্যা মানুষ ঘুরাফিরা করতেছে নানুভাই। কহন দেহা যায় আপুর সাথে ভেজাল লাইগে গেল। তার’তে ভালো আমার খেলা দেখবেনে বোসে বোসে।’
নানাজান আরেকটু ঘুমাবেন বলে শিয়রের জানালাটা বন্ধ করে দিতে দিতে নাতনিকে বললেন, ‘যা, ওর সাথে আয় ঘুরে।’
রাশভারী, স্বল্পভাষী মাহিয়ান রিমনকে কপাল কুঁচকে দেখল একবার। নানাজান বললেন বলে আর কোনো কথা বাড়ালো না সে। ঘরের দরজাটা আলগোছে লাগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো।
রিমন আগে আগে হাঁটছে, পিছু ফিরে একবার মাহির দিকে নজর দিলো। সাদা লেগিংসের ওপর ছাই রঙা লম্বা শ্রাগ গায়ে তার। গলায় পেঁচিয়ে রাখা উলের কালো রঙা মাফলারটা বুকের ওপর জুড়ে আছে। যাক, কাপড়চোপড় আর পরিবর্তনের ভেজাল নেই। মাহি শ্রাগের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দিব্যর মেসেজ দেখতে দেখতে হাঁটছিল রিমনের পিছুপিছু। রিমন হঠাৎ বলে বসল, ‘মা’পু, তুমি না একটু মোটা হইছো।’ মাহি কথাটা শুনলেও উত্তর দিলো না। রিমন আবার বলল, ‘হ, সত্যি কচ্ছি। কত কেজি হইছো?’
-‘ফিফটি ফাইভ।’
মাহির নজর তখনো ফোনে। রিমনের থেকে প্রশ্ন আসলো আবার, ‘তোমার উচ্চতার সাথে ঠিক আছে ওজন? হাইট যেন কত?’
-‘ফাইভ’সিক্স”।’
-‘উফ্, এত শর্টেকাটে উত্তর দেও ক্যান?’
-‘প্যাচাল বন্ধ কর। রিকশা ডাক তাড়াতাড়ি, যা।’
বড়ো সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে রিমন অটো বা রিকশার জন্য যখন অপেক্ষায়, তখন রাস্তার ওপাড় থেকে আশফিক সৌরভদের সাথে কথা বলতে বলতে রিমনকে দেখতে পেল জার্সি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। রিমন ওদের দেখেনি। সেদিকে আর নজর দিলো না আশফিক। মিনিট দুয়েক সময় যেতেই পরাগ হঠাৎ রাস্তার ওদিকে চেয়ে বলে উঠল, ‘কোথায় যায় মাহি রিমনের সাথে?’
কথাখানা শুনতে দেরি কিন্তু নিমিষে ওদিকে ফিরতে দেরি হলো না আশফিকের। মাহিদের রিকশাটা ওদের সামনে দিয়েই যাচ্ছে, আশফিক দ্রুত পায়ে এগিয়ে দাঁড় করাল ওদের, ‘কোথায় যাও রিমন?’
-‘ব্যাট বল খেলতে। খেলবেন?’ গাল চুলকাতে চুলকাতে জবাব দিলো রিমন। মূলত গাল চুলকানো আসে রিমনের বিরক্তি থেকে।
মাহি মনেমনে হাসছে৷ রিমনের পাগলামিতে যে নানাজানও সঙ্গ দেবেন ভাবেনি ও। ওকে আশফিকের থেকে দূরে রাখার কী প্রয়োজন তা বুঝে আসছে না। বাড়ির সকলের পাগলামি আর আশফিকের কাণ্ড কারখানা ভালোই মজা দিচ্ছে ওকে৷
ফোনের মধ্যে ব্যস্ত তখনো মাহি। দিব্যর পাঠানো ছবিগুলো থেকে নির্দিষ্ট একটা ছবি পছন্দ করে দিতে বলা হয়েছে ওকে। দিব্যর শখ ছিল মডেলিং করবার। কিন্তু তা পূরণ না হলেও সে মডেলিংদের মতো করে ছবি তুলতে ভীষণ পছন্দ করে৷ আর সেসবের মধ্যে সুন্দর ছবিগুলো বাছাইয়ের দায়িত্ব দিব্য ওকেই দেয়। আশফিকের নজর ঠিক ওর হাতের সেই ফোনের দিকেই।
-‘তুমিও কি ক্লাবে যাচ্ছ ওর সঙ্গে?’ প্রশ্নটা সরাসরি মাহিকেই করল ও।
দৃষ্টি তুলে দেখল মাহি ওকে। রিমনের সঙ্গে শহর অবধি যাবার পরিকল্পনা ছিল ওর। বৈঠকখানা রেস্টুরেন্টটা থেকে হট কফি পানের ইচ্ছা হচ্ছিল। সঠিক উত্তরটা দেবে না কি ক্লাবে যাবার কথা বলবে তা ভাবতে ভাবতে রিমন বলে উঠল, ‘আপু ক্লাব অবধি গিয়ে তারপর সরকারি কলেজটাতে যাবে একটু মনিকা ভাবির সাথে দেখা করতে।’
-‘রায়ান ভাইয়ার বউ?’
