রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ১০

0
420

রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ১০
___________________________

[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]

সালাম শিকদারের মুখে মেঘের ঘনঘটা। আরাম কেদারায় শয্যিত শরীরটাতে কাল অবধিও ফুরফুরে আমেজ ছিল।

মধ্যাহ্নভোজের পর্ব শেষ হতেই আগমন ঘটল মাহির বাবা আর ভাবির। তাতে মনেমনে খুশির অন্ত ছিল না তার। বড়ো মেয়েটা মারা যাবার পর থেকে বড়ো জামাইয়ের দেখা পাওয়াই যায় না তেমন। এই যে তেরো-চৌদ্দ বছরের মাঝে মাত্র তিনবার এলেন জারিফ শশুরবাড়িতে। নাহিয়ানটাও বিয়ের পরপর আসা-যাওয়া একেবারেই বাদ দিয়ে দিলো। আগেও যে খুব একটা আসত তা না। অনেকগুলো দিন পর ওদের এক সাথে পেয়ে প্রফুল্লচিত্তেই ছিলেন তিনি৷ কিন্তু বিকাল হতেই সে সতেজ মেজাজে ভাঁটা পড়ল তার বড়ো জামাইয়ের কথাবার্তাতে।

ঘরে এ মুহূর্তে ছ’জন মানুষের আলোচনাসভা বসেছে। শিকদার সাহেবের দুই ছেলে হাবিব আর রামিম, দুই নাতি নাহিয়ান আর রায়ান এবং তিনি ও জারিফ। রুমকি আর রায়ানের বিয়ের সময় হাতে আছে আর মাত্র তিন দিন। এত জলদি আসার মতো মনস্থির করেনি জারিফ গতদিনও। কিন্তু হঠাৎ না হওয়া আত্মীয় তবে ভালো বিজনেস পার্টনার জাওয়াদ রায়হানের সিদ্ধান্তে না এসে উপায়ও ছিল না।

জারিফের একটা কথাতেই সবার মুখভঙ্গি বদলে গেছে ইতোমধ্যে। আপাতত মৌনতা বিরাজ করছে সকলের মাঝে। নাহিয়ান চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি এসেছে কিছুক্ষণ আগে। এসেই নানাজানের ঘরে আলোচনাতে বসতে হলো। ভাবনাতে পড়েছিল সেও, বাবার হঠাৎ সিদ্ধান্তে। সে চিন্তার ইতি ঘটিয়ে গলার টাইটা ঢিলা করতে করতে নীরবতা ভাঙল, ‘জাওয়াদ আঙ্কেল কখন আসবেন এখানে?’
গুরুগম্ভীর গলাতে জারিফ উত্তর দিলেন, ‘পরশুদিন।’
-‘এ আলোচনা বিয়েটার পরে করলে হতো না?’
-‘ভেবেছিলাম তো তেমনই৷ আশফিকের তাড়াতে এগোতে হলো৷ এ বিষয়ের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানতে চাইছে সে শীঘ্রই।’
মুখ খুললেন শিকদার সাহেব, ‘কী আলোচনা করবা আর! সিদ্ধান্ত তো নিয়েই নিছো। মেয়ে যহন দিবাই তয় আর দেরি কইরে কী করবা? বিয়ের একখান ডেট ফেলায় দেও কথাবার্তা কয়ে।’

সকলেই বুঝতে পারলেন শিকদার মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। জারিফের সিদ্ধান্ত তার পছন্দ হয়নি। কিন্তু তার মতামত না পেলে কেন যেন স্বস্তিও পাচ্ছেন না জারিফ। মাহির দাদা-দাদী কেউ বেঁচে নেই। তার নিকটাত্মীয় বয়োজ্যেষ্ঠ বলতে শিকদার সাহেবই শুধু। মাহির মা বেঁচে থাকতে এ বাড়িতে যখন আসা হতো, তখন জারিফের প্রতি শিকদার সাহেবের নিখুঁত যত্নআত্তি চোখে পড়ার মতোই ছিল। তাই জারিফও তাকে সরাসরি জন্মদাতার স্থান দিতে না পারলেও অন্তরে তার পরের আসনই দিয়েছেন শশুরকে। সে হিসেবে শশুরের মতামতও খুব জরুরি তার কাছে। তাই তো জাওয়াদ ছেলের হয়ে আবারও প্রস্তাব রাখার পর তিনি দেরি না করে ছুটে এসেছেন শশুরের ভিটেতে।

