রোদ্দুরে ভেজা বুকপকেট – ১৬
___________________________
[প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত ]
সেই আমি কি না?
যাকে তোমরা কাদামাটির দলাতে পরিণত করেছ,
খেয়াল খুশিতে রূপ দিয়েছ,
উচ্চতাপে পুড়িয়েছ।
সেই আমি কি না?
এক পশুবৎ আরেক পশুবতের বক্ষে আমাকে আছড়েছ, আমাতে দিন ফুড়িয়েছ,
ফের আমাতে রাত নামিয়েছ।
হ্যাঁ সেই আমি ছিলাম, সেই আমাকে নিঃশেষ করেছি আমি।
এখন আমি বলবান, তেজঃপূর্ণ।
চাইলে হতেও পারি লৌহপূর্ণ।
ভেঙেই দেখো আমাকে,
পারো কি না!
ছুঁয়েই দেখো,
হাত পৌঁছায় কি না!
তবে আমিই ধরা দিই?
চাও কি না?
আমার ঘরের দ্বার আজ অবারিত।
এই যে, আমি নেই লুকিয়ে!
আসবে? এসে দেখাও।
তোমরাও বলবান কি না!
চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে সামনে বসা তিনটি মেয়েকে দেখল মাহি। তাদের মনোযোগ কি আছে কবিতাটিতে? বোঝা তো যাচ্ছে না।
-‘আরও আছে, লম্বা একটা কবিতা। শুনবি তোরা?’
প্রশ্নটায় একটু মোটাসোটা সুন্দর দেখতে শান্তা ফোলা ফোলা গালদু’টো আরেকটু ফুলিয়ে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়ল। রুমকি নির্বিকারই আছে। আর নোরা, মাহির পড়শী মেয়েটা। রুমকির সমবয়সী। সে চোরা দৃষ্টিতে পাশের টেবিলগুলোতে পরিবেশন করতে থাকা সুন্দর দু’জন ওয়েটারকে হা করে দেখাটা বন্ধ করল শীঘ্রই। এবার তিনজনের মনোযোগী দৃষ্টি মাহির মুখে।
-‘আপু, কবিতাটা সুন্দর। থামলা ক্যান পড়ো! একটা বিদ্রোহী নারী নারী ফিল পাচ্ছিলাম।’ রুমকি বলল। তার পূর্ণ মনোযোগ তবে কবিতাতেই ছিল।
-‘হ আসলেই। নাম কী রে কবিতার? নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা না কি?’ শান্তা জানতে চাইল।
মাহি মাথা নাড়াল, ‘আরে না, নারীবাদী হবে কেন? প্রতিবাদী বলতে পারতি। কবিতার কোনো নাম নাই। এটা উপন্যাসের বই। বইয়ের নাম কার্নিশে বকুল। কিছুটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখা বইটা। বইয়ের সারকথা ছিল এটা। পুরোটা তো তোরা শুনলিই না। থাক, শুনতেও হবে না। যে কাজে আসছি সেটা করার সময় হয়ে গেছে।’
নোরা চেয়ারে বসারত থেকেই কিঞ্চিৎ লাফিয়ে উঠল। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল মাহির দিকে। সে মেয়েটা একটু ভিতু গোছের, কিন্তু চাপা দুষ্টু সে। মানে তার দুষ্টুমির ধরনটা প্রকাশ্য নয়, কেউ সহজে টেরও পাবে না তার দুষ্টুমিগুলো। মুখটাও ভারী ভোলাভালা, সরল যেন। তাই মানুষ বিশ্বাস করে না ওর দ্বারা ফাজলামি, দুষ্টুমি সম্ভব।
-‘আপু! আপনি সত্যি ওয়েট্রেস হবেন!’
নোরার বিস্ফোরিত চেহারা দেখে হাসি পেলো মাহির, ‘সে তো বাসা থেকেই বললাম তোদের।’
মিনমিন করে বলল নোরা, ‘মানে প্রথম দেখাটা অন্যভাবেও স্মরণীয় করা যেত বোধ হয়। রেস্ট্রন্টের মতো জায়গায় ব্যাপারটা অড দেখায় না? ভাইয়া যদি অন্য ধরনের হয়? রাগ করে?’