-‘হুঁ, কী কাজ নাকি আছে। রুমকি আপুকে আসতে বলছিল ভাবি। কিন্তু আপু আসতে পারল না বলে মা’পুকে যাইতে বলল। তা ভাইয়া আসি আমরা? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
আশফিক হুঁ, হাঁ, কোনো শব্দই করল না। কুটিল চোখে মাহিকে দেখতে থাকল৷ সেই সুযোগে রিমন রিকশাওয়ালাকে তাড়া দিয়ে বিদায় নিলো। আশফিকের আসার সেই শুরুর দিন থেকে রিমন অত্যধিক চেষ্টা করে ওর থেকে মাহিকে দূরে রাখার৷ টার্মিনালে সেদিন চা খেতে চেয়েও খেলো না কেবল আশফিকের চোখে যেন মাহি না পড়ে৷ আবার ওইদিন সন্ধ্যাতেই তো আশফিক মাহির কাছাকাছি আসতেই ও ছুটে এসে ওদের দুজনের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ল, একটা কথা বলার সুযোগও দিলো না আশফিককে। কিন্তু আশফিক তা সেদিন বুঝতে না পারলেও আজ একদম বুঝে গেছে। তবু রিমন বাচ্চা একটা ছেলে বলেই ওর সকল ধৃষ্টতা মওকুফ করে দিতে পারলেও চোখের সামনে মাহির দিনরাত ফোনের মধ্যে মুখ গুঁজে রাখাটা আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না। খাবার টেবিলে ও যতবার কথা বলতে চেয়েছে ঠিক ততবার মাহির ফোনে টুংটাং মেসেজের শব্দে বিরক্ত হয়েছে৷ কেননা ওই মেসেজের জন্যই মাহির পুরো ধ্যান ফোনের মধ্যে ছিল।
***
দিনের অবসানকাল, ধীরে ধীরে কুমারী সন্ধ্যা কুয়াশায় নিজেকে যেন আবৃত করে নিচ্ছে। মেজো শিকদারের পুকুর পাড়ের দূর্বা ঘাসের ডগায় শিশিরের কণার ঠায় মিলতে শুরু করেছে সবে।
এতক্ষণ যাবৎ ছোটো শিকদারের নাতিপুতিরা ঘাসের ওপর জাপটে বসে গল্পে মশগুল ছিল। শীতের প্রখরতা বাড়তেই সবাই তড়-বড় করে উঠে পড়ল। জারিন সাদিয়া আর অপিও বসে ছিল৷ পুকুরপাড়ের দমকা হিমেল হাওয়া গায়ে লাগলেও মন্দ লাগছে না। তৎক্ষনাৎ পুকুরের একদম কিনার ঘেঁষে বসে থাকা মাহির দিকে নজর পড়ল ওদের। ঝকঝকে দাঁতগুলো বের করে হাসছে আর দিব্যর সঙ্গে প্রণয়ালাপন চলছে। কী ভীষণ সুখী লাগছে মেয়েটাকে! এমন সুখী একটা সময় আশফিকের পাশাপাশি থাকলেও দেখতে পেত। কেন যেন দিব্য ছেলেটার প্রতি খুব হিংসে লাগছে ওদের। শত অন্যায় করুক আশফিক, শৈশবের বন্ধু বলে কথা! সেই কিশোর বয়স থেকে ফটোগ্রাফি নিয়ে কত জল্পনা কল্পনা করত ছেলেটা! আজ সে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে। অথচ সেই সময়টাতেই কিনা ফেলে যাওয়া মনের মানুষটিকে ফিরে পেতে ছুটে আসলো? তবুও যদি সৃষ্টিকর্তা ওর সদয় হন!