-‘আব্বা, সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে নিলে তো এখানে আসার দরকার পড়ত না। আমি আমার তরফ থেকে মতামত জানাইনি এখনো। সম্পর্ক আবারও করলে মন্দ হবে কি না এটা নিয়েই তো আলোচনা করতে এলাম। আশফিক দেশে আসার পরই আমার কাছে এসে মন থেকে মাফ চেয়েছে সে তা বুঝতে পেরেছি। বয়স ওরই বা কতটুকু ছিল তখন! আমার নাহিয়ানকেই তো বিয়ে দিলাম উনত্রিশ বছর বয়সে। সেখানে আশফিক তখন সদ্য অনার্স পাস করা বেকার ছেলে ; তাও আবার এ যুগেরই ছেলে হয়ে অত জলদি সংসারের যাঁতাকলে কি পড়তে চায়? অল্প বয়স, উড়ুউড়ু মন ছিল, হঠকারীর মতো একটা কাজ করে বসেছিল। তাও তো আপনার নাতনির জন্য অন্য ছেলে দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে আর কারও সাথে দেখা করতেই ইচ্ছুক হলো না। শেষমেশ ওর ইচ্ছা হলো পাইলট হবার। ওর সিদ্ধান্তকেই মেনে নিলাম৷ তাই বলে তো আজীবন কুমারী হয়ে থাকবে সেটা মানা যায় না।’

এদের মাঝে রায়ান, হাবিব আর রামিম তাদের নিশ্চুপ থাকাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে বেশি। আসল সিদ্ধান্ত বা মতামত তো নেবেন জারিফ আর শিকদার সাহেবই। তারা কেবল নামমাত্র অভিবাবক কিনা! তবে নাহিয়ান অনেক কিছু বলতে চায়। শুধু বাবা আর নানাজানের কথা শেষ হবার অপেক্ষায়।

-‘আমিও মানতেছি না যে মাহিয়ান আবিয়াত্তা থাকব। বিয়ে হইল, কিন্তু আমার কতা হইল আশফিক যে আবারও ওইরহম হুটহাট সংসারধর্ম ফেলায় থুইয়া দ্যাশে-বিদ্যাশে সফর কইরে বেড়াবিনে তার কি নিশ্চয়তা? তুমারে কি জাওয়াদ কইছে ওর ছেলে আর দ্যাশ ছাড়ব না?’
-‘না, এমন কিছু বলেনি। কিন্তু আশফিকের বর্তমান পেশাটাই নাকি লন্ডন। সেই সূত্রে তো ওকে যেতেই হবে ওখানে।’
-‘মানে সে বাপের ব্যবসায় সামলাইবে না, মাহিয়ানরে নিয়ে যাবি অহানে?’
-‘এ বিষয়ে কোনো আলোচনায় হয়নি, আব্বা।’
নারাজ গলায় এবার তাই শিকদার বললেন, ‘না বাপ, আমি আর এহানে ভরসা পাইতেছি না। সম্বন্ধ এইবার করবার চাইলি আগে সক্কল বিষয়ে আলাপ আলোচনা কইরে নেও। আশফিকরে সহ বসায়ে কথাবার্তা কবা জাওয়াদের সাথে। ভালোভাবে সংসার করবি আশফিক, এরাম নিশ্চয়তা দিবি জাওয়াদ। তারপর বিয়ের সিদ্ধান্ত।’

সালাম শিকদারের শেষ জবান এটাই৷ জারিফের গাম্ভীর্যপূর্ণ মুখটা দেখে বোঝা গেল শশুরের কথাতে তিনিও সম্মত। এবার কথা বলা যায় ভেবেই নাহিয়ান নরম সুরে জবাব চাইবার ভঙ্গিতে বলল, ‘আর মাহিয়ানের কোনো সিদ্ধান্ত আছে কি না জানবেন না? আশফিক তো এসেছে এখানে তিনদিন হলো। মাহিয়ান ওর সঙ্গে আগের মতো স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলে বা মেনে নিয়েছে কিনা ওকে, তা কি আমরা জানি? রায়ান তো দেখেছিস এ ক’দিন ওদের। কী মনে হলো তোর?’

