রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ১৫
___________________________
[প্রাপ্ত বয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।]
প্রতিটা মানুষের নিশি রাতের গল্পগুলো এক হয় না। ঘুমের ঠিকানা কি আর সবার মেলে? যে পায় সে প্রশান্তির রাজা।
ঘণ্টা তিনেক ঘুমের পর দিলিশার ঘুমটা আর টিকল না। অনেকবার এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আর ধরা দিলোই না তাকে! আধখোলা জানার ফাঁক গলে বাইরের আলোয় চোখ পড়তে ঝিমুনি কেটে গেল। বেড সাইড সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখল রাত দেড়টা বাজে। তখন পাঠাগার থেকে ফিরে এসে প্রথমে অনলাইনে লন্ডন ফেরার টিকেট বুকিং করেছে সে। তারপর থেকেই মন ভার তার। কান্না পায় না, কিন্তু বুক ভেঙে আসতে চাইল যেন৷ খেতে যাবারও ইচ্ছা হয়নি তখন।
বিছানা ছেড়ে চটি পায়ে গলিয়ে শালটা হাতে নিয়ে ঘর ছাড়ল। কটেজের মনোরম পরিবেশের আরও একটি প্রধান দর্শন হলো পুকুরগুলো। সারা কটেজে নাকি এগারোটার মতো পুকুর হবে শুনেছে। ঘুরে দেখা হয়নি পুরোটা। কালকের শুটগুলো করেই সারা সময়টা নিজে নিজেই ঘুরে কাটাবে সে।
বারান্দায় দাঁড়ালে গা কাঁপিয়ে দেওয়া হিম বাতাস, কুয়াশাও নেমেছে বেশ। হেঁটে গিয়ে কটেজের কাছাকাছি পুকুরটার পাড়েই আশফিকের দেখা মিলল ওর। ল্যাপটপ কোলে চড়িয়ে কাজে মগ্ন লাগছে তাকে। মন্থরগতিতে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আশফিক বুঝতে পারল না মানব অস্থিত্ব। নিঃশব্দেই ওর পাশে বসতে হলো তাই।
সবুজ ঘাসের ওপর মাথা পাশাপাশি রেখে শুয়ে আশফিক সেলফি নিচ্ছে মাহির সঙ্গে। আকাশ নীল রঙা টি শার্ট দুজনের গায়ে মুচকি হাসছে। কী সুখী লাগছে দুজনকে! ল্যাপটপের স্ক্রিনে শোভা পাচ্ছে ছবিটা। এমন কত ঢঙে দিলিশাও আশফিকের সঙ্গে সুখ মুহূর্তগুলো ফ্রেমে বন্দি রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তা যে শুধু চাওয়া অবধিই।
খুব কি দহনে আছে আশফিক? রাতের এই নিস্তব্ধপুরীতে, এত শীতের মাঝে ঘর ছেড়ে সে বাইরে বসে কেন? মাহি কি আসেনি?
-‘অ্যাশ? কতক্ষণ বসে আছ এখানে? ঘুমাওনি কেন?’
কিঞ্চিম্মাত্র চকিত হলো আশফিক। ব্যগ্র চোখে চেয়ে আছে দিলিশা।
-‘তুমি ঘুমাওনি?’
-‘ঘুম ভেঙে গেল। তোমার কী হয়েছে? বললে না? মাহিকে মিস করছ?’
দিলিশার প্রশ্নে ল্যাপটপে চাইল আবার সে, ‘পুকুরপাড়ের সিনারিটা চমৎকার। তাই এসে বসলাম কিছু কাজ করবার জন্য। হঠাৎ পুরোনো ফোল্ডারের কথা মনে পড়ল, একটু দেখছিলাম।’
শূন্যে চেয়ে বিশীর্ণ রূপে হাসল দিলিশা, ‘গত পাঁচ মাস ধরে তুমি রোজই দেখো, তাই না?’
জবাব দিতে মন চাইল না আশফিকের। তার চুপ থাকতে ভালো লাগছে, একা থাকতে ভালো লাগছে। চোখদু’টো বুঁজে নিজেকে একা অনুভব করতে চাইল। আর দিলিশা দৃষ্টি শূন্যে মেলেই বলতে থাকল, ‘আমি খুব বোকামি করে ফেলেছি, অ্যাশ। আর তোমাদের সঙ্গে অন্যায়ও করেছি। লন্ডন থাকতেই আমি জেনেছিলাম তুমি কারও সঙ্গে এঙ্গেজড হয়ে গেছ। আমি তখন আগে পিছে না ভেবে পাগলের মতো ছুটে এলাম এখানে। আমার নির্বোধ মন সাহস দিলো আমাকে দেখলেই তুমি ভুলে যাবে তোমার বাগদত্তার কথা। নিজের আউটলুক নিয়ে ওভার কনফিডেন্ট ছিলাম। তারপর মাহির সঙ্গে দেখা করার অজুহাতে জাস্টিফাই করতে চাইলাম তুমি কতটা আকৃষ্ট মাহির প্রতি। তোমাদের দুজরকে এক সঙ্গে দেখে তোমার প্রতি আমার আস্থাটা একটু একটু করে ক্ষয় হতে লাগল। মনেমনে গডকে বহুবার স্মরণ করতাম যেন সে আমার প্রার্থনা শোনে৷ তোমার আর মাহির মাঝে শক্তপোক্ত একটা বন্ধন তৈরি হয়ে গেছে জেনেও আমি অবুঝের মতো নিজেকে তোমার কাছে প্রতিনিয়ত অ্যাট্রাক্টিভলি মেলে ধরছিলাম। তুমি মুগ্ধ হলেও আমার মায়াতে পড়লে না। তখন বিশ্বাস করে