রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ১৪
___________________________
[ প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
গাজীপুর জেলার বলিয়াদী জমিদার বাড়ি দর্শনীয় স্থানটিই নির্ধারিত হলো আশফিক, দিলিশার ফটোশুট আর ভিডিয়োশুটের জন্য। চনমনে আবহাওয়া দেখে আশফিকের দলটা আপাতত বাঘেরবাজার সাবাহ গার্ডেন রিসোর্টে থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। আবদারটা এসেছিল দিলিশার পক্ষ থেকেই৷ দেশের কত জায়গা তার এখনো অদেখাই থেকে গেল৷ অন্তত রিসোর্টে সতেজতাপূর্ণ গ্রামীণ পরিবেশটা মিস করতে চাইল না সে। এ সুযোগটা ঐশীও হাতছাড়া করল না। ঠিক করল শুটের পর তারা অন্তত দুটোদিন ঘুরেফিরে যাবে এখানে। আশফিকের ওপর দায়িত্ব পড়ল কটেজ বুকিং দেবার।
গাজীপুরে আসবার পথে সব থেকে বেশি আনন্দ করল দিলিশা আর ঐশীই। মাহি সেখানে অনুপস্থিত। সে বলেছিল শুট করবার আগ মুহূর্তেই এসে পৌঁছবে। নাহিয়ান আর ঐশী অনেক জোরজুলুম করল তাদের সঙ্গেই যাবার জন্য৷ রাজি করানো যায়নি তাকে। সে সময় আশফিকও বিরক্তি নিয়ে জানিয়েছিল, ‘অদ্ভুত তো! এত পিড়াপীড়ির কী আছে? ওর যখন মন চাইব তখনই না হয় আসুক। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।’
ঐশীর জন্য নাহিয়ান আশফিককে শক্তভাবে কিছু বলতেও পারছে না। বোনকে প্রত্যাখ্যান করার সেই বিচ্ছিরি অপমানসূচক ঘটনা সম্পর্কে সে ঐশীকে জানতে দেয়নি আর দিতে চায়ও না।
বেলা পড়ে যেতেই ফ্যাশন ফটোগ্রাফার ওদের জানান আগামীকাল শীতের সকালে মিষ্টি রোদ্দুরেই প্রথম ফটোশুটটা করতে চান তিনি। মাহি যেহেতু ইচ্ছা পোষণ করেছে আশফিক আর দিলিশার কিছু ফটোগ্রাফি সে করবে তাই আশফিক নাহিয়ানকে বলল সে যেন মাহিকে আজ রাতের মধ্যেই চলে আসতে বলে। নয়তো খুব ভোরে। যাতে করে সকালের প্রথম রৌদ্ররশ্মি মাহি ক্যামেরাতে ধারণ করতে পারে।
আকস্মিকভাবে মাহিকে কল করার পূর্বে সে-ই ভাইকে কল করে জানায়, রাতের মধ্যে চলে আসছে সে। আশফিক আর মাহির হাবভাবগুলো সকলের কাছে সহজ স্বাভাবিক লাগলেও যারা একটা সময় এই দুজন মানুষের মিষ্টি মধুর প্রেম দেখেছে তাদের কাছে মোটেও কোনো ব্যাপারই স্বাভাবিক লাগছে না৷ কোথাও না কোথাও একটা ঘুলঘুলি থেকেই যাচ্ছে৷ আর সেটা না ধরতে পারছে দিলিশা, না পারছে নাহিয়ান। মাহির আসবার খবরটা সবাইকে জানিয়ে নাহিয়ান আশফিককে বলল ওর জন্য একটা রুম বুকিং করে রাখতে
***
রিসোর্টের মনকাড়া, আকর্ষণীয় কেন্দ্রবিন্দু হলো পাঠাগার। বিশ্ব বিখ্যাত লেখকদের বইগুলোর সমারোহ স্বচোখে দেখবার জন্য দিলিশা সন্ধ্যার জলখাবার সেড়েই সেখানে ঢুকে পড়ে৷ বেছেবেছে একটা বই নিয়ে বসল।