চেয়ারে বসে বুকের ওপর হাত মুড়ে রায়ান নত দৃষ্টিতে ছিল। নাহিয়ানের প্রশ্নে অপরিবর্তনীয় ভঙ্গিতেই নিজস্ব কায়দায় কেমন ঠোঁট বাঁকাল, ‘আশফিকের আশেপাশেই ঘেঁষতে চায় না। যেখানে ওর উপস্থিতি সেখানে মাহিয়ান নেই। কথাবার্তা আশফিক বলতে চাইলেও ভদ্রতা দেখানোর জন্য যতটুকু বলা উচিত আর কী সেটুকুই বলে! রুঢ় ব্যবহার করতে দেখিনি অবশ্য আশফিকের সঙ্গে।’

মাহি স্বভাবই শান্ত ধারার মানুষ৷ রাগ, জিদ, সবই সে ভেতরে ভেতরে জিইয়ে রাখে চিরকালের জন্য। আর এ সকলের প্রকাশ ভঙ্গিও তার আলাদা৷ তাই বোঝার উপায় নেই, যে আদতে সে সব কিছু ভুলে গিয়ে সহজ হয়েছে কি না! এমন মানুষই হয় সব থেকে বেশি বিপজ্জনক। রাগ, ক্ষোভ পুষে রাখা মানুষ সর্বসম্মুখে শীতলতা দেখিয়ে অন্তরে অন্তরে ধ্বংসাত্মক মনোভাব পুষে রাখে। কে জানে মাহিয়ানও এমন ধারার মানুষ কি-না!

নাহিয়ান বাবা আর নানার মুখের দিকে পরপর চেয়ে তার আসল সিদ্ধান্ত জানাল এবার, ‘আমরা এই সম্পর্ক আবার গড়তে চাইছি একরকম নিজেদের স্বার্থেই। এ কথা অনস্বীকার্য নয়৷ জাওয়াদ আঙ্কেল এতবার করে মাফসাফ চেয়ে যেভাবে মাহিকে হাত পেতে চাইছে ছেলের জন্য, তাতে আমরা পিছু হটলে তার সাথে সম্পর্কে মরিচা ধরবে নিশ্চিত। কিন্তু ব্যবসায়িক স্বার্থ ভাবতে গিয়ে আমাদের ঘরের মেয়েকে সারাজীবনের জন্য অসুখী করে দেবো না তো? ভেবে দেখো আরেকটু তোমরা। ছোটো জীবনটাতে সবাই-ই আমরা ভালো থাকতে চাই। মাহিয়ানকে আশফিক রিজেক্ট করার পর ও যে নিজেকে সামলে নিতে পারবে সেটা কি আমরা চিন্তা করেছিলাম? আমরা তো ভেবেই নিয়েছিলাম মাহি ডিপ্রেশনে চলে যাবে। কিন্তু নিজেকে ও দৃঢ় করতে পেরেছে বলে যে আবারও সেই আশফিককে সহজে গ্রহণ করে নেবে, এমনটা ভাবা উচিত নয়। ওর মনে কী চলছে অ্যাটলিস্ট সেটা জেনে তারপর না হয় আঙ্কেলকে মতামত দিই। তাছাড়াও আশফিকই বা কতটুকু মাহিয়ানকে মানাতে পারে, ওর ধৈর্য কতটুকু সেটাও দেখি আমরা। তাহলেই না বুঝব আমার বোনকে ও সুখী রাখতে পারবে।’

বিরতিহীন কথাগুলো বলে নাহিয়ান লম্বা একটা শ্বাস ছাড়ল। তবে ওর কথাতে রায়ান মাথা ঝুলিয়ে সম্মতি দিলো। হাবিব আর রামিমও বোধ হয় একমত হলেন, তাদের চেহারা দেখে বোঝা গেল।

জারিফ শশুরের দিকে তাকালেন, শিকদার সাহেব খুব বেশি সময় না নিয়ে অভিমত দিলেন, ‘হ, কথাগুলান ঠিক কইছিস। মেয়ে বড়ো হইছে, আল্লাহই ভালো-মন্দ বুঝার জ্ঞানও দিছে। সিদ্ধান্ত নাহয় ওরেই নিতে দেই। খালি তো ব্যবসার চিন্তা করলিই হবিনে, যদি নিজেগের মেয়েই না ভালো থায়ে।’