-‘আমিও তো তার সেই অন্য ধরনটা দেখতে চাই। আমার এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ডটাই সে বিরক্ত এবং অবাক হবে নিশ্চয়ই? আর তখনই আমি বুঝতে পারব আমাকে সে ধৈর্যের সাথে কতটুকু মানিয়ে নিতে পারবে। বিয়ের পর সব সময় তো আমরা মেয়েরাই তো মানিয়ে চলি, স্বামীর মন মতো নিজেকে গড়ি। এই একই কাজটা কি স্বামীর থেকেও পেতে পারি না? এমন একটা মানুষকেই আমি অ্যাক্সপেক্ট করছি। পূরণ হবে কিনা জানি না।’
কথাগুলোই শান্তা কিন্তু বিরক্তি ঝাড়ল, ‘বই, উপন্যাস পড়তে পড়তে তোর চিন্তাভাবনা নাটকীয় ধরনের হয়ে পড়তেছে দিনদিন। কিছুদিন কথা বল, ঘোরাঘুরি কর। এমনিতেই তো চিনে যাবি ও ছেলে কেমন। এত ড্রামা করার কী দরকার ছাই!’
-‘বই পড়েই পড়েই চিন্তাভাবনা এমন হইছে তা আমিও স্বীকার করি। কথা বলা, ঘোরাফিরা তো করবই। মাঝেমধ্যে এমন পরীক্ষানিরীক্ষাও চলবে। তাতে পুয়া থাকলে থাক না থাকলে ভাগ।’
রুমকি নিরব। ছোটোবেলা থেকেই ও মাহির ভক্ত৷ খারাপ, ভালো সব কিছুতেই সে মাহিকে সমর্থন করে। আজও তাই৷
ওরা কোল্ড কফি সামনে নিয়ে বসে আছে। মাহি চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গেল ম্যানেজারের কাছে। গতকালকেই লোকটিকে নিজের পরিকল্পনার ব্যাপারে মানিয়ে নিয়েছে ও। এক্ষেত্রে বাবার পরিচয়ের সুবিধা নিয়ে অসৎ ব্যবহারটা করতে হয়েছে ওকে। এক সপ্তাহ হতে চলল ওকে আশফিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মাঝে দু’জন দু’জনের ছবি দেখেছে আর ফোনে ক’বার কথা বলেছে শুধু। দেখাটা হয়নি। রীত্যনুসারে দেখাটা হওয়া বাদ ছিল কেবল। দু’জনের বাবা সেটার ব্যবস্থাও করে দিলেন আজ। আশফিক সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক উপাধি পেয়েছে। বাবার অনুরোধে আজ সে দুপুরে চারজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে মিটিং এ অংশগ্রহণ করবে এই রেস্টুরেন্টে। তারপর ক্লায়েন্ট বিদায় নিতে সেখানেই দেখা করবে ওরা দু’জন। এমনই বলা হয়েছে ওদেরকে।
দুপুর বারোটার ওপারে এখন সময়টা। মাহি খোঁজ নিয়েছে আশফিক বারোটার মাঝেই চলে আসবে এখানে। বেশভূষা পালটানোর পর ওয়াশরুমের আয়নায় আগাগোড়া নিজেকে দেখে নিলো। হাসতে হাসতে স্বগোতক্তি করল, ‘ওপরের বাটনদু’টো খুলে দিলেই টু মাচ হট লাগবে। হা হা, স্মার্ট গেইটআপ।’
সে কাজটিতে অবশ্য গেল না ও। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বার কাউন্টার থেকে সাধারণ পানীয় নিলো হাতে। আশেপাশের মানুষের চোখ ছানাবড়া তখন। কারণ, এই একজন ওয়েট্রেস ছাড়া আর কোনো মেয়েকে দেখছে না তারা। ড্রিঙ্কসের গ্লাসগুলো নিয়ে নিজেদের টেবিলটিতে পরিবেশন করতে করতে বলল ওদের, ‘সমস্তটা ভিডিয়ো করবি কিন্তু।’
রুমকি পলক ঝুঁকিয়ে আশ্বস্ত করল ওকে।
রুফটপের একদম কর্ণারের টেবিলটা বুকিং দেওয়া রয়েছে আশফিকদের জন্য। মাহি খেয়াল করল সেখানে ইতোমধ্যে তিনজন এসে উপস্থিত। কিন্তু চেনা মুখটা নেই। তাহলে আশফিক বিলম্বে আসছে। প্রথম দিনেই সময়ানুবর্তিতা থেকে ছিটকে পড়ল সে! ব্যবসাতে অনাগ্রহী না কি ছেলেটা?