নিলাম তুমি আর মাহি এক অপরের মায়ায় জড়িয়ে অভিন্ন দুজন তোমরা। মাহির বাইরেও নিজস্ব সময় বলতে কিছু আছে তুমি তা বুঝতেই না। মাহি যেমনটা চায়, যেমনভাবে তোমাকে চায় তুমি তেমনভাবেই নিজেকে গড়তে। তোমার ব্যক্তি রূপের সঙ্গে তা কি যায়? আমার মনে হতে লাগল মাহি কিছুটা স্বার্থপর গোছের মেয়ে। তাই তোমার স্বকীয়তা নিয়ে ওর মাথাব্যথা ছিল না। সেই মনে হওয়াটা একদিন বিশ্বাস করে নিলাম যেদিন জানতে পারলাম তোমার দীর্ঘদিনের অভীষ্ট লক্ষ্যকে ভুলতে চাও। কেন চাও? প্রথম কারণ মাহি, দ্বিতীয় কারণ তোমাদের পারিবারিক ব্যবসা। আমি তখন খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি মাহি আদৌ দোষী কি না! শুধু মনে হয়েছে তোমার অর্ধাঙ্গী হবার যোগ্যতা ও রাখে না। ভালোবাসাটা যদি সত্যিই থাকে তোমার জন্য তবে তোমার প্রকৃত সুখ কোথায় তা বুঝবার সামর্থ্য ও রাখে না কেন? না কি ইচ্ছাকৃতই রাখতে চায় না? ওকে সুখে রেখে তুমি ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছিলে প্রতিটা দিন। অন্তত কেউ একজনের থেকে সাহস, অনুপ্রেরণা, উদ্দীপনা পাবার বড্ড প্রয়োজন ছিল তোমার। আমি কি সেই মানুষটা হয়ে ভুল করেছিলাম অ্যাশ? এটা আমার অন্যায় ছিল কি না জানি না। তবে তোমাকে অনুপ্রেরণা দেবার পদ্ধতিটা ভুল ছিল আমার৷ রাগ আর প্রতিহিংসা থেকে যখন পারতাম তখনই মাহির নেগেটিভিটা দেখানোর চেষ্টা করতাম তোমাকে। কিন্তু তুমি খুব ধৈর্যশীল পুরুষ ছিলে আর তোমার ফিয়ন্সের জন্য ভীষণ লয়্যাল। আমিই সেই সবটা জেনে, বুঝেও বেহায়া হয়ে পড়েছিলাম তোমাকে পেতে। বেঈমানের মতো তোমার শুদ্ধ বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে আমাদের সম্পর্কটাকেই কলুষিত করলাম। তুমি আমাকে পরোক্ষভাবে রমফোর্ড থেকেই এড়িয়ে চলছ। সেটা আগে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি। তোমার এড়িয়ে চলার কারণটা যখন আবিষ্কার করলাম তখন নিজেকে কতটা হীন প্রাণী মনে হচ্ছিল তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না অ্যাশ। এত কিছু বুঝেও তুমি আমাকে তোমার দেওয়া বন্ধুত্বের স্থান থেকে ছুঁড়ে ফেলোনি তার জন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এখান থেকে ফিরেই আমি লন্ডর ব্যাক করব। তিনদিন পর আমার ফ্লাইট। মাহির মুখোমুখি আমি দাঁড়াতে পারি না৷ কোথায় যেন একটা বাঁধে আমার। আমার হয়ে ওকে তুমি স্যরি বলে দিয়ো প্লিজ। আর এতদিনে আমার অন্যায় চাওয়াটার জন্যও আমাকে মাফ কোরো তুমি। কিন্তু তোমার কাছে আমার অন্তিম একটা প্রশ্ন। মাহি তোমার জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষ হলেও আমার সঙ্গে তোমার প্রথম পরিচয়। যদি মাহির সঙ্গে তোমার দেখা না হতো তবে আমাকে কি ওর মতো করে ভালোবাসতে?’
বদ্ধ চোখজোড়া মেলেও দিলিশার দিকে ফিরল না আশফিক। আসলেই তাই, সবটা বুঝত ও। ওর জন্য দিলিশার টানটা সেবার দেশে থাকতেই বুঝতে পেরেছিল। ভেবেও রেখেছিল দিলিশার তরফ থেকে সরাসরি প্রেম নিবেদন পেলে সেদিনই মাহির প্রতি ওর কতখানি দুর্বলতা তা স্পষ্টরূপে প্রকাশ করবে। সেখানে দ্বিতীয় কোনো নারীর কোনো জায়গা নেই। কিন্তু দিলিশা বুদ্ধিমতীর মতো নিজে থেকেই তা বুঝে নিলো আর তার প্রতি শুধু সাধারণ বন্ধুত্ব বজায় রাখতে শুরু করল। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল তাতে ও। তাই অন্য বন্ধুদের মতোই ওকেও আপন করে নিয়েছিল। গত পাঁচ মাস আগে যখন ওর পূর্বের ধারণাকেই সত্যি করে দিলিশা প্রেমের আকুতি জানাল ওকে, সেদিন নির্ঘুম রাতেই মাহির জন্য জমিয়ে রাখা সকল অভিমানদের ছুটি দিলো আর উপলব্ধি করল ওদের সম্পর্ক ভাঙনের পিছে দিলিশার ভূমিকা কতটুকু ছিল। তবে নিজের দোষটাও কি কম ছিল?