কী বলবেন জারিফ বুঝতে পারছেন না৷ মেয়েকে ভালো একটা জীবন দিতে অসম্ভব চিন্তিত তিনি। মাহিয়ানের কঠোর ব্যক্তিত্ব প্রশংসনীয় হলেও তার কাছে তা চিন্তারই। বেপরোয়া, একরকম লাগামহীন স্বাধীন জীবনযাপন করছে তার মেয়ে৷ এমন বিপদগ্রস্ত জীবন অতিবাহিত করতে দেবে না বলেই তো চার বছর পূর্বে জাওয়াদের দেওয়া প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। যাতে করে সমাজের বাকি পাঁচটা মেয়ের মতো তার মেয়েটাও সাধারণ জীবনযাপন করতে পারে। একটা মাত্র মেয়ে, তাকে রাখবেন সুখের চাদরে মুড়িয়ে। বিয়েও দেবেন তেমন ঘরেই যেখানে ভোগ-বিলাস, আনন্দ আর প্রকৃত সুখের অভাব হবে না। কিন্তু তা আর পারলেন কই? আমেরিকাতে এক বছরের ট্রেনিং সফলভাবে সম্পন্ন করে তার পরের বছরই সামরিক পাইলট হিসেবে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগদান করে। বিশেষ একটি কারণে ওর পেশার গোপনীয়তা রক্ষা করে সব জায়গাতে মিথ্যা প্রকাশ করা হয় যে, পাইলট হতে জানুয়ারি থেকে ট্রেনিং শুরু করবে সে। বিস্তারিত সত্য তথ্যগুলো শিকদার বাড়ির অনেকেই জানে না এখনো। এমনকি জাওয়াদ পরিবারও নয়। ছুটি হাতে আর খুব বেশিদিন নেই মাহির। যে-কোনো সময় হয়তো আবার চলে যাবে কর্মজগতে। তার আগেই বিয়ের কার্যটা সাড়তে পারলে নিশ্চিন্ত হতেন তিনি। তবে এ কথাও ফেলে দেওয়া যায় না। যাকে সুখী রাখবার জন্য এত ভাবনা, সে-ই যদি আশফিককে মানতে না চায়?

***
মাঝে একদিন খুব সহজে কেটে গেল। আশফিকের বন্ধুমহলকে এই একদিনে কোথাও দেখা যায়নি। রুমকি থেকে খবর পেয়েছিল মাহি, আশফিক গত পরশু সকালেই বন্ধুগুলোকে নিয়ে ফিরে গিয়েছে মোহাম্মদপুর, নিজের দাদাবাড়ি। তবে আজকে ফিরবার কথা ওদের।

শিকদার বাড়ির মস্ত উঠানটাতে প্যান্ডেল বাঁধা হয়ে গেছে, বিয়ের বিশাল গেটটা সাজসোজ্জায় পরিপূর্ণ। রাত হলেই রঙিন মরিচা বাতিগুলো সারা বাড়িতে জ্বেলে দেওয়া হয়। বাইরে থেকে শিকদার বাড়িটা দেখায় তখন অদ্ভুত সুন্দর। যেন কল্পনার পরীরাজ্য।

মাহির বিয়ের ব্যাপারটি জারিফ ফোনেই কথাবার্তা বলে জাওয়াদকে জানিয়েছেন এ বিষয়ে ঢাকা ফিরে আলোচনা করবেন তিনি। তাই মাহিকেও জানানো হয়নি আশফিকের চতুরতার গল্প। তবে আজকের মধ্যে ওদেরকে শিকদার বাড়িতে আসার নিমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

কিচিরমিচির আওয়াজে পাখিগুলো সাঁঝ সাঁঝ রব তুলে যখন কুলায় ফিরছে, তখনই দুইটা গাড়ি এসে পরপর থামল শিকদার বাড়ির বিশাল সজ্জিত গেটটার সামনে। আশফিকের বন্ধুগুলো আগে বেরিয়ে এলো, তারপরই দেখা পাওয়া গেল আশফিকের বাবা-মা’কে। বাড়ির মধ্যে এ মুহূর্তে জাওয়াদ ও তার স্ত্রী আসমানকে নিয়ে হইচই পরিবেশ। বিয়ে বাড়ির আমেজ আগে তো কম ছিল না, এখন হলো বাড়াবাড়ি। সকলে প্রায় ধরেই নিয়েছে আবারও হবু আত্মীয় হতে চলেছে জাওয়াদ পরিবার । এবং তাদেরকে থাকবার জন্য মেজো শিকদার বাড়িতে পাঠানো হলো, যাতে হুল্লোড় পরিবেশ ছাড়া শান্তিতে বিশ্রাম নিতে পারেন তারা।