আশফিক আসার অপেক্ষার মাঝে মাহি বারবার মূল দরজাতে ব্যাকুলতা নিয়ে দেখছে। এই সময়টুকুতে শান্তা আর নোরা এখনো ওকে বারণ করে যাচ্ছে এমনটা না করতে। সেই সাথে রুমকির উৎসাহ। ওদের জ্ঞান, পরামর্শে মাহি তালহারা হয়ে পড়তে চাইল। তবে শেষ পর্যন্ত সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল। হাত ঘড়িতে সময় দেখল বারোটা পঁচিশ বেজে গেছে। রুফটপে গিয়ে উঁকি দিলো মাহি। যা ভেবেছিল তাই। ওদের তর্ক বিতর্কের মাঝে আশফিক যেন কখন ঢুকে পড়েছে, মিটিংও শুরু হয়ে গেছে। এবার অপেক্ষা আশফিকের টেবিল থেকে ডাক আসার। রুমকিদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ‘অনেস্টলি বল, অ্যাম আই লুক প্রিটি?’
শান্তা জবাব দিলো, ‘মোর দ্যান এভার।’
নোরাও তাই বলল। রুমকি আলাদা করে বলল, ‘হাইট দাঁড়িয়েছে হাই হিলে তোমার ফাইভ’এইট”। তোমার আজকের সাজপোশাকে আমার একজন অপ্রিয় বলিউড হিরোইনের মতো লাগছে দূর থেকে। জানি তুমি তাদের সাথে তুলনাতে বিরক্ত হও৷ তাও বলছি, তার হাইটও এটাই। কিন্তু বিশ্বাস করো, সে আমার অপ্রিয় হলেও সুন্দর৷ তোমাকে তার থেকেও সুন্দর লাগছে।’
মাহি আর ঘটা করে সেই অপ্রিয় নায়িকার নাম জানতে চাইল না। কারণ, ও জানে রুমকির অপছন্দের নায়িকা ক্যাটরিনা কাইফ। আর ও বরাবরই ওর সৌন্দর্য কোনো যশস্বী ব্যক্তির সাথে তুলনা পেতে বেশি থেকেও বেশি অপছন্দ করে৷
চারপাশের কৌতূহলী, তীক্ষ্ণ, কুৎসিত দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে মাহি আশফিকের টেবিলের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। ম্যানেজার থেকে সরাসরি যেমন এমন অসম্ভব, পাগলাটে কাজের অনুমতি পেয়েছে। তেমনই অন্যান্য ওয়েটার ছেলেদের বারণও করেছে মাহিকে কোনোরূপ বিড়ম্বনায় না ফেলতে।
পঁচিশ মিনিটের আলোচনা, কথাবার্তা শেষে আশফিক ওয়েটার ডাকল। একজন ছেলে মেনু কার্ড নিয়ে এগিয়েও যাচ্ছির। মাহি দ্রুত তার পথ রোধ করে দাঁড়াল, ম্যানেজারের কথা উল্লেখ করে ছেলেটির হাত থেকে মেনু কার্ড নিয়ে চলে গেল আশফিকের টেবিলে। আশফিক কথাতে ব্যস্ত। মাহি মেনু কার্ড টেবিলে রাখল, ‘স্যার, অর্ডার প্লিজ!’