দিলিশার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিলো ও, ‘আমি ধৈর্যশীল একেবারেই ছিলাম না। আর না প্রেমনিষ্ঠ ছিলাম। থাকলে কি আর মাহির সাথে অন্যায়টা করতে পারতাম? তবে তোমার প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ। তোমার তখনকার মানসিক সঙ্গটা আর অনুপ্রেরণা মেডিটেশনের মতো কাজে দিয়েছিল আমায়।’
আশফিক নিজেও নিশ্চয়ই মনে মনে চায় দিলিশা চলে যাক। তাই তো ওর চলে যাবার কথাটা জানবার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল না। কতটা বিরক্তির উদ্রেক হচ্ছিল দিলিশা প্রতিনিয়ত? ভাবতেই এখনি ছুটে চলে যেতে ইচ্ছা করল ওর। আর ও যে মাফ চাইল সেটাও তো এড়িয়ে গেল আশফিক! খুব বেশিই কি ক্ষতি করে ফেলেছে ও? যা কিনা ক্ষমারও অযোগ্য?
-‘আমাকে মাফ করতে পারবে না অ্যাশ?’ কাতর গলা দিলিশার।
নৈশব্দে ওর দিকে ফিরে চেয়ে রইল আশফিক, অনেকক্ষণ পর বলল, ‘আমার সাফল্যের প্রথম সোপান তুমি। স্বপ্নকে জিইয়ে রেখেছিলাম শুধু। কিন্তু ছুঁতে পেরেছিলাম তোমার সহায়তায়। তাই আমার জীবনে দুর্মোচ্য এক অংশ তুমি। কিন্তু মাহি সুখের তৃষ্ণা নিবারণকারী। দিলিশা, চিরস্থায়ী সুখ সবাই পায় না। আর আমি পেয়েও হেলায় হারিয়েছি। স্বপ্ন আর প্রকৃত সুখ এ দু’টো অভিন্ন। তবে এক অপরের সঙ্গে ভীষণভাবে সম্পৃক্ত। কিন্তু আমার জন্য আমার স্বপ্ন আর সুখ হয়তো একজন আরেকজনের প্রতিদ্বন্দী। কীভাবে? বলছি। আমি পারিবারিকভাবে বিয়ের সূত্রে যদি মাহিকে না পেতাম তাহলে কিন্তু ওকে পাবার কোনো সুযোগই আমার ছিল না। ওই সময় আমার মতো কত বেকার যুবক ওর আগেপিছে ঘুরেছে! ওদের মতো আমিও যদি ওকে এক সাদামাটাভাবে প্রেমের প্রস্তাব দিতাম, সেখানে একশোভাগ অনিশ্চয়তা ছিল ওকে পাবার। সেই মেয়েকে কত অনায়াসে হাতের মুঠোয় আমি পেয়ে গেছি। তুমি বললে না ও আমাকে যেমনভাবে চাইত নিজেকে আমি তেমনভাবেই গড়তাম, একই কথা ওর বেলাতেও খাটে। সেটা তুমি হয়তো রাগ, ক্ষোভ থেকে দেখতে পাওনি। যখন যেমনভাবে ওকে আমার প্রয়োজন হয়েছে তখনই নিজেকে ও আমার জন্য উৎসর্গ করে দিতে চেয়েছে। আমার জন্য ওর ভালোবাসা তৈরি হতে সময় লাগেনি। কারণ, ওর সকল চাওয়া পাওয়া ছিলই আমাকে নিয়ে। স্বচ্ছ ভালোবাস দিয়েছে ও আমাকে। সেই ভালোবাসা পেতেও কপাল লাগে তাই না দিলিশা? আমি সত্যিই সুখী ছিলাম, নিশ্চিন্ত ছিলাম। জীবনের আসল মানুষটি যে খাঁটি আমার! চিরস্থায়ী সুখের জায়গা ও-ই। এদিকে আমার লক্ষ্য, আমার স্বপ্নকে ঘিরে পাওয়া সুখটাও ভীষণ দামী। সবাই-ই মনের গহীনে কোনো না কোনো স্বপ্ন পোষে। স্বপ্ন ছাড়া কোনো মানুষকে তুমি খুঁজে পাবে না । জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ সেটা। আর তা যদি বাস্তবে ছুঁতে পারা যায়, কেউ কি সেই সুযোগ উড়িয়ে দেবে? আমিও দিইনি। মাহি সেদিন আমাকে বোঝেনি। যার জন্য খুব অভিমান নিয়ে দেশ ত্যাগ করলাম। কিন্তু আমি হয়তো ধৈর্যশীল হলে সুখ আর স্বপ্নকে এক সঙ্গেই ছুঁতে পারতাম। মাহি আমাকে ভালোবেসেছিল। আমাকে খুশি দেখতে চাইলে ও অবশ্যই বুঝত আমাকে, যদি ধৈর্য রেখে বোঝাতাম। আমি কি তা করেছি?’