এত আনন্দ এত কোলাহলপূর্ণ, তবুও শূন্য শূন্য একটা অনুভূতির প্রশ্রয় মাহির অন্তঃপুরে। চারপাশ ঘুরেফিরে দেখে সেই শূন্যতার অর্থ ধরতে পারল আশফিকের অনুপস্থিতি টের পেয়ে। ধিক-ধিক করে বক্ষঃস্থলে ক্রমাগত ভাবনার রেশ জেগে উঠল তখন। এবং এতক্ষণে আন্দাজ করল, জাওয়াদ সাহেব যেহেতু উপস্থিত হয়েছেন তাহলে তা সাধারণ কোনো কারণে নয়৷ নিশ্চয়ই তা আশফিকের সঙ্গে পাকাপোক্ত সম্পর্কে জুড়ে দেবার আবদার ধরতেই এসেছেন৷ আর এর পেছনের কলকাঠি নাড়ছে আশফিক, তাতে আর সন্দেহের জো নেই। এত এত কূটনৈতিক, রাজনৈতিক কাণ্ডগুলো করলেই বা কী! ক্যাডেট পাইলট মাহিয়ান কি আর কারও ধরা-ছোঁয়ার মাঝে আছে? সেসব ভেবে মনেমনে হাসল মাহি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া জানায় সে অফুরান। তিনি খেলার চাল কখনো এক পক্ষকে দিতে দেন না। দ্বিতীয় পক্ষের হাতেও গুটি তুলে দেন। মাহি শুধু সুযোগ বুঝে সে গুটির চাল সঠিকভাবে দেবার অপেক্ষায়।

***
বড়ো শিকদারদের পাঁচতলা বাড়িটা ইঞ্জিনিয়ারের সাহায্যে করা আধুনিক ডিজাইনে তৈরি৷ ওপরের তিনতলা ভাড়াতে। আর নিচের দো’তলা নিজেদের ব্যবহারের জন্য। বাড়ির পেছন দিকে নানারকম গাছগাছালির বাগান বলে তাই প্রতিটা ঘরের বেলকনি পেছন দিকেই।

দূর আকাশে চলতে থাকা প্লেনের লাল নীল আলোর নেভা-জ্বলার এই সাধারণ দৃশ্যও মাঝেমধ্যে মনোযোগ কেড়ে নেয়, আবার মিটিমিটি তারার মেলার মাঝে প্লেনের এই চলাফেরাও কিন্তু কাউকে কাউকে মুগ্ধ করে। যেমন করত মাহিকে। আর আজকে সে ওই আকাশেই বিচরণ করে রাত-দিন, যখন তখন৷ তবে অনুরূপ আশফিককেও পাশের ঘরের ছোট্ট বেলকনিতে হঠাৎ দেখা যাবে , কল্পনাতীত ছিল।
-‘জিন পরীর মতো আবির্ভাব ঘটছে দেখি তোমার। এই আছ এই নেই।’
মাহির মৃদুস্বরের অকস্মাৎ আওয়াজ আশফিককে চমকেই দিলো বটে। মন সুদূর আকাশ কিনারাতে গেঁড়ে ছিল যে।
-‘তো তোমার পঙ্খীরাজ সরাসরি এ বাড়িতে এসে ল্যান্ড করেছে? আগে বলবে না! তাই তো বলি, কুচক্রী ছবিওয়ালা ব্যাটা কোথায় ঘাপটি মারল৷ ও বাড়িতে যে ওরা তোমাকে চেরাগ জ্বালিয়ে খুঁজছে।’