রিনরিনে কণ্ঠটা টেবিলের চার সদস্যসের মনোযোগ কাড়ল৷ দীর্ঘ উচ্চতার বেশ সুন্দরী একজন ওয়েট্রেস তাদের সামনে। আশফিক ছাড়া বাকি তিন সদস্য মধ্য বয়স্ক। সভ্য ধাচের মানুষ তারা৷ মুচকি হেসে মেনু কার্ডটা তারা আশফিককে নিতে অনুরোধ করল। কার্ডটা হাতে নিয়ে আশফিক তির্যক চাউনিতে মাহিকে পরখ করল। মাহিকেই তো দেখছে সে? হ্যাঁ, মাহিই তো। ও কি সত্যিই এখানের ওয়েট্রেস? অন্তত পোশাকে তো তাই বলছে। সাদা-কালো লেডিস শার্ট প্যান্ট পরনে আর দারুণ করে সামনের কিছু চুল টুইস্ট করে পনিটেইল চুলের বাঁধন। বিস্ময়বিমূঢ় আশফিক সামনে বসা তিনজন ক্লায়েন্টকে ভুলে যেতেই বসেছিল। উত্তপ্ত দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ করতে এসে খাওয়া হলো ঠিকই, তবে তা ধাক্কা। চকিত দৃষ্টি হটিয়ে ঠোঁটজোড়া জিভের ডগায় ভিজিয়ে সাদা শার্টের ওপর নীল টাইটা ঢিলে করল, বিনয়ী হেসে ক্লায়েন্টদের অনুরোধ করল খাবার তাদের অর্ডার করতে। তারা মেনু কার্ডে ব্যস্ত হতেই মাহিকে আলতো হেসে ও বলল, ‘হ্যালো মিস, আপনি কিছু যদি মনে না করেন আমি একটা কিছু কনফেস করতে চাই। আসলে আমার ফিয়ন্সে দেখতে পুরোটাই আপনার মতো।’
মাহি কপট বিস্ময় দেখাল, তারপর বিগলিত হেসে বলল, ‘সত্যি? ইট’স আমেইজিং স্যার! আমার ফিয়ন্সেও তো আপনার মতোই দেখতে!’
উত্তরটা শুনে চোখদু’টো ছোটোছোটো করে ফেলল আশফিক, মাথা উপর নিচ করে দুলিয়ে কাঠকাঠ চোয়ালে সেও হাসি দেখাল।
মাহি ওদের থেকে অর্ডার নিয়ে খাবার পরিবেশন শেষ করেই আবার ওয়াশরুমে চলে গেল, সাজপোশাকও বদলে ফেলল। এবার অপেক্ষা আশফিকের অভিব্যক্তি ও ব্যক্তিরূপের সাথে পরিচিত হওয়ার।
এরপর কাটল আরও পঁচিশ মিনিট। আশফিক কোল্ড ড্রিংকস ছাড়া তেমন কিছুই গ্রহণ করেনি৷ কারণ, মধ্যাহ্নভোজের পর্বটা সাড়তে হবে মাহির সঙ্গে। ক্লায়েন্টদের বিদায় জানিয়ে আশফিক বাবাকে কল করল প্রথমে। মিটিং এর আলোচনা সম্পর্কে সব জানিয়ে আশেপাশে নজর বুলাল। মাহিকে আর দেখা যাচ্ছে না। এমন একটা অসম্ভব, ছেলেমানুষি কাণ্ড কারখানা এই মেয়ের দ্বারা সম্ভব তা তো ওর বিশ্বাসই হচ্ছে না। ফোনে পাঁচ-ছ’বার কথা বলে ওর মনে হয়েছিল, বাবা আর ভাই বাধ্য সাধারণ গোছের এক মেয়ে মাহি। দেখতে সুন্দর এটুকুই তো মেয়েটার নিজস্বতা। কথা বলার সময় ও যখনই যা জিজ্ঞেস করত বা জানতে চাইত, মাহির উত্তর হতো, ‘আব্বু আর ভাইয়া যেমনটা বলবে তেমনটাই।’ আলাদা ব্যক্তিত্ব বলতে কিচ্ছু পায়নি ওর মাঝে। এ নিয়ে মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত ছিল ওর। কোনোমতে আর ক’টা দিন পার করে মাহির বিভিন্ন দোষত্রুটি দেখিয়ে বিয়ে ভাঙার পরিকল্পনা করেছিল। যদিও মাহির মাধুর্যপূর্ণ মুখটা দেখলেই ওর চাউনি থমকে দেয়। আজ তো মেয়েটির ছিপছিপে গড়নের আকর্ষণীয় সৌন্দর্যটা ওকে মতিচ্ছন্ন করে দিচ্ছিল প্রায়। কী যেন একটা সুন্দরতা সেই দৈহিক গঠনে, যা সকলের নজর কাড়ছিল। এই ব্যাপারটাই ওর অসহ্য লাগছিল। চোখের তারায় ধার আর মুখের অভিব্যক্তিতে আত্মশ্লাঘা, পুরোদস্তুর প্রবল আত্মবিশ্বাসী মেয়েটা। সফেদ কাগজের মতো মাহির স্বচ্ছ এক ব্যক্তিত্বের স্ফুলিঙ্গ ওর চোখে মুখে এসে যেন ছিটকে পড়ে ওই ক্ষণিকের মুহূর্তটুকুতেই। এবার পরিষ্কার, সবটাই মাহির নাটক ছিল তখন। আজকের কাণ্ডটার পর আর যাই হোক, সাংঘাতিক এই মেয়েকে তার মতের বিরুদ্ধে চলানো মুশকিল নয় বরং অসম্ভব।
ওয়াশরুমে গিয়ে চেহারাতে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিলো, কিঞ্চিৎ অগোছালো ভাবটা পরিপাটি করে আবার এসে বসল টেবিলে৷ তারপর ডায়াল করল মাহির নম্বরটা। মাহি ফোনটা হাতে নিয়েই বসে ছিল নিশ্চিত। প্রথমবার রিং হতেই ধরে নেয় ও।
-‘আমি ওয়েট করছি।’ আশফিক জানায়।
মাহির সহজ উত্তর, ‘আমি আসছি।’
রুফটপের দরজার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রইল আশফিক। গা থেকে বিশেষ নীল রঙা স্যুটটা খুলে চেয়ারের হাতলে বাঁধিয়ে রেখেছে। নিজের স্বরূপেই মাহির সামনে উপস্থাপন করতে চায় সে নিজেকে। মিনিট পাঁচের মধ্যেই মাহিকে দেখা গেল এবার পুদিনা সবুজ রঙা সেলোয়ার স্যুটে। হেঁটে আসার মুহূর্তটুকুতে আশফিক সর্বপ্রথম মাহির পা থেকে নজর বুলাতে বুলাতে নাক অবধি গিয়ে আটকাল। আগেই খেয়াল করেছে ও, নাকটা খুব সুন্দর মাহির। পুরু ঠোঁটে গাঢ় মেরুন রঙা লিপস্পিকটা চোখ ঝলসে বুদ্ধিভ্রংশ করে তুলতে চাইছে ওকে। ও ঠিক ধরেছিল। মেয়েটার বাহ্যিক সৌন্দর্যের মাঝে ছেলেদের চট করেই আকর্ষিত করার একটা ক্ষমতা আছে। সেটাকে গুণ বলা যায় কিনা ও বিভ্রান্ত৷ তবে এই মুহূর্তে সত্যি ওর কাছে সেটা দোষ লাগছে। ওর পাশাপাশি অন্য পুরুষের মাঝেও মাহি মধ্যমণি। বিয়ে করলে দু’দিন বাদেই যাকে বউ পরিচয়ে নিয়ে ঘুরতে হবে, তার দিকে অন্য পুরুষের মুগ্ধ চাহনি ওকে একদমই গর্বিত করবে না৷ কিন্তু আশফিকের মন এত হাবিজাবি ভাবনা ভেবে আসল ব্যাপারটাই বুঝল না যে, ইতোমধ্যে মাহির জন্য ওর মনে একচ্ছত্রাধিপত্য জন্ম নিয়ে নিয়েছে।
লম্বা মুখটার সুন্দর, সুগঠিত চোয়াল শক্ত করে বসে আছে আশফিক। মাহি আসতেই ওকে ভরাট কন্ঠে বলল, ‘বসো, চেঞ্জের কী প্রয়োজন ছিল?’