ব্যথাহত সুরে স্বীকার করল দিলাশা, ‘আমার মন্ত্রণায় তুমি তা পারোনি। একাংশ ভাগ দোষী আমি। এই মুহূর্তে প্রচণ্ড অপরাধবোধ হচ্ছে আমার।’
দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল ও। আশফিক সান্ত্বনা দিলো না। এই উপলব্ধি আর সন্তপ্তবোধ হওয়ার প্রয়োজন ছিল দিলিশার। শীতল গলায় তখনকার ওর শেষ প্রশ্নের জবাব দিলো, ‘মাহিকে প্রথম দেখেই বউ করবার মতো ভালোলাগাটা এসে যায়। তারপর কখন যে ওর জন্য ভালোবাসা জন্ম নিয়ে তা গভীরতাকেও অতিক্রম করেছে টেরই পাইনি। আমার প্রতি ওর আগ্রহের তুলনায় ওর প্রতি আমার আগ্রহটা মাত্রাতিরিক্তি ছিল। তার জন্যই তো অর্ধেক জীবনের লালিত অপরিহার্য স্বপ্নকেও পরিহার করতে চেয়েছিলাম। ওকে ভালোবাসার নির্দিষ্ট কারণ দেখাতে পারব না আমি। কারণের ঊর্ধ্বে তা। তোমার প্রতি আমার আলাদা ভালোলাগা আসলে প্রথম পরিচয়েই আসত। যে ক’টা দিন তোমার সঙ্গে যখন মিশেছিলাম, ততটুকই যথেষ্ট ছিল তোমাকে পছন্দ করবার। কিন্তু এমন কোনো ভাবনা আমার মধ্যে আসেনি আর না তেমন অনুভূতি হয়েছে। তবে প্রশ্ন যদি এটা থাকে তুমি আমার বাগদত্তা হলে? সেখানে আমার উত্তর, আমি তোমাকে ঠকাতাম না। অবশ্যই চেষ্টা থাকত তোমাকে ভালোবাসবার।’
এরপর দিলিশার না কোনো অভিপ্রায় বা কোনো হেতু থাকল বসে থাকবার৷ সত্বর গতিতে ফিরে গেল নিজের ঘরে। মাহিকে ভালোবাসবার আর ওকে না বাসবার এত সহজ স্বীকারোক্তি বুকে ওর খঞ্জর চালিয়ে দিয়েছে যেন।
***
ফোনের ওপাশে হেঁচকি তুলে কাঁদছে শান্তা। খারাপ লাগছে মাহির, বিরক্তও লাগছে। দেড় ঘণ্টায় পরিপূর্ণ ঘুম হওয়া সম্ভব নয়। যার ফলে মাইগ্রেন ব্যথাটা অত্যধিক পর্যায়ে এখন। দশ মিনিট হলে কথা চলছে শান্তার। আজ ওর স্বামীও গাজীপুর এসেছে। তার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে নাকি কী একটা ঝামেলা হয়েছে তা মেটাতে। আর আজই শান্তার প্রাক্তন রোহানের ফোন আসে ওর কাছে। ভীষণ অসুস্থ সে। কণ্ঠনালীতে টিউমার হয়েছে ছেলেটার। বেচারার অপারেশন আগামী সপ্তাহে। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর যোগাযোগ হলো। সমবয়সী প্রণয় সম্পর্কের পূর্ণতা পায়নি ওদের, তাই আজ দুজন দু’মেরুর মানুষ। এভাবে সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটায় বিয়ের পর শান্তার মানসিক অবস্থা দুর্বল হওয়ার কথা ছিল। ভাগ্রক্রমে মাহির মতো বন্ধুর সঙ্গ সর্বদা ছিল বলেই নিজেকে সামলে উঠতে পেরেছিল। তাই বলে ওর মনের ওপর কারও জোর খাটেনি। ওর স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা আর মায়া জন্ম নিলেও গোপনে গোপনে মেয়েটা আজও কাঁদে প্রাক্তনের জন্য। এ স্বীকারোক্তি কারও কাছে করবার সাহস হয়নি শুধু মাহি ছাড়া। হঠাৎ হঠাৎ রোহনের জন্য সুপ্ত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করে ও মাহির কাছেই। আজও সেই একদিন। নিজেকে আর কোনোভাবে সামলাতে না পেরেই সব দ্বিধা ঝেড়ে এই রাত দেড়টায় কল করে মাহিকে। পাগল প্রলাপ বকতে থাকে, ‘আল্লাহ ওর অসুখ আমারে দিক! আমারে দিক! ওর জন্য আমি কত দোয়া করি রে! সব সময় নামাজে বসে ওর সুখ চাই আল্লাহর কাছে। আল্লাহ ওরে এত বড়ো রোগ ক্যান দিলো মাহি? আমার সহ্য হচ্ছে না!’
অনেকক্ষণ যাবৎ চলছে এই প্রলাপ। বুঝতে পারল মাহি, ঘণ্টা একটার নিচে এই ফোন ছাড়া যাবে না। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল তাই। মাথা ব্যথা নিয়ে শুয়ে থাকলেও আরাম লাগে না। গলাটা কেমন শুকিয়ে গেছে। আশফিক পানির বোতলটা দিয়ে গিয়েছিল, খাবারও এনে দিতে চেয়েছিল। কানে তোলেনি ও, বোতলটার দিকেও নজর দেয়নি। বিছানার এক কোণে রাখা লাগেজের বাইরের পকেট থেকে চকচকা বোতলটা বের করে টকাটক গিলে গলা ভেজাল। তারপর দরজাটা খুলে কটেজের খোলা বারান্দায় এসে বসল। কানে ইয়ারফোন গুঁজে দু’হাতে মাথা চাপছে আর ভাবছে, ঠিক কোনটা শান্তাকে শান্ত করতে পারে? প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গম্ভীরতা থেকে ওর ভারী ধমক না কি নরম সুরে কান্না থামাতে বলা? কান্নার শব্দটা খুব কানে এসে লাগছে ওর। যার জন্য মাথার যন্ত্রণাটাও বেড়ে যাচ্ছে। তন্দ্রা মেশানো অন্যরকম গলায় ডাকল ওকে, ‘শান্তা? শান্তা!’