অপি দারুণ একটা ফন্দি এঁটে কল করল আশফিককে। আশফিক পরাগদের সঙ্গে রাস্তার পাশের দোকানে ছিল। ওকে এখানে আসতে বলে মাহিকে একা রেখেই চলে গেল ওরা৷
দোকান থেকে একদম ছুটে এলো আশফিক৷ মাহি কথা বলা শেষ করে বসা থেকে উঠে পড়তেই দৌঁড়ে এসে থামল আশফিক ওর সামনে। বাতাসে চুলগুলো উড়ে ফুড়ে এলোমেলো অবস্থা। এমনটা দেখে মাহি বিস্ময় ধরে রাখতে পারল না।
-‘আর ইয়্যু অলরাইট?’
না, একদমই ঠিক নেই আশফিক৷ চারটা বছর পর মাহির নিজে থেকে কথা বলা প্রথম বাক্য এটা। আর প্রথম বাক্যেই তাকে নিয়ে কিনা চিন্তিত মনোভাব! এটুকুতেই আশফিকের বুকে ডামাডোল হচ্ছে। এবার সে যেভাবেই হোক কথা এগোবেই।
-‘তুমি আমার প্রেজেন্সে খুবই নারাজ?’
-‘না, একেবারেই নয়।’ দৃঢ়ভাবে বলল মাহি। বিশ্বাস করে নেবার মতোই।
-‘ওয়েল, আমি তোমার থেকে আমার জন্য একাকী সময় চাই।’
ফোনে সময় দেখে নিলো মাহি। মাগরিবের আজান দিতে খুব বেশি সময় নেই। যদিও তার নামাজ নেই দু’দিন হলো। কিন্তু তবুও এমন একটা জায়গাতে দাঁড়িয়ে একদম একা হয়ে কথা বলতে চাইছে না সে আশফিকের সাথে৷ আশফিক তা ওর মুখের অভিব্যক্তিতে বুঝে নিলো৷ সেও ছাড়তে রাজি নয় মাহিকে। চট করেই ওর হাতটা টেনে নারকেল গাছের নিচে নিয়ে এলো। আর খুব কাছে এসে দাঁড়াল, যেমনটা কাছে আসতো যখন দুজনের সম্পর্কের একটা নাম ছিল। মুহূর্তেই স্মৃতিবেদনাতুর হয়ে পড়ল মাহি। অকস্মাৎ প্রবল বেগে হাওয়া বইতেই শীতে ও কুঁকড়ে গিয়ে গাছের গায়ে হেলে দাঁড়াল। দ্রুত গা থেকে লেদারসুটটা খুলে ওর শরীরে পরিয়ে দিলো আশফিক।
-‘আমি বাড়িতে ফিরে গরম কাপড় পরে নেব। এখনি যেতে চাই।’
আড়ষ্টতায় গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে নিতে নিতে বলল মাহি। স্মৃতি মানুষকে দুর্বল করে দেয়। সেখানে স্মৃতির মানুষটাই অতি নিকটে থাকলে আবেগকে ধরে রাখা বেজায় মুশকিল।
যেতে দিলো না আশফিক। মাহির গা ঘেঁষে দাঁড়াল একদম। তবুও মাহি দৃষ্টি তুলে চাইলো না ওর চোখে। না ওকে দূরে ঠেলল আর না নিজে থেকে জাপটে ধরল। এমন কাছে আসার মুহূর্ত ওদের স্মৃতি ক্যানভাসে তো কম নেই! তাই এত বছর পর আশফিকের ঘনিষ্ঠতা ওকে অপ্রস্তুত না করলেও বুকের মধ্যে ঠিকই শিরশিরানি বইয়ে দিচ্ছে। হৃদয়ভূবনে প্রথম প্রেমের মৃত্যু কখনো ঘটে না। ঘুমন্ত হয়ে আজীবন তা সহসা সহসা জেগে ওঠে। আশফিক সেই ভবনের ঘুমন্ত প্রেম৷ দিনে রাতে কতবার যে এই প্রেমিকের স্পর্শ কল্পনায় পেত! কিন্তু তা সুখের বদলে পক্ষান্তরে তা যাতনায় দিতো।
ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছে আশফিক। সীমা অতিক্রম প্রেম পাচ্ছে ওর। আচমকা গভীর ছোঁয়ায় ভীষণভাবে মাহিকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরতে ইচ্ছা করছে৷ কিন্তু বর্তমান সময়টা তার প্রতিকূলে। কোনো প্রকার ভুল করে পরিস্থিতি বিগড়ে দেওয়া যাবে না। তবে নিশ্চয়ই মাহিকে দুর্বল করা জরুরি। নয়তো যে মনের ভেতরে পিষ্ট হওয়া অভিমানকে সে মুক্ত করবে না। আর অভিমান ছুটি না পেলে ওকে কাছে টানার সুযোগ পাবে না যে।
একটু দূরত্ব বাড়ালো আশফিক দু’জনের মধ্যে। উতল হাওয়ায় ওকেও যেন অশান্ত করে তুলছে। উদ্বিগ্ন চাউনিতে মাহিকে গ্রাস করে নিতে চাইছে যেন ও। সতর্ক গলায় শুধাল ওকে, ‘এগিয়ে গেছ আমাকে ছাড়া?’
-‘লেট’স কারেক্ট, আমি কি নির্ভরশীল ছিলাম তোমার প্রতি?’ তেজোদৃপ্ত কণ্ঠ ওর। তবে চোখের ভাষা সেই আগের মতোই সরল।
-‘আমরা এক সঙ্গে ছিলাম। এতগুলো সময় পরও আমি এখনো একা।’
কথাটা বলে আশফিক একটু থামল। মাহি আগ্রহন্বাতি ওর পরবর্তী স্বীকারোক্তির জন্য।
-‘ওইদিন সময় আর তুমি দু’জনেই আমার বিপরীতে ছিলে। আমাকে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছ৷ কিন্তু আমার স্বপ্নকে না৷ তাই আমি কঠিন হতে বাধ্য হয়েছিলাম।’
শীত অনেকটাই বাড়ছে আঁধার ঘনিয়ে আসার সঙ্গে। আশফিকের গরম কাপড়টা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে দুজনের মাঝের শেষ দূরত্বটুকু ঘুচিয়ে নিলো মাহি, আশফিকের বুকের সঙ্গে মিশে গাঢ়স্বরে বলল, ‘তাহলে এখন কেন ফিরে এসেছ? এখনো তো আমার চাওয়া একই থাকতে পারে। ক্যামেরাটাকে ছুঁড়ে ফেলতে পারবে?’
কোনো উত্তর এলো না। মনোবিকারশূন্য আশফিকের ব্যথাতুর ভাসা ভাসা চোখজোড়ায় চেয়ে রইল মাহি। একটু হেসে উঠল তারপর, ‘তুমি বড্ড খামখেয়ালি ছেলে আশফি, আমি নই। তোমার পিছু ফিরবার বাজে স্বভাবটা থাকলেও আমি পিছু ফিরি না।’
বাক্যহীন আশফিক গভীর অনুরাগ নিয়ে জানাল, ‘তুমি সরল, তুমি মানুষটাই সুখস্পর্শের মতো৷ আমি তোমার এই কঠিনত্বকে বিশ্বাস করি না।’
একই সুরে অকপট স্বীকারোক্তি দিলো মাহি, ‘আমি তোমাকেও চাই না।’
বলেই চলে যাবার জন্য এগোলো। এবারও আশফি থমকে দিলো ওকে, ওর কটিদেশ জাপটে গাছের সঙ্গে মিশিয়ে দাঁড় করাল আর হাতের ফোনটাকে ইঙ্গিত করে লাগামহীন মেজাজি, কড়া সুরে জবাব চাইল, ‘তাহলে কি এই ভার্চুয়াল জগতের মানুষটাকে চাও? প্রচণ্ড বিশ্বাস অর্জন করে ফেলেছে সে?’