মাহি কিছু পলের জন্য স্তম্ভিত হলো, কানে বাজতে লাগল ‘বসো’। ওদের মাঝে সম্বোধনটা কিছু সময় আগেও ভিন্ন ছিল৷ মনের খাতাতে পয়েন্টটা টুকে রাখল দ্রুত৷ বাসায় ফিরে সমস্ত পয়েন্ট একত্র করে আশফিককে বিচার বিশ্লেষণ করতে হবে না?
চেয়ার টেনে বসে পার্স ব্যাগটা কোলের ওপর রাখল ও, বিপরীত মানুষটিকে জবাব দিলো, ‘ওয়েট্রেস তো আর ডেটে বসতে পারে না তোমার সঙ্গে।’ একই বলার ভঙ্গি। আশফিক তা খেয়াল করল। এবং সেও একবার বিড়বিড় করল ‘তোমার সঙ্গে’। ওর ধারণা ছিল মেয়েরা হবু বর বা অপরিচিত ছেলে যখন হুট করে প্রেমিক হয় তখন তাদেরকে শুরুতেই কখনো তুমি সম্বোধন করবে না। অনেক বেশি সম্মান বোঝাতে আর নিজেকে খুব সুশীল বোঝাতে বিপরীত পাশের মানুষটিকে আপনিই বলবে।
আশফিকের কপালে হালকা ভাঁজ পড়তে দেখেই মাহি বুঝে গেছে আশফিকের ভাবনা। স্বামী স্ত্রী তো একে অপরের পরিপূরক। তাই দুজনই দুজনকে সমানভাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা করা উচিত, তাই না? আশফিকের সাথে প্রথম সাক্ষাতে তুমি সম্বোধনটাই প্রকাশ পাচ্ছে বিশেষভাবে ওর প্রতি কতৃত্ব ফলানোর শুরু এটা। বেশ তো, হবু স্বামী হিসেবে এ অধিকার যদি ওকে দিতেই হয় তবে একই অধিকার ওরও প্রাপ্য। আর এটাই আশফিককে ও পরিষ্কার করে বোঝাবে প্রত্যেকটা কথাতে ও কাজে।
এক মিনিট কাটল দুজনের চোখ চোখ রেখেই। আশফিক আশা করেছিল মাহি লাজুকতার সাথে দৃষ্টি ঝুঁকিয়ে ফেলবে হয়তো। না, তা আর হয়নি৷ মনেমনে হাসল আশফিক, ভুলেও চেহারাতে সে হাসি দেখাল না। মাহিকে, মাহির কথাকে, পুরোটাই ও ভীষণ উপভোগ করছে। গম্ভীরতা বাড়িয়ে উত্তর দিলো, ‘বিয়েতে আজকের তিনটা মানুষও ইনভাইটেড থাকবে হয়তো। সেদিন কি তাদের কৌতূহল হবে না জাওয়াদ রায়নানের পুত্রবধূ এবং জারিফ ইসলামের এক মাত্র মেয়ে এত বিত্তশালী পরিবারের মানুষ হয়েও কেন ওয়েট্রেস ছিল? কী বলবে তখন? জামাইকে যাচাই-বাছাই করতে এবং সাথে নাস্তানাবুদ করতে?’
ব্যক্তি রূপে কঠোর আত্মবিশ্বাসী মেয়েটা এত সহজে ধরা খেয়ে গেল? বড্ড ভুল হয়েছে। আশফিককে গড়পড়তা পুরুষের কাতারে ভেবেছিল কিনা! তবে ভালো লাগল মাহির। চৌকশ জামাই! চমৎকার!