আসবার আগে খুব করে চেয়েছিল আশফিককে সঙ্গে আনতে। কিন্তু ওকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হলো হঠাৎ, এড়িয়ে গেল তাকে। দেশে আসার পর থেকে আশফিকের অবজ্ঞা, অবহেলার শিকার হচ্ছে সে বারবার৷ বোঝা যায়, পুর্নবার মাহিকে ফিরে পেতেই ঝকঝকে, উজ্জ্বল ক্যারিয়ারটা ছেড়ে চলে এসেছে সে। নিঃসন্দেহে দিলিশা হবে তবে তাদের মধ্যে একজন বহিরাগত অতিথি মাত্র৷
সে মুক্তমনা মানুষ। রক্তে তার বাঙালিয়ানা বটে তবে আভিজাত্যে সে বৃটিশ। মায়ের আদর্শেই বেড়ে ওঠা। কিন্তু মনেপ্রাণে সে নিজের বাবার মতো একজন খাঁটি বাঙালি প্রেমিক মানুষকে জীবনসঙ্গিনী চায়। তাই তো বছর ছয় আগে প্রথম যখন আশফিকের সঙ্গে পরিচয় হয়, মনপুরীতে সেদিন থেকেই ওকে জায়গা দিয়ে ফেলেছিল। শুধু দুর্ভাগ্রক্রমে পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকতে গিয়েই সেবার হারিয়ে ফেলতে বসল আশফিককে। ভাবেনি দ্বিতীয়বার ওকে ফিরে পাবার সুযোগ করে দেবেন বিধাতা৷ আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে সে দীর্ঘ চারটা বছর, ভালোবাসায় আচ্ছন্ন করতে আশফিককে। হয়তোবা ক্ষণিকের জন্য হয়েছিলও আশফিক। আর হয়েছিল বলেই তো না সেই নীল আকাশ তলে আর নীল সমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে নীল শাড়ি পরিহিতা বর্ণনাতীত রূপসী তাকে কাছে টেনে নিয়েছিল।
প্রাচ্য লন্ডন থেকে নাহুন সমুদ্রসৈকতে গত কয়েক মাস আগে আশফিক বন্ধুদের নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছিল। দিলিশা ওদের মাঝে একজন মাত্র নারীই সেখানে। অভিসন্ধি ছিল ওর, এবারই আশফিককে প্রণয় প্রস্তাব জানাবে ও। বাকি বন্ধুদের সঙ্গে সমস্ত পরিকল্পনাও করে রেখেছিল আগে থেকেই।
ওদের জাহাজটা যখন বড়ো বড়ো তরঙ্গমালার মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে, সবে সায়ংকাল তখন। বরাবরের মতো ক্যামেরাটা হাতে আশফিক ঝিকিমিকি করা একটা দু’টো নক্ষত্র জেগে ওঠা আকাশটাকেই ক্যামেরা বন্দি করছিল জাহাজের অগ্রমুখে দাঁড়িয়ে।
হাতা কাটা ব্লাউজের সাথে ফিনফিনে নীল শাড়ি, আঁচল দীর্ঘ করে নামিয়ে দেওয়া, খোলা চুলোগুলো কাঁধের এক পাশে রেখে দিলিশা শ্লথগতিতে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় আশফিকের পিছু। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ক্যাপ্টেন মৃদু হেসে চোখের ইশারায় ওকে শুভকামনা জানিয়ে ঘরের ভেতর চলে যায়।