নাক টানার শব্দ এলো এরপর, কান্নাও থামল শান্তার, ‘হ্যাঁ বল।’
-‘অসুখ বিসুখ প্রত্যেকেরই হয়। কারও ছোটো কারও বড়ো। তাই বলে কান্নাকাটি করলে কি তা সেড়ে যায়? আমার মাইগ্রেন ব্যথায় অবস্থা নাজেহাল। তোর কান্নাকাটিতে বেড়ে যাচ্ছে। কান্না বাদ দিয়ে নরমালি কথা বল।’
-‘ও হাসপাতালে ভর্তি হইছে আজকে। ও কী সব বলতেছিল জানিস? ওর কাছে নাকি মনে হচ্ছে আর বাঁচবে না বেশিদিন। টিউমার না, ক্যান্সার হইছে ওর তাই মনে হচ্ছে। তাই আজকে আর কিছু না ভেবে কল করছে আমারে। যদি সত্যিই মরে যায়?’ এত বছর হঠাৎ ফোন দিয়ে এসব বললে কেমন লাগে বল তো?’
-‘বুঝতে পারছি। ওর ফ্রেন্ড সালেমিরের সঙ্গে কথা বল। তার সাথে তো ফেসবুকে অ্যাড আছিস। ওর কাছ থেকে আপডেট নে।’
-‘নিচ্ছি ওর কাছ থেকেই আপডেট নিচ্ছি। ও বলতেছে রোহান ভয় পাচ্ছে বেশি। অপারেশন করলে সুস্থ হয়ে যাবে ঠিকই।’
-‘তাহলে তোরও তো এত ভেঙে পড়ার কিছু নাই। ভাইয়া বাসায় থাকলে কী হতো? সামলাতে শেখ নিজেকে। একটা বাচ্চাও আছে তোর। এখনো যদি এক্সকে নিয়ে মরা কান্না করিস সেটা সমাজ, ধর্ম কোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই ভালো দেখায় না।’
-‘জানি রে। তুই তো জানিস আমি কতখানি ট্রাই করি ওরে ভুলে থাকবার।’
-‘না, ট্রাই করিস না তুই। তুই নিজেই বললি নামাজে ওর জন্য মোনাজাত করিস সব সময়। সেটা খারাপ না কিন্তু ভালোও না। এটাকে ভোলা বলে না। আচ্ছা বাদ দে, তুই বেশি চিন্তা করিস না৷ ওর ফ্রেন্ডের থেকে খবর নিতে থাক। আমারও ধারণা ও সুস্থ হয়ে যাবে অপারেশনের পর, ইন শা আল্লাহ।’
-‘হুঁ, তোর কথা বল৷ মাইগ্রেন ব্যথা হলো কেন আজ আবার? দিব্যর সাথে ঝগড়াঝাঁটি, চেঁচামেচি করছিস?’
-‘হাহ্! আর ঝগড়া, চেঁচামেচি! ও আমাকে রিফিউজ করেছে। সেইদিনের পর আর কোনো ফোনই দেয় নাই।’
অবিশ্বাস্য অভিব্যক্তি শান্তার, ‘কী বলিস? তোরে রিজেক্ট করছে? আল্লাহ ক্যামনে? ও পারল এরকম অ্যাটিটিউড নিতে?’
-‘উহুঁ, অ্যাটিটিউড না। ও আসলেই সম্পর্কে জড়াতে চায় না।’
-‘কিন্তু কেন চায় না? তুই তো বলছিলি হি ইজ ফল ইন লাভ উইথ ইয়্যু।’
-‘এখনো তাই বলব।’
-‘তাহলে?’
-‘সেটাই জানতে চাই৷ কিন্তু নিজে থেকে আর কোনো ট্রাই থাকবে না ওর জন্য। আমি প্রচণ্ড ফ্রাস্টেটেডে।’
-‘আরে প্রপোজ যেহেতু করছিস রিজেক্ট কেন হলি সেটা তো শোনায় যায়।’
-‘কিছুক্ষণ আগে আমারও তাই মনে হয়েছিল৷ ওকে কল করব, জবাবদিহি চাইব৷ কিন্তু আমার পক্ষে আর সেল্ফ রেসপেক্ট খোয়ানো সম্ভব না। যে আত্মসম্মানের কাছে আজকে আশফির পরিশুদ্ধ ভালোবাসাও নগন্য। সেই আত্মসম্মান সামান্য প্রেমের জন্য বলিদান দিইনি আর দেবোও না। তাও তো নিজেকে এখন ব্যক্তিত্বনহীনই লাগছে দিব্যর রিজেক্টে। দিব্যর প্রতি আমার সুক্ষ্ম টান থাকলেও আমি তা প্রকাশ করতাম না ও না করা অবধি। অবশ্যি যেটা হয়েছে ভালোই হয়েছে। তুই সাতটা বছর সংসার করেও রোহানের ভালোবাসাটা ভাইয়ার জন্য ডাইভার্ট করতে পারিসনি। বায় চান্সও আমিও যদি না পারি? আল্লাহ পাক যা করেন বান্দার ভালোর জন্যই করেন।’
-‘স্যরি দোস্ত! আমার আর রুমকির প্ররোচনা ছিল বেশির ভাগ। আমাদের উস্কানিতে তুই সেদিন প্রপোজ করছিলি। এর জন্যই বলে পরের বুদ্ধি নিয়ে ধনী হওয়ার থেকে নিজের বুদ্ধিতে ফকির থাকা ভালো। আমি জানি অন্তত আমি যদি রাজি না করাতাম তোরে তুই জীবনেও বলতি না।’
-‘আমি মন থেকেই যা চাই তাই আমার অপূর্ণ থেকে যায়। এরপর থেকে কোনো কিছুতেই আর কোনো অতিরিক্ত প্রত্যাশা রাখব না আর।’
-‘যদি দিব্য পরে ফোন করে অ্যাক্সেপ্ট করে?’