-‘না, তবে আমি তার বিশ্বাস অর্জন করেছি। বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে চাই৷ কেননা সে আমার ধরাছোঁয়ার খুব দূরে। বিশ্বাসে ত্রুটি পেলে না বলেই হারিয়ে যাবে।’
এই শীতেও আশফিকের গলা শুকিয়ে এলো, মাহিকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে।
-‘আমার অপরাধের মাফ নেই?’ কী ভীষণ বেদনা এই কণ্ঠে! চোখে ওর আকুল আবেদন আরেকবার ফিরে পাবার। মাহির মায়া হয় না তবু। আসক্তিহীন স্বরে মুহূর্তে জবাব দিলো, ‘করে দিয়েছি। কিন্তু তুমি যা চাইতে এসেছ তা আমি দিতে পারব না।’
-‘আমি নিয়ে নেব।’ আশফিকও এক পল ব্যয় না করে জবাব দিলো। বলতে বলতে মাহির খোলা চুলগুলোকে কানের ওপর ছড়িয়ে দিলো। যাতে শীতটা কম অনুভূত হয়।
কপাল কুঁচকে, মুখে অদ্ভুত শব্দ করে বিরক্তি আর ধৈর্যহারা ভাবটা প্রকাশ করল মাহি, ‘কী ছ্যাচড়ামো করছ আশফি! আমি কী বলছি তুমি বুঝতে পারছ না?’
নাছোরবান্দা আশফিক উত্তর দিলো, ‘বুঝতে চাইছি না।’
-‘কিন্তু আমি বোঝাতে চাই। আ’ম স্টিল ভার্জিন। আমিও আমার মতোই পূতচরিত্র পুরুষ চাই।’
অবিশ্বাস আর বিস্ময়ে আশফিক তড়াক করে পিছিয়ে এলো মাহির থেকে৷ ওর বিশুদ্ধতা নিয়ে এমন বিচ্ছিরি ইঙ্গিত দিতে পারল মাহি? বিয়ে ঠিক হবার পর কখনো কখনো নিজের নৈতিকতার কাছে হেরে অনেকবারই ওকে আদর করেছে সে, কিন্তু তবু চূড়ান্ত মুহূর্তে পৌঁছয়নি৷ তারপরও এমন নিন্দা বাণী কি তার প্রাপ্য ওর থেকে? দেশের বাইরে থাকলেই বুঝি পুরুষেরা অন্তরঙ্গ চাহিদার ব্যাপারে নিয়ন্ত্রণহারা হয়ে পড়ে? এ ভাবনা মনে আসতেই এমন সন্ধ্যায় সেই ব্রাইটন বিচে দিলিশার অপ্রত্যক্ষ আবেগী আহ্বানের কথা মনে পড়ে গেল। এবার ঠিক লজ্জা লাগল ওর। তবে সেদিনের সেই ভুল হতে গিয়েও না হওয়া মুহূর্তটাই তো ওকে তীব্রভাবে উপলব্ধি করিয়েছে, আপন দেশটাতে ফেলে এসেছে যাকে সেই ওর সকল ছোঁয়ার অধিকারী। আর কেউ নয়। তারপরই তো সেখানে আবার সব ফেলে ছুটে এলো। জোরাল প্রতিবাদ জানাল ও, ‘তোমার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা যৌবনের টান বোঝার পর থেকে তার সৎব্যবহার শুধু তোমার সাথেই করেছে। না জেনে তুমি আমাকে এই জঘন্য, অরুচিকর ব্যাপারে ব্লেম দিতে পারো না।’
-‘এ ব্যাপারটা মোটেও জঘন্য, অরুচিকর নয় আশফি। আমার কনফিডেন্স হাই স্টেজে আছে৷ আজ অবধি আমি আমার দ্বারাও নিজের সতীত্বে দাগ বসাইনি। কিন্তু তুমি এমন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারবে না যে তোমার ভেতরের আদিমতাকে দমিয়ে রাখতে পেরেছ? আর তুমি বললেই কি আমি বিশ্বাস করব? এ ছাড়াও তোমাকে না বলার লজিক অঢেল।’
-‘তোমার কথা সংযত নেই মাহি। অতি মাত্রায় অসভ্য হয়ে গেছ তুমি। তাই এমন লেইম ব্যাপারকে টেনে এনে আমাকে এড়াতে চাইছ।’
-‘না আশফি। তোমার কাছে এ বিষয় লেইম, আমার কাছে মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট।’
মেজাজ আবারও লাগাম ছাড়া হয়ে পড়ল আশফিকের। তেড়ে গিয়ে মাহির হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে হুঙ্কার দিয়ে বলল, ‘এই দিব্য পূতপবিত্র খুব? এগারো হাজার কিলোমিটার দূরে থাকা ছেলেটার সঙ্গে না মিশে কেবল রাত দিন কথা বলে আমার থেকেও বেশি বিশ্বস্ত হয়ে গেল, বাহ্! কী দারুণ!’