আশফিক বহু পূর্বেই টের পেয়েছিল কেউ ওর কাছে আসছে। কোনো একজন বন্ধু হবে নিশ্চয়ই, তাই সেদিকে গুরুত্ব দেবার ইচ্ছে হয়নি। বাতাসের তোড়ে যখন মেয়েলী গায়ের সুগন্ধী নাকে এসে ঝাপটা লাগল, চকিতেই পিছু ফেরে ও । সব সময়ের অনিন্দ্য সুন্দরী দিলিশার হঠাৎ লাস্যময়ী রূপের ছটায় ভিরমি খাবার জোগাড় হয় তখন আশফিকের। ওর বিস্ময়াভিভূত চাহনি ঘুরে যায় দিলিশার ঔজ্বলহীন খয়েরি রঙা লিপস্টিকে রাঙা আন্দলনশীল ঠোঁটজোড়ায়, প্রচণ্ড চঞ্চলতায় ঘেরা বিড়াল চোখের মনিদু’টোই, বারবার ঝাপটানো কৃত্রিম অক্ষিপক্ষ্মে। দ্বিতীয়তে নজর যায় স্বচ্ছ নীল শাড়ি ভেদ করে দিলিশার তৈলাক্ত বুকের বিভাজনে, চিক্কণ উদরে, ক্ষীণকটিতে। ক্ষণেই বুকের ভেতর শীতল সরীসৃপের মতো ঠান্ডা মসৃণ কিছু যেন বেয়ে যায় ওর।
কী চায় দিলিশা? প্রশ্নটি এক অদৃশ্য সত্তা আশফিককে শুধালে আশফিক মৌন শব্দে জানায় তাকে, ‘প্রেমের আকুতি।’ দিলিশার মনোভাবনা বুঝে নিতেই ওর প্রতি জমে রাখা বন্ধুত্বের সুতোয় টান পড়ে। কোথাও না কোথাও এই চার বছরে ওর ছোট্ট হৃদয়ের এক কোণে একটুখানি দিলিশার জন্য কোমল জায়গা তৈরি হয়ে গেছে। অধিক সময় এক সঙ্গে থাকতে থাকতেই হয়েছে। কিন্তু সেই কোমলতাকে কি প্রেমের অনুভূতি বলা যায়? না না, একেবারেই না! এবার দিলিশার বেলাতে সে একটুও দ্বিধাদ্বন্দে নেই। যেমনটা মাহির বেলাতে ছিল। একত্র থাকা দু’ঠোঁট ওর কিছু বলবার জন্য নড়ে উঠতেই দিলিশা ঈষৎ হেসে নিবিড় হলো ওর সঙ্গে। এক অসংগতি আবদারে বলল, ‘তোমার পছন্দের একটা বাংলা গানে তোমার পায়ে পায়ে পা মেলাতে চাই। আর তুমি নির্মল আদরে আমাকে জড়িয়ে রাখবে তোমার গায়ে। প্লিজ অ্যাশ!’
দিলিশার অমলিন মুখটাই চেয়ে মায়া হয় আশফিকের। একটু হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিতেই দিলিশা চমকে দিয়ে হাতটা টেনে নেয় ওর সুশ্রী কোমরে।
-‘মিউজিক!’
বলতেই ভেসে আসে ইংলিশ গান। বাংলা গানের পরিবর্তে ইংলিশ গান ওকে বিরক্ত করার বদলে আনন্দিতই করল৷ বাংলা গানের সুর ওকে যে ছোঁয় না। আশফিককে খুশি করতেই বাংলা গান বাজাতে বলেছিল বন্ধুদের। আশফিকের অন্তরে চলা সংকোচ ও সংশয়ে গানের দিকে হুঁশ নেই। দিলিশা চোখের চাউনিতে ওর সেই দোলাচল চিত্তকে নিজেতে আকৃষ্ট করে নিলো যেন কোনো এক জাদু বলে৷
সমুদ্রের দানবীয় ঢেউ জাহাজের গায়ে বাড়ি খেয়ে মৃদুভাবে দুলে উঠছে। বিক্ষিপ্ত হাওয়াই দিলিশার রেশমি চুলের অবাধ্যতা, ওর পাতলা রাঙা ঠোঁট ছড়িয়ে আলতো হাসিতে ডান গালে খাঁজ পড়া নির্নিমেষ চেয়ে দেখে আশফিক, আর নরম বাঁধনে কোমর ধরে। ফিসফিস করে দিলিশা তখন বলে, ‘আমি তোমার নিঃশেষ চাওয়া হতে চাই, অ্যাশ।’