-‘ভেবে দেখব তখন। আগেপিছে অনেক চিন্তাভাবনা করে ভেবে দেখে কমিটেড হবো।’
সান্ত্বনা দেবার সাহসটুকু পেলো না শান্তা। জ্ঞান আর সান্ত্বনা এই ব্যাপারদু’টো মাহি নির্দিষ্টরূপে নিতেই পারে না কখনো। দু’টো সান্ত্বনার বাক্য ঝাড়লে তাকে বিপরীতে বলে বসবে, ‘নিজের সান্ত্বনা নিজে খুব ভালো নিতে পারি।’
মাহির কথাতে আজ সত্যিই নৈরাশ্য ভাব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। দিব্যকে নিয়ে সে খুব আশাবাদী ছিল। ভালো না বাসলেও ওর সঙ্গে ভালো থাকবার একটা সুযোগ পেতে চেয়েছিল। কোনো একদিন তো কাউকে জীবনের সঙ্গে জড়াতেই হতো। সেই মানুষটার সঙ্গে যদি আগে থেকে বোঝাপড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা ঠিক থাকে তাহলে সুখে থাকার নিশ্চিয়তা থাকে আশি ভাগ। দিব্যর সঙ্গে ওর আলাপটা তিন বছরের। এ সময়টা অনেক দীর্ঘ। যেটা ওর আর আশফির বেলাতে ছিল স্বল্প। তাই সেই সম্পর্কের নিশ্চয়তা, নিবিড়তা তৈরি হয়েছিল না। তিন মাসের সম্পর্কটা তিন ঘণ্টাতে সমাপ্তি ঘটেছিল। এই ভুলটা ও দিব্যর বেলাতে করতে চায়নি বলে মনের গোপন অনুভূতিও সামনে আসতে দেয়নি৷ মা মারা যাবার পর থেকে ঘনিষ্ঠ সঙ্গ দেবার মতো মানুষের অভাববোধ করত প্রদি পদে পদে। বড়ো ভাইটা পারত কিছুটা ভরসাযোগ্য, বন্ধুভাবাপন্ন হওয়ার। বাবাও পারত। তা হলো কই? সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত৷ আত্মীয় মানুষগুলো যতটুকু সময় দিতো, তার মাঝে করুণা আর সান্ত্বনাই খুঁজে পেতো ও। বন্ধুহীন সেই ক্লান্তিকর, সুদূর অতীতের পর আশফিক এসেছিল উজ্জ্বল রৌদ্র হয়ে। ও হয়ে গেল তখন ওর নতুন লক্ষ্য, নতুন স্বপ্ন, নতুন আকাঙ্খা। তাই তো ওকে ধরে রাখতে ভালোবাসাকে কঠোর অধ্যবসায়ের মতো রক্ষণ করতে থাকল। তবুও কি ধরে রাখতে পারল? একটা খুঁটির জোরে যে ঘরের ছাউনি নড়বড়ে ছাড়া মজবুত হয় না!
মাহির জিদ্দি মনের ভাবনা আশফির অনুতপ্তবোধ, চিত্তের বিশুদ্ধতাসাধন হয়তো ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য। তবে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেবার মতো নয়। চলে যাওয়া সুদীর্ঘ চারটা বছর পুনরায় ফিরে আসবে না তাতে। সমাজের কাছে বিয়ে ভেঙে যাওয়া মেয়েকে নিয়ে নোংরা সমালোচনা, কটু বাক্য শ্রবণ, টিটকারি, দুর্দশা, তার একাকীত্বে ধুঁকেধুঁকে মরার মতো গভীর বিষণ্নতা, আপন মানুষের থেকে স্রেফ প্রবোধদান বা কারও থেকে দোষারোপ, তারপর ভঙ্গুর নিজেকে ফের একটু একটু করে পুনরায় গড়ে তোলার সংগ্রাম। এগুলো পুরো চারটা বছরের একটা চিত্র। যে চিত্র বদলানো যাবে না যতই সে উঁচু স্তর বা বড়ো বাবার সন্তান হোক। কারণ সে এক নারী, নামজাদা বংশপ্রদীপ নয়। এ সব কিছু ভুলেও যদি সেই মানুষটিকেই গ্রহণ করা হয়, তবে চারপাশের বোধ নির্বোধ প্রতিটা মানুষের আলোচনা, সমালোচনা হবে এটাই, ‘এই এই দেখো, জারিফ সাহেবের মেয়েটাকে বিয়ে না করে পালিয়ে গেল যে ছেলেটা সেই ছেলেটার সাথেই আবার বিয়ে হচ্ছে!’
-‘তাছাড়া আর করবেই বা কে? তিন চারটা বছর ধরে ঘরে পড়ে আছে। বড়ো কোনো সমস্যা না থাকলে কি আর এমন দুর্গতি হয়?’
-‘চেহারা আর টাকা থাকলেই ভালো ঘর ভালো বর পাওয়া যায় না।’
-‘নিশ্চয়ই ছেলেটা দেশে ফেরার পর হাতে পায়ে ধরে না হলে সম্পত্তি লিখে দেবার লোভ দেখিয়ে গছিয়ে দিচ্ছে!’