কোনো কথা বলছে না আশফিক। এমন চুপচাপ কি ওকে মেনে নেওয়া যায়? ওকে কেমন অদ্ভুত লাগছে গত পরশু থেকে। কেমন করে চেয়ে আছে দেখো! যেন নেশা চেপেছে মাথায়। নিঃসন্দেহে বিচ্ছিরি কোনো ফন্দী আঁটছে অভদ্রটা। খাদে নামানো গলাতেই চাপা ধমক দিলো ওকে, ‘ওই! অমন খিচ মেরে আছ কেন? চোখ নামাও বলছি! লুচ্চা নজরে অন্যদের দেখবে, আমাকে না।’
-‘কী আশ্চর্য! আফ্রিকার আদিবাসীদের মতো হেই হই, হেই হই করছ কেন? নরম গলায় কথা বলতে ভুলে গেছ? কানাডিয়ান ছেলেটার সাথেও দেখি কেমন ধমকা ধমকি করে কথা বলো। কোমলতা হারিয়ে গেছে না কি?’
-‘আমার কথাবার্তা, ভয়েজ টোন নিয়ে অত বিশদ বিবরণ শোনানো লাগবে না তোমার৷ ওয়ার্নিং দিচ্ছি, নিজের লিমিটেশন খেয়াল রাখবে৷ দাওয়াত খেতে এসেছ, সোজা দাওয়াত খেয়ে বিদায় নেবে। কাল সকাল সকাল ও বাড়িতে যেয়ো। তোমাকে ওদের প্রয়োজন।’
-‘আমাকে? কেন? আর তুমি ওই বেলকনি থেকে আমার বেলকনিতে এসে তোমার আজেবাজে কথাগুলো বলো। এমনিতেই কম দূরত্ব নেই আমাদের মধ্যে। মাঝের এই গ্রিলকে আরও ভারত বাংলাদেশের তাড়কাটা বর্ডার লাগছে।’

পাত্তা দিলো না মাহি৷ যতটুকুও বা এগিয়ে গিয়ে কথা বলছিল, এবার একদম কোণায় চেয়ার টেনে বসল। ফোনের স্ক্রিনে নজর বিদ্ধ করে বলল, ‘রুমকি তোমাকে ওর বিয়ের প্রতিটা মুহূর্তের ফটোগ্রাফি করতে বলেছে। তোমার তোলা ছবি নাকি দারুণ হয়। তাই ও জেদ ধরেছে কোনো ক্যামেরাম্যান নয়, ছবি তুললে তোমার ক্যামেরা থেকেই ছবি তুলবে ও।’ বলতে বলতে ঠোঁটে দুষ্টু হাসি সাজিয়ে রেখেছিল।
কথাগুলো শুনে আশফিক তেড়েমেড়ে শুধু এগোতেই পারল না, হুঙ্কার ছেড়ে উঠল, ‘তুমি আমার প্রফেশন আমার প্যাশনকে অপমান করলে মাহি? আমি ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি করি। ওয়েডিং ফটোগ্রাফি না। আর তোমরা রীতিমতো আমাকে কেউ ফ্যাশন ফটোগ্রাফি করতে বলছ, কেউ ওয়েডিং ফটোগ্রাফি! কারও কাজকে কি এভাবে নিচু করা উচিত?’

ইশ! ছেলেটা দিলে খুব চোট পেলো বোধ হয়। ভাবতেই আবারও হেসে ফেলল মাহি, ‘ফ্যাশন ফটোগ্রাফি? মানে আঙ্কেল অফার করল না কি?’
-‘হ্যাঁ, তোমার আঙ্কেলই। তিনিও প্রায়-ই ফোনে নেগলেক্ট করে বলতেন তার কোম্পানির মডেলের ফটোগ্রাফিগুলো করে দিতে। তুমি, তোমরা সেদিনও আমার স্বপ্নকে ভালোবাসোনি আর আজও না।’
-‘তাহলে আবার এসেছ কেন?’ সম্মুখাভিমুখে তিগ্ম দৃষ্টি ছুঁড়ে শুধাল।
ওর প্রখর রৌদ্রের মতো দাহজনক চোখজোড়াতে চোখ রেখে আত্মবিশ্বাসী সুরে বলল আশফিক, ‘আজ রাতে তা জানাব। একটু পরেই পরাগ সবাইকে নিয়ে এ বাড়িতে আসছে। এ বাড়ির সবাই ও বাড়িতে বলে লেট নাইট অবধি আজ ওরা মুভি দেখার প্ল্যান করেছে। তোমাকে, আমাকে তার আয়োজন করতে বলল।’
কান থেকে ইয়ারফোনটা খুলে চেয়ার ছেড়ে উঠল মাহি, ‘বেশ তো, চলো তাহলে।’

পেইজের রিচ একদম ডাউন। আপনারা যদি লাইক কমেন্ট না করেন অনেকের কাছে ধারাবাহিকটা পৌঁছবে না। অন্তত উপকার করার উদ্দেশ্যে এটুকু করবেন আশা করছি।

ইসরাত জাহান দ্যুতি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here