এই বাক্যের পুনরাবৃত্তি হলো আশফিকের কাছে। দিলিশার বাদামী চোখে চেয়ে ভাবতে চাইল একই অনুরোধ এর পূর্বে কবে, কোথায় শুনেছিল সে? কিন্তু ভাবনা টানতে পারল না। কোমরে থাকা ওর শিথিল হাতটা সেখানে চেপে ধরল দিলিশা। পলকবিহীন চোখজোড়ায় এবার পলক পড়ল আশফিকের। সেই মুহূর্তে ওর ঠোঁটের খুব কাছে দিলিশা। একটু এগোলেই ঠোঁটে ঠোঁট কথা বলবে। কিন্তু মনোযোগ গিয়ে আটকাল হঠাৎ পরিবর্তন হওয়া বাংলা গানটিতে।
প্রথমত আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই
শেষ পযর্ন্ত আমি তোমাকে চাই।
মাহিকে ছেড়ে আসার আরও পনেরোদিন আগে নিজের ঘরের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চর্চা ছাড়া সাধারণ গলায় মাহিকে উৎসর্গ করেই গেয়েছিল সে, ওন মান ভাঙাতে। আর মাত্র বলা দিলিশার বাক্যটাও মাহিই বলেছিল পরাগদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। আজকের থেকেও সে দিনগুলো ছিল চিরসুখময়। এই অকাট্য, অপরিবর্তনীয় সত্যটা আশফিক টের পেলো কিনা দিলিশার প্রাগঢ় আবেদনে সাড়া দেবার মুহূর্তে! এই বোঝার শক্তিটা কেন আরও আগে এলো না? তার আদরে জড়িয়ে নেওয়া, তার মুগ্ধ চোখের চাউনি পাওয়া, সব কিছুতে একচ্ছত্র অধিকার শুধু মাহির পাওয়ার কথা। সে তো চিরতরে বিদায় নিয়ে আসেনি যাকে সে শেষ পর্যন্ত চায়। এসেছে ক্ষণস্থায়ী অভিমানকে সঙ্গে করে। যা সে এতদিন নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে ভীষণ অন্যায় করেছে! সে ভালোবাসাকে এতদিন বাদে এসে উপলব্ধি করেও ভীষণ অন্যায় করেছে।
নিঝুম অন্ধকারে তোমাকে চাই
রাত ভোর হলে আমি তোমাকে চাই
সকালের কৈশোরে তোমাকে চাই
সন্ধের অবকাশে তোমাকে চাই
বৈশাখী ঝড়ে আমি তোমাকে চাই
আষাঢ়ের মেঘে আমি তোমাকে চাই
শ্রাবণে শ্রাবণে আমি তোমাকে চাই
অকাল বোধনে আমি তোমাকে চাই।
এ গানের প্রতিটা লাইন যে সত্যই ছিল মাহির জন্য।
দিলিশার কোমর থেকে হাতটা একেবারেই সরিয়ে আনল আশফিক। এবং ওর আকুতিকে প্রশ্রয় দিতে অপারগতা প্রকাশ করল, মিইয়ে পড়া সুরে জানাল, ‘ও দেশে ফেলে এসেছি আমার অযত্নে রাখা প্রিয়দর্শিনীকে। আমি তার আমানত।’ বলার পথেই অনাকাঙ্ক্ষিত ওর ঠোঁটের কিঞ্চিৎ ছোঁয়া পড়ল দিলিশার ঠোঁটে। অকস্মাৎ পিছু হটল আশফিক। নিদারুণ অপরাধে বুক ফেটে আসতে চাইল। ওর প্রতিটা অপরাধ শুধু অকলঙ্ক, বিশুদ্ধ নারীগুলোর সঙ্গেই কেন হয়? যন্ত্রণাচ্ছল হওয়া চোখদু’টোই দিলিশার নোনাজলের অস্তিত্ব ওকে দগ্ধ করল ভীষণ। পুনরায় কাছে এগিয়ে এসে এবার নিঃসঙ্কোচে ক্ষীণ সময়ের জন্য দিলিশার হাতের পিঠে চুমু খেল। প্রণয় প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যান হলেও এ চুমুর অর্থ বন্ধুত্বের চাওয়ার নিঃশেষ দাবি যে কোনো সময় করতে পারবে ওর কাছে। কিন্তু তা বোধ হয় দিলিশা বুঝল না। এরপর আশফিক আর দাঁড়ায়নি, দিলিশাও আর ডাকেনি। সুপ্ত বাসনা জিইয়ে রাখল তবুও।