তার দোষগুণের সম্যক বিচার বিশ্লেষণ হবে আবার নতুন করে এভাবেই। যা এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণ। আসল ব্যাপারটিই তো এখানে, পুরোনো সেই ক্ষতির পূরণ আর হবে না আশফিককে বিয়ে করে। বরং এই বিয়েটা হবে পুরুষ শাসিত সমাজে সাধারণ এক মেয়ের আত্মাদর বলিদানের উৎসব। মাহি তো সেই তথাকথিত সাধারণ স্তরের মেয়ে নয়, সেভাবে নিজেকে সে তৈরি করেনি। আশফিকের প্রেম পূজার ফুল তার পায়ে লুটিয়ে দিলেও সেই ফুল অবনত হয়ে সে তুলবে না। সেখানেই যে নারী আত্মমর্যাদা বিলীন হয়।
টিক টিক টিক টিক! মৃদু আওয়াজে হাত ঘড়ির মিনিটের কাটাতে সময় বয়ে যাওয়ার শব্দ কানে আসছে রাতের নিবিড় নিস্তব্ধতায়। মাহির নিস্পৃহতার মুহূর্তে শান্তা নিরুপায় হয়ে ফোন রেখে দিয়েছে ইতঃপূর্বে। কষ্ট হচ্ছে মাহির। ভীষণ! সে কষ্ট শুধু শরীরগত নয়, হৃদয়গতও। আশফিক ওকে ফেলে যাবার পরও খুব দুস্তোষ্য হয়েছিল না ওর মন। একটাবার আশফিক কল ধরত ওর, না হয় দু’চার মাস পর ভুল করেই কল করত! ওর ভুলটাকে মার্জনার দৃষ্টিতে পরিমাপ করত! নিজের অহংবোধকে এক পাশে রেখে সম্পর্কটাকে ভেঙে না যেতে দিতো! কিন্তু আশফিক ওকে দিয়ে গেল লঘু পাপে গুরুদণ্ড।
চোখদু’টো জ্বলছে, পুড়ছে। অত্যাচারী কান্নাকে দমন করা মুশকিল হয়ে পড়ছে খুব। পিলারে মাথা ঠেকিয়ে জোরে জোরে ক’বার শ্বাস নিলো মাহি। মাথাটায় কী যে ব্যথা! জগত ভুলিয়ে দিচ্ছে। শরীর টলছে, অবশ লাগছে, নড়বার ক্ষমতা নেই৷ বসে থাকা ছাড়া আর উপায় কী? তার জন্য মাত্র চার-পাঁচটা ঘণ্টা বসে কাটানো বড়ো কোনো বিষয় না। তবু হেঁটে ঘরে ফিরবার শক্তিবল নেই। সন্ধ্যার পর খুুব অন্যায় হয়ে গেছে কলিগদের সাথে মজ-মাস্তি করা। তখনের কাজটাও ঠিক হয়নি। যা খাওয়ার অভ্যাস নেই তাই খেয়েছে। ভুলটা মনে পড়তেই নিজেকে গালাগাল করতে শুরু করল, ‘নিজেই মস্ত বড়ো পাপ করে এসে কিনা আরেকজনকে ধর্মের জ্ঞান দিলাম! শা’লী বেঈমানদার, অখাস্তা! আমার খারাপ হবে না তো কার খারাপ হবে?’
ঘুম বেশ আয়োজন করে এসেছে আশফিকের কাছে। ঢের অপেক্ষার পর এলো। এখন কার ঘরে গিয়ে বিছানায় ভাগ বসাবে সেটা ভেবে এগোতে এগোতে পড়েছে মাহির সামনেই। ডিসেম্বরের শেষ দিক। শীতের আধিক্য বাড়ছে এবং বাড়বে। ঘরে না থেকে বারান্দায় বসে ঢুলুঢুলু করবার মানে কী? আরও এগিয়ে আসে ও। বিড়বিড় করে বলা না বোঝা কথা শুনতে পাচ্ছে। কী বলছে মাহি? এখানে কী করছে? যার জন্য আরামের বিনাশ ঘটিয়ে এই রাতের বেলা উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাকে ঘরের বাইরে দেখে মেজাজ কেমন হয়? তড়তড় করে আরও কাছে চলে এলো ওর। পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ খুলল মাহি, সামনে আরেক পিলার দেখতে পাচ্ছে মনে হলো ওর। তাও একটা না, দু’টো। ওকে ভালো করে দেখতে সু্বিধা করে দেওয়ার জন্য আশফিক ঝুঁকল, ঝাড় দিতে গিয়েও সংযত করল, ‘না ঘুমিয়ে ঠান্ডার মধ্যে বসে আছ কেন?’
জুল-জুল চোখে তাকাল, পাগলের মতো প্রত্যুত্তর করল, ‘এক্স আশফির জন্য! না মানে এক্স ফিয়ন্সের জন্য! ওহ তুমি? না তাহলে তোমার জন্য না। এক্স….এক্সের জন্য।’
মারাত্মক অস্বাভাবিক আচরণ, এলোমেলো কথা। ও কি মাতাল? কখন হলো?
-‘এই! এই মাহি কী বলছ তুমি? হুঁশে আছ না? কী ব্যাপার ঘটল বলো তো?’
বলতে বলতে মাহির পাশে এসে বসল। ওর উচ্চবাচ্যেই মাহির আধা বেহুঁশ ভাব ছুট দিয়েছে। আশফিকের মুখটা এত কাছে, অনুজ্জ্বল আলোয় কী সুন্দর! ছুঁয়ে দিতে মন চাইল ওর। কপালে পড়ে থাকা অবাধ্য চুলগুলো আদরে এক পাশে গুছিয়ে দিলো। রাত বাড়ছে, হিম হাওয়ার গতিবেগও বাড়ছে। স্পর্শনেন্দ্রীয় নির্লজ্জতার শিকার হতে চাইছে দুজন দুজনের ছোঁয়ায়।
জানাশোনা, অধিকারবিহীন ভুলটা আবার করা উচিত কি? বিপর্যস্ত আশফিক। মাহিকে দু’হাতে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে ধরল…. ঠোঁটের আদর দিলো মাথার চাঁদিতে…. পরে কপালে…. অনেকক্ষণ। আরেকবার ভুলে ভুল বাড়াতে চায় না আর।
-‘ঘরে চলো, সোনা। শীতে কাঁপছ।’
বক্ষঃস্থলে স্পর্শানুভূতির আর স্ফূর্তির হিল্লোলে ভেসে যাচ্ছে মাহি। হাজারো মুহূর্ত বাদে এই বুক, এই দেহের ঘ্রাণে, এই আদর দ্বিতীয়বারের মতো পাওয়া। আশফিক কি শুনতে পায় ওর কল্লোলময় অনুভূতির হই-চই? রয়েসয়ে ব্যথার উপশম ঘটছে এবার। তাই শুধাল ওকে, ‘আরও আগে কেন এলে না?’