আশফিক চেয়ে আছে এবার গাঢ় চোখে। চঞ্চল, অপ্রস্তুত হলো তখন মাহির দৃষ্টি। একটু তো অস্বস্তিপূর্ণ লাগেই। আশফিক তাও বুঝল। চকিতে দৃষ্টি নত করল সে। আর মাহি গা ছাড়া ভাব নিয়ে জবাব দিলো, ‘প্রথম সাক্ষাৎ, তাই এটিকে স্মরণীয় রাখার ইচ্ছা।’
উত্তর শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকল আশফিক। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হঠাৎ সেও এক ভঙ্গিমায় ধীরস্বরে পুনরাবৃত্তি করল, ‘প্রথম সাক্ষাৎ, তাই এটিকে স্মরণীয় রাখার ইচ্ছা।’ পরবর্তীতে হাসলও।
-‘খিদে পেয়েছে। আসল ওয়েট্রেসকে ডাকি এবার?’
কী বলবে মাহি? ওয়েট্রেস আছে না কি? তবে লজ্জা পেলো কিছুটা।
ইট পাথরের শহরে নিসর্গ শরতের এই দুপুরটা সত্যিই ওদের স্মরণ থাকবে আমরণ। কথাবার্তা ছাড়া খাওয়ার পর্ব শেষ হলো প্রথমে আশফিকের। একটু সময় অপেক্ষা করতে হলো ওকে মাহির জন্য৷ এই সুযোগে সে লুকোনো দৃষ্টিতে মাহিকে আবারও অবলোকন করতে থাকল। খেতে বসে সরাসরি দৃষ্টিতে দেখা ঠিক নয় যে। মাহি কিন্তু তা বুঝে ফেলেছে। পুরুষের চোরা চাউনিও মেয়েরা স্বভাবজাতভাবে টের পেয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে অন্য কেউ হলে বলার অবকাশ থাকে না সে খেতেই পারত না। কিন্তু মাহি ধীরে ধীরে আরও আরামে খাওয়া শেষ করল৷
-‘তো নেক্সট প্ল্যান আছে কি?’ আশফিকের সেই মেকি গাম্ভীর্যের সঙ্গে প্রশ্ন।
-‘না নেই।’
-‘ওয়েল, আমার আছে৷ বিল পে করি। এই ফাঁকে তোমার ওয়াশরুম ইউজ করার থাকলে যেতে পারো।’
-‘ওকে।’
খানিক চিন্তা নিয়ে মাহি ওয়াশরুমে এসে শান্তাদের ফোন করে জানাল আশফিকের কথা। উত্তরে শান্তা জানাল ওদের চলে যাওয়া ভালো হবে তাহলে। মাহিও আপত্তি করল না৷ ফিরে এসে দুজন বেরিয়ে পড়ল এক সাথে। আশফিকের হাতের ওপর ওর স্যুটটা। তার হাঁটার চলন আর দেহ ভঙ্গিমায় ঝকঝকে ভাব, কোনো সামরিক ইন্টেলিজেন্স এজেন্ট যেন। মাহি নিখুঁত দৃষ্টিতে সবটা দেখল।
বিনম্রতার সাথে গাড়ির পেছন দরজাটা খুলে মাহিকে বসতে ইশারা করল আশফিক। মাহি বসতেই ও ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ‘উইন্ডোজ ওপেন থাকবে না কি এসি অন থাকবে?’