***
মাহি যখন এসে পৌঁছল তখন রাত সাড়ে এগারোটা। তার আগ পর্যন্ত চিন্তাতে চিন্তাতে আশফিক বেশ ক’বার নাহিয়ানকে ওর খোঁজ নিতে বলছিল। যা দেখতে ভালোই লাগছিল নাহিয়ানের। কিন্তু আশফিকের এ খেয়াল হলো না নাহিয়ান কেন বোনের জন্য পেরেশান হচ্ছে না? ওকে চিন্তিত রেখেই নাহিয়ান চলে যায় ঘুমাতে। আর দিলিশা মনোকষ্ট নিয়ে পাঠাগার থেকে ফিরে রাতের খাবার না খেয়েই শুয়ে পড়ে। একা রয়ে যায় আশফিক।
কটেজের বারান্দায় দাঁড়াতে আশফিকের দেখা মেলে মাহির। নাহিয়ানের সহকারী কর্মচারী গিয়ে এগিয়ে নিয়ে এসেছে ওকে। সে চলে যেতেই মাহি বিলম্ব না করে আশফিককে বলল, ‘আমি যে কোনো মুহূর্তে মাথা ঘুরে পড়ব। আমাকে জলদি ঘরটা দেখাও।’
নিয়ন বাতি জ্বলছে প্রতিটা কটেজের সামনে৷ ধীরে ধীরে রিসোর্ট শান্ত হয়ে উঠছে। নাহিয়ানকে আর ঘুম ভাঙিয়ে বিরক্ত করতে চাইল না আশফিক। মাহির অবসাদে ঢাকা মুখটা নুইয়ে পড়তে চাইছে। এত কেন রুগ্ন দেখাচ্ছে ওকে?
মাহি শুনতে পেলো বোধ হয় ওর অনুচ্চারিত প্রশ্নখানা। জবাব দেবার ভঙ্গিতেই বলল, ‘আমার মাইগ্রেন ব্যথার কথা জানা নিশ্চয়ই তোমার।’
-‘আসো।’
আশফিকের পিছু পিছু এসে কটেজের একটা ঘরে ঢুকল। আজ আর ও আশফিককে মনে করিয়ে দিলো না সে ওর জন্য নিষিদ্ধ পুরুষ। বিদায় না নিতে বলেই বিছানাতে গা ছেড়ে দিলো। আর মুহূর্তেই বিছানার চাদর থেকে নাকে এলো আশফিকের পারফিউমের ঘ্রাণটা। শয়নরত থেকেই জিজ্ঞেস করল, ‘এই ঘরটা তোমার?’
সোফার কাছে দাঁড়ানো আশফিকের গুরুগম্ভীর জীবন্ত মূর্তিটা। ভেবেছিল ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানিটা বের করে দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু কথা একটু বলবার সুযোগটা ছাড়ল না।
-‘চাকরিজীবী সকলের ভ্যাকেশন টাইম চলছে হয়তো। আর কোনো কটেজ বা সিঙ্গেল রুম খালি পাওয়া যায়নি।’
মাহি বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইলেই আগের মতো করেই জবাবদিহি সুরে বলল আশফিক, ‘ভাইয়া আর ভাবি একান্তভাবে থাকতে চায়৷ তারা বেবি প্ল্যানিং করবে হয়তো।’
-‘ছিঃ!’
খুব সাধারণ ভাবনা থেকেই তো কথাটা বলেছিল আশফিক। তীব্র ধিক্কারের কী হলো? মাহির হঠাৎ ওই উষ্মান্বিত দৃষ্টি দেখে বিভ্রান্ত হলো ও।
-‘কী হয়েছে? তোমার ভাই আর ভাবি বলছিল তো। তখন ভুল করে আমি শুনে ফেলেছিলাম।’
ধীরস্থির হলো মাহি৷ তা বুঝে আশফিক প্রস্তাব রাখল, ‘আপত্তি হলে বিছানার চাদর পালটে দিই?’