-‘খুব অন্যায় হয়ে গেছে। মাফ করো বউ।’
-‘করব, করব তো। ব্যথা কমুক।’
-‘খুব কষ্ট পেয়েছ, না?’
-‘পাচ্ছি এখনো।’
-‘আমাকেও কষ্ট দাও। শরীরে, মনে, সবখানে। শুধু আমার অধিকার ফিরিয়ে দাও প্রাণ। কসম, তোমার সব কষ্ট মুছে দেবো।’
-‘এক্ষুনি দাও, এক্ষুনি….এক্ষু….নি!’
ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল ওর কণ্ঠস্বর। বুকে চেপে ধরে রইল ওকে আশফিক।
আর থাকা যাবে না। অসুস্থ হয়ে পড়বে মাহি। ওকে ডাকলেও সাড়া দেবার বোধটুকু নেই ওর। বুক থেকে সরিয়ে ওকে পাঁজাকোল করে তুলল আশফিক। ঘরে গিয়ে বিছানায় শোয়াতেই ঝট করে চোখ মেলল৷ আঁধার ঘর, চেহারা আবছা স্পষ্ট হলেও রক্তবর্ণ ওর চোখদু’টো দেখতে পেলো না ঠিকঠাক।
-‘তুমি কি চলে যাচ্ছ?’
নিমেষহারা আশফিক। ওকে বুঝতে পারছে না ঠিক। ও তো যেতে চায় না।
-‘না হয় থেকেই যাও!’
-‘সত্যি? তুমি চাইছ?’
-‘আমি চাইছি।’
-‘এরপর?’
-‘এরপর?’
-‘আমাকে ফেরাতে পারবে না আর।’
-‘কোথায় আসবে?’
মাহির কাছটায় এসে দাঁড়াল আশফিক, আবেগে ঠাঁসা গাঢ় গলায় বলল, ‘তোমার কাছে।’
-‘কেন?’
-‘তোমাকে পেতে।’
-‘সে অধিকার তো তোমার নেই।’
-‘আছে, খুব আছে। তুমি দিলে।’
-‘যদি না দিই?’
-‘তাও আসব। এবার তুমি ডেকেছ। তাই ফিরিয়ে দিতে চাইলেও ফিরব না।’
চোখ বুঁজে ফেলল মাহি, সাথে সাথেই দু’চোখের কোণ থেকে অশ্রুপাত গড়াল, ‘উহ্! আমার কষ্ট হচ্ছে খুব।’ কেঁপে উঠল ওর গলা। শিথানে গিয়ে বসল আশফিক। -‘ঘুমাও। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।’ চুলে বিলি দিতে
থাকল।
-‘তুমি শোও না! আমাকে তোমার বুকে নিয়ে শোও….আগের মতো….সেই আগের মতো।’
আশফিক শুলো। এক পাশ হয়ে শুয়ে মাহিকে বুকের ওপর নিয়ে জড়িয়ে রাখল। জাপটে ধরল মাহিও।
-‘সোনা? কী করে হলো এমনটা?’
আশফিকের উষ্ণতায় মাখামাখি মাহি, আহ্লাদীত সে একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করল, ‘কী করে হলো?’
-‘তুমি বলো। আমি জানব কেন?’
-‘আমি বলব না৷ তুমি জানবে না কেন?’
হেসে ফেলল আশফিক, আগের মতোই মাথা বুলিয়ে দিতে থাকল, ‘আমার কি জানার কথা?’
-‘না কেন?’
-‘তুমি ধোঁয়াশা এখন আমার কাছে।’
-‘খিলি পান ভাঙ মেশানো, অনেকগুলো।’
-‘উহুঁ, সম্ভব নয়৷ আর কী ছিল?’
-‘ওটার নাম দেখিনি। তবে রাশিয়ার। অসম্ভব টেস্টফুল।’
-‘কখন ট্রাই করেছ? আর কাদের সাথে?’
-‘ওয়ান আওয়ার অ্যাগো।’
শুনেও কিছুক্ষণ চুপ থাকল আশফিক, পরের প্রশ্নটার জবাবের অপেক্ষায়। কিন্তু মিলল না। অনুচ্চস্বরে বলল, ‘ইমপ্যাক্ট পড়ছে স্লোলি স্লোলি। কাল সকালে তো উঠতেই পারবে না।’
-‘না উঠব। তোমাকে আর দিলিশাকে দেখব।’
-‘আচ্ছা দেখো।’ মৃদু হাসল আশফিক।
তারপর আরও কিছু বলল মাহি। আহ্লাদী বাচ্চার মতো কথাগুলো। আস্তে আস্তে ঘুমে তলিয়ে যেতে থাকল। তখনো কথা চলতে থাকল একটু একটু। আশফিক দু’একটা শব্দ বুঝতে পারল শুধু। জবাব, শোধ, বিয়ে, ককপিট। এমনকিছু।
ইসরাত জাহান দ্যুতি
এটা সারপ্রাইজ৷ ভাবলাম বর্তমানটা ১৫ পর্ব অবধি চলুক। অতীতটা বেশি মিষ্টি তো আর তিক্ত তো। সবুর করেই দিই।