-‘জানালায় খোলা থাক।’
ড্রাইভারকে জানালা খুলে দেওয়ার আদেশ জানিয়ে মাহির কাছাকাছি সরে এসে বসল আশফিক। মাহি খেয়াল করল, আপাতত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। নীরবে একটু সময় যেতেই জানালার ফাঁকে হাতটা রাখল ও। নিমজ্জিত দৃষ্টি বাইরে। অপেক্ষাতে আছে ও আশফিকের নিজ থেকে পরবর্তী পরিকল্পনা জানানোর। হঠাৎ চমকে উঠল সে৷ আশফিক ওর হাতটা ধরেছে বিনা অনুমতিতে! শীতল, দৃঢ় চোখে ওর দিকে চেয়ে হাতটা জানালার ফাঁক থেকে সরিয়ে আনল আশফিক, যেন কৈফিয়ত দিলো, ‘বেখেয়ালে বাইরে চলে গিয়েছিল তোমার হাত।’
আসলেই কি তাই? মাহি যথেষ্ট সাবধান ছিল। আশফিকের হঠাৎ কাছ ঘেঁষে বসা, আকস্মিক হাত ধরা, মুখের ভাষা আর চোখের ভাষায় ভিন্নতা। সবই কোনো উদ্দেশ্যের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। চরম একটা ভুল হয়ে গেছে ছেলেটির হঠাৎ প্রস্তাবে রাজি হওয়া। ঘাবড়ে যাচ্ছে ও। কিন্তু এ মুহূর্তে ঘাবড়ানো একবারেই বোকামি। এখন প্রচণ্ড কঠোরতা দেখানো আবশ্যক।
মাহির হঠাৎ ভড়কে যাওয়া, বেশ খানিকটা ভয়ও পাওয়া ধরা পড়ে গেছে আশফিকের চোখে। অপ্রকাশ্যে মজাও পাচ্ছে সে। নারী মানুষটি নিজের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য শতভাগ দুর্বল অধিকাংশ জায়গাতেই। তা থেকে এই যে আশফিকের পাশের মানুষটিও বাদ গেল না।
মাহির ভীষণ হামবড়া ভাবটা এবং নিজেকে তেজীয়ান দেখানোটা আশফিকের ভালো লেগেছে। কিন্তু ভালো লাগেনি তখন ওয়েট্রেস বেশে এসে অকস্মাৎ ওকে হতবুদ্ধি করা। যাচাইয়ের প্রয়োজনটা জরুরি ঠিক, কিন্তু পরিবেশ জ্ঞানও তো রাখা উচিত সেই সাথে। সেই সময়ে প্রত্যেকটা পুরুষের কেন্দ্রবিন্দু ছিল মাহি। একাকীভাবেও অন্য কোনো উপায়ে ওর পরীক্ষা নেওয়া যেত! ফলস্বরূপ এখন ওরও কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় যে মাহিকে যাচাই করা কিংবা বদলা নেওয়া।
-‘আমরা সিনেপ্লেক্সে যাচ্ছি। এই সময়ে একটা শো আছে। কিন্তু ভীড় তুলনামূলক কম। রিল্যাক্সে কিছু সময় কাটাতে পারব৷ সাথে আমাদের নিজেদের মাঝে জানাশোনাও চলবে আর…’
শেষ মুহূর্তে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে থেমে গেল আশফিক।
এই কথার সুরটাই পছন্দ হলো না মাহির। না, এভাবে আর আশকারা বাড়তে দেওয়া যাবে না ছেলেটির। এখনো সময় ফুরায়নি, নেমে যাবে ও।
-‘ওহ্, কিন্তু আমি দুঃখিত। আমার হাতে এত সময় নেই। এত সময় কাটাব সেটাও বাসায় জানিয়ে আসা হয়নি।’
-‘চিন্তার কারণ নেই। আমাদের বাবাকে আমি জানিয়ে দিচ্ছি। তারা শুনলে আরও খুশিই হবে।’
বলেই প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করার চেষ্টা করল। মাহি আর মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না। কখন যেন ধামকি – ধুমকি শুরু করে দেবে সে। নয়তো ছেলেটির চোখ ফাটিয়ে বসবে।
অতীত থেকে আবার টুপ করে বর্তমানে ডুব দেবো আমরা৷ এভাবেই চলবে। আর কী বলব! সপ্তাহে মাত্র দুটো দিন পর্ব দিই। তাও অনিয়ম। কী যে নির্মম ব্যস্ততা আমার! পর্বটাও পুনরায় পড়ে দেখা হয়নি। এই হালে দ্বিতীয় কোনো লেখায় হাত দেবো তা ভাবাও বাড়বাড়ি৷ এই উপন্যাসটা আপনারা আগামী বছর বইমেলাতেই হাতে পাবেন৷ এর মাঝে আর কোনো বই লিখতে পারব এমন আশা দিতে চাই না। ওহ হ্যাঁ, উপরের কবিতাটি আমার অপ্রকাশিত, অলিখিত কার্নিশে বকুল উপন্যাসের টুকরো কিছু লাইন।
ইসরাত জাহান দ্যুতি