-‘ওকে টানছ কেন? কথা হবে শুধু আমার তোমার ব্যাপারে। তবে যেহেতু ওর ভার্জিনিটি নিয়ে প্রশ্ন তুললে উত্তর তো দিতেই হয়৷ আমি জানি ও কেমন। জেনেশুনেই এগিয়েছি আমি। যেমনটা আমার চাই ও তেমনটাই।’
হিতাহিত জ্ঞান ভুলে আশফিক মাহির ডান বাহু চেপে ধরে কাছে আনল, ‘ভিডিয়ো চ্যাটে প্রমাণ দিয়েছে না কি ওর ভার্জিনিটির? কীভাবে? আমাকেও বলো আমিও দিই!’
-‘সে বিষয়ে তোমাকে কেন বলব? তোমার ভার্জিনিটির প্রমাণ আমার চাই না। যত পদ্ধতিতেই প্রমাণ দাও না কেন? আমার এক কথা, যা একবার অন্য মেয়ের… ‘
-‘এই মেয়ে!’
উচ্চস্বরেই ধমকে উঠল আশফিক। মাহির থেকে অমন বাক্য পুরোটা শোনার ধৈর্য, ক্ষমতা, ইচ্ছা, কোনোটাই নেই।
-‘ছিঃ! কতটা অসভ্য হয়ে গেছ তুমি! এমন কথা আর চিন্তা আসে কীভাবে? তুমি তো এমন ছিলে না!’
-‘আমি এমনই ছিলাম, চরম অসভ্যও ছিলাম। সেই অসভ্যতা শুধু বৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। তুমি সে সুযোগ দাওনি, তাই তোমার জানাও হয়নি।’
কথাগুলো বলেই আশফিকের পায়ের পাতার ওপর ভর দিয়ে দাঁড়াল সমান উচ্চতার হতে। এরপর ওর কানেকানে ফিসফিস করে বলল, ‘আমি অসভ্য ছিলাম বলেই তুমি ঠোঁট ছেড়ে আমার কণ্ঠ অংশ থেকে আরও গভীরে তোমার এই ঠোঁট ছোঁয়াবার প্রশ্রয় পেয়েছিলে।’
মাহির কথা বলবার ঢংটায় যথেষ্ট ছিল আশফিককে উত্তেজিত করবার। আরও সেই পুরোনো দিনের আশকারা পাবার আদরঘন মুহূর্তগুলো মনে পড়ে যাওয়া! বেসামাল হতে চায়নি আশফিক৷ মাহিকে দু’হাতে বেষ্টিত করার পূর্বেই মাহি দূরে সরে এলো, এমনকি দাঁড়ালও না। নির্বাক চাহনি ছুঁড়ে চেয়ে রইল মাহির যাবার পথে। মাহি মধ্যপথে থামল আবার, পেছনে ফেলে আসা মানুষটির দিকে ফিরে বলল, ‘দিব্য আমাকে খোঁজেনি, আমি দিব্যকে খুঁজেছি। তুমি চলে যাও আশফি। আমি আর ফেরার পথে নেই।’
ইসরাত জাহান দ্যুতি
এডিট করা হয়নি। লেখার সময়ই পাই না। আপনারা কিন্তু মন্তব্য করতে ভুলবেন না।
ছবি আঁকিয়ে – সুমাইয়া আক্তার মনি ❤️