-‘তা কেন?’ ভ্রু কুঁচকাল মাহি।
-‘শোবার পর নাক শিটকলে যে।’
-‘তুমি থাকবে কোথায়?’
-‘আরও তো কয়েকজন এসেছে। তাদের কারও সাথে শেয়ার করে নেব।’
-‘দিলিশার সঙ্গে কি থাকা যায়? মানে ও কি রাজি হবে আমার সঙ্গে থাকতে?’
একঘেয়ে প্রসঙ্গে বিরক্ত ফুটে উঠল আশফিকের চেহারায়, ‘ও ঘুমিয়ে পড়েছে। তাছাড়া তুমি আর ও কেউ-ই মন থেকে চাইবে না এক সঙ্গে থাকতে।’
মনের কথাটা মুখের ওপর বলায় লজ্জা পেল মাহি। এমনিতেও আরাম বিছানাটা সত্যিই ছাড়তে মন চাইছে না ওর। আশফিকের সাথে যতটুকু সৌজন্যতা দেখানো যায় এ নিয়ে ততটুকুই দেখাতে চাইছে সে। এছাড়া তার মোটেও সাধ নেই এ ঘর ছাড়বার। তবে আশফিক যে বুঝতে পেরেছে দিলিশাকে নিজের প্রতিদ্বন্দী ভাবে ও, সেই ধারণাটা অবিলম্বে বদলে দিতে চায়। কী মনে করে আশফিক নিজেকে? দু’দুটো পরীর মতো সুন্দর মেয়ে ওকে পেতে মরিয়া! জীবনেও না। ও চায় দিব্যকে! মেয়েদের মতো সৌন্দর্য নিয়ে অহংকার করা ওই দিব্য ফারহানকে। যে এক সপ্তাহ আগে ওকে পরোক্ষভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ ওই পুরুষের চোখের ভাষা, তার কথার গভীরতা বুঝতে ওর ভুল হয়নি। দিব্য ওকে পছন্দ করে, বউ করা যায় এমনভাবেই পছন্দ করে। সেই ছেলে কেন ওকে প্রত্যাখ্যান করল তা জানা অতবি জরুরি, আশফিককে শাস্তি দেবার থেকেও জরুরি। দ্বিতীয়বারের মতো প্রেমের প্রত্যাখ্যান সহ্য করার মতো ধৈর্যশীল মেয়ে আর হতে চায় না সে। তবে এই মুহূর্তে এসব চিন্তা বাদ। আশফিককে তার জায়গা দেখানো এই মুহূর্তে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ওর ভাবনা চিন্তার মৌন সময়ের মাঝে কখন যেন ফ্রিজ থেকে পানির বোতলটা বের করে চলে যাচ্ছিল আশফিক। মাহি বিছানায় ফের গা এলিয়ে দিয়ে কোনো প্রসঙ্গ ছাড়ায় তেরছা জবাব দিলো, ‘নিজেকে শাহরুখ খান ভেবো না। আমি তোমার কুছ কুছ হোতা হ্যায়’র কাজল না।’
-‘কী বললে?’ দরজার হাতল ছেড়ে দিলো আশফিক, কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।
-‘কিছু না। ধন্যবাদ তোমাকে৷ যেতে পারো।’
বিছানার যে কোণাতে মাহি শোয়া, সেখানেই এসে দাঁড়াল আশফিক। কাঠকাঠ গলায় বলল, ‘আমাকে তোমার শত্রু ভাবা বন্ধ করো, মাইন্ড গেম খেলাটাও বন্ধ করো। আমি আশফিক নিজের পরিচয়েই গর্বিত। আমাকে আল্লাহ পাক যা দান করেছেন তা আমার জন্য শুকরিয়ার। তোমাকে আমার কাজল ভাবা যায় না। তবে ডনের প্রিয়াঙ্কা ঠিক আছ৷’
ইসরাত জাহান দ্যুতি
পরের পর্ব থেকে আমরা অতীত বর্তমান এক সঙ্গে ঘুরব।